অবন্তিকা পাল
–অ্যাডাল্টারির বাংলা পরকীয়া নাকি ব্যাভিচার?
–দুটোই তো লিখছে দেখছি।
–আমার কিন্তু দুটো শব্দ নিয়েই বিস্তর আপত্তি ছিল।
–তুমি তো রেবেল। সবসময় ‘মানছি না মানব না’।
–সে তো মনে মনে তুমিও। প্রকাশ্যে বলতে ভয় পাও।
–পরকীয়া শব্দটা কাব্যের ভাষা।
–কিন্তু পলিটিকালি বড্ড খারাপ। প্রেম আবার পরকীয়া হতে যাবে কেন। প্রেম মাত্রই স্বকীয়। পজেসিভনেস বলতে চাইছি না কিন্তু। অধিকারবোধ-টোধ নয়। একটা নিজস্বতার বোধ। খোলা হাওয়া। আকাশ। কিন্তু আমার আকাশ, আমার নিজের, যেখানে খুশিমতো ওড়া যায়।
–হ্যাঁ, কিন্তু শব্দের মধ্যে একটা রোম্যান্টিসিজম আছে সেটা অস্বীকার করতে পারো না।
–সেটা আবার অন্য ইন্সটিংক্ট। মানুষ স্বভাবত গোপনীয় কিছুর প্রতি সহজে আকৃষ্ট হয়। এই যদি দ্যাখো পর্নোগ্রাফি ব্যাপারটা খুল্লামখুল্লা হচ্ছে, মানুষ কিন্তু ক্রমশ কৌতূহল হারাবে। সেভাবেই পরকীয়া। ঘোষিত ‘পরকীয়া’ হলে ছাপোষা মানুষগুলো হয়তো সেই চার্ম-টুকু আর খুঁজে পাবে না। তাই রাধিকাকে আজও মধ্যরাতে লুকিয়ে আন-বাড়ি পাঠায় কবিরা। দাড়িবুড়োর ওই ‘গুপ্ত প্রেম’ ‘ব্যক্ত প্রেম’ ছিল না…?
–বেশ খারাপ কবিতা।
–সে আর বলতে। ইংরেজি ভাষা কিন্তু মাঝেমধ্যে বেশ আধুনিক। কেমন ‘এক্সট্রাম্যারাইটাল’ বলে ফেলতে পারে সহজে। আর আমরা বলি ‘বিবাহবহির্ভূত’। আসলে তো ‘বিবাহ-অতিরিক্ত’। বহির্ভূত শব্দের মধ্যে কী চূড়ান্ত নেগিটিভিটি। যেন চাপিয়ে দেওয়া অপরাধবোধ।
–তোমরা এখনকার ছেলেমেয়েরা কেমন খোলা চোখে পৃথিবীকে দেখতে পারো।
–তুমিও তো এখনকার। নইলে আমি তোমার কোল ঘেঁষে বসে আছি কী করে? শোনো, তোমার লেখা পড়াও না অনেকদিন।
–অন্যদিন পড়াব। আজ এমনি কথা বলি।
–হুঁ। এত কম দেখা হয়… মুখ ভুলে যাই।
–আমি তো ইনস্টাগ্রামে তোমার সাজুগুজু দেখি।
–আমার তোমায় রক্তমাংসে দেখতে হয়৷ এই, তুমি মহালয়া শোনো?
–মহিষাসুরমর্দিনী? হুম মেয়েরা থাকতে ভোরবেলা চালাত। গতবার বউ চালাল। আমি একটু পরে উঠলাম। কিছুক্ষণ বাদে ঘুমিয়েও পড়লাম।
–বুড়ো কোথাকার।
–সন্দেহ আছে? গুচ্ছ গুচ্ছ সমবয়সী অ্যাডমায়ারারদের প্রত্যাখ্যান করে আমার মধ্যে কী যে পেলে!
–তুমি তো আমার সমবয়সীই।
–বটেই তো। তোমার দ্বিগুণের চেয়ে বছর তিন বেশি আর কী।
–এহহে, এ দেখি সত্যি বুড়ো। তোমরা জন্মসাল দিয়ে বয়স মাপো নাকি?
–তবে কী দিয়ে মাপব? চল্লিশের পর উলটো গুনতি?
–তাই বা কেন! তোমার বয়স তো তোমার ইচ্ছাধীন। যেদিন ইচ্ছে করবে সেদিন সাতষট্টি, যেদিন করবে না সেদিন সাত।
–পাগল মেয়ে।
–আচ্ছা সেদিন যখন আমরা তুমুল বৃষ্টিতে দক্ষিণ কোলকাতার অল্পচেনা গলির মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাম, যখন তোমার কাছে মাত্র একটাই ছাতা ছিল যা দিয়ে তুমি আমাকে জলের ঝাপটা থেকে বাঁচাতে চাইছিলে প্রাণপণ আর নিজে ভিজছিলে, কিন্তু আমি স্বভাবসুলভ অবাধ্যতায় কেবলই ছাতা থেকে সরে সরে যাচ্ছিলাম, তখন তোমার বয়স কত ছিল তুমি জানো?
–তুমি বলো।
–এই ধরো, বিয়াল্লিশ। পরিণত। বিচক্ষণ। প্রেমিকার প্রতি দায়িত্বশীল।
–আর ভিজে চুপচুপ ডেনিম কুর্তি গায়ে শীত করতে করতে আমি যখন তোমায় বড় রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রেখে একটা প্রায়-চলন্ত বাসে উঠে উধাও হয়ে গেলাম, তখন তোমার বয়স হয়েছিল সতেরো। হাইস্কুল পড়ুয়া। অসহায় কিশোর। সে চায় তার নারীকে জাপটে জড়িয়ে রাখতে ওই অসহ্য বৃষ্টির রাতে। কিন্তু পারে না। সে জানে না কীভাবে আটকাতে হয়৷ জানে না কেমন করে চোখের কোল আলতো ভিজে যাওয়া লুকিয়ে ফেলতে হয়।
–ধুর। আমি কাঁদি না।
–তোমার ওই কালো টিশার্ট-টা নিয়ে আমি একদিন পালিয়ে যাব।
–আমাকে নয়?
–তুমি যে ভয় পাও। সমাজ। সংসার। বয়সের ক্লিশে গণ্ডি ভেঙে বেরোতে পারো না কিচ্ছুতেই। আগে আগে ভাবতুম তোমার বোধ হয় আমাকে তত পছন্দ নয়।
–ভুল ভাঙল কী করে?
–ভাঙেনি তো। আর শোনো, আমার অনেক বয়ফ্রেন্ড — এটা কিন্তু একটা মিথ।
–আমি কি জানতে চেয়েছি কিছু?
–কেন চাওনি? চাও! অমুকের গা ঘেঁষে নাটক দেখতে বসলাম বলে তুলকালাম করো! তমুকের হোয়াটসঅ্যাপ বারবার এলে কথা বন্ধ করে দাও! দাও! যা ইচ্ছে হয় করো!
–মনে মনে করি তুলকালাম, ফেসবুকে যখন অন্য অন্য পুরুষদের নিয়ে কবিতা দেখতে পাই, ভয়ানক রাগ হয়। তারপর ভাবি, ঠিকই তো আছে। বিগতযৌবনে আটকে থাকবেই বা কেন… আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়।
–কেন? শাড়ি বলে? জিন্স পরলে দেখায় না?
–তা কই বললাম। বোধ হয় নীল শাড়ি বলে। তুমি শোনো, মহিষাসুরমর্দিনী?
–হুমমমমমমম। প্রত্যেকবার। আগে যখন পুরনো-বাড়ি থাকতাম, রেডিও চালিয়ে ঠাম্মিকে তুলতাম ঘুম থেকে। তারপর শিউলিফুল এনে ঠাকুরের পায়ে দিতাম। ঠাম্মির হাতেও। ভোরবেলায় আমাদের দৌরাত্ম্যে মা উঠে পড়ত কিছুক্ষণ পর। চা বসাত। তিনজনে খেতাম৷ একটু একটু করে আলো ফুটত বাইরে। পুজো এলে ঠাম্মিকে বড্ড মনে পড়ে।
–উনি তো আছেন তোমার মধ্যে।
–আমার যে রক্তমাংসে থাকতে হয়!
–আছি। হয়তো তুমি যেভাবে চাও আমি তা পারি না। কিন্তু আছি এ কথা জেনো।
–স্বকীয়। পরকীয়া নয়। তুমি আমারি তুমি আমারি, মম অসীমগগনবিহারী…
–মম শূন্যগগনবিহারী… দ্যাখো, ওই বুড়ো কিন্তু তোমার আকাশটা দেখতে পেয়েছিলেন ঠিক।