চোখ

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

 

তিতলির চোখে যা কিছু ধরা পড়ে শ্রাবণী এখন তার সবটাই দেখতে পায়।

বছর পাঁচেক আগে শ্রাবণী কিন্তু এই সুবিধাটা পায়নি। তখন তিতলিকে নজরে রাখত সিসিটিভি। তিতলির বেডরুম থেকে লিভিং রুম অব্দি হেঁটে যাওয়া, খুচরো হোঁচট, জুম করে হাসিকান্নার মুহূর্তগুলো শ্রাবণী দেখে নিত স্মার্টফোনে ইন্সটল করা অ্যাপে।

সময় গড়িয়েছে। রাস্তা বড় করা হয়েছে পাশের ঢাউস গাছগুলো কেটে। পেটিএম গুগলপে-র একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক মানুষ বেছে নিয়েছে আমাজন পে-কে। সেটাই এখন ট্রেন্ড। আর অন্যদিকে গঙ্গার নিচে মেট্রো, তিরিশতলা গ্রিন আরবানার ওপরে সুইমিং পুল, ভোট, আইপিএল ইত্যাদির মধ্যে দিয়েই বসন্তও এসে গিয়েছে শহরে।

সেই বসন্তের এক দুপুরে কলেজে গণহত্যার রাজনীতির একঘেয়ে লেকচারের পর শ্রাবণী দেখল, তিতলিকে খাইয়ে দিচ্ছে আয়া। হাততালি দিয়ে ঝিকমিকিয়ে তিতলি খেলে বেড়াচ্ছে সারা ঘর। উল্লাসে তিতলি যত লাফায়, শ্রাবণীর হৃদয়টাও যেন খিলখিলিয়ে লাফিয়ে ওঠে। তিতলির সুখ মানে তারই তো সুখ, তিতলির হাসিতে শ্রাবণীর দিলখুশ। সে ষোলো আনা নিশ্চিন্ত।

শুরুর দিকে শ্রাবণীর সায় না থাকলেও সিসিটিভির কথাটা সৌগতই তুলেছিল। বলেছিল, আরে বাবা এত অসুবিধার কী আছে! অকারণ ভয় পাচ্ছ কেন? দেখো শ্রাবণী, আমাদের সময়টা আলাদা ছিল। বাবা-মায়ের চোখের আড়ালে আমরা কোথায় কী করে বেড়াতাম, কারও অত মাথাব্যথা ছিল না। আমাদের সময়টায় এত দাঙ্গাহাঙ্গামাও ছিল না। কিন্তু এখন তো আর ছেলেমেয়েকে রাস্তাঘাটে দূরের কথা বাড়িতেও একা রাখা যায় না। সিসিটিভি জাস্ট একটা এক্সট্রা চোখ। আর কিছুই না। আমরা দুজনেই অফিসে বিজি। কারও পক্ষেই সম্ভব নয় তিতলিকে চোখে চোখে রাখা। ফাতেমা যত ভালো আয়াই হোক, বাইরের লোক তো, আমাদের অ্যাবসেন্সে ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো তো একটু বুঝতে হবে। আর এখন তো সব জায়গাতেই টেকনোলজি…

শ্রাবণী আর আপত্তি করেনি। সে নিজেকে বুঝিয়েছে, সিসিটিভি নিরীহ যন্ত্র। ঘরের কোনায় জবুথবু হয়ে কেবলই খেয়াল রাখবে তিতলির ওঠাবসা, গোপন গতিবিধি, মনোরম দুষ্টুমি। সে তো ভালোই। কিন্তু তবুও একটা অজানা আশঙ্কা শ্রাবণীর মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। তবে সেটা ঠিক কী, অনেকখানি তলিয়ে ভেবেও সে তার কূলকিনারা করতে পারেনি। চারপাশে যা সব চলছে, যে কেউ যখন তখন তো…! সিসিটিভি এমনিতে খুব কাজের জিনিস। আর তাছাড়া তিতলিও তো চার দেয়ালের মধ্যেই, তবুও কী যেন একটা! শ্রাবণী সঠিক জানে না। ঠিক যেমন সৌগত তার রিলায়েবল হাজবেন্ড। স্মার্ট। মাপজোক করে কথা বলে। সংসারে কোথাও কোনও ফাঁক রাখেনি যেখানে শ্রাবণীর বন্ধুদের স্বামীর বিরুদ্ধে খুব সহজেই অভিযোগ আনা যায়। বিয়ের আগে সৌগতর কোনও গার্লফ্রেন্ডও ছিল না। স্কুল-কলেজও বয়েজ। এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের ধারেকাছেও সে ঘেঁষবে না। মোদ্দা কথা, চরিত্র হোক বা চাকরি, প্রত্যাশিত থেকে বিচ্যুতির কোনও সম্ভাবনাই সৌগত মধ্যে নেই। এমন হাজবেন্ডের সঙ্গে মেঘ না চাইতে জলের মতো শ্রাবণী পেয়েছে অটুট আর্থিক নিরাপত্তা। তা সত্ত্বেও, চারপাশে যা সব চলছে, শ্রাবণীর মাঝেমাঝেই মনে হয়, আচমকা যদি খারাপ কিছু একটা…! ঠিক এই চিন্তাটাই শ্রাবণীকে হুল ফোটায়। বাড়তে থাকা ক্যান্সারের মতো ভাবনাটা তাকে কিছুতেই রেহাই দেয় না।

তিতলি এখন বড় হয়েছে। তার যাতায়াত কারমেল ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্টে। সৌগতর মনে হয়েছিল, ইন্টারন্যাশনাল শব্দটা কানে ভালো বাজে, বেশ একটা ইয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার স্বপ্নও দেখিয়েছে স্কুলের ইলেক্ট্রনিক ব্রসিয়োর।

মিডিয়াতে, খবরের কাগজে  শ্রাবণী বারবার দেখে, সময় নাকি এখন আগের চেয়ে আরও খারাপ। তিতলিকে কোথাও একা ছাড়তে সে ভীষণ ভয় পায়। ছেলেদের চেয়ে আজকাল মেয়েদের ওপর বিচ্ছিরি রকমের কিছু একটা ঘটে যাওয়া সম্ভাবনাও যে অনেক বেশি। কিন্তু উপায় নেই। তিতলির সঙ্গে তো আর সিসিটিভি তার মাথার ওপর সারাক্ষণ ঘুরতে পারে না। শ্রাবণী বোঝে, যত তাড়াতাড়ি ফেসবুকে স্ক্রল করা যায় জীবনের গতিপথ মোটেও তেমন নয়। অল্প সময়ের জন্য উঁকি দেওয়া সুখ আর শান্তির মুহূর্তগুলো হাতের মুঠোয় ধরে রাখা বালির মতোই গলে যায়। যাবেই। যত বেশি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা, তত তাড়াতাড়ি উধাও। তিতলির জন্য চিন্তায় শ্রাবণীর রাতে ঘুম আসতে অনেক দেরি হয়। তিতলিই তার অবশিষ্ট জীবনের সবটুকু। তার বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই।

সৌগতকে আলাদা করে আর কিছু বলতে হয়নি। শ্রাবণীর চোরা টেনশন তার মধ্যেও জারিত হয়েছে। দেরি না করে সে এবার নিজেই উদ্যোগ নিল। শ্রাবণীকে সে বলল, একটু খরচা হবে কিন্তু মাইরি বলছি তিতলিকে তুমি এবার চাইলেও চোখে হারাতে পারবে না। বাইরের মাল, কিন্তু সলিড। কাটিং এজ।

সিদ্ধান্তের এক মাসের মধ্যেই লাখ খানেক খরচ করে তিতলির চোখে পরিয়ে দেওয়া হল অরগ্যানিক কন্টাক্ট লেন্সে নতুন সফটওয়্যার আইলিঙ্ক। এখন থেকে তিতলির চোখে যাই ধরা পড়বে শ্রাবণী একেবারে লাইভ দেখতে পাবে তার স্মার্টফোনে। তিতলি কিন্তু জানেই না তার চোখে লাগানো কন্টাক্ট লেন্সটি একেবারেই অন্যরকম।

প্রতিটি মুহূর্তেই চোখে চোখে রাখা যাবে তিতলিকে। তিতলি যখন আয়া, স্কুলটিচার, বেস্ট ফ্রেন্ড আয়েশার দিকে তাকায় শ্রাবণী মেয়ের চোখ দিয়ে তাদের মুখের সবটুকু দেখতে পায়। আয়া বিরক্ত হলে শ্রাবণীও বিরক্ত। আয়েশা হাসলে তার মুখেও হাসি ফোটে। সন্ধের অবকাশে শ্রাবণী দেখে, ড্রয়িং খাতায় তিতলি আকাশে নীল রং ভরে দিচ্ছে, গোলাপে লাল, আইসক্রিমে ক্রিম। সেদিন তো পিজ্জার ছবিও এঁকেছিল। ডমিনোজ।

তিতলির স্কুলে আজ অ্যানুয়াল পিকনিক। তিতলি আবদার করে বলল, মম তুমিও আজ চলো স্কুলে। খুব ফান হবে। আয়েশার মম ড্যাডও আসছে। উইল প্লে ডুডলি ডুডল টুগেদার।

—না সোনা, আমাকে আজ অনেক খাতা দেখতে হবে। ইউ গো অ্যান্ড এনজয়।

শুধু সেমিস্টারের খাতা দেখবে বলেই নয় আমাজন থেকে কেনা নতুন পোশাকে তিতলিকে মনের মতো করে সাজিয়ে তুলবে বলেও শ্রাবণী আজ কলেজ যায়নি। সৌগত আবার গতরাতেই বিজনেস ট্রিপে কুয়েত গিয়েছে। সৌগতর নতুন ক্লায়েন্ট ইজরায়েলের। ক্লায়েন্টের টেকনিক্যাল প্রবলেম সলভ করে সে তুড়ি মেরে দিন দুয়েক আগে বলেছিল, দেখে নিও, আমার ভারত আর পাঁচ বছরের মধ্যে টপ ইকোনমিক সুপার পাওয়ার হবে। দিস ইজ নিউ ইন্ডিয়া ইন্ডিড। শ্রাবণী জানে শুধু ইন্ডিয়া নয়, তিতলি, পরিবার, চাকরি, ল্যাপটপ, বিজনেস ট্রিপ এ সব কিছুকেই সৌগত সমান গভীরতায় ভালোবাসে। সুদর্শন মজবুত চেহারার সৌগতর এই প্রেম আর আত্মবিশ্বাসের দুর্লভ মিশেল দেখেও শ্রাবণী কী এক কারণে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। সৌগত তো সারাদিনই ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকে। খোলা ল্যাপটপে কত সংখ্যা আর ডলারচিহ্ন। আমেরিকা-ইজরায়েল-ইন্ডিয়ার মধ্যে সৌগতর কোম্পানির কত টাকার লেনদেন ছড়িয়ে রয়েছে ওই স্ক্রিনটার মধ্যে। শ্রাবণীর অস্বস্তি হত। ল্যাপটপ নিরীহ যন্ত্র। তবুও।

একা বাড়িতে শ্রাবণীর কিছুতেই সময় কাটে না। খান দশেক খাতা দেখার পরেই মনোযোগ হারিয়ে সে গোটা ঘর জুড়ে পায়চারি করে। ভাবার চেষ্টা করে, ঠিক কী কাজ করলে মনটা শান্ত হবে। শ্রাবণী অনেকদিন পর তানপুরাটা বের করে সবচেয়ে প্রিয় গানগুলো করতে পারে, প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণের আরণ্যক আবার পড়ে ফেলতে পারে। কিংবা জীবনানন্দ! শিশুটিও ছিল; প্রেম ছিল, আশা ছিল, জোছনায় তবু সে দেখিল কোন্ ভূত? এমনকি ইচ্ছে হলে সে তো প্রয়োজনের থেকে বেশি গাঢ় লিপস্টিক মেখে লুকিয়ে দেখা করে নিতে পারে তার আট বছর আগের পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে। তারপর তো ইচ্ছেকে তিলে তিলে প্রশ্রয় দিয়ে কত কিছুই করে ফেলা যায় সকলের নজরদারির বাইরে। শ্রাবণী কিছুই করল না। বুমেরাং হয়ে তিতলিই ফিরে এসে মনটাকে ভরিয়ে তুলল আবার। তার শুধুই মনে হয়, তিতলি এখন ঠিক কোনখানটায়, কী করছে! সে ঠিক আছে তো! চারপাশে যা সব চলছে। সে নিজে জানতেও পারে না, কখন যেন শ্রাবণীর হাত খুঁজে নিয়েছে স্মার্টফোন। মুচকি হেসে সে মনিটরে চোখ রাখে। কিন্তু স্ক্রিনটা কেন কাঁপছে! কেউ রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে ভিডিও করলে ঠিক যেমন হয়। মানুষ পালাচ্ছে। বাচ্চারাও। চোখে মুখে প্রচণ্ড ভয়। রাস্তার পাশের একটা বাড়িতে বোমা পড়ল। আগুন। কালো ধোঁয়া। ছড়িয়েছিটিয়ে বেশ কয়েকটা লাশ। কারও হাত নেই। কারও পা। একটা বাচ্চা মেয়ের মুখের ডানদিকটায় লাল রঙের এবড়োখেবড়ো মাংস। বা চোখটা কোটর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, জেনিন উদ্বাস্তু শিবিরে আট বছরের আদাম সামের আল ঘৌলেটকে একদম সামনে থেকে মাথায় গুলি করেছে ইজরায়েলি সেনা। পনেরো বছরের বাসিল সুলেমান আবু আল ওয়াফাকের বুকে গুলি।

এসব কী দেখছে শ্রাবণী! আতঙ্কে যেন ওর চোখ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। সে ছুটে যায় তিতলির ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্টের দিকে। তিতলি কোথায়?

কই না তো! সবই তো ঠিকই আছে। তিতলি উল্লাসে খেলছে। ছুটে বেড়াচ্ছে। খুশিতে ডগমগ করছে তার গোটা শরীর। আয়েশাকে জড়িয়ে গালে চুমু দিল এক্ষুনি। তাহলে শ্রাবণী এসব কী দেখল মেয়ের চোখে! সে প্রচণ্ড রেগে ফোন করে আইলিঙ্ক কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে।

—আসলে ম্যাডাম, আমাদের সফটওয়্যার হ্যাক হয়েছে। ওটা অ্যাকচুয়ালি তিতলির চোখই নয়, সোরাইয়ার।
—কে সোরাইয়া?
—এগুলো বলা যাবে না ম্যাম। কনফিডেনশিয়াল ব্যাপার। বারণ আছে।
—আমি ওসব কিছু শুনতে চাই না। এত টাকা খরচ করে যখন কিনেছি উত্তর আপনাকে দিতেই হবে। না বললে আমি আপনাদের কোম্পানির এগেনস্টে কেস করব। বলুন, কে সোরাইয়া?
—প্যালেস্টাইনের একটা রিফিউজি মেয়ে ম্যাম। ওই মেয়েটার চোখে যা ক্যাপচার হয়েছে সেগুলোই আপনি মোবাইলে দেখলেন। এর বেশি কিছু আর বলতে পারব না। চাকরি চলে যাবে।
—স্ট্রেঞ্জ! কী যা তা বলছেন! তার মানে তো রিফিউজি মেয়েটার চোখেও কন্টাক্ট লেন্স লাগানো আছে! ওই লেন্সের সঙ্গে তিতলির চোখের লেন্সের কী রিলেশন! হচ্ছেটা কী! এমন কি আদৌ হতে পারে! আমাকে পরিষ্কার করে বোঝান তো।
—ট্রাস্ট মি ম্যাম। আমরা এর বেশি কিছু জানি না। অথরিটিও নেই জানার। ম্যানেজারের কাছ থেকে যেটুকু শুনেছি তাই জানিয়েছি। টেকনোলজির ব্যাপার। কীভাবে যে কী হ্যাক হয়ে যাচ্ছে বলা খুব ডিফিকাল্ট। আজই আমরা ফিক্স করে দেব। ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করছে। কাল চেক করবেন। গ্যারান্টি। সোরাইয়া না। কাল থেকে আবার আপনার মেয়ে তিতলি।

শ্রাবণীর সমস্ত কথা হারিয়ে গিয়েছে। চোখের পলক পড়ে না। মনটা থমকে। সামনেই তিতলি। প্রজাপতির মতো সে উড়ে বেড়াচ্ছে অনলাইন পোশাকে। আর ওদিকে তিতলির বাবা দেশকে ভীষণ ভালোবাসে। সে দেশের জন্য দেশের বাইরে থেকেও কাজ করছে। আর তাছাড়া আমজনতা থেকে কাস্টমার কেয়ার, সবাই তো বলছে, পৃথিবীর সবকিছুই ঠিকঠাক!

শ্রাবণী দেখে, তিতলির সারা শরীর জুড়ে রক্ত। একটা চোখ নেই। কেউ খুবলে নিয়েছে। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া লাশগুলোকে পাশ কাটিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করে সে পালাতে চাইছে। দিশেহারা। একটু আগেই তো সুদর্শন মজবুত চেহারার একটা মিসাইলে তার বাবা-মার শরীর…।

শ্রাবণী চোখ বন্ধ করে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আহা! চমৎকার লেখা।
    জয় হোক।
    হীরক সেনগুপ্ত

আপনার মতামত...