অর্জুন

শুভ্র মৈত্র

 

তোমায় স্বাগত জানাতে কুণ্ঠা হয়। উপহাস হয়ে যদি ফিরে আসে যাবতীয় অভ্যর্থনা। অথচ এই হাতের মৃদু ইশারার জন্য অপেক্ষা করে সহস্র চোখ, লালায়িত থাকে অনুগ্রহের।

অতীত এসে জড়ো হয় তোমার উপস্থিতিতে। সেদিন অনুযোগ করেছিলে তুমি, বলেছিলে যুদ্ধজয়ের পর রণাঙ্গন ত্যাগ করার আগে বিজয়ের ক্লান্তিতে সিক্ত আমি দীর্ঘতম শেষ কথা বলতে চাইনি তোমার সঙ্গে। আমি মত্ত ছিলাম উপভোগে, সাফল্যের সুধা চুঁইয়ে পড়ছিল আমার তৃপ্ত ঠোঁট বেয়ে। কিন্তু তা তো সত্যি নয়, আমি দেখেছিলাম তোমায়। আমার দ্বিধাগ্রস্ত অগ্রসরতার সামনে মুখ ফিরিয়ে ছিলে তুমি। আমি স্পষ্ট শুনেছিলাম সেই অনুচ্চারিত কণ্ঠস্বর। জিজ্ঞেস করেছিলে কাকেই বা বলে শেষকথা? জানতে চেয়েছিলে উচ্চাশা ছাড়া আর কী আছে ঝুলিতে আমার। তা নিয়ে কি আদৌ কথা হয়?

থলিতে সত্যি বলতে, ছিল দু-একটি মুহূর্তের শস্যদানা, যাকে আমি সাফল্য বলে চিনি। তা নিয়েই কত কথা শোনাব ভেবেছিলাম! বুঝিনি, ভিখিরির অধম ছিল সেই বীজগুলি। জল চায়, বৃষ্টি চায়, এমনকি বেহায়ার মতো অন্ধকার চেয়ে বসে। আমার ছিল শস্যফলনের কথা। উচ্চকিত ছিল সেই জয়গাথা। জানতেও পারিনি যে দীর্ঘদিন বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলোনি, তাই এত শুষ্ক ছিল তোমার ঠোঁট, জিভ। চোখে এক মরুভূমি বাসা বেঁধেছিল।

সকল পরাজিতের মাঝে আমি বিজয়পতাকা উড়িয়েছি তখন। আমার উচ্চতা ক্রমশ বেড়েছে, ছুঁয়েছে আকাশ। পাখির দল উড়তে ভয় পায় সেই আকাশে। আমি যোগ্যতার প্রমাণ দিতে চেয়েছিলাম, ঘোষণা করেছিলাম গর্ভবতী মেঘের সুলুক আমার জানা। পশ্চিম থেকে তাদের ডেকে আনতে পারি, বাধ্য করতে পারি নতজানু হতে। আসলে কিছুই বলতে পারিনি জানি। যা কিছু উচ্চারণ সবই অন্যলোকের অন্যঘরের কথা। তোমার আমার কথা তো ভেঙেছে আগেই। বিজয়ের গৌরবে মত্ত আমার শিরস্ত্রাণে পালক গোঁজার ফাঁকে তোমার অনুচ্চার অভিযোগের আগুনে পুড়তে থাকে আমার সত্তা, আমার পৌরুষ।

এই মুহূর্তে তোমাকে সামনে দেখে সেসব কথা ভিড় করে আসে। আমি মধ্যম পাণ্ডব, ইন্দ্রের সন্তান। জ্ঞান হওয়ার পরে পিতা হিসেবে পরপুরুষকে সম্বোধন করেছি। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে সিংহাসনে আসীন করার লক্ষ্যে সাজিয়েছি যাবতীয় যুক্তি। চেয়েছিলাম সকলকে আমার মুখাপেক্ষী করে রাখতে। বীরগাথা রচিত হবে আমার নামে। তাই সাজিয়েছিলাম আমার দাস্তান। আখ্যানকারেরা লিপিবদ্ধ করেছিল আমার ইস্তাহার। পাহাড়ের চেয়ে ভারি ধনুকে গুণ টেনেছি, সহস্র প্রলোভনের মাঝে মনঃস্থির করেছি, অচঞ্চল আমি, শব্দে কান পেতেছি, ছুড়েছি তির অব্যর্থ লক্ষে। প্রবল হর্ষধ্বনির মাঝে বিজয়মালা পরেছিলাম সেদিন। উপহারে দু-হাত ভরেছে আমার।

প্রশংসায় মুখর হয়েছে ভীত প্রাণীর দল। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের অপেক্ষা করিয়েছি। ওরা এসেছিল অনুগ্রহের আশায়। চেয়েছিল নিরাপত্তা। আমার কৃপাদৃষ্টি ওদের সুরক্ষা দেবে, এমন আশা ছিল ওদের। চাইনি কেউ আমার অনুশীলনের সাক্ষী থাক, অনুশীলনে ব্যর্থতা দৃষ্টিগোচর হওয়ার দূরাগত সম্ভাবনা। আমি চাইনি তা। ঘামে ভেজা শরীর নয়, প্রদর্শনের জন্য উপস্থিত করেছি রাজবেশ।

আমাকে কাঁধে করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল যারা, অতিরিক্ত ভারে বা নিজেদের ব্যর্থতায় তারা ন্যুব্জ হয়নি, সান্ত্বনা খুঁজেছিল আগামী বর্ষার কথা ভেবে। প্রাপ্তি যা কিছু তা অকিঞ্চিৎকর, বরমাল্য নিছক অলঙ্কার, আসলে নিজের পৌরুষ লেহন করেছিলাম সর্বসমক্ষে, যোগ্যতা হয়েছিল প্রশ্নের অতীত। তোমার অস্ফুট উচ্চারণ হারিয়েছে শত কণ্ঠের ভিড়ে। আমি দূর থেকে তোমার ঠোঁটের স্পন্দন দেখে উপলব্ধি করেছি সে ভাষা। সেখানে ছিল সেসব অযুত প্রাণের সমবেত বীজরোপণের ইতিহাস যা আমার যোগ্যতা তৈরি করেছিল। জয়মদমত্ত কানে সে ভাষাবিশ্লেষণ প্রবেশের অনুমতি পায়নি।

জ্যেষ্ঠদের চোখে স্বীকৃতি আর ব্যর্থদের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছিল আমার উপঢৌকন। এই অনুমানে অনিবার্যতা ছিল, ভয় পাওয়া লোক সংখ্যায় বেশি হবে। তোমার প্রতি দৃকপাত আমার দুর্বলতার প্রকাশ হত। তাই উত্তর আকাশে সুউচ্চ পর্বতমালা আমার দৃষ্টিতে সিঞ্চিত হয়েছিল সেই দিন। আমি জানতাম অভিসারে একাই থাকার কথা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা এক নিম্নবিত্ত কুসংস্কারের নাম।

সেই আমার কাছে এসেছ তুমি আজ, অস্ফুটে চাইছ নিরাময় দিতে। সেদিনের উপেক্ষার কোনও জবাবদিহি চাওনি কেন? সেটাই তো সমীচীন বলে জেনেছিলাম। আসলে সাফল্য আমাকে দ্রুতি দিয়েছিল, গতিমন্থরতা যাদের চিরকালীন অসুখ, তাদের করুণা করেছি। অনেক অনেক বাক্যবিন্যাসে নিজের যুক্তি সাজিয়েছিলাম আমি, সাজিয়েছি নিজের আভরণ। ছায়া দেওয়ার কথা ছিল যে গাছের সে গাছ ছায়া চাইতে যায় কার কাছে? তোমার সেই মায়াবী শব্দের জালে সংকুচিত আমার প্রশ্বাস নির্গমন খোঁজে।

বুঝিনি স্বপ্নের চেয়েও মিথ্যা ছিল সেই ভ্রষ্ট সচলতা। আসলে সব স্থির। যে স্বয়ম্বরে সফলতার জন্য ছিল আমাদের প্রাণপাত, সে নির্বাচন স্বয়ং আজ পরীক্ষার মুখে। আসলে তোমাকে প্রাপ্তি ঘটেছে এক সামগ্রিক বঞ্চনা আর অনাচারের বিনিময়ে। আমার যোগ্যতা প্রশ্নাতীত নয়। আমাকে ঘিরে ধরে অবিশ্বাস। আমার চিৎকার এই কোলাহলের প্রাচীর ভেদ করতে ব্যর্থ।

যে রাজকোষে ছিল তোমার অবাধ সঞ্চালন, তোমার বিলাস-বিনোদনে যে ছিল ধ্রুবকের মতো অকৃপণ, তা আজও তোমার ভ্রূভঙ্গির অপেক্ষায়— তোমার উচ্চারণ স্পষ্ট শোনা যায়। তোমার এই মাটির দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টি, তোমার এই অবিরাম ওষ্ঠসঞ্চালন, এ-সবের অর্থ আমি বুঝি। তুমি এনেছ সেই সংখ্যা হয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলিকে, যারা আমার জয়গানে আজও সমান পারঙ্গম। কিন্তু কীভাবে বোঝাই তোমায়, আমাকে স্পর্শ করতে অপারগ এই অনুকম্পা?

তোমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত এবং সর্বজনীন। প্রজন্মের পর প্রজন্মে তা স্বীকৃত— তোমার শব্দে জলজ মেঘের সুবাস পেতাম আগে, এখন তা নিষ্ঠুরভাবে শুষ্ক। তোমাকে বলা হয়নি, আমার কাছে অস্ত্রচালনার কৌশল শিখতে এসেছিল যে কিশোর, তার চোখে সমর্পণ নয়, এখন সন্দেহ দেখতে পাই। গাণ্ডীব ধরে আবার পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি পেশি শিথিল হয়েছে। তোমার মুখোমুখি হতে পারি না পাঞ্চালী, আমি শিখরে বসে পদচ্ছাপের ভিড়ে একা।

এই দীর্ঘ সময়ে নিজের গতি নিয়ে মত্ত আমি তাকাইনি পেছনে, শিরোনামে থাকা আমার তাকানো বারণ ছিল পংক্তির দিকে। দেখিনি পিছিয়ে পড়েছে কারা। ওরা নিগূঢ় অনুশীলনে ক্ষিপ্রতা রপ্ত করেছে, স্থিরতায় শিখেছে লক্ষ্যভেদ। তবু বারবার বঞ্চিত হয়েছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে। আসলে পরীক্ষাক্ষেত্র তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে রাজসভা। সে কি শুধু আর কোনও পাঞ্চালী ছিল না রাজভাণ্ডারে বলে? নাকি জন্মসূত্রে অভিশপ্ত ছিল ওরা সুতপুত্রের মতো? পশ্চাদপানে দৃকপাত করা বারণ ছিল সফল আমার। কীর্তির ইমারত গড়ায় ব্যস্ত আমি অজ্ঞাত থেকেছি এই সত্যে, পরীক্ষা নেওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে রাজা। সে নিজে আজ পরীক্ষার মুখে। ক্ষাত্রধর্মে দীক্ষিত আমার কণ্ঠে তীব্র ভর্ৎসনা জমা হয়েছিল, কিন্ত নির্গমনের পথ পেল না সেই ঘৃণা। আমি এক সন্দেহজালে বাঁধা পড়ছি ক্রমশ। অবিশ্বাস গ্রাস করছে আমায়। দর্পণের দিকে তাকাতে সঙ্কোচ হয়। যদি আমার মুখাবয়ব দুয়ারে আসা অনুগ্রহপ্রার্থীদের সঙ্গে মিলে যায়! যে মর্যাদায় বিজয়তিলক আঁকা হয়েছিল আমার কপালে, তার স্থায়িত্ব এত কম হবে ভেবেছিলে তুমি? তোমাকে নতুন করে জয় করার জন্য আমি পরীক্ষা দিতে অপারগ।

এখন কেমন আছ? তোমাকে ছুঁয়ে দেখিনি বহুদিন। বারণ ছিল, অক্ষরে অক্ষরে মেনেছি সেই নিষেধাজ্ঞা। শুধু জেনেছি সম্পর্কের ফাটলে ফাটলে নীল ভগ্নাবশেষ জমে আছে।

মধ্যমপাণ্ডব আমি, সহস্র দৃষ্টির কেন্দ্রে থাকা অভ্যেস আমার, শত্রুনিধনে অগ্রগামী, অন্ধকার শেষে উজ্জ্বল আলোর আশায় আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে পরিজন। সেই আমি আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। তোমাকে সত্যিই কিছু বলার নেই আজ। যে রাজা শাসনের অধিকার হারিয়েছে, তার অনুগ্রহ আমাকে বিবশ করে। যুদ্ধাস্ত্রের ভার বহনে অক্ষম আমি, সমরসজ্জা এখন অবয়বের পরিপন্থী, শত্রু চিহ্নিতকরণে সঙ্কোচ এসে গ্রাস করে। তুমি, যে তুমি নিয়ে এসেছ কর্তব্যরঙে রাঙানো ফুলের গোছা, তাকে প্রত্যাখ্যানের অধিকারটা শুধু প্রার্থনা করি আমি।

আজ ছায়া দিতে ব্যর্থ আমি আকাশের দিকে চাই। মনে হয়, আমি রোজ বড় হব, ফুরোনোর মতো। আমার আদর ঘুমোয়, যেভাবে ঘুমোয় বুকে শৈশব… গান…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...