
অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়
গাঙ্গেয় ভারতের অন্তত অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে বোধহয় নিজের জন্মদিনে কাব্যগ্রন্থের ২৮ নং শীর্ষকহীন কবিতার এই কথাগুলি খাটে: ‘নদীর পালিত এই জীবন আমার।/নানা গিরিশিখরের দান/নাড়ীতে নাড়ীতে তার বহে,/নানা পলিমাটি দিয়ে ক্ষেত্র তার হয়েছে রচিত,/রহস্যরস নানা দিক হতে/শস্যে শস্যে লভিল সঞ্চার।’ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে বিভিন্ন গ্রিক ও ল্যাটিন লেখকরা এক রাজ্যের কথা বলেছেন যার নামের মূল ‘Gangarid’, ভাষার বিভিন্ন বাঁকানো চেহারায় দাঁড়িয়েছিল ‘Gangaridai’, ‘Gangaridae’ and ‘Gangaridum’, আর যার শিকড় ছিল বোধহয় ‘Gangahrd’, অর্থ গঙ্গাকে কেন্দ্র করে, হৃদয়ে নিয়ে, গড়ে ওঠা রাজ্য। সংস্কৃত শিকড় খুঁজলে বোধহয় গ্রিক/ল্যাটিন পর্যন্ত চলনটা হবে গঙ্গাহৃদি/গঙ্গাঋদ্ধি/গঙ্গারিডি, গঙ্গাহৃদয়, গঙ্গারিদই/গঙ্গারিডই (লাতিন: Gangaridae; গ্রিক: Γανγαρίδαι, পেরিপ্লাসের নাবিকের ভাষায় গঙ্গাদেশ)। এটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতকের একটি অজ্ঞাত রাজ্য, আজকের দিনে বঙ্গোপসাগরীয় পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ তো বটেই, এক গ্রিক নাবিকের লেখা O Periplous tes Erythras Thalasses/Periplus Maris Erythraei (The Periplus of the Erytrean Sea) অনুযায়ী সেই গঙ্গাদেশের বিস্তৃতি ছিল Desarene-এর বা উপকূলীয় ওড়িশার পূর্বদিক পর্যন্ত। অনিতা অগ্নিহোত্রীর মহানদী উপন্যাসের নামনদীটি ‘ছোটনাগপুর বিলাসপুরের মালভূমি, বড়াখোল আচঙ্কমার অভয়ারণ্য, হাসদেও, মহান, রিহান্দ নদীরা, বাঁয়ে মাইকাল পর্বতশ্রেণি, ডানে সুনাবেড় উপত্যকা, নুয়াপাড়া, পাটনাগড়, বলাঙ্গিরের অল্প-বৃষ্টি ক্ষুধাপীড়িত এলাকা, এই বলয়ের মধ্যে ছত্তিশগড়ের সিহাওয়া প্রদেশের সানুদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে ছত্তিশগড়ের মধ্যে দিয়ে ওড়িশায় ঢুকে সম্বলপুর হয়ে শেষে এখানেই বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, কটকের কাছে জগৎসিংহপুরে আঠারোবাঁকির দক্ষিণে, তাকে গঙ্গাহৃদির অংশ করে নিয়ে।
আমি এই নদীটির পুরো স্রোতধারা ও গতিপথ ঘুরে এলাম। না, Mark Twain-এর Life on the Mississippi বইয়ের মতো সহকারী পাইলট হিসেবে দুবার স্টিমবোটে চড়ে নদীজীবনের নানা কৌতুকাবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে বা স্মৃতিচারণ করতে করতে নয়, অথবা John Steinbeck-এর The Log from the Sea of Cortez বইয়ের মতো Ed Ricketts-এর সঙ্গে সঙ্গে জলজীবনের নমুনা সংগ্রহ করতে করতে নয়। অনিতা অগ্নিহোত্রীর সঙ্গে নদীর পাশে পাশে ঘুরে, মাঝে মঝে চরিত্রগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় নদী পার হয়ে, ভাবতে ভাবতে যে বাঙালির নদীগল্প বা নদীছবিগুলি আলাদা, তাতে হাসির চেয়ে কান্নার ভাগ অনেক বেশি। তারা নদীপাশের মানুষের জীবনের সুখদুঃখের, দুঃখ-দুর্দশার জীবন নিয়েই বেশি ভাবে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালিন্দী বা হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য এই নদীগুলির চরে/তীরে মাটি আর মানুষের গভীর সম্পর্ক আর তা নিয়ে মানুষদের সুখদুঃখই। সে কথাটা ঠিক যেমন অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে নদীতীরের মালোদের ক্ষেত্রে, তেমনিই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে সেই মালো মাঝিদের ক্ষেত্রেও। অন্য অনেক নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ইছামতী উপন্যাসে নদীটিকে তত প্রাধান্য দেননি, যতটা দিয়েছেন নদীতীরে শিপটন সাহেবের নীলকুঠি ছাড়াও নদীতীরে সারে সারে অন্য নীলকুঠি ও তাদের অত্যাচারের মধ্যে ও তার থেকে আলাদাভাবে নদীর তীরে গরিব মানুষদের জীবনের দুঃখদুর্দশাকে। সমরেশ বসু তাঁর গঙ্গা উপন্যাসেও গঙ্গার তীরবর্তী জনপদগুলিতে জেলে আর মাঝিমাল্লাদের নিয়েই বেশি লিখেছেন। অমর মিত্র-র নেশা আবার সুবর্ণরেখা-কে নিয়ে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ’ (১৯৭৭) হাতিবাড়িতে সুবর্ণরেখা দেখার পর লেখা। আবার ‘সুবর্ণরেখা’ নামেই একটা উপন্যাসও আছে (১৯৮৩)। এছাড়া তাঁর ‘একটি গ্রাম একটি নদী’ (২০২০) উপন্যাসে এসেছে ইছামতী ও সুবর্ণরেখা। নদীতীরের মানুষকে নিয়ে লিখেছেন নলিনী বেরাও তাঁর ‘শবরচরিত’ উপন্যাসে। সেখানে সুবর্ণরেখা বা মাঝে মাঝে ছোটনদী ডুলুং কেবল আবহ রচনা করেছে। একই কথা তাঁর ‘সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা’ নামের আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘গহীন গাঙ’ উপন্যাসেও মালোদের দুঃখের বিবরণ দিয়েছেন। আবার হারানো নদীর (যমুনা খাল) খোঁজ নিয়ে লেখা হয়েছে ভগীরথ মিশ্র-র ‘শিকলনামা’, আর অমর মিত্র-র ‘সোনাই একটি নদী ছিল’। দেবেশ রায়ের ৮০০ পাতারও বেশি সাইজের উপন্যাস তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-র তো জবাব নেই।
কিন্তু দ্বিধা না রেখেই বলছি এই সব উপন্যাসের থেকে আলাদা অনিতা অগ্নিহোত্রীর মহানদী। বোধহয় বিভূতিভূষণ একুশ শতকে আরণ্যক লিখলে বা তাঁকে এই অঞ্চলে ছেড়ে দিলে উপন্যাসটা এইরকমেরই হত। এই উপন্যাসে অসংখ্য মানবিক চরিত্রের পাশাপাশি নিজের বিশদ, প্রায় কার্টোগ্রাফিক, ভৌত, মানবিক আর সাংস্কৃতিক ভূগোল নিয়ে মহানদী আর তার উপরে হীরাকুদ বাঁধ নিজেই উপন্যাসের দুই প্রধান অমানবিক চরিত্র। আর মহানদী যত এগিয়েছে গতিপথে ততই তার দুপাশে চোখের সামনে উঠে এসেছে অজস্র মানুষ, তাদের সম্প্রদায়, সম্প্রদায়গত জীবিকা ও তার সমস্যা, আশা, আশাভঙ্গ, জীবনের লড়াই, প্রেম, হিংসা, প্রতিশোধ ইত্যাদি নিয়ে। তৈরি করেছে একটা এপিক।
বহুদিন পরে পড়া এই মহাকাব্যিক উপন্যাসে প্রথম পর্ব ‘বৈদ্যরাজ’-এ দেখা পাই ফার্সিয়া বা মহানদীর উৎস মাত্র আড়াই ক্রোশ দূরের এক গ্রাম সিহাওয়ার চন্দনবাহারা গ্রামের অধিবাসী, যেখানে থাকেন বৈদ্যরাজ তুলারাম ধুরু আর তাঁর মদতদাতা ফরেস্টার অবধূত সিং। মহানদীর উৎসের দক্ষিণ ঘেঁষা সীতানদী অভয়ারণ্য তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। তাঁর আক্ষেপ তাঁদের পড়শি নদী সন্দুর আর সীতানদীর আশেপাশে তাঁদের শৈশবের প্রিয় অরণ্যভূমি ডুবিয়ে দিয়েছে সন্দুরে বা্ঁধ দেওয়ার ফলে ‘শত শত এককের জলবিস্তার’। হারিয়ে গিয়েছে অজস্র পশুপাখি, সাপ-সরীসৃপ, আর ভেষজ, বৃক্ষের জৈববৈচিত্র্য। কিন্তু নতুন জলভাণ্ডারের বুকে জন্ম নেওয়া নতুন গুল্ম, সীতানদী অভয়ারণ্য আর মহানদী, সন্দুর আর তাদের বিবিধ শাখা-ও-উপনদীর ‘জলমালা’-র সন্নিহিত অরণ্যে বৈদ্যরাজ তুলারামের মতোই গোঁড় জাতির আরও জনা চল্লিশেক ভিষগ-বৈদ্যর নিত্য যাতায়াত, যাঁরা জঙ্গলের ওষধি গাছগাছড়ার বিশেষজ্ঞ। তাঁরা জঙ্গলবিভাগের লোকজনদের শেখান এই সব গাছের পাতা বা মূল তোলার ও সংরক্ষণের কায়দাকানুন। বিনিময়ে নিজেরাও সেগুলি সংগ্রহ করেন ও ওষুধ বানান, যেমন সাঁকরার রেঞ্জ অফিসের লাগোয়া গুদামঘরে অনেক সাজসরঞ্জামের সাহায্যে ওষুধ বানান তুলারাম, যা সাঁকরাতে জঙ্গলবিভাগের দোকানে ছাড়াও অন্য জেলা সদরেও লভ্য। মৃগীরোগের চিকিৎসায় নামডাকওয়ালা এই তুলারামকে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ‘বৈদ্যরাজ’ উপাধি দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন আদিবাসীপুত্র ছত্তিশগড়ের রাজা (‘রাজোয়া’) ও বর্তমানে দিল্লিতে সাংসদ সুজনকুমার। তিনি তুলারামের মুখে বিকেন্দ্রিত শাসনের সুফলবর্ণন আর বিভিন্ন স্থানীয় ভেষজের গুণবর্ণন আর জৈববৈচিত্র্যের আখ্যান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন, বুঝেছিলেন যে এই ‘মানুষটার মধ্যে শত শত বছরের জানা, আনন্দ, ইতিহাস পাললিক শিলার মতো চুপ করে বসে আছে।’ কিন্তু যেদিন রাজিমে আসে তুলারাম নিজের মোবাইকে ড্রাইভার অবধূতের সঙ্গে, রেঞ্জার সাহেবের কাছ থেকে এই উপাধির ঘোষণার আগাম খবর পেয়ে, সেদিনই নির্বাচনী প্রচারের সময় গাড়ির সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষে সুজনকুমার দারুণ জখম হওয়ায় তুলারামের স্বীকৃতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়।
ভগ্নমনোরথ তুলারাম যখন অবধূতের সঙ্গে তার বউ পুনরির কাছে ফিরছে, তখন আমি নিজের মন ভাল করে সারার আগেই অনিতা অগ্নিহোত্রীর সঙ্গে পৌঁছে যাই (দ্বিতীয় পর্ব ‘মহুল সই’) হীরাকুদ বাঁধের গড়া অনেক বড় বিচ্ছেদভূমিতে। সেখানে মানেশ্বর গ্রামের মেয়ে হিমিরানি আর আদিবাসী মেয়ে মালতী, দুই অত্যাগসহনো ‘মহুল সই’ ছিটকে গেছে একে অন্যের থেকে অনেক দূরে। ‘কোথায় মহানদীর পশ্চিমকূলে’ ‘সদা জলে ছলছল’ কুঠেরপালি গ্রাম, আর কোথায় ‘দক্ষিণ মুড়োর কাছে’ ‘পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা জুজুমরা গ্রাম পঞ্চায়েতের নুয়াবলডা’ গ্রাম। মালতীরা ছিল কুঠেরপালির হীরাকুদ বাঁধভাসিদের শেষ উদ্বাস্তু দল, যারা নামমাত্র ক্ষতিপূরণ পেয়ে কুঠেরপালি থেকে নদীহীন, পেয় জলহীন, বাড়িঘরহীন, গোশালা-তুলসিমঞ্চহীন, বিরূপ প্রকৃতির নুয়াবলডায় চূড়ান্ত কষ্টের জীবন যাপন করছিলেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে হিমিরানির শ্বশুরদের ভিটে কুঠেরপালিতে হীরাকুদ জলভাণ্ডারের সীমারেখার অনেক বাইরে উচ্চতম বিপদসীমার স্তরেরও অনেক বাইরে থাকায় হিমিরানির শ্বশুরবাড়ির লোকরা কিছু জমি হারালেও হীরাকুদ জলভাণ্ডারের সেচসুযোগ নিয়ে আপেক্ষিক সমৃদ্ধির সাক্ষী হয়। কিন্তু নুয়াবলডায় নির্বাসিত মহুল সই মালতীর সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং তার জীবনব্যাপী যাতনা ঘোচাতে হিমিরানির মাতৃভক্ত কবিপুত্র কুবের মালতীর খোঁজ নিতে গিয়েও সেখানকার মানুষদের অবর্ণনীয় দুর্দশার সঙ্গে মালতীর ভগ্নস্বাস্থ্য দেখে তাঁর আশীর্বাদী স্নেহস্পর্শ পেয়েও তাঁর কথা মাকে জানায়নি, হিমিরানির মন ভেঙে যাবে বলে। উপন্যাসের মধ্যে এই মনকেমন ছোটগল্পে আমার দ্রব মন তার আর্দ্রতা হারানোর আগেই আমরা তৃতীয় পর্বে হীরাকুদ থেকে দক্ষিণে বওয়া মহানদীর পাশ ধরে সুবর্ণপুর তথা সোনপুরে পৌঁছই। মহানদীর সবচেয়ে বড় উপনদী ‘তেল’, দক্ষিণ কোশলের অসংখ্য প্রত্নচিহ্নের বাহক ‘নামডাকী’, দক্ষিণের মালভূমি থেকে উঠে আসা ‘উতেই’, খরাদগ্ধ বলাঙ্গিরের বক্ষ ভেদ করে আসা ‘সুখতেল’, আর বরগড়-পদ্মপুরের হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসা ‘অং’ এখানে মহানদীতে মিশে একসময়ে সুবর্ণপুরকে ‘জমজমাট রাজ্যপাট’-এর জায়গা করে তুলেছিল। অতীতের সে দিন না থাকলেও সোনপুর কয়েকবছর আগে বলাঙ্গির জেলার মহকুমা থেকে নিজেই জেলা হয়েছে।
এই চাকচিক্যহীন জেলায় সোনপুরের তেঁতুলতলার ঘাটে আমাদের দেখা হয় প্রত্নসামগ্রী উৎসাহী সুবল ও তাঁর পরামর্শদাতা কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক ও সোনপুরের প্রত্নসামগ্রীবিদ সত্যেন্দ্র প্রধানের সঙ্গে। তাঁর প্রস্তাবিত দিনে মহানদীর বুকে নদীভ্রমণের জন্য সুবল গণ্ডারাম মাঝি বা নীলকণ্ঠ গণ্ডকে বলে রেখেছে। কিন্তু সত্যস্যার আসার এবং তাঁর আলিঙ্গনের পর নৌকোয় ওঠার আগেই সুবলের সঙ্গে তিনি আলাপ করিয়ে দেন ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী যুবতী, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা স্মিতা কুজুরের। একটু আকস্মিকভাবেই তিনি সহযাত্রী। নিয়মগিরির পাহাড়, পর্বতের উপরে বক্সাইট খননের নামে কর্পোরেট পুঁজির থাবার বিরুদ্ধে প্রবীণা গান্ধিবাদী নেত্রী সাবিত্রী দেশমুখের [মেধা পাটকর?] সঙ্গে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার জন্য রাষ্ট্রের উর্দিধারী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনির আক্রমণে সাবিত্রীর সঙ্গে তিনিও আহত। কিন্তু তবু এক সহমর্মী সাংবাদিকের সাহায্যে পালাতে হয়েছে তাঁদেরই, অচৈতন্য সাবিত্রীকে দিল্লির সীমান্তপারের হাসপাতালে, আর তাঁকে সত্যস্যারের তত্ত্বাবধানে সম্বলপুরে। তাঁদের সঙ্গে যখন আমি তেঁতুলতলার ঘাট থেকে নৌকোয় উঠে মদে চুরচুর গণ্ডারামের আর অনীতার পথনির্দেশনায় ‘পারের কাছে ঘনসবুজ’-প্রায় মরকত রঙের জল থেকে দূরের আকাশনীল জলের মধ্যে দিয়ে একটু উত্তরে সুবর্ণপুরের পুর্ণযৌবনা নদীতে গণ্ডারামের কোশলি ডঙ্গায় প্রথমে লঙ্কেশ্বরীর দহ, কেওট-ধীবরদের কালো মুগুনি পাথরের লঙ্কেশ্বরী দেবীর সাতযোগিনী দেবীর ছবি আঁকা মন্দির, তার বৌদ্ধসূত্র, রাজঘাট, দসমতী ঘাট, গৌরী ঘাট, ঘোড়াদল ঘাট দেখি, তখন একসঙ্গে মিশে যায় সোনপুরের আর মহানদীর প্রাচীন সব মিথ আর ভারতের সমকালীন বাস্তবতা। হীরাকুদের ফলে নদীতে মাছ কমে গেছে। মাছধরা আর বছরভর উৎসব নেই। নদীর ধারে শুকোচ্ছে জেলেদের বেঙ্গা, ফেঁকা, চৈদ্দি, মটলা, ঘণ্টি ইত্যাদি নামের বিভিন্ন সাইজের ও প্রজাতির মাছের জন্য বিশেষ জাল। নদীর উপরে ব্রিজ হওয়ার বলে খেয়া পারাপারও কমে গেছে। সব মিলে নদীর ঘাটে পড়ে আছে সারিসারি অচল ডিঙি। এর ফলে গণ্ডারামের যে বিষণ্ণতা তা নিয়েই অমোঘ প্রশ্ন স্মিতার— ‘আমাদের নদী— সত্যেন্দ্র সকালে বলেছিলেন… নীলকণ্ঠেরও নদী, সুবলেরও— সত্যিই কি তাই? প্রকৃতি, পাহাড়, নদীজল, মৃত্তিকাজাত ঐশ্বর্য তা কি আর ভূমির সন্তানদের আছে?’ এই প্রশ্নের কারণ তাঁর এই উপলব্ধি যে—
“বহুজাগতিক ও বেসরকারি পুঁজিও যখন জমি-জায়গা কেনে, কিছুই বাদ দিতে চায় না তারা। প্রাকৃতিক, প্রাচীন জলধারা, নদী, পাহাড়শ্রেণি সবই তাদের প্রোজেক্ট রিপোর্টের অংশ হয়ে যায়। তারপর একদিন যখন পাঁচিল তৈরি হয়, গেট বসে, উর্দি পরা সিকিওরিটি বসে, তখন নদী পাহাড়ের কাছে আসতেও মানুষের গেটপাস লাগে, সে পাস তাদের জন্য বানিয়ে দিতে বয়ে গেছে সিকিউরিটির। কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট তার নির্দেশনামায় বলেছে, প্রাকৃতিক সম্পদে সাধারণ মানুষের এক্তিয়ার যাতে বজায় থাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। কিন্তু এই দায়িত্ব রাষ্ট্র কেন নেবে?” (পৃঃ ৭৮)
এই উপলব্ধি বোধহয় গোটা উপন্যাসটির চাবিকাঠি। এক প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনকারী/কামী পুঁজিসেবক রাষ্ট্রের জনগণের প্রতি দায়িত্বহীনতা, যার কথা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ির মতো অনেকেই বলেন[1], আর আমিও, সেটা অনিতা তুলে এনেছেন স্মিতার মুখে, আর সেটাই তাঁর উপন্যাসে পরে বিভিন্ন স্তরের বুনাকার, কাঁসারি, … ইত্যাদির দুর্দশার মূল। সত্যেন্দ্র, নীলকণ্ঠ, স্মিতাদের সঙ্গে মহানদীর বুকে/কূলে মৎস্যেন্দ্রনাথঘাট, দারীকাপাদের নামে দারীপাথর, ছকাপাথর, হাতিপাথর, ঘোড়াঘাটপাড়া ছেড়ে একটু এগিয়ে উত্তরে তাঁবুপাথর, রাজঘাটের ঠিক উলটোদিকে নদীর বুকে জেগে থাকা লালপাথর, ওষধিসমৃদ্ধ প্রান্তীয় দিলবাহারপুর জঙ্গল তথা বাঘমারাকুদ জঙ্গল, কাকবিহ্বল কুয়াকুদ দ্বীপ, ইত্যাদি দেখতে দেখতে পুলিশের লাঠির যন্ত্রণা এবং অন্যান্য কারণে অচৈতন্যা স্মিতাকে নিয়ে আমরা ফিরে আসি এই কথা ভাবতে ভাবতে। ফেরার পরে লেখক বলেই সর্বদর্শী অনিতার সূত্রে ফেরার পর আরুণি ঝরার অভিসারে যাওয়া নীলকণ্ঠের আরুণির রাঁধা শোলমাছ-ভার স্বামী সীতানাথের হাতে চিংড়ি মারার বিষে মৃত্যু দেখে ভাবি, এর জন্যও কি অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও দায়ী নয় নেহরুভীয় সমাজতন্ত্রের অধীনে গড়া হীরাকুদ বাঁধ আর তার পরে নয়াউদারনীতিবাদের নামে মহানদীর বিধৌত অঞ্চলে কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে মানুষের গান্ধিবাদী প্রতিবাদের উপরও রাষ্ট্রের নিষ্পেষণ। হীরাকুদ গণ্ডারামের মাছমারা জীবিকা নষ্ট করেছে, ব্রিজ তার বার্ষিক ইজারা দেওয়া খেয়াপারাপারের উপার্জন কমিয়ে তাকে অবসাদগ্রস্ত মদ্যপে পরিণত করেছে, যার মধ্যে তার জীবনের সুখ আনন্দ ছিল তার জন্য হেঁশেলে হাঁড়িতে কেউ ভাত রেঁধে রেখেছে এই বোধ। সেই ভাতেই ছিল বিষ।
এই বোধ থেকেই আমি উপনদী নামের চতুর্থ পর্বে মহানদীর সবচেয়ে বড় উপনদী তেল, যেটি কালাহান্ডি, নবরঙ্গপুর, বলাঙ্গির জেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে টিটিলাগড় শহরের কাছ দিয়ে গিয়ে সোনপুরের কাছে মহানদীতে মিশেছে, তাদের সঙ্গমে— দ্বাদশ শতাব্দী থেকে তৈরি বহুতর শিবমন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সাক্ষী বৈদ্যনাথ মন্দিরখ্যাত বৈদ্যনাথ গ্রামে ঢুকি, আর সেখানে দেখা পাই নয়াউদারনীতিবাদী বাজারের সুবিধা লোটা, ভ্রষ্ট বুনাকার বানিয়া রমেশ মেহের-এর। তার সঙ্গেই দেখা পাই আরও কত জাতশিল্পী বুনাকারের, যাঁরা সুতোর বাঁধকাজ তথা ইক্কতের অলীক ফুল ফোটাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন মথুরা মেহের, বুনাকারিতে ভেষজ রঙের ব্যবহারের সমর্থক গান্ধিবাদী সমবায়-নেত্রী সীতাম্মা। কিন্তু বুঝি যে সমবায় সমিতিগুলির ভ্রষ্টতা, দুর্নীতি আর অবক্ষয়ের মধ্যে যে বুনাকাররা, তাদের যে ধর্মঘটগুলো ন্যায্য মজুরির জন্য করতে বাধ্য হবে তাদের দমনের মধ্যে বাজারও হারাতে থাকবে, তাদের মধ্যে রমেশদের ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত হবে। যে বুনাকাররা দূর গ্রামান্তরের বাজার কখনও চোখে দেখেনি, আর কর্পোরেট পুঁজি আর তার সহায়ক সরকার যাদের হাতে তারা নিঃস্ব হয়ে
“কেওনঝড়, ভদ্রক, জগৎসিংহপুর পর্যন্ত যে কোটি কোটি টাকার রথ দৌড়চ্ছে, তাদের পাশাপাশি প্রায় অদৃশ্য হয়ে দৌড়চ্ছে রমেশরাও— কেন্দুপালি তরভা বরপালি বৈদ্যনাথপুর নিমনার হাড়জিরজিরে গ্রামগুলি উজাড় হয়ে গেলেও রমেশরা থাকবে, শহরের ঝুপড়ি জ্বালিয়ে উৎখাত করে তারা তুলবে নতুন বাড়ি, ঝকঝকে দোকান, খাবার জল যেখানে অকুলান, সেখানে বিক্রি করবে ঠান্ডা জল, কপর্দকশূন্যের সামনে ঝোলাবে বিমা পলিসি, ভিতর বাড়িতে টেনে আনবে বাজারের হাঁ মুখের সামনে। বাজার বাড়লে রমেশরা বাঁচবে, বাজারকে বাঁচিয়ে, বাড়িয়ে, জ্বালিয়ে রাখার জন্যই তাদের দৌড়।” (পৃঃ ১০৭)
অসহায়, অচতুর, উদারনীতির বাজারের পক্ষে বেমানান মানুষদের বসতের পাশ কাটিয়ে যে পথে রমেশের গ্রামে আর না-ফেরার সঙ্কল্পের গাড়ি ছুটছে, তার একপাশে শিতুলিয়ায় বাস করে যে গ্রামের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত সরকারি জবরদখল করা জমিতে চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করা ছত্রিশগড়িয়া, ছত্রিশগড়ি-লরিয়া বুলির ভ্রাম্যমাণ আদিবাসীরা। তাদের খাঁটি পেতলের সংস্থান নেই। তাই ‘কিছুটা খাঁটি বা পুরো পিতলে মেশে ভাঙা পিতল, দস্তা, টিন— সব কিছু গলিয়ে মাটির ছাঁচে ঢালা।’ কিন্তু তাও অকুলান। এসব নিয়েও নিজেদের হাতে ডোকরার অসাধারণ কাজ করেও সরকারের দ্বারা অবজ্ঞাত, তাদের নিয়ে কাজ করছে দেবব্রত।
“বলাঙ্গির, শোনপুর ও কালাহান্ডি-নুয়াপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হাজারের বেশি শিল্পী-কারিগরকে সংগঠনে বাঁধার চেষ্টা করছে ওর দল “পৃথিবী”। এদের দল তৈরি, রেজিস্ট্রি করা, ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে ঋণের টাকা বার করা, তারপর বাজারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা, একেবারেই বুকে হেঁটে এগোনো।” (পৃঃ ১১০)
এর মানে হল রাষ্ট্র তথা প্রিন্স আর বাজারের নতুন প্রণয়ে মানুষের আশ্র্য় অসরকারি সংগঠনের একটা বিশেষ রূপ,[2] যাকে আমরা বলি, ‘community-based organizations’। বিপুল সংখ্যক মানুষের একমাত্র ভরসা তারাই।
এই সব সমস্যা পেরিয়ে আমরা ‘প্রত্নবিষাদ’ নামের মহানদী-র পঞ্চম পর্বে বৌধ্ জেলায় দেখি ‘সিড়িঙ্গে ঢ্যাঙা মাথায় ঠাসবুনট চুল’ ডুমাল তথা নন্দ-গৌড় জাতির মানুষ শম্ভু মহাকুদ-কে আর ঢোলা খাদির শার্ট আর ধুতি আর মোটা কাচের চশমা পরা, অন্যমনস্ক চোখের ভোই জাগতি হাইস্কুলের হেডমাস্টার, কুলতা জাতের হারাধনকে। শম্ভু পরাগলপুরে এসেছে সম্ভবত নীলকণ্ঠ মাঝির হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বতালাশের খোঁজে। কারণ সোনপুরে ঝরাদের গ্রামে সীতানাথের বাড়িতে শেষ দেখা গিয়েছিল নীলকণ্ঠকে। আর পরাগলপুরে বড় ঝরাপল্লী আছে যারা একাধারে কেওট-মৎস্যজীবী ও মাঝি। কিন্তু পুলিশের চাকরির বাইরে তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য স্থানীয় লৌকিক ঐতিহ্যের যাত্রাশিল্প তথা কংসবধকেন্দ্রিক চলমান ধনুযাত্রায় কংসচরিত্রে অভিনয়, আর তার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মোটা হওয়ার ওষুধ খাওয়া। আর হারাধন এসেছে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য তৃতীয় পর্ব ‘সুবর্ণপুর’-এ সত্যেন্দ্র প্রধানের মতোই বৌধ্ জেলায় ও বৌধ্ কন্ধমাল অঞ্চলে প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করার জন্য। অনিতা অগ্নিহোত্রীর সঙ্গে মহানদীর গতিপথে না ঘুরলে আমরা জানতেই পারতাম না যে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম আর শৈব হিন্দুধর্মের মিলনক্ষেত্র বৌধ্ জেলায় বহু গ্রামে আবক্ষ বুদ্ধমূর্তিই অধিবাসীদের গ্রামদেবী। ঝণ্টানুয়া পরবে নতুন ওঠা শিম তাঁর থানে চড়িয়ে তবেই খাওয়া হয়। অষ্টম বা নবম শতাব্দীর বিরল ভূমিস্পর্শ বুদ্ধমূর্তি সেখানে শহরে অবহেলায় পথের ধারে পড়ে থাকে, এবং অবৌদ্ধ স্থানীয় বুনাকার মেহের, কেওট কিংবা ব্যবসায়ীদের কাছে বুঢ়ারাজা বা শিব হিসেবে পূজা পায়। আবার ডুমালদের দেবী থাম্বেশ্বরী তথা খুঁটিদেবতা, গন্ধরাঢ়ী গ্রামের জোড়ামন্দিরে স্থানীয় মালিজাতির পূজিত শিব আর ব্রাহ্মণ পূজারীর দ্বারা অর্চিত নীলমাধব বিষ্ণুর একত্র পূজা হয়। সঙ্গে আছে মহানদীর বুকে একটু এগিয়েই মার্জাকুদ দ্বীপে পীতাবলী দেবী আর তীরে গ্রামপতির পীঠ। উভয়েই কন্ধ উপজাতির আরাধ্য দেবী। মার্জাকুদ গ্রামে শম্ভুর স্বপ্নসাধ পূর্ণ হয়। ছোটবেলায় সে বরগড় গ্রামে দেখেছে বরগড়কে মথুরাপুর, পাশের জিরা নদীকে যমুনা আর জিরা নদীর অন্য পারে অম্বাপালীকে গোপপল্লী করে অসাধারণ ভ্রাম্যমাণ ধনুযাত্রা, যাকে শম্ভু পুনরাবৃত্ত করে মার্জাকুদ দ্বীপে। আমি অতলস্পর্শী বিস্ময় দিয়ে মহানদীবিধৌত অঞ্চলকে নিয়ে অনিতার এই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দলিল পাই। এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক কিন্তু শোষিত, দরিদ্র মানুষ। সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক আলোচনার টানে তাঁদের কথা ভোলেন না বলেই বৌধ্ জেলার পদ্মতোলা অভয়ারণ্যে শেষবারের মতো পুরনো গার্লফ্রেন্ড সুমনাকে নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের অথেন্টিক খবর করতে আসা রঙ্গনাথনের চোখ দিয়ে (ষষ্ঠ পর্ব ‘নির্জন গভীর’ অংশে) দেখালেন যে নদীকূলের অজস্র গ্রাম, যেখানে মানুষ নিরুপদ্রবে ‘বসত করেছে বহু বছর ধরে, তখন অরণ্যই ছিল তার চারপাশে, অভয়ারণ্য ঘোষিত হয়নি। অভয়ারণ্য চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার পর মানুষ আর তার পার্শ্বভূমির সম্পর্ক বদলে গেছে। জঙ্গল আইন আর অন্য প্রাণীসম্পদ সংরক্ষণ আইনের চোখে মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনুপ্রবেশকারী।’ (পৃঃ ১৫২) অথচ ‘অনেক বেশি বিপদ আনল বহিরাগত ব্যবসায়ীর লোভের থাবা অরণ্যের শরীরে। ক্রমঅগ্রসরমান শিল্প … তাদের লোভে লাগাম পরাতে এল জঙ্গল আইন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, বনরক্ষকের নিয়ন্ত্রণে এল অরণ্য। অথচ যে মানুষরা অরণ্যের কোলে শৈশব থেকে লালিত হয়েছিল, তাদের আশ্রয় হয়ে পড়ল অনিশ্চিত। একের পর এক অরণ্যগ্রাম হয়ে উঠল এমনই ঠিকানাহীন মানুষের বাসভূমি।’ (পৃঃ ১৫২) এই মানুষদের মধ্যে আছে কন্ধ আদিবাসী হরমু, সনাতন প্রধান, তারা ‘দণ্ডনাচ’ করে, ‘মাধব সুলোচনা’ পালা করে যা প্রকৃতি আর অরণ্যচারী মানুষের। কিন্তু মালিশাহী কুটুরি-র মতো কোর এরিয়ার গ্রামে কর্মহীন, জমির পাট্টাহীন, কোর এরিয়ার মধ্যে থাকায় মহানদীর জল টেনে আনার অধিকারহীন মানুষ যতটুকু ফসল ফলাতে পারে বর্ষার জলের উপর ভর করে তাও তুলতে পারে না নীলগাই, বরাহ, আর হাতির অত্যাচারে। স্কুল নেই বলে শিশুরা মূর্খ হয়ে থাকে। খুঁড়ে আনা বিভিন্ন কন্দমূল— মাসিয়া, ওরগুণা ইত্যাদি বিস্বাদ খাবার খেয়ে খিদে মেটায়।
এদের থেকে অবস্থা বিশেষ ভাল নয় উত্তরে অনুগুল, দক্ষিণে বৌধ্ জেলার সীমান্ত দিয়ে বয়ে কটক ও নয়াগড়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত মহানদীর তীরে ব্রহ্মাদ্রি ও হিমাদ্রি পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত আশু ও যতীন কাঁসারি, মদন মহারাণা ইত্যাদি কাংস্যশিল্পীর। তীব্র কায়িক পরিশ্রম লাগে কাঁসার বাসন তৈরিতে, কিন্তু তার জায়গা নিয়ে নিচ্ছে ইস্পাতের বাসনপত্র। চাহিদায় ভাঁটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধাতুর জোগানের অনিয়মিতি। আর অসীম দারিদ্র্যের মাঝখানে নীরবে চলেছে মাওবাদীদের রিক্রুটমেন্ট। তাদেরই এক চোরাগোপ্তা আক্রমণে হত হয়েছে আশুর বড় ছেলে। আবার এই কন্টিলোর কাছেই মহানদীতে এসে মিশেছে গঞ্জাম জেলার ভঞ্জনগরের পঞ্চবটি পাহাড়ে জন্ম নেওয়া কুসুমি, আর নয়াগড় জেলার খন্দপাড়া তহশিল সীমান্তে দুয়ান্ত আর ডাহুকের সঙ্গে মেশার পর। তাদের সম্মিলিত জলধারাকে ধরে রাখে বুঢ়াবুঢ়িয়ানী জলভাণ্ডার। আবার সাতকোশিয়ার অভয়ারণ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খলখলা নালা আর কুঁয়ারিয়া নামের মহানদীর এক উপনদীর উপর বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে কুঁয়ারিয়া নামেরই এক জলভাণ্ডার। এদের সম্মিলিতভাবে ছাড়া অতিরিক্ত জলে মঙ্গরাজপুর, গুনটুনি, সালিঝরা, রনপুর, দাশপাল্লা, ওঁড়গাও ইত্যাদির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ২০০৩, ২০০৯, ২০১২ এবং ২০১৩-র নীলকান্তমণির নামধারী Phailin ঝড়ের পর জীবনবিধ্বংসী বন্যা আসে। এরকম এক বন্যার মধ্যে দাশপাল্লার ‘আরণ্যক’ নামের কৃষি প্রয়োগশালায় বাবা তথাগত-র গড়া সমবায় সমিতির মাধ্যমে আশেপাশের চল্লিশটি গ্রামের ক্ষেতে তাঁদের তৈরি ধানবীজ, কীটনাশক ইত্যাদির সাহায্যে বিদেশ থেকে ফেরা আশাবরী ১৯৯৯ সনের মহাবাত্যায় উদ্ধার করে সন্তানস্নেহে মানুষ করা ঝঞ্ঝার সঙ্গে আছেন। আর একদিকে এই অঞ্চলের উদ্ধার আরেকদিকে হঠাৎ করে স্নেহ চাগিয়ে ওঠা ঝঞ্ঝার নিঃসন্তান কাকার মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার মোকাবিলা কী করে করা যায় তাই ভাবছেন আকুল হয়ে (সপ্তম পর্ব ‘নীলমাধব’)।
এর পর আমি এই উপন্যাসের লেখিকার পথ ধরে কটক জেলায় মহানদীর অববাহিকা অঞ্চলে চলে আসি, অষ্টম পর্বে, যেখানে সাতকোশিয়ার গিরিপথ থেকে অনেক নিচে নেমে নয়াগড় ও ঢেনকানল জেলার সীমান্ত বরাবর বয়ে আঠগড় মহকুমার নরসিংহপুর তহশিলে মহানদী কটক জেলায় প্রবেশ করেছে। আর এখানে কটকের অল্প দূরে, পশ্চিমে নরাজ-এর কাছে মহানদী সমতলে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ায় অজস্র তার শাখানদীর ধারা— মূলস্রোত ও কাঠজোরী, কটক জেলার মধ্যভাগে ব্রাহ্মণী, বৈতরণী, কটক শহরের দক্ষিণে চিত্রোৎপলা, সুখপাইকা, বুঢ়া, ব্রাহ্মণী নিজে আর তার শাখাদীগুলি খরসুয়া, পতিয়া, নিমিরিয়া, গেঙ্গুটির সঙ্গে জুড়ে যাওয়া কেলো, বিরূপা ইত্যাদির মিলন-বিরহ-পুনর্মিলনের বিচিত্র জলছবি, বন্যাপ্রবণ কটকে স্থানীয় অতিথি ইন্দ্রনাথ মহান্তি ও তাঁর অতিথির আলাপচারিতে কটক জেলায় সুভাষচন্দ্রের বিপুল প্রভাব, ইন্দ্রনাথ ও তাঁর এককালের প্রেমিকা ও পরে বন্ধুর স্ত্রী এবং তারও পরে বিধবা হওয়া তাপসীর সঙ্গে তাঁর অনির্বাণ প্রণয় ইত্যাদির অত্যন্ত জীবন্ত বর্ণন দেখে আমরা পর্যটকের মতো পৌঁছে যাই কটকের কাছেই একটি গ্রামে, মহানদী উপকূলের কাছে বাঁকি-আঠগড়-নুয়াপাটনা-তিগিরিয়া-মানিয়াবন্ধ-এর দশ-বারোটি গ্রামের একটিতে, নুয়াপাটনায়, যেখানে আগে অশ্বিনীপাটরা, গৌড়ীয়পাটরাদের মতই সরাক গোত্রের মহাযান বৌদ্ধ উপমন্যু পাত্র তাঁর ভাই নিরঞ্জন পাত্রর সহযোগিতায় বৌদ্ধ বুনাকাররা রেশমকীটকে মারতে হওয়ার কারণে বাঁধাকাজে বা বান্ধকামে রেশম ব্যবহার করতেন না। সেখানে উপমন্যু পাত্র যে শুধু সেই রেশমের কাজকে আপন করে নিয়েছেন তাই নয়, স্বদেশে এবং বিদেশে সমাদৃত সংসারবিমুখ, সৃষ্টির সময় স্ত্রী মোহিনীর সঙ্গআসঙ্গবিমুখ, প্রচারবিমুখ, এমনকি নিজের সৃষ্টিকে হাতছাড়া করতে গররাজি এই শিল্পী গত পনেরো-কুড়ি বছর ধরে বছরে দু-তিনটি মাত্র শাড়ি বুনেছেন। তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে স্বদেশে বিদেশে সংগ্রাহকরা। তারপর, গত ছয় বৎসর ধরে একবেণীহিয়া হয়ে রেশমের উপর গীতগোবিন্দের অজস্র শ্লোকখচিত একটি অসাধারণ শিল্পকর্ম রচনা করেছেন। তাঁর কাজের খবর রাখে সমঝদার ধনী সংগ্রাহকরা। ফলে কাজ শেষ হওয়ার দিনই জগৎসিংহপুরের ইস্পাতদৈত্য পস্কো কোম্পানির ম্যানেজার পার্সোনাল রিলেশনস খেতান-এর উপরে কোম্পানির আদেশ আসে একটি নাগরিক সম্বর্ধনা এবং পস্কোগ্রুপের লন্ডনস্থ মিউজিয়ামের জন্য চল্লিশ হাজার ডলারে কেনার দুটি পরস্পর সম্পৃক্ত ব্যাপারে উপমন্যুকে রাজি করানোর। হয়ত এর পিছনে প্রতিবেশী জগৎসিংহপুরে, মহানদীর মোহনা ও পারাদীপ অঞ্চলে এখনও বেশি না এগোতে পারা পস্কোর জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে বৈধতা অর্জনের চিন্তাভাবনাও আছে। কিন্তু উপমন্যু নাগরিক সম্বর্ধনা এবং শিল্পদ্রব্য বিক্রয় দুই ব্যাপারেই না বলে দেওয়াতেই বোধহয় তাঁর মন খারাপ দূর হয়ে মোহিনীর সঙ্গে তাঁর ষষ্ঠবার্ষিক মিলন হতে পারে, যার সম্পাদনের উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে পরিচারিকা রাধা। ‘টানা ভরনি’ নামের এই নবম পর্বে ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে বর্ণিত হরপার্বতীর মিলন না দেখতে হয় এই প্রতিজ্ঞায় চরাচরের, ত্রিলোকের সবার চোখ যেমন নিমীলিত, তেমনি এই দৃশ্য থেকে চোখ এড়িয়ে আমি চলে যাই ‘ময়নাতদন্ত’ নামের দশম পর্বে যেখানে মানিয়াবন্ধে রেশমকীট হত্যা না করার সঙ্কল্পবদ্ধ সুতোর বান্ধকর্মের কারিগরদের অকল্পনীয় দুর্দশা। কেউ কেউ আচমকা ‘সুন্দর পাড়ের বোনা সুতোর কাছিম, মাছ বা লতার উপর দেওয়ালে টাঙানোর জন্য’ জাতীয় পুরস্কার পেলেও অধিকাংশের দুর্দশা মূর্তি পেয়েছে স্ত্রীপরিত্যক্ত তোষদের বাড়ির কর্ণ-র বিষপানে আত্মহত্যায়। এই সব আত্মহত্যাকে খবর করে তোলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ‘মানিয়াবন্ধ প্রহরী’ নামের স্থানীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক ত্রিনাথ সাহু, আর তাদের আটকাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ১৯৯৯-এর মহাবাত্যা এবং তার পর বিভিন্ন পারিবারিক কারণে মুম্বাইএর স্পিনিং মিলে টেক্সটাইল টেকনোলজিস্ট-এর চাকরি ছেড়ে এই অঞ্চলের বুনাকারদের ব্যাপারে ঢালহীন তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের সরকারি চাকরি নেওয়া অরূপ। সহস্র প্রতিবন্ধকতা, বুনাকারদের ‘মাস্টার’ এবং অবনী মাইকরায়দের মতো রাজনৈতিক মদতপুষ্ট লোকজন এবং তাদের মাফিয়া প্রোটেক্টরদের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া অরূপ কর্ণকুমার তোষের অনাহারজনিত আত্মহত্যার পূর্নাঙ্গ রিপোর্ট পাঠাতে পারেনি।
অনিতার এই উপন্যাস পড়ে আমরা বুঝি যে অত্যাচারী-রাষ্ট্র আর বৃহৎ বেসরকারি পুঁজির এই নব্য উদারনৈতিক প্রণয়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের রাস্তা বন্ধ। যে কারণে, ‘মোহনা’ নামের একাদশ পর্বে আঠারোবাঁকির দক্ষিণে মহানদী যেখানে সমুদ্রে মিশেছে সেখানকার অসংখ্য জলধারার উপরে তৈরি পারাদীপ বন্দর, এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কুজঙ্গর মানুষদের মতোই, জঙ্গিরা গ্রামের ধারালো, কর্মঠ চেহারার কেওট বৌ পার্বতীর কাজ নেই। গত বছর চারেক হল নতুন সার কারখানার বর্জ্য পড়ে পড়ে গ্রামের সামনের গাঙে আর মাছ আসে না। মাছ ধরতে যেতে হয় দূরে মোহনার কাছে, মেরিন ফিশারির লোকদের ধরপাকড় এড়িয়ে বা হাতে পয়সা গুঁজে। গরমের তিন মাস তাও বন্ধ। কাছিমের ডিম পাড়ার সময় বলে। দূরসমুদ্রে গিয়ে নিখোঁজ হলেও জেলে-বউকে মুখ বুজে থাকতে হয়। এমনিতেই পার্বতীর স্বামী অসুস্থ আর মদ্যাসক্ত। ছেলে শহরের হোটেলে মালিকের অত্যাচার সয়ে কাজ করছে। সে উপায়ান্তর না দেখে অতল জলের আহ্বান ছেড়ে মাটির পুতুল নির্মাণের কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়। সেখানে তাকে বাঁচাতে আকুল বারবার ডাকছে ঐতিহ্যগতভাবে কুম্ভকার অধ্যুষিত এবং সীমান্তর প্রভাবে প্রায় রূপান্তরিত লুনকুয়া গ্রামের শ্যাম। ১৯৯৯-র মহাবাত্যার সময় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই গ্রামকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলেছে সীমান্ত-র মস্তিষ্কপ্রসূত ‘মৃত্তিকা’, পোড়ামাটির শিল্পকলার ট্রেনিং আর নির্মাণের সংগঠন। প্রথমে শ্যামের ভাঙা বসতবাড়ির অক্ষত অংশে যাত্রা শুরু করা এই মৃত্তিকা পরে নিজের তিনতলা বাড়ি তৈরি করেছে। পোড়ামাটির চুল্লি, নতুন গ্লেজড পটারির ফার্নেস, ইত্যাদির সাহায্যে তার কর্মশালায় তৈরি পশ্চিমা স্টাইলের মানুষের সাইজের বাজনদার পুতুল, নানা ধরনের ছোটখাটো মূর্তি, বাড়ির টালি, জীবনযাত্রার বিবিধ সাজসরঞ্জাম স্বদেশে ছাড়াও আমেরিকায় বিক্রি হচ্ছে। আর তাতে কাজ পেয়েছে বেশ কয়েকশো স্থানীয় মানুষ। সীমান্ত প্রথমে ট্রেনিং দিয়েছে শ্যাম, পান্না, অভিরাম ইত্যাদি অতীতে বাঁকে করে হাঁড়ি পাতিল বেচা নতুন প্রজন্মের কুমোরবাড়ির ছেলেদের। পরে তারাও অন্যদের শিখিয়েছে। শেষ পর্ব ‘বাতিঘর’-এ আমরা দেখি নিজের কর্মশালার কাজের বাজার আমেরিকা ছাড়াও আগ্রহী জার্মানি ও আর্জেন্টিনার দুটি শপিং চেনের মাধ্যমে বাড়ানোর ব্যাপারে লজিস্টিকস-এর ভাবনার মধ্যে কাজনা গাঁয়ে বাঁশের ঝুড়িচুবড়ির কারিগরদের মধ্যে বেতের কাজের ব্যাপারে ইচ্ছুক কর্মী খুঁজতে গিয়ে সীমান্ত পস্কোবিরোধী আন্দোলনের শ্রীকান্ত সামন্তর লোকদের আক্রোশের মুখে পড়েছে, যারা রাস্তায় অনাহারে পড়ে মরা লোকের মধ্যে নিজের ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’-র ভুল বার্তা ছড়ানোর কারণে তাকে আক্রমণ করে। ইস্পাত কারখানার বিরোধী অনেক। এক, কারখানার ফলে জলের বাড়তি চাহিদার কারণে চাষের জলে যে টান পড়বে জগৎসিংহপুর, কেন্দ্রাপাড়ার চাষিরা তার ভয়ে ভীত। তাছাড়া জগৎসিংহপুর, সুন্দরগড় ও কটকে পানের বরোজ, খনিজ আকরিক, জল, আর অববাহিকা বাঁচাতে চার-চারটে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। সীমান্ত এসব নিয়ে ভাবে না বলে তার নিঃশর্ত আনুগত্য সত্ত্বেও শ্যামের মনে দুঃখ আছে। উচ্চাশী, দরিদ্র মানুষের সেবাব্রতী উদ্যোগপতি সীমান্তর প্রতি আনুগত্য আর নিজের দেশজ সত্তার টানাপোড়েনের কারণেই গায়ে শুকনো মাছের গন্ধ লেগে থাকা শক্ত, সমর্থ চেহারার ইচ্ছুক পার্বতীর সঙ্গে মিলন হয় তার। পদাতিকের কাছে নদী জলধারার নিয়ত বিভাজন ও গতি পরিবর্তনের ফলে খরিলাসি নদীর পাশে কৌড়িয়া দ্বীপের ধারে বাতিঘর গ্রামে বাতিঘরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আসা একটি ইংরেজ পরিবারের তিন সদস্যের সমাধির পাশে শুয়ে শ্যামের ইচ্ছে করে ভয়ডরহীন, বনের আদিমতম মহুল গাছটির মতো ঋজু মানুষীটিকে এখানে নিয়ে আসতে, যেখানে কাছেই পারাদীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।
বইটি পড়ে আমি স্তব্ধ, বিমূঢ়। মহানদী যেন এক কথানদী, যার বাঁকে বাঁকে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে অজস্র জনসম্প্রদায়, তাদের জীবিকা ও জীবন, তাদের সমস্যা এবং তার সঙ্গে বাজার, পুঁজি আর রাষ্ট্রের যোগ ইত্যাদির কথা নিয়ে, ভারতের রাজনৈতিক অর্থব্যবস্থার ‘dirigiste’ পর্যায় থেকে নব্য উদারনৈতিক পর্যায় পর্যন্ত। এই বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষের মুখে ভাষা দিয়েছেন অনিতা। আর আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছেন এই আশ্চর্যের কথা যে কোনও ভাগেই ভারতের জাতীয় ও প্রাদেশিক রাষ্ট্রনায়করা তাঁদের অনেক Indic, বৈদিক বুলির মধ্যে মনে রাখেননি অর্থব্যবস্থার সম্বন্ধে কৌটিল্যর এই সংজ্ঞা— ‘মনুষ্যানাং বৃত্তিরর্থঃ। মনুষ্যবতী ভূমিরিত্যর্থঃ। তস্যাঃ পৃথিব্যাঃ লাভপালনোপায় শাস্ত্রমর্থশাস্ত্রমিতিঃ।’ এই কথা সত্যি প্রোজ্জ্বল ‘India’-র পাশে নিষ্প্রভ সমগ্র ‘ভারত’ সম্পর্কেই। তারই একটি পূর্বাঞ্চলীয় আখ্যান তুলে এনেছেন অনিতা, তাঁর এই মহাগ্রন্থে। তাতে পাই সহলেখক হিসেবে অধ্যাপক বিজয় বহিদারের সঙ্গে প্রোফেসর মনোরঞ্জন মহান্তির অসাধারণ বই ওড়িশা দরিদ্র কাহিঁকি (ওড়িশা কেন দরিদ্র)[3] বইয়ের কেন্দ্রীয় প্রশ্নটির উত্তর, যা সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যেরও দেওয়ার কথা। তাঁকে অজস্র ধন্যবাদ ও নমস্কার।
[1] Engineer, Meher; Chakraborty, Rabin; Mukhopadhyay, Subhasis; Guha Thakurta, Soumya & Rai Chaudhuri, Dipanjan. A conversation with Amit Bhaduri: alternatives in development. Sanhati. Oct 1, 2008. and Deshpande, Neeta. ‘Where Indian growth is crooked’: Economist Amit Bhaduri speaks about the current direction of the Indian economy. HIMAL. Aug 29, 2012.
[2] Nerfin, M. Neither prince nor merchant: citizen; an introduction to the third system. in World Economy in Transition: Essays Presented to Surendra Patel on His 60th Birthday. Oxford: Pergamon Press. 1986. pp. 47-59.
[3] মহান্তি, মনোরঞ্জন ও বহিদার, বিজয়। ওড়িশা দরিদ্র কাহিঁকি। কটক: কটক বুক স্টোর। ১৯৯৩।