অপর্ণা ঘোষ
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল। তারপরেও মণিপুরে শান্তি ফেরেনি। অবশ্য রাষ্ট্রপতি শাসনে শান্তি ফেরে— এটাই বা কে কোথায় দেখেছে? তবে সংবাদমাধ্যমে মণিপুরের যেটুকু জায়গা জুটত, ধীরে ধীরে সেটুকুও হারিয়ে গেছে। আমরা জানি না শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কী চলছে, জানি না শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে কি না, বা কবে যেতে পারবে। আরাম্বাই তেঙ্গলের মতো সশস্ত্র ইনসারজেন্ট দলগুলো এখনও সক্রিয়, জাতিহিংসার আগুন এখনও জ্বলছে। পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘ এক-দেড় মাস বিদ্যুৎ নেই, শরণার্থী ক্যাম্পগুলিতে একটি ঘরে তিন-চারটি পরিবার থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। চিকিৎসা বা অন্যান্য পরিষেবা বাদই দিলাম— পান করার জলটুকুও অত্যন্ত দূষিত, জীবাণুসঙ্কুল
লেখাটি তৈরি হওয়ার সময়ে বেঁচে ছিলেন রতন থিয়াম। লেখাটিকে তাঁর প্রতি একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবেই বিবেচনা করার সনির্বন্ধ অনুরোধ রইল মাননীয় পাঠকদের প্রতি...
মণিপুর উচ্চারণ করলে বাঙালিমানসে চিত্রাঙ্গদা এবং নেতাজির বাইরে আর কোনও ছবি চট করে ভেসে উঠত না, যতক্ষণ না পর্যন্ত শর্মিলা ইরম চানুর দীর্ঘ জেদি অনশন আর মণিপুরি মায়েদের নগ্ন মিছিল আমাদের স্নায়ু ও চেতনা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আরও একটু সাংস্কৃতিক যাঁরা, তাঁরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যব্যক্তিত্ব রতন থিয়ামের নাম জানেন। তবে হয়তো জানেন না যে, মে ২০২৩ থেকে যে হিংসাত্মক জাতিদ্বন্দ্বে মণিপুর পুড়ে খাক হচ্ছে, তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করে ক্রমাগত প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি, পিস কমিটি থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁকে না জানিয়েই সরকার কমিটিতে তাঁর নাম তুলে দিয়েছিল। তিনি স্পষ্ট করে দেন, “Unless the Centre takes greater interest, how can a Peace Committee here solve the problem?” এবং প্রশ্ন রাখেন, “Are we a part of India?”[1] এই প্রশ্নের উত্তরের মতোই আমরা মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির ইতিহাস, দ্বন্দ্ব, দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা— প্রায় কিছুই জানি না। বাঙালি তাও কিছু জানতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অনস্বীকার্য সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ইতিহাস আছে বলে। বাকি ভারত? তবে আমরা এটা জানি যে, মণিপুরের সাধারণ মানুষ যদি কখনও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়, তাহলে আমাদের কিছু না-জেনেও লাফিয়ে পড়ে বলতে হবে ‘মণিপুর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’। এই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে গত মে ২০২৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া অবধি কী কী ক্ষত তৈরি হয়েছে, একবার দেখে নিই পিছু ফিরে।
মে ২০২৩-ফেব্রুয়ারি ২০২৫
নিহত হয়েছেন ২৮৫ জনেরও বেশি, যার মধ্যে কুকি-জো গোষ্ঠীর মানুষ বেশি সংখ্যায়। মেইতেইরা তুলনায় কম। নিহতদের মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীরাও রয়েছেন।
আহত: প্রায় ১,১০০ জন
গৃহচ্যুত: প্রায় ৬০,০০০ জন
ধ্বংস হয়েছে: ৪,৭৮৬টি বাড়ি এবং ৩৮৬টি ইসলামি ও খ্রিস্টান উপাসনাস্থল। ইম্ফল থেকে কুকিদের এবং চূড়াচাঁদপুর থেকে মেইতেইদের কার্যত মুছে ফেলা হয়েছে।
স্কুল?
সরকারি পরিসংখ্যান (তাতে স্কুলের হিসাব পাচ্ছি না) বাস্তবের ক্ষুদ্রায়িত ছায়া মাত্র। গত ডিসেম্বরে এই প্রতিবেদকের মণিপুরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তখন জানা যায় যে স্থানীয় সাধারণ মানুষের হিসাব একেবারেই সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে মেলে না। আবার গ্রীশ্মা কুত্থার— Frontline-এর অসমসাহসী সাংবাদিক, যিনি মণিপুরের মাটি কামড়ে পড়ে থেকে টানা রিপোর্টিং করে যাচ্ছেন— তাঁর হিসেবও সম্পূর্ণ আলাদা। স্কুল পুড়ে যাওয়ার নির্ভরযোগ্য তথ্য তাঁর লেখা ও পডকাস্টে পাওয়া যাবে।[2]
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল। তারপরেও মণিপুরে শান্তি ফেরেনি। অবশ্য রাষ্ট্রপতি শাসনে শান্তি ফেরে— এটাই বা কে কোথায় দেখেছে? তবে সংবাদমাধ্যমে মণিপুরের যেটুকু জায়গা জুটত, ধীরে ধীরে সেটুকুও হারিয়ে গেছে। আমরা জানি না শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কী চলছে, জানি না শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে কি না, বা কবে যেতে পারবে।
আরাম্বাই তেঙ্গলের মতো সশস্ত্র ইনসারজেন্ট দলগুলো এখনও সক্রিয়, জাতিহিংসার আগুন এখনও জ্বলছে। পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘ এক-দেড় মাস বিদ্যুৎ নেই, শরণার্থী ক্যাম্পগুলিতে একটি ঘরে তিন-চারটি পরিবার থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। চিকিৎসা বা অন্যান্য পরিষেবা বাদই দিলাম— পান করার জলটুকুও অত্যন্ত দূষিত, জীবাণুসঙ্কুল।
হাতে গোনা দু-একটি সংবাদমাধ্যম ছাড়া নিরপেক্ষ সংবাদ দেশের অন্য অংশে পৌঁছে দেওয়ার কেউ নেই। বরং নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ হয়েছে, ভয় দেখানো হয়েছে, তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, এর পেছনে শাসক বিজেপির দীর্ঘ হাত।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জাতিদ্বন্দ্বের ইতিহাস পুরনো, সৌভ্রাতৃত্ব যে ছিলই না, তাও বলা যাবে না। সন্দেহাতীতভাবে এই দ্বন্দ্বগুলিকে বিচিত্র রাজনৈতিক আকার দেওয়ার কাজটা ঔপনিবেশিক শাসক তার সুবিধা অনুযায়ী করেছে। ব্রিটিশ ক্রাউনের সবচেয়ে বড় সমর্থক আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবার এই ছকে কেমন করে ঢুকে পড়ল, আর উত্তর-পূর্বের জনজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলে হিন্দুত্বের জয়গাথা কীভাবে দামামা-সহ বেজে উঠল— তা ইতিহাস হিসেবে বহুমাত্রিক এবং কৌতূহলোদ্দীপক।
উপনিবেশ ও জাতিদ্বন্দ্ব
প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে মণিপুর তার সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন জনজাতি-সহ একটি বনাঞ্চলপ্রধান ভূখণ্ড ছিল। নিজস্ব ধরনে গড়ে ওঠা একটি রাজতন্ত্র ছিল। এমনকি কোনও ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাও ছিল না। পুরুষেরা মাসে দশ দিন রাজার কাছে বেগার খেটে দিতেন। বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) অঞ্চলের সঙ্গে খুচরো ঝামেলা লেগেই থাকত। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক থেকে বার্মার আগ্রাসন তীব্র হয়ে ওঠে। প্রচুর মণিপুরী (উপত্যকার মেইতেই) ও নাগা মানুষ বার্মায় বন্দি হিসেবে, দাস হিসেবে প্রেরিত হন।[3]
এই সুযোগেই এই অঞ্চলে ঔপনিবেশিক শক্তির জোরালো অনুপ্রবেশ ঘটে। বার্মা-ব্রিটিশ বিরোধ ও মণিপুরের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান মণিপুরের উপর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের সূচনা করে। ১৭৬২-তে মণিপুরের রাজার সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তি সাক্ষরিত হয়। লুসাই পাহাড়ের বিদ্রোহী নাগা/মিজোদের শায়েস্তা করতে ব্রিটিশ বাহিনীকে সহায়তাও করে মণিপুর। মনে রাখতে হবে, তখন মণিপুরে শ্রমশক্তির বড় অংশ ছিলেন নাগা জনজাতির মানুষ। এর পর বার্মা-ব্রিটিশ সংঘাতেও নাগা দাসদের যুদ্ধে পাঠিয়ে ব্রিটিশদের সহায়তা করেন তৎকালীন রাজা। জেমস জনস্টোন (ব্রিটিশ আধিকারিক) ১৮৯৬ সালে Manipur and the Naga Hills গ্রন্থে লিখেছেন, এই নাগা সৈন্যদের মাইনের অর্ধেক মণিপুরের রাজার কোষাগারে যেত।
অন্যদিকে, ১৮৪৫ সালে কুকিরা লুসাই পাহাড়ের অন্য জাতিদের (ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে) তাড়া খেয়ে নাগা পাহাড়ে আসেন। ভূমি দখল নিয়ে ব্যাপক হিংসা ও রক্তপাত ঘটে। প্রচুর নাগা খুন হন তাঁদের হাতে। নাগা পাহাড় ও মণিপুর উপত্যকার মাঝে কুকি গ্রাম বসিয়ে বাফার জোন তৈরির ব্রিটিশ অপচেষ্টার ফলে দুই জনজাতির মধ্যে অজস্র প্রাণহানি, রক্তক্ষয় ও দীর্ঘ শত্রুতার সূত্রপাত ঘটে।
এই চাপে স্বাধীনচেতা নাগা উপগোষ্ঠীগুলির কয়েকজন নেতৃত্বকে নিরাপত্তার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে ঔপনিবেশিক শক্তি। মণিপুরের শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার পুরনো সম্পর্ক ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে বদলাতে থাকে, জনজাতি গোষ্ঠীগুলির আন্তঃবিরোধও অন্য রাজনৈতিক মাত্রা পেতে থাকে।
বার্মার সঙ্গে ইয়ান্দাবুর জয়সূচক সন্ধির (১৮২৬) পরও ব্রিটিশরা মণিপুরের রাজার সঙ্গে বিনা আলোচনায়, সামান্য বার্ষিক ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে, মণিপুরের কাবো উপত্যকা বার্মাকে দিয়ে দেয়। বহু মণিপুরী মানুষ (মূলত মেইতেই) বার্মায় স্থানান্তরিত হন। ব্রিটিশ এজেন্ট রাজসভায় থাকলেও ১৮৯১ অবধি মণিপুরের একধরনের সার্বভৌমত্ব বজায় ছিল। এও মনে রাখতে হবে, এই সময় জুড়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য জনজাতির বিদ্রোহ দমনে মণিপুরের মেইতেই রাজবংশ ব্রিটিশদের সহায়তা করেছে।
১৮৯১ সালে উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে অ্যাংলো-মণিপুরি যুদ্ধ বাধে। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আবেগে উদ্বুদ্ধ মণিপুরের নারী-পুরুষ রাজার পক্ষে মরণপণ লড়াই করেছিলেন। ব্রিটিশ জয়লাভ অনিবার্য ছিল। মণিপুর অধীনস্থ দেশীয় রাজ্যে পরিণত হয়।
এই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, কুকিদের নিজস্ব ঐতিহাসিক বাসভূমির সমস্ত বৈধ উত্তরাধিকার ব্রিটিশরা ধ্বংস করে রেখে গেছে। পরবর্তীতে, বিভিন্ন সময়ে— ব্রিটিশ-সহ স্বাধীন ভারতে বিভিন্ন শাসকের হাতে যোদ্ধাবাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন তাঁরা। পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁদের অস্ত্রে সজ্জিত করেছে শাসক।
জটিলতার এই বহুমাত্রা লিখিত ইতিহাসও সব সময় ধরে রাখতে পারে না।
সহজ করে বুঝিয়েছিলেন ইম্ফল উপত্যকার যে হোমস্টেতে থাকার সুযোগ হয়েছিল, তার তরুণ মালিক। বয়সে তরুণ হলেও, তাঁর জনজাতির মৌখিক ইতিহাসজ্ঞান শিকড়ছিন্ন নাগরিকদের মতো নড়বড়ে নয়।
ব্রিটিশ অধীন দেশীয় রাজ্য মণিপুর
১৮৯১ থেকে ঔপনিবেশিক সরকার জাতিবিদ্বেষ বিস্তারের নীতিগুলি পূর্ণ শক্তিতে প্রয়োগ করতে শুরু করে। মেইতেই-প্রধান উপত্যকা এবং নাগা ও কুকি-জো-প্রধান পাহাড় এলাকায় পৃথক প্রশাসন তৈরি হয়। মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব কটি ভূখণ্ডেই জনজাতিদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য রুখতে ব্রিটিশরা বিচিত্র ও বিবিধ কৌশল গ্রহণ করে।
মণিপুর উপত্যকার মেইতেইদের থেকেই রাজবংশের উদ্ভব। স্বভাবতই মেইতেই অভিজাতরা ইংরেজ-মিত্র। আগে থেকেই বিশিষ্ট সংস্কৃতি ও ভূসম্পত্তির অধিকারী হিন্দু[4] মেইতেই অভিজাতরা ব্রিটিশ অনুগ্রহে আরও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠলেন। মেইতেইদের মধ্যে মুসলমানও আছেন, বলা বাহুল্য তাঁরা প্রভাবশালী নন।
অন্যদিকে, সুবিধাবঞ্চিত দ্বন্দ্ব-বিধ্বস্ত নাগা/কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই জাতিঘৃণা বাড়তে থাকে। পাহাড়ি অঞ্চলে ক্রমাগত খ্রিস্টান মিশনারি পাঠিয়ে গণহারে নাগা/কুকিদের ধর্মান্তরণ ঘটিয়ে উপত্যকার মেইতেইদের সঙ্গে একধরনের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টাও চালায় ব্রিটিশ প্রশাসন। মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে নাগা, কুকি ও জোমি সম্প্রদায়ের সামাজিক মেলামেশার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
১৯৩০-এর পরবর্তী সময়ে সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে ‘নিখিল হিন্দু মণিপুরি মহাসভা’, পরে যার নাম হয় ‘নিখিল মণিপুর মহাসভা’, যে ব্যাপকতর আন্দোলনগুলি গড়ে তোলে, তাতে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলির কোনও যোগ ছিল না। আর এইসব আন্দোলনের সুফলও পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্গীয় মেইতেইরাই পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, ব্রিটিশ আগ্রাসনে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জোর করে ব্রিটিশ সেনাদলে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে যখন কুকিরা শাসকের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন (১৯১৭-১৯), তখন মেইতেইদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সামান্য অংশই তাতে সমর্থন জানিয়েছিলেন। বৃহৎ অংশই ছিলেন নিষ্ক্রিয় আর অভিজাত সরকারি অংশ মেইতেই আধিপত্য রক্ষার স্বার্থে কুকিদের দমন করার পক্ষে ছিলেন।
বনজ ও খনিজ সম্পদ দখল এবং ক্ষমতা কব্জায় রাখার খেলায় উত্তর-পূর্বের দৃঢ় স্বাধীনচেতা প্রকৃতিরক্ষক আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যেকার নিজস্ব দ্বন্দ্বকে ঔপনিবেশিক স্বার্থে কাজে লাগানোর নকশাটি না বুঝলে মণিপুর-সংঘর্ষের বহুমাত্রিক জটিলতা বোঝা অসম্ভব।
১৯৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরের পর এই অঞ্চলগুলির স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে সামরিকীকরণ (আফস্পা তো জানেনই সবাই) ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে ধূলিসাৎ করে, ছোট ছোট উপনিবেশ বানিয়ে, স্থানীয় আদিবাসী মানুষের দীর্ঘকালাশ্রিত স্বশাসনের ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করে ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত করে ফেলা হয়।
সঙ্ঘ পরিবারের মঞ্চ-অধিকার
ষাটের দশক থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ধ্বংস করে আসাম থেকে অরুণাচল অবধি এক আগ্রাসী হিন্দু-জাতীয়তাবাদের প্রসারের পরিকল্পনা নেয় আরএসএস। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্যানারে ১৯৬৬ সালে আসামের জোরহাট সম্মেলন খুবই উৎসাহ তৈরি করে। গোলওয়ালকর নিজে এই সম্মেলনে তিন দিন ধরে বসে থাকেন। আরএসএস-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বেশ কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর নেতৃত্বকে সেখানে হাজির করানো যায়। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের জনপ্রিয় নাগা নেত্রী রানি গুঁইডালো।
হেরাকা আন্দোলনের নেত্রী গুঁইডালো নাগা সংস্কৃতি ও পরিচিতি রক্ষার জন্য লড়েছিলেন পশ্চিমা প্রভাবের বিরুদ্ধে, খ্রিস্টান ধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে। তিনি কংগ্রেসের যথেষ্ট কাছের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও, কংগ্রেস সঙ্ঘ পরিবারের এইসব প্রচেষ্টায় কোনও বাধা দেয়নি। তারা ভেবেছিল, আরএসএস-এর এইসব উদ্যোগ তাদের রাষ্ট্রীয় ঐক্যাকাঙ্ক্ষায় সফলতা জোগাবে।
যাই হোক, অরুণাচলে পরশুরামের মন্দির সারাইয়ের মধ্যে দিয়ে এই যোজনা সফলভাবে যাত্রা শুরু করে। খ্রিস্টান ও মুসলমানদের অপরায়ণের মাধ্যমে[5] এই যোজনা সাফল্য পেতে শুরু করে। সমগ্র অঞ্চলজুড়ে সুযোগবঞ্চিত ‘বনবাসী’ ও ‘গিরিবাসী’ শিশুদের লক্ষ করে গড়ে তোলা হয় অসংখ্য আবাসিক বিদ্যালয়। সেগুলিতে অন্যান্য আরএসএস-চালিত স্কুলের মতোই সংস্কৃত এবং হিন্দুরাষ্ট্র তৈরির জন্য সব পাঠ দেওয়া হয়— শুধু শিশুটির নিজের সংস্কৃতি ছাড়া। পার্থক্য একটাই— সাভারকরের সঙ্গে এখানে আম্বেদকরের ছবিও ঝোলানো হয়। দীর্ঘকাল ধরে রানি গুঁইডালো-সহ বিভিন্ন অন্যান্য আদিবাসী নেতাদের ছবি ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যাতে তাঁদের ধর্ম-সংস্কৃতি হিন্দু ধর্ম বলেই তাঁদের চৈতন্যে গেঁথে যায়। এসব স্কুলে ঝোলানো থাকে লক্ষ্মীদেবীর ছবি, ভারতমাতা নামে। সংস্কৃত মন্ত্র লেখা থাকে, শিশুরা আবৃত্তি করে। অর্থ জানে না। দেওয়ালে বড় করে লেখা থাকে “Knowledge leads to unity / Ignorance leads to diversity.”
কংগ্রেস ভেবেছিল, তাদের খুব লাভ হচ্ছে— তাই এই আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী কর্মকাণ্ডে পরোক্ষ ধোঁয়া জুগিয়েছে। কংগ্রেসের অভিজাতরা যাদের বাগে আনতে পারেনি, আজ তাদেরই বিরাট অংশের সম্মতিতে সেই অভিজাত উচ্চবর্ণই ক্ষমতা ভোগ করছে।
আজ জনজাতি বিকাশ সমিতি, আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার সফল। মিজোরাম ছাড়া পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চল আজ বিজেপির দখলে। বিভেদকামী, হিংস্র অপরায়ণ ও গা-জোয়ারির হিন্দুত্ব এই অঞ্চলের তন্তুতে তন্তুতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। এই সর্বাত্মক অভিঘাতের একটি প্রতিক্রিয়া— মণিপুর।
বর্তমান অস্থিরতা: চলমান হিংসা
২০২৩ সালের মে মাস থেকে যে অস্থিরতা চলছে, তার আপাত হেতুটা সকলেই জানেন। মেইতেই সম্প্রদায়কে শিডিউলড ট্রাইব-ভুক্ত করার জন্য মণিপুর হাইকোর্টের একটি অর্ডারকে ঘিরে অশান্তি শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে IWGIA-র একটি প্রতিবেদন থেকে নিচের অংশটি উদ্ধৃত করা যাক:
In 1948, a merger agreement between Manipur State with the National Government of India was made. This agreement only covered the valley area, also known in pre-colonial times as the Princely State under which the Meitei were ruled. Historically and traditionally, the Meitei occupied the valley lands of the region while the Nagas and Kukis are hill people and have always wanted to remain independent. However, adding a level of complexity that continues to exist today, the Meitei claim that the entire territory of the region, including the hills, is the traditional territory of Manipur, whereas it is in fact only the valley, out of fear that this would bifurcate the administration of the areas, allowing separate political entities to remain in control of both the hill people and the Meitei’s land in the valley.
These issues remain unresolved, and the current conflict is directly related to that.
The Nagas have found it difficult to get involved in the current conflict because the Kuki raised the issue of separate administration, which by default involves administration and ownership of land. However, the Nagas are providing relief to Kuki victims as they are in agreement that the Meiteis should not receive Scheduled Tribe status and upend the delicate political balance in the area and lose the independence they have been fighting for centuries.
আপাত হেতুটি আসলে খুঁচিয়ে তোলা সমস্যা।
নাগা-কুকি-মেইতেই ত্রিমুখী জটিলতা থেকে কী কী ফায়দা তোলার জন্য বিভিন্ন ইনসারজেন্ট গ্রুপগুলিকে পয়সা ও অস্ত্রশস্ত্র জুগিয়ে[6] শাসক বিজেপি মণিপুরের মানুষকে এই আত্মধ্বংসী তাণ্ডবে জুতে দিল তার কারণগুলিও অজানা নয়।
ড্রাগব্যবসা
দরিদ্রতম কৃষকরা মাদক মাফিয়াদের কাছ থেকে সার এবং কীটনাশকের জন্য আর্থিক অগ্রিম নিয়ে পপি চাষ করেন। ভারতে পপি চাষ লাইসেন্সপ্রাপ্ত বলে মায়ানমার থেকে মাদকব্যবসার কেন্দ্র এখন মণিপুরে সরে এসেছে। যদিও মাদক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে অবৈধ পপি চাষে রাজ্যের তিনটি প্রধান গোষ্ঠীর— কুকি, নাগা এবং মেইতেই— মানুষ যুক্ত রয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই বিত্তশালী গোষ্ঠী হিসেবে নিয়ন্ত্রণ মূলত মেইতেইদের হাতে। কিন্তু কেবল কুকিরাই অবৈধ চাষে লিপ্ত দুষ্কৃতি, এই ধরনের প্রচার চালিয়ে, মণিপুরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং এই র্যাকেটের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে চান। দুর্জনে বলে, এই ব্যবসায় তাঁর নিজের লগ্নিও কম নয়। এতে তিনি পুরনো জাতিদ্বন্দ্বের সঙ্গে সফলভাবে হিন্দু-খ্রিস্টান অ্যাঙ্গেলটাও জুড়ে দিতে পেরেছিলেন।
স্থানীয় সিভিল অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, মণিপুরে মাদকব্যবসা থেকে বার্ষিক রাজস্ব আনুমানিক ৫০,০০০ কোটি টাকা (প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ইউরো), যা রাজ্যের ৩০,০০০ কোটি টাকার (প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন ইউরো) বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। এত বড় নেটওয়ার্ক রাজনৈতিক মদত ছাড়া— বিশেষত শাসকের মদত ছাড়া— চলতে পারে না। প্রাক্তন সহকারী পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট থৌনাওজাম বৃন্দা এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টই বলেছিলেন: “মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী (বীরেন সিং) অবৈধ মাদকব্যবসার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন না; বরং তিনি এর অংশ— মাদক-মাফিয়াদের পৃষ্ঠপোষক এবং রক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।” এই সাহস দেখানোর জন্য তাঁর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভবত তিনি চাকরিটিও ছেড়ে দিয়েছেন।
রাষ্ট্র ও কর্পোরেট: নব্য-উদারবাদী যৌথ প্রকল্প
সারা ভারত জুড়ে বনাঞ্চল ও খনিজ সম্পদ দখলের লক্ষ্যে বনবাসী জনজাতিরা উচ্ছেদ, অত্যাচার, ধর্ষণ ও গণহত্যার শিকার হচ্ছেন। মণিপুরের জঙ্গল-পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর— সে-ই বা বাদ থাকবে কেন?
সাংবিধানিক সুরক্ষাকবচ এখনও পাহাড়ি অঞ্চলকে পাহাড়িদের অধিকারে রাখায় কর্পোরেট সেভাবে ঢুকতে পারেনি। মেইতেই সম্প্রদায়কে শিডিউলড ট্রাইবের মর্যাদা দিলে কুকি ও নাগারা যে বিপর্যস্ত বোধ করবেন— তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পাহাড়ে মেইতেইদের জমিতে অধিকার জন্মালে, তাদের হাত ধরেই যে কর্পোরেট পাহাড়ে উচ্ছেদ চালাবে তা শিশুরও বোধগম্য।
বিজেপির সমর্থকভিত্তি মেইতেইরা। তাতে হিন্দুত্বের মিশেলও রয়েছে। জাতিদাঙ্গা লাগিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি ঘটানো বিজেপির পুরনো— এবং একমাত্র— পন্থা। মণিপুরেও তারা তাই করছে।
বাকিটা ব্যক্তিগত
গত ডিসেম্বরে যখন ইম্ফলে যাই, মণিপুর উপত্যকা এবং নাগা পাহাড়ি জেলাগুলিতে যাওয়ার জন্য ইনারলাইন পারমিট নিতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই কুকি এলাকার পাহাড়ে যাওয়া যাবে না। কলকাতায় ফিরে আসার পরেও দপ্তর থেকে ফোন করে খোঁজ নেওয়া হয়— মণিপুর ত্যাগ করেছি কিনা।
যাই হোক, খুব সীমিত ঘোরাঘুরির মধ্যে যেটুকু অবাক হয়ে দেখেছি, তা হল সাধারণ মেইতেই মানুষের বিষমুক্ত মন। ইম্ফল বিমানবন্দর থেকে ২ কিমি দূরে, মইত্রম নামে একটি গ্রামীণ এলাকায় হোমস্টে, এক অল্পবয়সী দম্পতি সেটি চালান। তাঁদের ব্যবসা প্রায় লাটে উঠেছে। ট্যুরিস্ট নেই। মেয়েটি এমনিতে হাসিখুশি, কিন্তু বিষণ্ণতা বেরিয়ে আসে খানিক কথা বললে। সেই বিষণ্ণতা ঠিক ব্যবসায় ভাঁটা পড়ার জন্য নয়। বলেন—
“দিদি, এমন কেন হচ্ছে বলুন তো! আমরা তো খুব ভালোই ছিলাম। আর কি কখনও পাহাড়ে যেতে পারব না? আর কি কখনও সব ঠিক হয়ে যাবে না?” চোখ ভরে জল আসে তাঁর।
এমন প্রশ্নের মুখে চুপ করে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
বাইরের লোক গেলেও, নাগাদের পাহাড়ে মেইতেইরা নিরাপদ নন। তবু মেয়েটির মুখে কুকিদের সম্পর্কে একটিও শাপ-শাপান্ত শুনিনি। সব ঠিক হবে কিনা— এইটুকুই তাঁর বিপন্ন জিজ্ঞাসা।
তরুণটি গাড়ি চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান। যেতে যেতে অনেক কথা হয়, অনেক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্ন করি। কোথাও কোনও দ্বেষ দেখি না। মণিপুরের বাইরে থেকে পড়াশোনা করে বাড়ি ফিরে হোমস্টে চালান। যৌথ পরিবার। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে। ছোট ভাই বিশ্বভারতীর শিল্পকলার স্নাতক শুনে আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠি। তিনি বলেন—
“কুকিদের দোষ দিই না। ওদের তো নিজেদের কোনও জায়গাই নেই। সবাই ওদের লেঠেল হিসাবে ব্যবহার করেছে। সবে ওদের ১-২টো জেনারেশন পড়াশোনা শুরু করেছিল, হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিল।”
বরং আরাম্বাই তেঙ্গলের মতো স্বঘোষিত রক্ষক গ্রুপগুলোর দৌরাত্ম্যে তাঁরা দিশেহারা। চাঁদা দিতে দিতে ফতুর সাধারণ মানুষ। এইসব দল তাঁরা আগে দেখেননি। কোথা থেকে কীভাবে এসব তৈরি হচ্ছে, বিশদে না বললেও, সরকারি মদতের কথা অস্বীকার করেন না তিনি।
ইম্ফল জুড়ে এক থমথমে ভাব। একদিন লোখটাক হ্রদ দেখতে যাই। এখন কেউ যায় না সেখানে। শিলজেন্দ্র নামে এক হোটেলমালিকের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। সটান বলেন— “এসে ঘুরে চলে যেতে হবে। হোটেল বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কুকি-মেইতেই বর্ডার জোন। নিরাপত্তার দায়িত্ব তো নিতে পারব না।”
সকাল-সকাল বেরিয়ে লোখটাক পৌঁছই। দেখি শিলজেন্দ্র একেবারেই অল্পবয়সী মেইতেই তরুণ। ‘গ্রামোন্নয়ন’ নিয়ে পড়াশোনা করে স্থানীয় লোকজন নিয়ে ইকো-স্টে তৈরি করেছিলেন। ভারী সুন্দর। বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
কফি বানিয়ে দেন। আড্ডা চলতে থাকে। নির্বিকারভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বোঝান। কুকি-বিদ্বেষ দেখি না তাঁরও। কথা চলতে চলতে দুজনেই বুঝে ফেলি উভয়েরই বামদিকে চলা মন। আসার আগে বলেন— “গোলমাল মিটলে আসবেন আবার। এবার তো থাকা হল না।” তারপর যোগ করেন— “একবার কলকাতা গেছিলাম। আপনাদের বইয়ের যে বড় বাজার আছে না…।” আমি খেই ধরিয়ে দিই— “হ্যাঁ, কলেজ স্ট্রিট…।”
“ওখানে গেছিলাম… মার্কস-এঙ্গেলসের কিছু ভল্যুম কিনে এনেছিলাম।”
হাসিতে উজ্জ্বল মুখ নিয়ে করমর্দন করেন। এই সময়ে ঠিক কেমন লাগে বলে বোঝানো যায় না। হাস্যোজ্জ্বল তরুণ মুখখানা বুড়ো বুকে এঁকে নিয়ে ফিরে আসি।
নাগা পার্বত্য জেলা উখরুলে যাই দুদিনের জন্য। যেদিন বাস ধরে চলে যাচ্ছি, ইম্ফলে বোমা পড়ে, গুলি চলে, বন্ধ। যেতে যেতে দেখি মিলিটারি চেকপোস্ট। দু-এক জায়গায় কুকি এলাকার প্রবেশমুখ পড়ে রাস্তায়। সেখানে মিলিটারির পাশাপাশি কুকি যুবকেরা অস্ত্র হাতে নিজস্ব চেকপোস্ট তৈরি করেছেন। অবশ্য বাইরের লোকেদের দিকে ফিরেও তাকান না।
মনে মনে ভয় পাই। ভাবি— ইম্ফলে কার্ফু হবে না তো? ইন্টারনেট থাকবে তো? ফিরতে পারব তো ইম্ফলে? ফেরার বিমান ধরতে পারব তো?
উখরুলে পৌঁছে দেখি অন্য মণিপুর। চার্চে ক্রিসমাস ক্যারল, মাঠে মাঠে বাচ্চাদের স্পোর্টস। সেগুলোর আয়োজক কোনও না কোনও চার্চ। এদের কারও কারও সঙ্গে কথা হয়। চার্চের কর্তাব্যক্তি। কেউ বিদেশে থাকেন। দেশে ফেরেন এ-সময়ে। চ্যারিটি করেন। এদের মধ্যে অনেকেরই মোদিভক্তি প্রবল।
এইসব সমীকরণ মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে দিই। সবাই অতিথিকে বড় আদরযত্ন করেন।
ইমা বাজার
পুরুষদের রাজার অধীনে বেগার খাটতে হত মাসে ১০ দিন। তারপর অন্য কাজ। মণিপুরে তাই যৌথ বাজার স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ মেইতেই মেয়েদের একটি প্রাচীন অর্জন। আজ ইম্ফলে যে নারী-পরিচালিত বাজার, ইমা কেইথেল (Ima Keithel), তার পরিচালন-ব্যবস্থার গুণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে তার ইতিহাস লিখতে গিয়ে ডঃ হাওবাম বিলাসিনী দেবী তাঁর Images: Impact on Memory গ্রন্থে লিখেছেন:
Woman Market is an institution in its own right with specific do’s and don’ts… Any plot or vendor allotted to a woman could or could not be inherited by her son or daughter or daughter-in-law. Under no circumstances can it be sold away or disposed of… Nor is it governed by the land revenue department… It is an institution of Manipuri women.
যে আশ্চর্য জড়তাহীন অথচ অনুচ্চকিত আধুনিকতায় সকল স্তরের মেইতেই মেয়েদের আত্মশক্তিমান বিচরণ দেখেছি সেটা ঠিক ভাষায় বোঝানো যায় না। এর আগে যখন মেইতেই মেয়েদের হাতে কুকি নারীনিগ্রহের বীভৎস ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হল, তখন বেদনায় ধ্বস্ত হয়ে ভেবেছি নগ্ন মিছিলের সেই মেইতেই মায়েরা কোথায় গেলেন? তারপরই দেখেছি শর্মিলা চানুর তীব্র প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের তিক্ত সমালোচনা। মণিপুরে এসে দেখেছি, সাধারণ মেইতেই মেয়েদের ভাষাও চানুর মতো। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁদের এই ঘটনার নিন্দা করতে দেখেছি। আমরা এখানে বসে জানতে পারিনি, কুকি মেয়েদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তাঁরা মিছিল ও প্রতিবাদসভা করেছেন। যাঁদের সঙ্গে এই বিষয়ে অল্প কথা বলতে পেরেছি, তাঁদের কাউকেই ইনিয়েবিনিয়ে কুকিদের দোষ ধরতে দেখিনি।
বিলাসিনী দেবীর লেখা এতটুকুও অতিশয়োক্তি নয়। ইমা বাজার সম্পর্কে তিনি লিখছেন—
It is the centre of all decision-making. All women’s movements in recent past have had their origins in this marketplace. From time to time, women decide major actions to take up against atrocities, injustice, oppressive laws, violence and so on.
ইম্ফলের কেন্দ্রীয় বৃহৎ ইমা বাজার শুধু নয়, গ্রামীণ স্থানিক সমস্ত ইমা বাজার দেখলে এই শক্তির আন্দাজ পাওয়া যায়। ইমা বাজার থেকে হাতির পুল পেরিয়ে সারে সারে থিয়েটার হল বন্ধ। যেসব মঞ্চ মণিপুরের শক্তিশালী মেয়েদের অনবদ্য নাট্য ও নৃত্যপ্রদর্শশালা। ভাষার ব্যবধানের কারণে অনেক কথা বুঝতে পারিনি, বোঝাতে পারিনি। তবে, নিজের মতো কল্পনা করে নিতেই বা বাধা দিচ্ছে কে? সবাই তো হিন্দি, ইংরেজি বলেন না, আমিও মাতৃভাষা বাদে ওই দুটোই অল্পস্বল্প জানি।
আমি দু-চোখ মেলে শহরের সর্বত্র সবরকম কাজে সক্রিয়, সপ্রতিভ, কর্মঠ মেয়েদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকেছি। আর গ্রীশ্মা কুত্থারের পডকাস্ট থেকে জেনেছি, কুকি মেয়েরা কীভাবে গড়ে তুলেছেন মানবাধিকার সংগঠন। তাঁদের মন্ত্র জাংনা-দপ, যার অর্থ সংহতি। হিংসায় সবহারানোদের জন্য দেশে-বিদেশে, যেখানে যেখানে কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন, তাঁদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তাঁরা শরণার্থীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
এখন কেমন আছে মণিপুর
সবচেয়ে খারাপ আছে শিশুরা। দীর্ঘকাল তারা স্কুলে যায় না। আরও খারাপ আছে আন্তঃজাতি বিবাহের শিশুসন্তানেরা। কুকি-মেইতেই বা মেইতেই-কুকি দম্পতিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজ নিজ এলাকায় বা নিজ গোষ্ঠীর শরণার্থী শিবিরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কবে তাঁরা আবার মিলিত হতে পারবেন, জানেন না। হতে হলে এ-রাজ্যের বাইরে যেতে হবে। তাই বা কীভাবে সম্ভব। মায়ের কাছে থাকা শিশুরা তাই বাবার দেখা পায় না।
কুকিদের অবস্থা অবর্ণনীয়। উপত্যকায় বসবাসকারী কুকিরা স্বজনের মৃতদেহ কবরও দিতে পারেননি সে-সময়ে। অনাথ শিশুর কান্নায় ক্যাম্পের বাতাস ভারী হয়ে আছে।
রাষ্ট্রপতি শাসন জারির পরেও পাঁচটি জেলার পার্বত্য সীমান্ত দিয়ে এখনও মায়ানমার থেকে অস্ত্র আসছে। হিংসা চলছে অবিরাম। সীমান্তবর্তী মোরহে গ্রাম থেকে মেইতেই ব্যবসায়ীদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন কুকিরা। একদা জমজমাট বাজার এখন মৃত। কেউ কি কোথাও ফিরে যেতে পেরেছেন? যদিও স্থানীয় প্রশাসন দাবি করেছে, ১০,০০০ শরণার্থী আর বাড়ি ফিরে যেতে বাকি আছে। আগামী ডিসেম্বরে তারা ক্যাম্পগুলি বন্ধ করে দিতে পারবে। এ-খবর ২০২৫ সালের ৫ জুলাইয়ের।
কিন্তু বাস্তবটা? উচ্ছেদ হওয়া মানুষজন অসহ অর্থনৈতিক কষ্টে, অসম্মানে দিন কাটাচ্ছেন এমনটা গত মাসেও নিউজ পডকাস্টে শুনেছি। সরকারি সাহায্য বা পুনর্বাসনের কোনওই সুরাহা নেই তাও। নির্বাচন, এবং একটি নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষা করে আছে মানুষ।
কেন্দ্রীয় সরকার কি চায়? বা, কী চায়?
‘প্রধানমন্ত্রী কেন মণিপুরে যান না?’-র চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্ন।
[1] Eminent Theatre Personality Ratan Thiyam Quits Manipur Peace Panel. The Wire. Jun 15, 2023; Sinha, Bhadra. ‘Are we a part of India?’ — playwright Ratan Thiyam questions ‘Modi’s silence’ on Manipur violence. The Print. Jun 21, 2023.
[2] Dispatches from Manipur. Suno India.
[3] আধুনিক রাজনীতিতে এই ঘটনার গভীর প্রভাব রয়েছে; সাম্প্রতিক হিংসাতেও বার্মা সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্র এবং মেইতেই যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ জাতিহিংসার আগুন কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
[4] অষ্টাদশ শতকে মণিপুরে হিন্দুধর্মের প্রবেশ— যদিও পুরনো ধর্ম সনামাহিজমও তখন শক্তিশালী। আরএসএস-এর দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সনামাহিজমকে হিন্দুধর্মেরই একটি অঙ্গ করে ফেলা গেছে এবং বর্তমানে বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন করে এর চর্চা, মন্দির সংস্কার ইত্যাদি হতে দেখে এসেছি; পুরোহিতরা কেন্দ্রীয় পুরস্কারও পাচ্ছেন।
[5] যে অঞ্চলে যেটা দরকার— যেমন, মণিপুরে মুসলমান মেইতেইদের সমাজে তেমন প্রভাব নেই, কিন্তু তাঁদের উপস্থিতি আরএসএস-এর কাজে এসেছে।
[6] সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, স্টেট আর্মারি থেকে খোয়া গেছে ৫,৬০০টি অস্ত্র এবং ৬,৫০,০০০ রাউন্ড গুলি।

