
শান্তনু চক্রবর্তী
‘শূন্য’ আবিষ্কারের বিষয়ে ভারতীয় অবদানের প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানের ইতিহাস কী বলে তার একটা প্রাথমিক রূপরেখা দিতেই এই নিবন্ধ। কিন্তু ইতিহাসের খুঁটিনাটিতে যাওয়ার আগে শূন্য আবিষ্কার বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে এবং সেই ক্ষেত্রে ভারতীয় অবদানের প্রকৃতি কী, তা-নিয়ে কিছু প্রাথমিক কথা বলা জরুরি
ভারতীয় সমাজে “শূন্য আবিষ্কার” একটি বহুল-আলোচিত বিষয়। এ-বিষয়ে পণ্ডিতি গবেষণা হয়েছে, ইংরেজি-সহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় লেখা হয়েছে প্রচুর গ্রন্থ, আর বাংলা ও উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষায়ও অনেক রচনা আছে। তবুও, এই বিষয়ে নতুন কিছু বলার সুযোগ কি এখনও রয়ে গেছে?
আছে অবশ্য। কারণ অনেক কিছু আজও অজানা। কিন্তু সেই অজানা বিষয়ে আলোকপাতের সাধ্য আমার নেই। তবে, অনেক সময় মনে হয়েছে, যাঁরা বিজ্ঞানের ইতিহাসের অনেক খবর রাখেন না কিন্তু রাখতে আগ্রহী, সেসব পাঠকের জন্য গণিতের ইতিহাসের কিছু কথা হয়তো একটু অন্যভাবে আলোচনা করলে ভালো হয়। এখানে সেই চেষ্টাই করব।
চেষ্টা করব ‘শূন্য’ আবিষ্কারের বিষয়ে ভারতীয় অবদানের প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানের ইতিহাস কী বলে তার একটা প্রাথমিক রূপরেখা দিতে। কিন্তু লেখার সময় মনে হল, ইতিহাসের খুঁটিনাটিতে যাওয়ার আগে শূন্য আবিষ্কার বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে এবং সেই ক্ষেত্রে ভারতীয় অবদানের প্রকৃতি কী, তা-নিয়ে কিছু প্রাথমিক কথা বলা জরুরি। নিবন্ধের প্রথম ভাগে সেটাই করব।
রচনা দীর্ঘ। পাঠক যাতে প্রসঙ্গের ভিড়ে পথ না হারান, তাই শুরুতেই এর পরবর্তী বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত সূচি উল্লেখ করছি—
ক) শূন্য— মিস্টিক বনাম মামুলি
খ) ভাষা-ভাবনার শূন্য ও গণনার শূন্য
গ) সংখ্যালিপির শূন্যচিহ্ন
ঘ) সংখ্যা, সংখ্যাচিহ্ন ও অঙ্ক (Number, numeral, and digit)
ঙ) আমাদের দশটি অঙ্ক
চ) শূন্য— সংখ্যালিপি ও গণিতে
ছ) শূন্যচিহ্ন বাদ দিয়ে সংখ্যালিখন
জ) স্থান, মান, অঙ্কলিখন
ঝ) সংখ্যালিপি শূন্য পেল
ঞ) লিপিকৌশলের দেশভ্রমণ: ইসলামীয় সভ্যতা ও পশ্চিমি দুনিয়া
ট) রচনার পরবর্তী ভাগে যা থাকতে পারে
ক) শূন্য— মিস্টিক বনাম মামুলি
শূন্য প্রসঙ্গে ভারতীয় অবদানের আলোচনা করতে গিয়ে অনেক সময় বলা হয়, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিস্টিক চেতনার দাপট ছিল এবং তার ফলে এই সংস্কৃতিতে শূন্যের ধারণার উত্থান সহজ হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিস্টিক চেতনার দাপট অন্য সংস্কৃতির তুলনায় বেশি ছিল— এই দাবি খুব মজবুত বলে মনে হয় না। যদি বেশি হয়ও, সেই চেতনার দৌলতে ভারতীয়রা গাণিতিক শূন্য আবিষ্কারের ক্ষেত্রে একটু বেশি সুবিধা পেয়েছে, এই যুক্তি ধোপে টেকে না।
টেকে না তার কারণ, শুধু প্রাচীন ভারতে নয়, সাধারণভাবে সব সংস্কৃতিতেই শূন্যের ধারণা ছিল। আর তা না থেকে উপায়ও নেই। ওই থলিতে অনেকটা গম ছিল, এখন থলি ফাঁকা; গাছে অনেক ডাব ছিল, এখন একটিও নেই; ছেলেটার ঘটে কিস্যু নেই— অনস্তিত্ব বা অভাবের এই জাতীয় ধারণা ছাড়া দৈনন্দিন জীবনে ভাষা ব্যবহার চালানো যায় না, আর এই ধরনের শূন্য-ভাবনা ভাবার জন্য মানুষের স্বাভাবিক মননক্ষমতাই যথেষ্ট। তাই, কমবেশি সব ভাষাতেই শূন্যের সমার্থক শব্দ বা শব্দবন্ধ ছিল।
খ) ভাষা-ভাবনার শূন্য ও গণনার শূন্য
তবে, সাধারণভাবে ভাষা ও ভাবনার শূন্য সব সংস্কৃতিতে গণনা বা পরিমাপের শূন্য হয়ে ওঠেনি। পূর্ণাঙ্গরূপে তা প্রথম হয়েছিল ভারতীয় সংস্কৃতিতেই। কেন হল? কীভাবে হল? তবে এসব আলোচনা শুরু করতে গেলে প্রথম যে প্রশ্নটা ওঠে, তা হল— গণনা বা গণিতের শূন্য বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি?
গণনার শূন্য শুধু অনস্তিত্বের ধারণা নয়, এটি একটি সংখ্যা। অর্থাৎ, তা দিয়ে গাণিতিক ক্রিয়া করা যায়, যেমন যোগ, বিয়োগ, গুণ ইত্যাদি।[1] সবচেয়ে সহজে এটি বোঝার জন্য নীচের সমীকরণটি দেখা যেতে পারে—
৮ – ৮ = ০ (অবশ্য এখানে ৮-এর জায়গায় যে-কোনও সংখ্যা বসানো যেতে পারে; z-কে যেকোনও একটি সংখ্যার প্রতিনিধি ধরে নিয়ে লেখা যায়: z – z = ০)।
উপরের সমীকরণ থেকে আমরা গাণিতিক শূন্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারি। দেখা যাচ্ছে, যে-কোনও সংখ্যাকে নিজের থেকে বিয়োগ করলে যা পড়ে থাকে, সেটাই শূন্য। শূন্য সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণার গাণিতিক রূপ হিসেবে এই সমীকরণটি গ্রহণ করা যেতে পারে।
শূন্য কিন্তু শুধুই গাণিতিক ক্রিয়ার ফল নয়। তা দিয়ে গাণিতিক ক্রিয়াকর্মও করা যায়। এবার আমরা শূন্যকে চিনব অন্য গাণিতিক ক্রিয়ার আলোয়।
z – ০ = z;
z + ০ = z;
z x ০ = ০।
(এখানে z যে-কোনও সংখ্যা)।
লক্ষ করুন, আমরা z ÷ ০ লিখিনি। কারণ, কোনও সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করার কি কোনও অর্থ আছে, আর থাকলে তা ঠিক কী— এ-নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যার একটা ইতিহাসও আছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় গণিতবিদরা এ নিয়ে গভীর চিন্তা করেছেন। উনিশ শতকেও আধুনিক গণিতজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে নানা মতপার্থক্য ছিল, এবং বিশ শতক কিংবা একুশ শতকেও এই আলোচনার শেষ হয়নি। আজকের গণিতের পাঠ্যপুস্তকে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, শূন্য দিয়ে ভাগ ‘আনডিফাইনড’ বা এর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই।
গ) সংখ্যালিপির শূন্যচিহ্ন
উপরের সমীকরণগুলো থেকে আমরা শূন্য নামক সংখ্যাটির কয়েকটি গাণিতিক ধর্ম চিনতে পারি। কিন্তু যোগ, বিয়োগ, গুণ— এতসব করার আগেই আমরা একটি গোলাকৃতি চিহ্নকে শূন্যের চিহ্ন বা সঙ্কেত হিসাবে চিনে ফেলি। এই পরিচয় ঘটে সংখ্যালিপি চেনার সময়। আমরা শিখি যে ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ এবং ৯— এই দশটি সঙ্কেত দিয়ে সব সংখ্যাকে লিখিত রূপে প্রকাশ করা যায়। এই সঙ্কেতগুলোকে বলে অঙ্ক (digit)।
সংখ্যালিখনে এই অঙ্কের ব্যবহার প্রসঙ্গে পরে আসব, কারণ সে-প্রসঙ্গের সঙ্গে গাণিতিক শূন্যের ধারণা ও শূন্যচিহ্নের ভূমিকার নিবিড় যোগ রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর আগে অন্য দু-একটি বিষয় নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন।
ঘ) সংখ্যা, সংখ্যালিপি, সংখ্যাচিহ্ন ও অঙ্ক
ইংরেজিতে তিনটি শব্দকে আমরা কমবেশি চিনি— নাম্বার (number), নিউমারাল (numeral) এবং ডিজিট (digit)। এদের বিষয়ে একটু বলে নেওয়া ভালো।
‘নাম্বার’ মানে সংখ্যা। কিন্তু সংখ্যা বস্তুটি কী? এর সংজ্ঞা বিষটি একটু খটোমটো, কিন্তু তাতে অসুবিধা নেই। আমরা সবাই একরকম বুঝি ব্যাপারটা কী। রাজভোগ ক-টা আছে, টেবিলটির দৈর্ঘ্য কত মিটার, বা মুম্বই কলকাতা থেকে কত কিলোমিটার দূরে, এসবের উত্তর হল কোনও না কোনও একটি সংখ্যা। অর্থাৎ ক-টা ও কত এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর হল সংখ্যা। আরেক ধরনের ক্ষেত্রেও সংখ্যার ব্যবহার হয়- ক্রম বোঝাতে। অর্থাৎ, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ইত্যাদি। কিন্তু এখানে আমাদের কারবার ক্রমবাচক সংখ্যা নিয়ে নয়।
একটি সংখ্যাকে কিন্তু নানাভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে— হাতের ক-টা আঙুল তুলে ধরে, ব্ল্যাকবোর্ডে ক-টা আঁচড় কেটে, কিংবা ক-বার শিস দিয়ে। এইভাবে সংখ্যা প্রকাশ কিন্তু তুচ্ছ ব্যাপার নয়। অনেক পরিস্থিতিতে এসব করেই সংখ্যা বোঝাতে হয়। মুক বধিরদের ইঙ্গিতের ভাষায়, যেমন ধরুন ভারতীয় বা আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে, তালু ও আঙুলের মুদ্রা দিয়ে প্রকাণ্ড সব সংখ্যাকেও প্রকাশ করা যায়।) আবার আমরা ১৩, ১৭, ৩১ প্রভৃতি লিখিত চিহ্নের মাধ্যমেও সংখ্যা বোঝাতে পারি।
যেকোনও সংখ্যা-নির্দেশক চিহ্নকে বলা হয় নিউমারাল (numeral)। যেমন, ৪, ১৩ বা ১৭ হল ভারতীয় বঙ্গীয় সংস্করণে তিনটি স্বতন্ত্র সংখ্যার নির্দেশক চিহ্ন। রোমানরা সংখ্যালিখন পদ্ধতিতে লিখলে এই তিন সংখ্যাকে আমরা লিখতাম যথাক্রমে: IV, XIII এবং XVII। আবার, মায়া সভ্যতায় ব্যবহৃত পদ্ধতিতে লিখলে, লিখতাম যথাক্রমে—
[পাঠক হয়তো বুঝতে পারছেন, মায়াদের লেখায় ফুটকি চিহ্ন এক (১) এবং অনুভূমিক রেখাগুলো পাঁচ (৫)-এর নির্দেশক।]
সাধারণত, সংখ্যানির্দেশক লিখিত চিহ্ন সম্পর্কেই ‘নিউমারাল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তালু-আঙুলের মুদ্রা দিয়ে বা মুখে সংখ্যানির্দেশক শব্দ উচ্চারণ করেও সংখ্যা বোঝানো হয়। ফলে, যুক্তির বিচারে সেই মুদ্রা ও শব্দগুলোও ‘নিউমারাল’। যেকোনও সংস্কৃতির সংখ্যালিখন পদ্ধতিকে বলা হয় ‘নিউমারাল সিস্টেম’। অনেক সময় বাংলা তরজমা করা হয়, ‘সংখ্যালিপি’। কিন্তু শুধু ‘নিউমারাল’ শব্দটির বাংলা কী হবে? অর্থাৎ, আলাদা করে ‘৪’, ‘১৭’, ‘১৩’ বা ‘৫৭’— এসব চিহ্নকে কী বলব? বলতে পারি, ‘সংখ্যাচিহ্ন’।
তাহলে ‘ডিজিট’ কী? যখন আমরা ৪, ১৩, ১৭ বা ৫৭ ইত্যাদি সংখ্যাচিহ্ন লিখছি, তখন ‘৪’, ‘১’, ‘৩’, ‘৫’, ‘৭’ ইত্যাদি সঙ্কেত ব্যবহার করি। এই এক একটি স্বতন্ত্র সঙ্কেতকে বলা হয় ‘ডিজিট’। এই সঙ্কেতগুলোও কোনও না কোনও সংখ্যার নির্দেশক। এসব স্বতন্ত্র সঙ্কেত বা ডিজিটকে আমরা বাংলায় বলি ‘অঙ্ক’। রোমান সংখ্যাচিহ্নের ক্ষেত্রে অঙ্ক হল I, V, X, L প্রভৃতি এবং মায়া সভ্যতার সংখ্যালিপিতে সবচেয়ে পরিচিত অঙ্ক হল ফুটকি চিহ্ন (●) এবং অনুভূমিক রেখা (―)(যথাক্রমে এক ও পাঁচ সংখ্যার চিহ্ন)। কিন্তু, শুধু কয়েকটি অঙ্ক দিয়ে তো সব সংখ্যাকে প্রকাশ করা যায় না। তাই, বাকি সংখ্যাদের প্রকাশ করতে অঙ্কদের পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে অন্য চিহ্ন তৈরি করতে হয়। অর্থাৎ, একটি একটি স্বতন্ত্র চিহ্ন হল অঙ্ক (ডিজিট) ও তাদের জুড়ে গড়া তৈরি হয় বাকি সব নিউমারাল বা সংখ্যাচিহ্ন।
অর্থাৎ অঙ্ক ও সংখ্যাচিহ্নের মাধ্যমে বিভিন্ন সংখ্যা বা নাম্বারের ধারণাকে প্রকাশ করা হয়। আর, কোনো দেশ বা সংস্কৃতির সংখ্যাচিহ্নের (নিউমারাল-এর) সমষ্টিকে বলা যায় সংখ্যালিপি (নিউমারাল সিস্টেম)। একই দেশে অনেকসময় একাধিক সংখ্যালিপি চালু থাকে। যেমন, প্রাচীন ভারতে উত্তর পশ্চিমে চলত খরোষ্ঠী সংখ্যালিপি আর অন্যত্র চলত ব্রাহ্মী সংখ্যালিপির বিভিন্ন সংস্করণ।
মায়া সভ্যতার মানুষ গাছের বাকল ব্যবহার করে লিখতেন। এমনই একটি গাছের বাকলে লেখা বই প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে The Dresden Codex নামে বিখ্যাত। এই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার ছবিতেই অনেকগুলো মায়া সংখ্যাচিহ্নের নমুনা মেলে।
সূত্র: The complete Kingsborough version of the Dresden Codex in PDF format.

ঙ) আমাদের দশটি অঙ্ক
আমাদের লাগে ঠিক দশটি অঙ্ক (digit)— ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ এবং ৯। শুধু এই ক-টি অঙ্ক আর একটি বিশেষ সাজানোর কৌশল ব্যবহার করেই, যত বড় সংখ্যাই হোক না কেন, তার সংখ্যাচিহ্ন (numeral) অনায়াসে লেখা যায়। প্রাক্-আধুনিক যুগে অন্য কোনও সংস্কৃতিতে সংখ্যাকে এত নিখুঁতভাবে লিখিত রূপে প্রকাশ করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। অনেকেই কাছাকাছি পৌঁছেছিল, কিন্তু আধুনিক যুগে আমরা সংখ্যালিখনের যে-পদ্ধতি ব্যবহার করি, তার ভিত্তি গড়েছিল ভারতীয়রাই। এই ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য ও স্বকীয়— এখানে অন্য কোনও প্রভাব এখনও প্রমাণিত হয়নি।
চ) শূন্য— সংখ্যালিপি ও গণিতে
উপরের দশটি চিহ্নের মধ্যে ০ চিহ্নটি আমাদের বিশেষভাবে নজর কাড়ে। এর ভূমিকা ঠিক কী? সংখ্যালিখনে এই ০ কি আমরা যে গাণিতিক শূন্য নিয়ে গোড়ায় আলোচনা করেছি, তারই প্রতীক? আমরা সাধারণত তেমনটাই শিখি।
কিন্তু সম্ভবত সংখ্যালিপির এই ০-কে গোড়া থেকেই ভারতীয়রা গাণিতিক শূন্য হিসেবে চিনত না। তবু একটা সময় এল, যখন সংখ্যালিপির শূন্য আর গণনার শূন্য— এই দুই মিলে এক হয়ে গেল। আর সেই মিলনের মাধ্যমেই ভারতীয়দের গাণিতিক শূন্যভাবনা পূর্ণতা পেল। এই ব্যাপারটা একদিনে হয়নি।
ভারতেই কেন এমন হল এবং কীভাবে তা ঘটল— সে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকবে লেখার পরবর্তী অংশে।
কিন্তু ইতিহাসে যা ঘটেছিল, তার গুরুত্ব পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদের আগে শূন্য এবং শূন্যচিহ্ন— এই দুটিকে বাদ রেখে সংখ্যালিখন ভাবার চেষ্টা করতে হবে। সেই চেষ্টাটাই এবার করা যাক।
ছ) শূন্যচিহ্ন বাদ দিয়ে সংখ্যালিখন
দিদিমণি দশমিক সংখ্যাচিহ্ন লিখতে শিখিয়েছিলেন খোপ কাটা ঘরের সাহায্যে। যেমন ধরুন ‘পাঁচশো পঞ্চান্ন’—দিদিমণি সেটি লিখতেন এইভাবে:
তিনি যা বুঝিয়েছিলেন, নির্বোধ বালকের মগজে তা যখন ধীরে ধীরে প্রবেশ করল, তখন বুঝলাম— সবকটি ঘরে পাঁচ থাকলেও সব পাঁচের মান সমান নয়। প্রথম পাঁচটি ‘শত’-এর ঘরে, তাই তার মান আসলে ‘পাঁচশো’। দ্বিতীয়টি ‘দশ’-এর ঘরে, মানে তা ‘পঞ্চাশ’। আর শেষের পাঁচটি নেহাতই বেচারা— সে ‘এক’-এর ঘরে আছে, তাই তার মান শুধুই ‘পাঁচ’।
এসব যখন একটু একটু করে বুঝলাম, তখন আরও জানলাম যে বাঁদিকে ঘর বাড়িয়ে যাওয়া যায়। যেমন, একইভাবে লিখতে পারি ‘দু-হাজার পাঁচশো পঞ্চান্ন’। ক্রমে জানলাম, আরও বড় সংখ্যাও একইভাবে লেখা যায়। যেমন, ‘বত্রিশ হাজার পাঁচশো পঞ্চান্ন’:
বুঝলাম, বাঁদিকে যত সরি, ঘরের মান ঠিক দশগুণ করে বাড়ে। অর্থাৎ, লক্ষের পর বাঁদিকে সরতে থাকলে ক্রমান্বয়ে আসবে দশ লক্ষ (মিলিয়ন বা নিযুত)[2], এক কোটি, দশ কোটি, একশো কোটি, হাজার কোটি ইত্যাদি। ক্রমে শিখেছি, উপরের ঘরের মান লেখার প্রয়োজন হয় না। একটু অভ্যাস হয়ে গেলেই সংখ্যাচিহ্নগুলো একের পর এক সাজিয়ে বড় বড় সংখ্যা সহজেই লিখে ফেলা যায়। যেমন, ‘ছেচল্লিশ হাজার চারশো একত্রিশ’:
আরও পরে বুঝলাম, এই সংখ্যা লেখার সূত্র লুকিয়ে আছে আমরা যেভাবে সংখ্যা বলি তার মধ্যেই। আমরা যখন সংখ্যা বলি, ওইভাবেই বলি— এত কোটি, এত লক্ষ, তত হাজার, অত শত ইত্যাদি।
আরও পরে জেনেছি, এই দশ, একশো, হাজার, দশ হাজার ইত্যাদি সংখ্যাগুলোকে ‘দশের ঘাত’ বলা হয়। এদের এভাবে সাজানো যেতে পারে:
আর তারও অনেক পরে জেনেছি, আমাদের দেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই সংখ্যা গোনার ক্ষেত্রে দশ, শত, সহস্র, অযুত (দশ সহস্র), নিযুত (লক্ষ), প্রযুত (মিলিয়ন)[3], অর্বুদ (দশ মিলিয়ন) ইত্যাদি দশের ঘাতের (powers of ten) ব্যবহার ছিল। অর্থাৎ, যে-কোনও সংখ্যাকে বলা বা লেখার সময় আমরা হামেশা এত লক্ষ, এত অযুত, এত সহস্র, এত শত ইত্যাদি বলে তা প্রকাশ করতাম।
তবে এর সঙ্গে লোকজীবনে দৈনন্দিন কেনাকাটা গোনাগুনতির সময় চার, ষোলো ও কুড়ির গুণিতকের ব্যবহারও প্রচলিত ছিল। (শুভঙ্করী গণিতের একটি অংশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।) কিন্তু বৃহৎ সংখ্যার ক্ষেত্রে এবং বিশেষত সংখ্যালিখনে দশের ঘাতের প্রাধান্য ছিল।
চিনেও তাই। চিন ও ভারত এই দুই এলাকায় দশ ও দশমিকের দাপট সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। অন্য দেশেও ছিল, তবে এত জোরদার ও সঙ্গতিপূর্ণভাবে নয়। কয়েকটি অন্য সংস্কৃতিতে দশের বদলে অন্য সংখ্যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল; যেমন মায়া সভ্যতায় কুড়ি। অন্যদিকে, ব্যাবিলনীয় সংখ্যালিখনে দশের সঙ্গে ষাটের ব্যবহার ছিল।
কিন্তু প্রথম ভাগে এসব বিষয়ে এইটুকুই থাক। এখন খোপ কাটা ঘর ব্যবহার করে সংখ্যা লেখার ব্যাপারটা আরেকটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
এবার আগের মতো আর পাঁচশো পঞ্চান্ন নয়, এবার লিখি পাঁচশো পঞ্চাশ। খোপ কাটা ঘরই ব্যবহার করব। উপরের সারিতে ঘরের মান আর লিখব না— দশের ঘাতের নিয়মেই তা একের পর এক বাড়বে। শুধু একটা শর্ত রাখছি— শূন্যচিহ্ন ব্যবহার করব না। সুতরাং লিখলাম:
লক্ষ করুন, একের ঘর ফাঁকা। কিছু নেই। তারপর শো-এর ঘরে পাঁচ, আর দশের ঘরেও পাঁচ বসালেই হয়ে গেল— পাঁচশো পঞ্চাশ। কোনও শূন্যচিহ্নের দরকার পড়ল না।
আরও একটি উদাহরণ দেখা যাক— ধরা যাক লিখতে হবে পাঁচশো পাঁচ।
এখানে দশের ঘর ফাঁকা।
কিন্তু শুধু সংখ্যালিখনের জন্য নয়, খোপ কাটা ঘর ব্যবহার করে দিব্যি যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ— সবই করা যায়। আমরা আপাতত শুধু একটি যোগের উদাহরণ দেখব।
আমরা পাঁচশো পাঁচের সঙ্গে ছয়শো ছয় যোগ করে পেলাম এক হাজার একশো দশ— একটি সুপরিচিত প্রক্রিয়া, যার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু খেয়াল রাখা জরুরি, যেখানে আমরা আজ শূন্য লিখি, সেখানে কেবল ঘর ফাঁকা রাখা হয়েছে। তবু বোঝার কোনও অসুবিধা হয় না। খোপ কাটা ঘর আর মাত্র ন-টি চিহ্ন ব্যবহার করেই আমরা অনেক দূর পর্যন্ত নিখুঁতভাবে হিসেব কষতে পারি।
জ) স্থান, মান, অঙ্কলিখন
এইভাবে সংখ্যালিখনকেই বলা হয় সুসঙ্গত স্থানিক মান অঙ্কলিখন (বা অঙ্কপাতন) পদ্ধতি। ‘স্থানিক মান’ কথাটির অর্থ, প্রতিটি স্থানের একটি নির্দিষ্ট মান থাকে। আর ‘সুসঙ্গত’ কেন? কারণ, প্রতিটি স্থানের মান সঙ্গতি রক্ষা করে পূর্ববর্তী স্থানের তুলনায় ঠিক দশগুণ করে বাড়ছে।
তবে, দশ গুণ করেই বাড়তে হবে, তার কোনও বাধ্যতা নেই। সুসঙ্গতভাবে পাঁচ গুণ, কুড়ি গুণ বা অন্য কোনও সংখ্যার গুণ হিসেবেও তা বাড়তে পারে। যেমন, মায়া সভ্যতায় স্থানিক মান কুড়ি গুণ করে বাড়ত। তাদের অঙ্কপাতন পদ্ধতিও ছিল সুসঙ্গত স্থানিক মানভিত্তিক। তবে কিছু সমস্যাও ছিল। অন্যদিকে, ব্যাবিলনীয়দের অঙ্কপাতন পদ্ধতি স্থানিক মান অনুসারী হলেও, তা তেমন সুসঙ্গত ছিল না। মায়া ও ব্যাবিলনীয় অঙ্কপাতন নিয়ে বিশদ আলোচনা পরবর্তী কোনও দফার জন্য তোলা থাক।
এইখানে এসে হয়তো একটু অস্বস্তি হচ্ছে, কারণ এখনও আমরা শূন্যচিহ্ন ব্যবহার না করেই চলেছি। তবে এই অস্বস্তি আসলে নেহাত অনভ্যাসের ফল। অবশ্য মনে হতেই পারে— ঘর ফাঁকা রাখলে তো একটা বাস্তব সমস্যা থেকে যায়। ফাঁকা ঘরে যদি দাগ পড়ে যায়, তাহলে সেটিকে ভুল করে কোনও সংখ্যা বলে ধরে নেওয়ার আশঙ্কা থাকে। হাতে লেখা চিহ্নের ক্ষেত্রে এমন বিভ্রান্তি স্বাভাবিক। কিন্তু, এ-ধরনের সমস্যা তো শূন্যচিহ্ন লিখলেও থাকে। কারণ, শূন্যচিহ্নের উপর দাগ পড়লে, ওটা শূন্যচিহ্ন কি না— তা নিয়েও সংশয় দেখা দিতে পারে।
প্রাক-আধুনিক কালে ভারতে খোপ কেটে সংখ্যাচিহ্ন লেখার প্রচলন ছিল— এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। অনেক সময় বলা হয়, চিনারা তাঁদের কাঠি সংখ্যাচিহ্ন (rod numerals) ব্যবহার করে প্রাচীন সংখ্যালিখন ও যোগ-বিয়োগ-গুণ ইত্যাদির জন্য এই ছক কাটার পদ্ধতি ব্যবহার করত। বিষয়টি আগ্রহোদ্দীপক, তবে কিছুটা জটিল ও তর্কসাপেক্ষ।[4] তাই, এ-নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রইল লেখার পরের ভাগে।
প্রসঙ্গত, চতুর্দশ শতক থেকে চিনে গণনার জন্য ‘সুয়ানপান’ (অ্যাবাকাস) নামে একটি গণনাযন্ত্র ব্যবহারের প্রচলন হয়।[5] সেখানেও পুঁতিগুলো এক, দশ, শত… এইভাবে সাজানো থাকত। পুঁতিগুলো ওপর-নীচ করে সংখ্যা প্রকাশ করা যেত; এমনকি যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করা যেত। ওস্তাদ ব্যবহারকারীরা বর্গমূল বা ঘনমূলও হিসাব করতে পারত।

মোদ্দা কথা, চিন ছাড়া এখনও পর্যন্ত গণনার ক্ষেত্রে স্থানিক মান বোঝাতে ছক কাটা ঘরের সারি ব্যবহারের প্রমাণ অন্য কোনও দেশের অতীতে মেলেনি।
অথচ, শূন্যচিহ্ন ব্যবহার না করলে খোপ কাটা বাঞ্ছনীয়, কারণ খোপ কাটা থাকলে স্থানিক মান বোঝানো সহজ ও নির্ভুল হয়। ধরুন, আপনি ‘কুড়ি হাজার পাঁচশো’ সংখ্যা কথায় না লিখে শুধু অঙ্কে লিখতে চান। তখন শুধু শয়ের ঘর আর দশ হাজারের ঘর ভরলেই হয়ে যাবে। অভ্যাস হয়ে গেলে ঘরের মানও আর আলাদা করে লিখতে হবে না।
এবার সব খোপ মুছে ফেলুন। দেখুন কী হয়:
২ ৫
সংখ্যাটি বোঝা যাচ্ছে কি? মাঝখানে ঠিক কটি ফাঁকা স্থান আছে? আর ৫-এর ডান পাশে কোনও ফাঁকা স্থান আছে কি? থাকলে কতগুলো?
খোপ কাটা ঘর ব্যবহার না করলে স্থানিক মান বোঝানোর দুটি ভালো উপায় রয়েছে। তার প্রথম পদ্ধতিটিও অবলম্বন করেছিল প্রাচীন চিনারা। পদ্ধতিটি সংক্ষেপে এইরকম:
প্রত্যেকটি ঘর বা স্থানের জন্য একটি স্বতন্ত্র চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছিল।[6] চিনারা ওই ঘরের সংক্ষিপ্ত সঙ্কেত হিসেবে চিনা হরফ ব্যবহার করত, কিন্তু আমরা বাংলায় করলে এভাবে লিখতে পারি—
একের ঘরের জন্য (এ), দশের ঘরের জন্য (দ), শত-র জন্য (শ), হাজারের জন্য (হা), দশ হাজারের জন্য (অ), লক্ষের জন্য (ল) ইত্যাদি। [এখানে দশ হাজারের জন্য (অ) লেখা হল, কারণ ‘অযুত’ শব্দটি দশ হাজারের সমার্থক।] এই পদ্ধতিতে ‘কুড়ি হাজার পাঁচশো’ এইভাবে লেখা হবে:
২(অ) ৫(শ)
অর্থাৎ, ২ অযুত ৫ শত। দিব্যি হয়ে গেল।
এবার, যদি এই সংখ্যার সঙ্গে তেরো যোগ করে ‘কুড়ি হাজার পাঁচশো তেরো’ লিখতে হয়, তাহলে লেখা যাবে:
২(অ) ৫(শ) ১(দ) ৩(এ)
এই হল প্রথম পদ্ধতির বঙ্গীয় রূপ। তবে এর রয়েছে দুটি সমস্যা। প্রথমত, সংখ্যাচিহ্ন ছাড়াও প্রত্যেকটি সংখ্যার জন্য স্থানের চিহ্ন আলাদাভাবে লিখতে হবে। অর্থাৎ খোপকে সরালেও, তার বদলে যোগ হল একগুচ্ছ বাড়তি চিহ্ন। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতি সরাসরি যোগ, বিয়োগ, গুণ বা ভাগ করতে সহায়ক নয়। এই কাজগুলোর জন্য অন্য উপায় খুঁজতে হয়।
এই কারণেই অপর এবং প্রশ্নাতীতভাবে উৎকৃষ্টতর পদ্ধতি হল, ফাঁকা স্থান বোঝাতে একটি স্বতন্ত্র চিহ্ন বসানো।
ঝ) চিহ্নরূপে শূন্য এল
অমন একটি চিহ্ন বসালেই খোপ কাটা ঘর কিংবা অন্য কোনও বাড়তি চিহ্নের আর প্রয়োজন পড়ে না। এই পদ্ধতিটিই প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয়রা সবচেয়ে সফলভাবে ব্যবহার করেছিল। তারা খোপ কাটেনি— আর সম্ভবত সেই কারণেই এই পথে এগোনো তাদের পক্ষে তুলনায় সহজ হয়েছিল।
শূন্যের চিহ্নটি যা-খুশি হতে পারত। ঘটনাচক্রে, প্রথমে হয়েছিল একটি বিন্দু, যা পরে ক্রমে গোলাকৃতি এক চিহ্নের রূপ নেয়। এই চিহ্ন ব্যবহারের ফলে উপরের সংখ্যাটি— কুড়ি হাজার পাঁচশো তেরো— লেখা হবে এইভাবে:
২০৫১৩
আর কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। তবু, এখানেও এক গুরুত্বপূর্ণ কথা থেকে যায়…
লক্ষ করুন, উপরের সংখ্যাটি লেখার ক্ষেত্রে দুটো গাণিতিক ক্রিয়া কাজ করছে— প্রথমে গুণ, তারপর যোগ। ২০৫১৩-র ক্ষেত্রে আমরা যা করছি, তা হল: ২ × ১০,০০০; ৫ × ১০০; ১ × ১০ এবং ৩ × ১; এবং এর পরে সবকিছু যোগ করছি। এখন লক্ষ করুন, যদি হাজারের ঘরে ০-র বদলে অন্য কোনও অঙ্ক থাকত, তাহলে তাকেও হাজারের সঙ্গে গুণ করতে হত। কিন্তু এখানে ০ রয়েছে— এবং আমরা কী করলাম?
এর দুটো উত্তর হতে পারে। প্রথমত, আমরা হাজারের ঘরে শূন্যচিহ্নটি আছে বলে সেই ঘরটি উপেক্ষা করছি। কিন্তু এমনটা হলে ০ চিহ্নটি আসলে সংখ্যার অংশ হয়ে উঠছে না— শুধুই একরকম ফাঁকা স্থানের নির্দেশক হয়ে থাকছে।
দ্বিতীয় একটি উত্তরও হতে পারে।
আমরা ০-কে উপেক্ষা করছি না। বরং, আমরা ধরে নিচ্ছি— শূন্য একটি সংখ্যা, এবং ওই চিহ্নটি তারই নির্দেশক। এই শূন্যের সঙ্গে কোনও সংখ্যাকে গুণ করলে ফল হয় শূন্য, এবং কোনও সংখ্যার সঙ্গে যোগ করলে সেই সংখ্যার মানের কোনও পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ, আমরা যেমন আগে দেখেছি: z + ০ = z এবং z × ০ = ০। এই যুক্তিতে, সংখ্যাচিহ্নের যে-স্থানেই শূন্য থাকুক, সেখানে আমরা স্থানিক মানের সঙ্গে শূন্য গুণ করে ফল পাই শূন্য, ফলে যোগফলে তার কোনও প্রভাব পড়ে না।
এইভাবে বিচার করলে, সংখ্যার প্রতিটি অঙ্কের মতোই ০-ও একটি যথার্থ সংখ্যার চিহ্ন হিসাবে নিজস্ব গুরুত্ব ও মর্যাদা পায়।
এই দ্বিতীয় উত্তরটা দেওয়ার অর্থ হল, গাণিতিকভাবে আমরা শূন্যকে একটি সংখ্যা হিসাবে মেনে নিচ্ছি। ফলে, শুধু যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের ক্ষেত্রে শূন্যচিহ্নকে স্বচ্ছন্দে ব্যবহারই নয়, সংখ্যাচিহ্ন লিখনের ক্ষেত্রেও শূন্যের নিজস্ব ধর্ম ও গুরুত্ব স্বীকৃতি পেল।
এই দ্বিতীয় উত্তরটি যে অন্তত কালক্রমে ভারতীয়রা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তার প্রমাণ— ওই গোলাকৃতি ‘০’-টিই কালক্রমে হয়ে উঠেছিল গাণিতিক ক্রিয়াকর্ম ও সংখ্যালিপিতে ব্যবহৃত শূন্য সংখ্যার চিহ্ন। ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত এই সংখ্যালিপি পরবর্তীকালে ইসলামিক সাংস্কৃতিক জগতের মাধ্যমে পশ্চিমে পৌঁছায় এবং সেখানেও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
ঞ) লিপিকৌশলের দেশভ্রমণ: ইসলামীয় সভ্যতা ও পশ্চিমি দুনিয়া
এ-নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ইউরোপীয়রা দশমিক স্থানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতি ও নির্দিষ্ট সংখ্যাচিহ্নের ব্যবহার পেয়েছিল ইসলামীয় সভ্যতার কাছ থেকেই। সম্ভবত এই ব্যবস্থার সঙ্গে তাদের প্রথম সত্যিকারের পরিচয় ঘটে পারসিক বংশোদ্ভূত দিক্পাল পণ্ডিত মুহাম্মদ ইব্ন মুসা আল-খোয়ারিজমি-র লেখা পাটীগণিত গ্রন্থের লাতিন অনুবাদের মাধ্যমে। অনুবাদটি হয়েছিল দ্বাদশ শতকে। তবে, সে-সময়ে অন্য মুসলিম পণ্ডিতরাও এ-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা করেছিলেন, এবং তাঁদের কিছুকিছু লেখা অনূদিতও হয়েছিল। এ-বিষয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনা বারান্তরে করা যাবে।
সম্ভবত প্রথম ইউরোপীয় গণিতবিদ যিনি এই পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে এর প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা নেন, তিনি হলেন ইতালির লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি (Leonardo Fibonacci)। তাঁর Liber Abaci গ্রন্থে এই পদ্ধতির ব্যাখ্যা ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও কার্যকরী।
তবে, ইউরোপীয়রা তাদের দশমিক লিপির সংখ্যাচিহ্নগুলো (1, 2, 3, 4, … ইত্যাদি) সরাসরি আরব বা পারসিক পণ্ডিতদের কাছ থেকে পায়নি। যতদূর বোঝা যায়, পেয়েছিল আর একটু হাত ঘুরে— স্পেনের মুর জাতিগোষ্ঠীর মাধ্যমে। এই মুরেরা ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরব ও উত্তর আফ্রিকার বার্বার (Berber) জনগোষ্ঠীর মানুষ। তারা যে দশমিক সংখ্যাচিহ্ন ব্যবহার করত, তা পরিচিত ছিল মাঘরেবি (Maghrebi) বা ঘুবার (Ghubar) চিহ্ন নামে। এই চিহ্নগুলি ইসলামীয় দুনিয়ার পূর্বাঞ্চল— অর্থাৎ মধ্য এশিয়া, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া বা আরবে ব্যবহৃত সংখ্যাচিহ্নের তুলনায় কিছুটা ভিন্নরকম ছিল।[7]
এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করা দরকার। মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা পেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপ (অর্থাৎ বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) পর্যন্ত বিস্তৃত ইসলামীয় সভ্যতা কেবল গ্রিক, ভারতীয় বা চিনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পশ্চিম ইউরোপে প্রবাহ ঘটানোর মাধ্যম হিসেবেই কাজ করেনি— তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করেছে। মধ্য এশিয়া, আরব, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া ও স্পেনের পণ্ডিতরা শুধু অনুবাদ করেননি, তাঁরা এসব অনূদিত রচনার উপর অসাধারণ টীকা ও ভাষ্য রচনা করেছিলেন, যা গ্রিক ও ভারতীয় জ্ঞানচর্চার বহু বিষয়ের উপর নতুন আলো ফেলেছে। তাঁরা গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন, যার অনেকটাই পরে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়ে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশ করে। তবে সব কিছুই সে সময়ে পৌঁছায়নি— অনেক কিছুই অনেক পরে আবিষ্কৃত হয়েছে।
ট) রচনার পরবর্তী ভাগে যা থাকতে পারে
ইতিহাসের ছোঁয়া থাকলেও, এই ভাগে মূলত জোর ছিল সংখ্যালিপি ও শূন্য নিয়ে বিশ্লেষণ-ঘেঁষা আলোচনার উপর। ফলে ইতিহাসসংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখানকার পরিসরে আসেনি। পরবর্তী ভাগে হয়তো ইতিহাসের গল্পগাছা বেশি থাকবে— অন্যান্য দেশের সংখ্যালিপির রূপ, ভারতীয় সংখ্যালিপির বিবর্তনের কিছু খোঁজ, সেই সংখ্যালিপিতে শূন্যের আবির্ভাব ঠিক কবে এবং কীভাবে ঘটেছিল, ভারতীয়রা এই বিষয়ে অন্য কারও থেকে কিছু শিখেছিলেন কি না, এ-সম্পর্কে প্রামাণ্য সূত্র ও অনুমানের ভিত্তি কী, শূন্য নামক সংখ্যাকে ঘিরে ভারতীয় গণিতবিদরা কেন এত আগ্রহী হলেন এবং কী ভাবনাচিন্তা করেছিলেন— এসব বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনার চেষ্টা করব।
তবে, পরবর্তী ভাগেও সব কিছু ধরা যাবে কি না, বলা কঠিন। দেখা যাক।
নির্বাচিত সূত্রপঞ্জি:
- Chrisomalis, Stephen. Numerical Notation: A Comparative History. Cambridge: Cambridge University Press. 2010.
- Crossley, John N. and Henry, Alan S. “Thus spake Al-Khwarizmi: A Translation of the Text of Cambridge University Library MS Ii.vi.5”. Historia Mathematica, Vol. 17, Issue 2. May, 1990. Pages 103-131.
- Katz, Victor (ed.). The Mathematics of Egypt, Mesopotamia, China, India, and Islam: A Sourcebook. Princeton: Princeton University Press. 2007.
- Sigler, Laurence. Fibonacci’s Liber Abaci: A Translation into Modern English of Leonardo Pisano’s Book of Calculation. Edited by Gerald D. Toomer. New York: Springer, 2002.
- Ramasubramanian, K. (ed.). Gaṇitānanda: Selected Works of Radha Charan Gupta on History of Mathematics. Singapore: Springer, Ebook. 2019.
- Volkov, Alexei and Freiman, Viktor (eds.). Computations and Computing Devices in Mathematics Education Before the Advent of Electronic Calculators. Springer, Ebook, 2018. Vol. 11 of Mathematics Education in the Digital Era Series, Springer.
[1] অবশ্য ভাগ করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। সে-প্রসঙ্গ একটু পরেই আসবে।
[2] এখন অনেকসময় ‘নিযুত’ লেখা হয়। কিন্তু প্রাচীনকালে অনেকক্ষেত্রেই ‘নিযুত’ শব্দটিকে লক্ষ বা একশো হাজার অর্থে ব্যবহার করা হত এবং দশ লক্ষকে ‘প্রযুত’ বলা হত। যেমন শুক্ল যজুর্বেদীয় বাজসেনীয় সংহিতাতে। তবে আবার অন্য কয়েকটি ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রগ্রন্থে ‘নিযুত’ শব্দকে দশ লক্ষ অর্থেও ব্যবহার করা হয়েছে। বৌদ্ধ দার্শনিক বসুবন্ধু তাঁর অভিধর্মকোষকারিকা-তে powers of ten-এর একটি বড় তালিকা দিয়েছেন। সেখানে আবার একশো হাজার-কে ‘লক্ষ’ এবং দশ লক্ষকে ‘অতিলক্ষ’ বলা হয়েছে। এ-প্রসঙ্গে দেখুন, Gupta, R.C. “World’s Longest Lists of Decuple Terms”. in K. Ramasubramanian (ed.), Gaṇitānanda: Selected Works of Radha Charan Gupta on History of Mathematics. Singapore: Springer. Ebook, 2019. pp. 109-115.
[3] আগের টীকাটি দেখুন। কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে পরিভাষার ক্ষেত্রে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সমতা থাকা ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় ধারার মধ্যেও মুশকিল ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধারা এবং লোকব্যবহারে আরও অন্যরকম নানা পরিভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তারই মধ্যে, ভারতের নানা অঞ্চলের মধ্যে যতটা পারিভাষিক সমতা নজরে পড়ে, তা উল্লেখযোগ্য।
[4] দেখুন— Volkov, Alexei. “Chinese Counting Rods: Their History, Arithmetic Operations, and Didactic Repercussions,” in Alexei Volkov and Viktor Freiman (eds.), Computations and Computing Devices in Mathematics Education Before the Advent of Electronic Calculators. Springer, Ebook. 2018, pp. 137-88.
[5] অন্য অনেক অঞ্চলে আরও অনেক আগে থেকে অ্যাবাকাসের ব্যবহার ছিল, যেমন মেসোপোটেমিয়া, গ্রিস, ও রোমান সাম্রাজ্য।
[6] Dauben, Joesph W. “Chinese Mathematics,” in Victor Katz (ed.), The Mathematics of Egypt, Mesopotamia, China, India, and Islam: A Sourcebook. Princeton: Princeton University Press. 2007. pp. 189-91.
[7] বিস্তারিত আলোচনা নানা জায়গায় রয়েছে। অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ আলোচনা জন্য দেখুন— Chrisomalis, Stephen. Numerical Notation: A Comparative History. Cambridge: Cambridge University Press. 2010. pp. 216-19.
আমার জানার ইচ্ছে বহুগুন বেড়ে গেল। পরবর্তী আলোচনার অপেক্ষায় রইলাম।
পাঠকের সুবিধার্থে লেখক প্রাঞ্জল ভাবে অঙ্কের মার প্যাঁচ তুলে ধরেছেন। পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।