মুরলীধর

স্বকৃত নোমান

 

বাঁশি বাজাতে বাজাতে লোকটি বঙ্গভবন রোডে ঢুকে পড়ল, অথচ ডিউটিরত পুলিশ টেরই পেল না! এসআই তানেসউদ্দিনের মনে হচ্ছিল ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখছিল, স্বপ্নে শুনতে পাচ্ছিল বাঁশির মনোহর সুর। লোকটি চলে যাওয়ার পর তার মনে হচ্ছে, না, স্বপ্নে নয়, বাস্তবে কোথাও বাঁশি বাজছে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে বাঁশির সুর; দক্ষিণে, বঙ্গবভনের দিকে। ডিআইটি রোডে যানবাহনের শব্দে সহসা চাপা পড়ে যায় সেই সুর। তার সহকর্মী চার কনস্টেবল মোবাইলে ঢাকা এফএম রেডিও স্টেশনে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের ধারাবিবরণী শুনছিল। তাদের দৃষ্টি ছিল রাস্তার দিকে, কিন্তু মন ছিল খেলার দিকে। এসআই তাদের জিজ্ঞেস করে, এই পথে কি কোনও বাঁশিওয়ালা গেছে?

সিনিয়র কনস্টেবল বলল, বাঁশির সুর আমিও শুনেছি স্যার। কিন্তু আশপাশে তো কাউকে দেখলাম না। সম্ভবত ডিআইটি রোডে কেউ বাজাচ্ছিল।

জুনিয়র কনস্টেবল বলল, শহরে নাকি এক বাঁশিওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে। খামারবাড়ি, ফার্মগেট, কাওরানবাজার ও শাহবাগ এলাকায় তাকে প্রায়ই দেখা যায়। হেঁটে হেঁটে বাঁশি বাজায়, কোথাও দাঁড়ায় না, কারও সঙ্গে কথা বলে না। লোকটা ভারি অদ্ভুত। একবার নাকি বাঁশি বাজাতে বাজাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢুকে পড়েছিল। গার্ডদের কেউ টের পায়নি। পরে দুজন গার্ড তাকে জোর করে হোটেল থেকে বের করে দেয়। সেই দুই গার্ড স্ট্রোক করে এখন হাসপাতালে।

—বলো কী!
—জি স্যার। সত্য-মিথ্যা জানি না, শোনা কথা, শাহবাগ থানার জুলহাস স্যার বলল সেদিন। সম্ভবত ওই লোকটা আশপাশে কোথাও এসেছে।
—বঙ্গভবনের দিকে যায়নি তুমি শিওর?
—না স্যার, রাস্তা তো ফাঁকা, কাউকে তো দেখলাম না।

বাঁশিওয়ালা লোকটি ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে প্রেসিডেন্ট রোডে। ডানে পুলিশবক্স। বক্সের বাইরে বন্দুক হাতে চার পুলিশ। লোকটি বাঁশি বাজাতে বাজাতে হাঁটছিল। এক কনস্টেবল ধমকে উঠল, এই! কই যান আপনি? দাঁড়ান।

লোকটি ঘুরে পুলিশবক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাতাসে দুলে ওঠে তার সাদাকালো লম্বা দাড়ি। সে বাঁশি বাজিয়ে চলে, সুমধুর সুরে। মাথায় লাল গামছা, পরনে জিন্সের প্যান্ট ও হলুদ ফতুয়া, কাঁধে ঝুলছে পাটের নকশিথলে। গলায় ঝুলানো একটা লেমিনেটেড কাগজে আঠাশ সাইজ ফন্টে লেখা ‘মুরলীধর’।

—কে আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?

লোকটি ঢেউ খেলিয়ে মাথা নাড়ায়, বাঁশিতে তোলে আরও মনোহর সুর। পুলিশদের চেহারায় বিস্ময় জাগে। তারা ভেবে পায় না এই লোক এখানে ঢুকল কেমন করে। ডিআইটি মোড়ের পুলিশেরা তাকে বাধা দিল না কেন? বিস্ময়ের আরও কারণ লোকটির বাঁশির সুর। বাঁশির সুর এমন মধুর হতে পারে! মানুষ এমন মধুর সুরে বাঁশি বাজাতে পারে!

—মুরলীধর কি আপনার নাম? এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল এসআই।

বাঁশি বাজাতে বাজাতে লোকটি মাথা নাড়ায়, মুচকি হাসে। বুঝিয়ে দেয়, হ্যাঁ, তার নাম মুরলীধর।

এসআই তাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল সে কোথায় যাচ্ছে। করল না। কেননা তার মনে হল, প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে লোকটি সুর থামিয়ে দেবে। তাতে কেটে যাবে মুগ্ধতা। বাঁশি তার প্রিয়। ছাত্রজীবনে বাজাত, এখনও সুযোগ পেলে বাজায়। মুগ্ধচোখে সে তাকিয়ে থাকে মুরলীধরের দিকে। তার সহকর্মীরাও। সুরমগ্ন হয়ে তারা তলিয়ে যেতে থাকে সুরের গভীরে। তাদের মুখ বন্ধ, চোখও বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। কেউ যেন তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, চোখে বুলিয়ে দিচ্ছে শান্তির পরশ। তাদের ঘুম পাচ্ছে। এখানে, শিরিষের ছায়াঘন এই ফুটপাতে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।

তলাতে তলাতে তারা যখন সুরসমুদ্রের তলানি স্পর্শ করে, মুরলীধর আবার পা বাড়ায়। ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে বঙ্গভবনের দিকে, অবিরাম বাজাতে থাকে বাঁশি। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে গেলে, বাঁশির সুর অস্পষ্ট হয়ে এলে এক কনস্টেবল ছুট দেয় তাকে ধরতে। এসআই তাকে ডাক দিয়ে বলে, থামো, যেতে দাও। লোকটি সম্ভবত মহামান্যের এলাকার মানুষ, মহামান্যের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

কনস্টেবল ফিরে আসে। তারও মনে হচ্ছে লোকটি গ্রাম থেকে আসা। চেহারায় গ্রামীণ সহজতার চাপ। এমন সহজতা শহরবাসী কোনও মানুষের চেহারায় দেখা যায় না। সম্ভবত হাওরাঞ্চলের কোনও নিভৃত গ্রামে তার বাড়ি। হাওরাঞ্চল থেকে প্রায় প্রতিদিন মহামান্যের সাক্ষাতে আসে লোকজন। ওদিকে আউল-বাউলদের বাস। লোকটি হয়তো দ্বীন ভবানন্দ, জালাল খাঁ কিংবা শাহ আবদুল করিমের মতো কোনও বাউল, কোনও সঙ্গীতসাধক।

তবু তার মনের দ্বিধা কাটে না। আজকাল চেহারা বা বেশভূষা দেখে মানুষ চেনা দায়। দাড়িওয়ালা, জোব্বা পরা লোকজন ইয়াবা পাচার করছে। প্রায়ই গ্রেপ্তার হচ্ছে। যাত্রাবাড়ির এক মসজিদ থেকে গত মাসে দশ হাজার পিস ইয়াবা-সহ এক হাফেজকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গাবতলিতে দশ কেজি গাঁজা-সহ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এক মৌলবিকে। হতেও তো পারে লোকটি দুষ্টচক্রের কেউ। জিজ্ঞাসাবাদ না করে যেতে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? পরে কোনও অঘটন ঘটলে তো কারও চাকরিই থাকবে না।

এসআই তাকে আশ্বস্ত করে, মনে হচ্ছে না খারাপ লোক। খারাপ লোক কখনও এমন মধুর সুরে বাঁশি বাজাতে পারে না। তা ছাড়া গেটে তো পিজিআর আছেই। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া এলে তারা ভেতরে ঢুকতে দেবে না।

ততক্ষণে মুরলীধর পৌঁছে গেছে বঙ্গভবনের প্রধান ফটকের কাছে। বাঁশির সুর শুনে রিসেপশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে দুই লোক। সম্ভবত বঙ্গভবনের কর্মকর্তা বা কর্মচারী। দর্শনার্থীও হতে পারে। হঠাৎ খুলে যায় প্রধান ফটকের দরজা। ভেতর থেকে বের হয় একটি পাজেরো। পাজেরোতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জেডএইচ মাহমুদুল হাসান। সেনাকুঞ্জের এক প্রোগ্রামে যোগ দিতে যাচ্ছেন। গাড়িটি বের হতেই ভেতরে ঢুকে পড়ে মুরলীধর। ফটকরক্ষী দুই পিজিআর সদস্য প্রথমে তাকে বঙ্গভবনের পাচক খলিলুর রহমান ভেবেছিল। খলিলুর রহমান কেরানিগঞ্জের আধ্যাত্মিক সাধক বাবা জাহাঙ্গিরের শিষ্য। তার মুখেও সাদাকালো চাপদাড়ি। মাঝেমধ্যে তাকেও হলুদ ফতুয়া পরা অবস্থায় বঙ্গভবনের ভেতরে শাহজালাল দখিনি, নওগোজি শাহ ও চন্দন শাহর মাজারের আশপাশে ঘুরতে দেখা যায়। ফটকরক্ষীরা যখন নিশ্চিত হয় যে আগন্তুক খলিলুর রহমান নয়, তখন একজন ধমকে ওঠে, কে আপনি? কী চাই এখানে?

মুরলীধর ডানে-বায়ে মাথা দোলায় আর বাঁশি বাজায়।

—আপনি কি দর্শনার্থী? অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এলে রিসেপশনে যান প্লিজ। এই যে ওদিকে। যান, যান।

এগিয়ে আসে আরও তিন পিজিআর সদস্য। মুরলীধর কয়েক পা এগিয়ে এক ফটকরক্ষীর মুখোমুখি দাঁড়ায়, বাজাতে থাকে বাঁশি। কয়েকটি শালিক উড়ে এসে দেবদারুগাছটায় বসে। বসে থাকে নিশ্চুপ। যেন তারাও বাঁশির সুরে মগ্ন। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে রেড অ্যালার্ট পেয়ে ছুটে আসে চার পিজিআর সদস্য। প্রত্যেকের হাতে বিডি-০৮ অ্যাসল্ট রাইফেল। দেবদারুগাছটার কাছে এসে তারা থেমে যায়। তাদের পা চলতে চায় না, হাত চলতে চায় না, মুখ চলতে চায় না। ধীরে ধীরে নেমে যায় তাদের রাইফেলের নল। হাঁ-মুখে তারা তাকিয়ে থাকে মুরলীধরের দিকে। তাদের মাথার ভেতরে উড়ছে মেঘদল। উড়তে উড়তে এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে। সেখানে আশ্চর্য সুন্দর এক সিংহাসনে বসে মুরলীধর বাঁশি বাজাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির প্রোটোকল অফিসার সৈয়দ আবরার হোসেন এক কাজে রিসেপশন কক্ষে এসেছিলেন। বাঁশির সুর শুনে তিনি বাইরে এলেন, প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ালেন নিরাপত্তারক্ষীদের পাশে। মুরলীধরকে দেখে তার মনে পড়ে সুখময়ের কথা। সুখময় রায় বঙ্গভবনের আপন বিভাগের উপসচিব। গতকাল তিনি জনৈক বাঁশিওয়ালার কথা বলেছিলেন, জন্মাষ্টমীর দিন যাকে দেখা গিয়েছিল ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। লোকটি নিজেকে শ্রীকৃষ্ণের একজন পরম ভক্ত বলে পরিচয় দিয়েছিল। তার বাঁশির সুর শুনতে শত শত পূজার্থী ভিড় করেছিল। ভিড় সামলাতে লালবাগ থানা থেকে গিয়েছিল পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স। এ নিয়ে কোনও এক দৈনিকের ভেতরের পাতায় ছোট্ট একটা খবরও ছাপা হয়েছিল।

মুরলীধর বাঁশি বাজাতে থাকে। রিসেপশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ। জনবিভাগ ও আপন বিভাগ থেকেও আসে সাত-আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। ডাকঘর, ব্যাঙ্ক, ক্যান্টিন থেকেও আসতে থাকে লোকজন। সবাই মুরলীধরকে ঘিরে দাঁড়ায়, মগ্ন হতে থাকে সুরে। তাদের মনে হয়, বঙ্গভবনে নয়, তারা দাঁড়িয়ে আছে কোনও এক হরিৎ প্রান্তরে, যেখানে গরুরা চরে বেড়াচ্ছে, ময়ূরেরা পেখম মেলে নাচছে, পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে এবং ফুলেরা সুবাস ছড়াচ্ছে।

ততক্ষণে নিরাপত্তা দপ্তরে পৌঁছে গেছে বঙ্গভবনে এক উটকো লোক ঢুকে পড়ার খবর। ব্যস্ত হয়ে ওঠেন কমান্ড্যান্ট। তার তড়িৎ নির্দেশে ছুটে আসে অস্ত্রসজ্জিত পিজিআরের একটি দল, যাদের কারও হাতে রাইফেল, কারও হাতে মেশিনগান। তারা নিজ নিজ অস্ত্র তাক করে মুরলীধরের দিকে। মুরলীধর থামে না, একমনে বাঁশি বাজিয়ে চলে। পিজিআর বাহিনী স্পষ্ট শুনতে পায়, কেউ যেন বলছে, শান্তি শান্তি শান্তি! দেখো চারদিকে কেমন শান্তির সুবাতাস। শোনো বাঁশরী কী করুণ সুরে শান্তির বাণী ছড়াচ্ছে। পিজিআর সদস্যরা কর্তব্য ভুলে যায়, ট্রিগারে হাত রাখতে ভুলে যায়, প্রত্যেকের অস্ত্রগুলো ধীরে ধীরে নেমে যায়। তাদেরও মনে হতে থাকে, তারা বঙ্গভবনে নয়, দাঁড়িয়ে আছে দিগন্ত প্রসারিত এক সবুজ উদ্যানে, যেখানে বইছে বসন্তের বাতাস, গাইছে কোকিল, বাতাসে ভাসছে মনকাড়া ঘ্রাণ। তারা উদ্যানের শাপলা-পুকুরের শান্ত-শীতল জলে নামে। ডুব দেয়। তলিয়ে যেতে থাকে গভীর পাতালে।

মুরলীধর পা বাড়ায়। বাঁশি বাজাতে বাজাতে হাঁটতে থাকে প্রাসাদের দিকে, যেখানে রয়েছে দরবার হল, রাষ্ট্রপতির শয়নকক্ষ, সামরিক-অসামরিক সচিবদের দপ্তর, ক্যাবিনেট কক্ষ, হলঘর, অডিটোরিয়াম ও গেস্টরুম। নিরাপত্তায় নিয়োজিত পিজিআর সদস্যরা নির্বাক, চলচ্ছক্তিহীন। অপলক তাকিয়ে আছে মুরলীধরের দিকে। তারা লোকটিকে বাধা দিতে চায়, কিন্তু পারে না। যেন তাদের মুখ বাঁধা, হাত বাঁধা।

হঠাৎ এক নিরাপত্তারক্ষী পিস্তল উঁচিয়ে বলে, সাবধান, থামুন। অনেক হয়েছে, এবার বের হোন, গেট আউট।

তখন প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লোকমান হোসেন। তিনি হাত তুলে বললেন, থামো। আমি কথা বলছি তার সঙ্গে।

মুরলীধরের মুখোমুখি দাঁড়ালেন কমান্ড্যান্ট। মুরলীধর থামে না, বাজিয়ে চলে বাঁশি। কমান্ডেন্ট বললেন, কে আপনি? কোথা থেকে এসেছেন? এটা কি তামাশা করার জায়গা?

মুরলীধরের ঠোঁটের কোণে ফোটে মুচকি হাসি। কয়েক পা এগিয়ে সে কমান্ড্যান্টের মুখোমুখি দাঁড়ায়, বাজিয়ে চলে বাঁশি। পায়ে তাল ঠুকে, মৃদু লয়ে নাচতে নাচতে সে বাঁশি বাজায়। তারপর ঘুরতে থাকে। ঘূর্ণায়মান দরবেশদের মতো ঘুরে ঘুরে বাজাতে থাকে বাঁশি। কমান্ড্যান্টের চেহারায় ফোটে প্রশান্তি। সকাল থেকে তাঁর মন খারাপ ছিল, মেজাজ চড়া ছিল। এখন শান্ত হয়ে আসছে মেজাজ, ভালো হয়ে আসছে মন। মনে হচ্ছে এই পৃথিবী সুন্দর, বেঁচে থাকা সুন্দর। তিনি মরমি ধারার মানুষ। তাঁর দাদা ছিলেন চিশতিয়া তরিকার পীর। খানকায় নিয়মিত গান-বাজনা করতেন। দাদার প্রভাব কিছুটা তাঁর মধ্যে আছে। তিনি জালালউদ্দিন রুমির ভক্ত। সুযোগ পেলেই মসনবি পড়েন। তাঁর মনে পড়ে রুমির শের: ‘বেশনূ আজ নায় চু হেকায়েত মী কুনাদ/ওয জুদাঈ হা শেকায়েত মী কুনাদ।’ মনে পড়ে দাউদ নবির কথা, যাঁর বাঁশির সুরে কাঁপত আসমান-জমিন, যাঁর বাঁশির মনোহর সুর শুনতে নদীতীরে ভিড় করত মাছেরা। কমান্ড্যান্টের মুগ্ধতা বেড়েই চলে। আর সবার মতো তিনিও তন্ময় হয়ে পড়েন, তলিয়ে যেতে থাকেন সুরসমুদ্রের তলদেশে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি তখন শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দিয়েছেন সকালে। দুপুরে ফিরে লাঞ্চ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মোবাইল কলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমানোর আগে ফোন দিয়েছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ বন্ধু শামসাদ মোবারককে। তখন রিসিভ করেননি, এখন কলব্যাক করেছেন। রিসিভ করতে ইচ্ছে হল না রাষ্ট্রপতির। পরে ব্যাক করবেন বলে মেসেজ পাঠিয়ে দিলেন। ওয়াশরুম থেকে মুখ ধুয়ে উত্তরের জানালাটা খুলে দিলেন। বাগানে কৃষ্ণচূড়া গাছটির ডালে বসে আছে একটি বানর। একটি প্রজাপতি এসে বসল জানালায়। রাষ্ট্রপতির কানে এল বাঁশির সুর। বড় মনকাড়া সুর। টানা বেজে চলেছে। কে বাজাচ্ছে বাঁশি? পাচক খলিলুর রহমান? ব্যক্তিগতভাবে খলিলুর রহমানকে তিনি চেনেন। স্নেহও করেন। কোনও কোনও রাতে সে উদ্যানের বেঞ্চিতে বসে যে বাঁশি বাজায় জানেন। কিন্তু এই অবেলায় তো তার বাঁশি বাজানোর কথা নয়। বহুদিন পর বাঁশির সুর তাঁকে স্মৃতিকাতর করে তুলল। কৈশোরে তিনিও বাঁশি বাজাতেন। এক জ্যোৎস্নারাতে শুকিয়ে যাওয়া হাওরের মাঝখানে বসে মধ্যরাত পর্যন্ত বাঁশি বাজিয়ে বাড়ি ফেরার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, এ জিনিস ছাড়, বাপ। বাঁশির নেশা বড় খারাপ নেশা। একবার ধরলে এই নেশা কেউ সহজে ছাড়তে পারে না। তিনি বলেছিলেন, মানুষের তো নেশার প্রয়োজন হয়, বাবা। কেউ নেশা করে মদ খেয়ে, কেউ গাঁজা খেয়ে, কেউবা পান-সিগারেট খেয়ে। মদ-গাঁজার চেয়ে তো বাঁশি ভালো নেশা।

এ-সময়ে রাষ্ট্রপতি সাধারণত কফি পান করেন। রুটক্যানেল করা দাঁতটা চিন চিন করছে। গরম কফি খেলে ভালো লাগত। কফির অর্ডার দিতে গিয়েও দিলেন না। বাঁশির সুর তাঁকে টেনে আনে বাইরে। এবার আরও স্পষ্ট শুনতে পান বাঁশির সুর। দেখতে পান বাঁশিওয়ালাকেও। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বিস্তর মানুষ। সবাই সুরে মগ্ন। রাষ্ট্রপতির মনে পড়ে চড়কগাছিয়ার বাল্যবন্ধু মোহসেন মণ্ডলের কথা, লোকে যাকে বাঁশি মণ্ডল বলে ডাকে। দুজন একই স্কুলে পড়েছেন। তার বয়স এখন প্রায় ছিয়াত্তর, এখনও বাঁশি ছাড়েনি, হাটে-বাজারে ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজিয়ে রোজগার করে। কয়েক বছর আগে, রাষ্ট্রপতি যখন গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন, দেখা করতে এসেছিল বাঁশি মণ্ডল। একবার বঙ্গভবনেও এসেছিল রাষ্ট্রপতির নিমন্ত্রণে। সে কি আবার এল? কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না মোহসেন মণ্ডল।

রাষ্ট্রপতি এগিয়ে গেলেন। নিরাপত্তা দপ্তর থেকে দুই নিরাপত্তারক্ষী এসে তাঁর পেছনে দাঁড়াল। একজন এগিয়ে চট করে মুরলীধরের হাত চেপে ধরে। মুরলীধরের ঠোঁট থেকে ফসকে যায় বাঁশি, থেমে যায় সুর। রাষ্ট্রপতি বললেন, ছাড়ো ছাড়ো, তাকে বাজাতে দাও। এ তো ভারি সুন্দর সুর, বাধা দিচ্ছ কেন?

কমান্ড্যান্টের ঘোর কাটে। রাষ্ট্রপতিকে স্যালুট দিয়ে তিনি বললেন, মহামান্য, লোকটি অনুমতি ছাড়া ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

—তাই নাকি? রাষ্ট্রপতি হাসলেন। বললেন, ঢুকেই যখন পড়েছে কী আর করা। বাজাক বাঁশি। তাকে বাজাতে দিন। বাঁশির সুর খারাপ না। সবচেয়ে সুন্দর ও পবিত্র।

নিরাপত্তারক্ষী সরে দাঁড়ায়। মুরলীধর মুচকি হেসে হাতজোড় করে রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানায়। ডান হাতটা তুললেন রাষ্ট্রপতি। মুরলীধর আবার বাজাতে শুরু করে বাঁশি। বুকে দুই হাত মুড়েন রাষ্ট্রপতি। ধীরে ধীরে মগ্ন হতে থাকেন সুরে। দাঁতের চিনচিনে ভাবটা এখন আর টের পাচ্ছেন না। মাথাটা হালকা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে বাঁশির সুর তাঁর করোটিতে ঢুকছে। তিনি বড় শান্তি অনুভব করেন। এমন শান্তি বহুদিন অনুভব করেননি। তিনি ভাবেন মোহসেন মণ্ডলের কথা। মোহসেন মণ্ডল তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ বাঁশিওয়ালা। তিনি মনে করতেন মোহসেন মণ্ডলের চেয়ে ভালো বাঁশি এই দেশে আর কেউ বাজাতে পারে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সুরের কাছে মোহসেন মণ্ডলের সুর তুচ্ছ। ক্রমে তিনি ডুবে যেতে থাকেন সুরের গভীরে। মুরলীধর বাঁশি বাজাতে বাজাতে এগিয়ে যায় প্রাসাদের দিকে। সম্মোহিতের মতো রাষ্ট্রপতি চললেন তার পিছে। বাকিরাও।

বাঁশি বাজাতে বাজাতে মুরলীধর দরবার হলের দরজার সামনে গিয়ে থামল। ভেতরে কয়েকজন কর্মচারী কাজ করছিল। আগামীকাল এই হলে প্রধান বিচারপতির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। সাফ-সুতরো চলছে। মুরলীধর ঢুকে পড়ে ভেতরে। নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দিতে চেয়েও পারল না। তারা ভাবল লোকটি বুঝি দরবার হলে সবাইকে বাঁশি বাজিয়ে শোনাবে।

হলের যেখানে রাষ্ট্রপতির চেয়ারটি রাখা, বাঁশি বাজাতে বাজাতে মুরলীধর সেদিকে এগিয়ে যায়। সতর্ক হয়ে ওঠে নিরাপত্তারক্ষীরা। রাষ্ট্রপতি হাত তুলে তাদের শান্ত থাকতে বলেন। চেয়ারটির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায় মুরলীধর, বাজিয়ে যায় বাঁশি। প্রায় দুই মিনিট। তারপর ঠোঁট থেকে বাঁশিটি সরায়। নীরবতা নামে হলজুড়ে। সবার চোখ তার দিকে স্থির। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে হুট করে সে বসে পড়ে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে। আঁতকে ওঠে সবাই। নিরাপত্তারক্ষীরা রাইফেল ও মেশিনগান তাক করল তার দিকে। রাষ্ট্রপতি হাত তুলে আবারও তাদের শান্ত থাকতে বলেন। মুরলীধরের কাছাকাছি গিয়ে বললেন, এ কী করলেন আপনি! এই চেয়ারে তো রাষ্ট্রপতি ছাড়া আর কারও বসা নিষেধ।

পায়ের ওপর পা তুলে বসে মুরলীধর। ঈষৎ ভাঁজ পড়ে রাষ্ট্রপতির কপালে। ঠোঁটে মুচকি হাসি টেনে মুরলীধর বলে, আমি তো জানতাম না। বসার আগে আপনারা তো কেউ আমাকে নিষেধের কথা জানাননি।

—এখন তো জানলেন। উঠুন, উঠুন।

কমান্ড্যান্ট চিৎকার করে বললেন, ওঠ্ হারামজাদা! নইলে এক্ষুনি ফায়ার করব।

মুরলীধর হাসিটাকে আরও প্রশস্ত করে বলে, ফায়ার করবেন? হা হা হা। আইনত তা আপনি পারেন না। এই চেয়ার যদি কেবল রাষ্ট্রপতির জন্য সংরক্ষিত হয়, তবে আমিই এখন রাষ্ট্রপতি। কেননা এই চেয়ারে এখন আমিই উপবিষ্ট। আপনারা এখন আমার হুকুমের অধীন। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনী যদি রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে, তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

রাষ্ট্রপতি হেসে উঠলেন। বললেন, লোকটা তো দেখছি আস্ত পাগল।

মুরলীধর বলে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি নির্দেশ দিচ্ছি, আপনারা বসুন, শান্ত হয়ে বসুন।

রাষ্ট্রপতির পাশে এসে দাঁড়ালেন সহকারী সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এয়ার মাহমুদ খান। রাষ্ট্রপতি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, লোকটা তো বিরাট প্রবলেম ক্রিয়েট করে বসল। তারপর কমান্ড্যান্টের উদ্দেশে বললেন, হলের দরজা বন্ধ করতে বলুন। যাঁরা ভেতরে আছেন থাকুন, বাইরের আর কেউ যাতে ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিন। এই খবর বাইরে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে।

—আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? মুরলীধরকে জিজ্ঞেস করলেন রাষ্ট্রপতি।

মুরলীধর গলায় ঝুলন্ত লেমিনেটেড কাগজটি ধরে বলে, এখানেই তো লেখা আছে আমার নাম। মুরলীধর, আমার নাম মুরলীধর। আরও নাম আছে। কেউ ডাকে দাউদ নামে, কেউ ডেভিড নামে। কারও কাছে আমি অর্ফিয়াস, কারও কাছে কৃষ্ণ।

—হেঁয়ালি করবেন না। রাষ্ট্রপতির রাগান্বিত কণ্ঠ।

মুরলীধর হেসে বলে, হেঁয়ালি করছি না। মানুষের কি একাধিক নাম থাকতে পারে না? এই যে আপনার পেছনে বঙ্গভবনের পদাতিক প্রধান কন্ট্রোলারকে দেখুন। তার নাম আবু সালেহ মোহাম্মদ ত্বকী ওসমান চৌধুরী। এক নামের মধ্যে পাঁচটি নাম। আমারও পাঁচটি নাম।

রাষ্ট্রপতি বললেন, আচ্ছা মানলাম আপনার পাঁচ নাম। এবার বলুন আপনি কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন? এখানেই-বা ঢুকলেন কেমন করে?

মুরলীধর বলে, কেমন করে ঢুকলাম তা তো ফটকরক্ষীরা দেখেছে। আর ঠিক কোথা থেকে এসেছি বলতে পারব না। কারণ আমার কোনও ঠিকানা নেই। আমি ভূমিহীন। বহু বছর আগে প্রমত্তা পদ্মা ভেঙে নিয়ে গেছে বাস্তুভিটা। তারপর থেকে আমি যাযাবর। পথে পথে ঘুরে বাঁশি বাজাই।

—এখানে কেন এসেছেন?
—বঙ্গভবনে মানুষ কেন আসে? কেউ আসে রাষ্ট্রীয় কাজে, কেউ আসে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ধরুন আমিও আপনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলাম।
—কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না।
—আমি তো আপনাকে চিনি।
—আমাকে তো এ-দেশের সবাই চেনে।
—সবার মধ্যে আমিও একজন। এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অধিকার আমারও আছে।
—তা আছে, স্বীকার করছি। কিন্তু আপনি তো সমস্ত নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করেছেন।
—কীভাবে?
—প্রথমত অনুমতি ছাড়া বঙ্গভবনে ঢুকে পড়েছেন। আর সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছেন রাষ্ট্রপতির সংরক্ষিত চেয়ারে বসে। এই অপরাধে আপনার মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।

মুরলীধর হাসে। গামছায় কপাল মুছে বলে, আমি যদি নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে থাকি, তাহলে বঙ্গভবনের নিরাপত্তারক্ষীরাও ভঙ্গ করেছে। তাদের কাজ এই মহান বঙ্গভবনের নিরাপত্তা রক্ষা করা। তারা আমাকে ঢুকতে দিল কেন? কেন আমাকে আটকাল না? চাইলে তো গুলিও করতে পারত। গুলির পারমিশন তো তাদের দেওয়া আছে। কেন করল না? কেন আমাকে এই দরবার হলে ঢুকতে দিল? কেন মহিমান্বিত এই চেয়ারে বসতে দিল? আমার মৃত্যুদণ্ড হলে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে বিধি মোতাবেক তো তাদেরও গুরুতর শাস্তি হওয়া উচিত।

রাষ্ট্রপতি মৌন হলেন। কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, কী চান আপনি?

মুরলীধর বলে, কিছুই না। আপনি জনগণকে সম্মোহিত করে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, আর আমি বাঁশি বাজিয়ে আপনাকে সম্মোহিত করলাম। আপনার সামরিক-অসামরিক সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্মোহিত করে এই চেয়ারে বসলাম। বোঝাতে চাইলাম এই জগৎ-সংসার সম্মোহনেই চলে। আসুন, আপনি আপনার চেয়ারে বসুন, আমি চললাম।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...