
অংশুমান দাশ
অনেক ছোট কাজের একসঙ্গে আসা জরুরি— ছোট কাজগুলো একলা একলা বড় হয়ে ওঠার চেয়ে। যখন আমরা বিকল্প কাজগুলোর প্রচার ও প্রসার করি, যতই ভালো উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, সেখানে যদি মতবাদ ছড়িয়ে যাওয়ার বদলে কোনও একজনের প্রচার বেশি হয়, তাহলে কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। কর্পোরেট ফান্ডে করা মেলা, বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়া মেলা, ফ্লেক্সে মুড়ে দেওয়া মেলা, বৈভবের প্রচারমুখী মেলা— আজকাল ‘বিকল্প’ হিসাবেও এই একই মডেল চলে। এইসবের বাইরে, যখন সকলের আর্থিক ও কায়িক অংশগ্রহণে কিছু গড়ে ওঠে, তা এই একরৈখিক স্কেলের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে
পাহাড়ে নানা সমস্যা। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় তার দুর্গমতা। ইস্কুল, কাছারি, চিঠিপত্রের আদানপ্রদান, হাসপাতাল— সবই বড় দূরে দূরে। আমি যদি সবজি বেচতে চাই, তা-ও সেই মাথায় করে নিয়ে পায়ে হেঁটে বাজারে পৌঁছতে হয়। আমার যদি একটা মুদিখানার দোকান থাকে, তবে বাজার থেকে তার কাঁচামাল আনতে গিয়েই দম বেরিয়ে যায়। এই ধরো, টুকটাক হলুদগুঁড়ো, ধনেগুঁড়ো, সাবান, তেল— এই সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্যও থাকতে হয় অপেক্ষায়। দামেরও কোনও হদিস নেই। দুর্গমতার মূল্য একেবারে পাইপয়সায় মিটিয়ে নেয় বাজার।
রাজমহল পাহাড়ের মাথায় থাকে পাহাড়িয়ারা। সপ্তাহে একদিন ঘোড়ার পিঠে বোঝা চাপিয়ে নিচ থেকে সওদাগর ওঠে নুন, সাবান, মশলা নিয়ে। এক কেজি নুনের বদলে নেয় এক কেজি পাহাড়ে ফলানো দেশি বরবটি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন কাঁদি কাঁদি কলা পাকতে থাকে, তখন সে কলা আর এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের হাটে-বাজারে নিয়ে যাওয়া যায় না। এক গ্রামের মানুষ আর কত খাবে! একই অবস্থা নেপালেও। এক পাহাড় ঘুরে আরেক পাহাড় পেরোতে পেরোতে সূর্য যায় ডুবে।
কিন্তু এই দুর্গমতার কি কোনও সুবিধা নেই? আছে তো। সেই সুবিধা রয়েছে তার স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারার সম্ভাবনায়।
উত্তরাখণ্ডের রানীক্ষেত জেলার চার-পাঁচটা গ্রাম-পিছু বসানো গেল এরকম একটি করে শস্য গুঁড়ো করার মেশিন— বেশ কয়েকটি। লঙ্কা, হলুদ, আদা, ডাল, আটা— সব গুঁড়ো করে নেওয়া যায় বাড়ির একটি ঘরে বসানো মেশিনেই। ফলে ওই সব গ্রামে বাজারের বড় মুনাফাখোরদের এই সব জিনিস আসা বন্ধ হয়েছে। এমনকি এবারে দেখি আদা, পেঁয়াজপাতা, রসুনপাতা— একসঙ্গে শুকিয়ে গুঁড়ো করে নতুন ধরনের মশলাও বানিয়ে ফেলেছেন একজন। উৎপাদক-প্রক্রিয়াকারক-ক্রেতা যখন একই জায়গায়, তখন মহার্ঘ্য ব্র্যান্ডের দরকার কী? কী দরকার প্রাতিষ্ঠানিক বাজারের?
বাজারের দরকার অবশ্য আছে পাহাড়েও। কারণ, বাজার তো আর শুধু বিকিকিনির জায়গা নয়— তা এক সামাজিক অন্তরঙ্গতার জায়গাও বটে। সপ্তাহে একবার চুলে তেল দিয়ে, মুখে পান গুঁজে বাজারে গিয়ে যত না বিক্রি হয়, তার চেয়ে বেশি হয় খবরের আদানপ্রদান, গল্পগাছা। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়িতে তাই হল এরকম বাজারের ছাউনি, বেশ কিছু। রোদে-বৃষ্টিতে নয় আর। একটু-আধটু কলা, মুলো, আলু, হাঁসের ডিম এনে বসা গেল। উদ্বৃত্ত যা কিছু, ফড়েরা কিনতে এল এই বাজারে। এখন যেহেতু সব উৎপাদকরা একসঙ্গে এই বাজারে, এখানে ওজনযন্ত্র আছে, আছে একসঙ্গে অনেকখানি ফসল— ফড়েরা আর ঠকাতে পারল না। ঠকাতে চাইলেও উৎপাদকরা সব এখন বাজারের ছাউনির তলায় একসঙ্গে, তারা রে রে করে ওঠে। এমন বাজার-ছাউনি গড়ে উঠল সীমান্তের এপারে উত্তরাখণ্ডেও।
দুর্গমতার কারণে পাহাড়ে মানুষের স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার চাহিদা সমতলের চেয়ে বেশি। সমতলে যেহেতু ফেলো কড়ি, মাখো তেল-এর অভ্যাস বেশি, তাই স্বয়ম্ভর হওয়ার ইচ্ছাও বোধহয় খানিকটা কম। এখান থেকে ওখান থেকে খাবার আমদানি-রপ্তানির কার্বন ফুটপ্রিন্টের ঠেলায় যখন পৃথিবীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন খাদ্যে স্বনির্ভর গ্রামগুচ্ছই আদর্শ। আর আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এই রাস্তায় পাহাড় ও তার মানুষজন অনেক এগিয়ে আছেন।
এই ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ ব্যাপারটিকে আর একটু তাত্ত্বিক রূপ দেওয়া যাক।
তুলো থেকে জামা তৈরি করা, সরষে থেকে তেল তৈরি করা, হলুদ থেকে গুঁড়ো হলুদ করা— কাঁচামালে এই সব মূল্য যোগের কাজগুলি হয় গ্রামের বাইরে। অর্থাৎ, উৎপাদক কেবল এই উৎপাদিত জিনিসের দাম বাড়ার প্রক্রিয়ায় কাঁচামালের জোগানদাতা, অংশগ্রাহী নন। সুতরাং জিনিসের আসল মূল্য তৈরি হচ্ছে গ্রামের বাইরে। ধান গ্রামে উৎপাদিত হল, কৃষক তা বেচে দিলেন ১৫ টাকায়। ধান চলে গেল মফস্বলের চালকলে। সেখান থেকে চাল বিক্রি হল ৩০ টাকায়। চাল চলে গেল বাজারে, চলে গেল মুড়ি-চিঁড়ে তৈরির কারখানায়— আরও দাম বাড়ল। উৎপাদকের কিন্তু রইল সেই ১৫ টাকাই। ওই চাল-মুড়ি-চিঁড়ে আবার সেই গ্রামেই ফিরে এল— কৃষক আবার সেই ১৫ টাকা থেকেই তা কিনে খেলেন। আবার, কাঁচামাল যখন বাইরে গেল, তখন ঝাড়াই-বাছাই-পেষাই-গুঁড়ো করার ফলে যে বাইপ্রোডাক্ট বেরোল, তাও আর গ্রামে ফিরে এল না। অর্থাৎ, গ্রামের মাটি থেকে জল আর পুষ্টি বাইরে বেরিয়ে গেল— গ্রামের মাটি ধীরে ধীরে অপুষ্ট হতে শুরু করল।
খাবারের আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে এই যে মাটির পুষ্টির যোগ, জলের যোগ— এটা যতক্ষণ না বুঝতে পারছি, ততক্ষণ “হা পরিবেশ, হো পরিবেশ” করে চেঁচামেচিতে কেবল উপরের মাটি আঁচড়ানোই হবে, সোনার খনির খোঁজ পাব না।
যে-ধরনের ছোট মেশিন উত্তরাখণ্ডে বসানো হয়েছে, তা এই আর্থিক ও পৌষ্টিক অপচয় রোধের পথ। উৎপাদন তো স্থানীয় মানুষ কিনছেনই; তার চেয়েও জরুরি ভুসি, খোসা, জল সব আবার ওই মাটিতেই ফিরে আসছে। স্থানীয় বিক্রিতে প্লাস্টিক প্যাকেজিং-এরও তেমন প্রয়োজন পড়ছে না। পাহাড়ের এই ধারণা ঝাড়খণ্ডের রাজনগর, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পঞ্জাব ও রাজস্থানের কিছু অঞ্চলে করা গেছে। মেশিন সেখানে বড় হলেও সমস্যা তার সঙ্গে সমানুপাতেই বেড়েছে। পাহাড় যত সহজে এই জিনিস মেনে নিচ্ছে, সমতল বোধহয় অপশন বেশি হওয়ার কারণে অত সহজে মেনে নিচ্ছে না। তবুও স্থানীয় খাদ্যব্যবস্থা ফিরিয়ে আনায়, কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে এই গ্রামীণ প্রসেসিং সেন্টারের জুড়ি নেই। এখন এখানে লগ্নি করা পুঁজিতে স্থানীয় মানুষের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে মন দিয়ে।
মোদ্দা যে প্রশ্নটি তুলতে চাইছি, তা হল— খাবার উৎপাদন ও বণ্টন স্থানীয়ভাবে করলে কেমন হয়? একটা গোডা হিসেবে একটা পঞ্চায়েত বা ব্লকের মোট জমিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে চাহিদা অনুযায়ী ফসল উৎপাদন ও বণ্টন করা যায় না? আমাদের বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে, কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। গোডাউনগুলোকেও যদি আরও স্থানীয় করে ফেলা হয়, কেনা-বেচা সবটাই? একদম নীচের স্তরে পরিকল্পনার জন্য গ্রাম সংসদ আছে, পরিকল্পনাও হয়— কিন্তু সেগুলো সবই জেলা ও রাজ্যের দেওয়া পরিকল্পনার ফর্ম ভর্তি করার মতো, মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নয়। স্থানীয় স্তরে পরিকল্পনাও আমার এই প্রস্তাবেরই অংশ। এর সঙ্গে জুড়ে আছে স্থানীয় খাবারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টিও। এই যে বাজার বলে দিচ্ছে, কোনটা আমার খাবার, কোনটা আমার ফসল— এই শিকল থেকেও বেরিয়ে আসা যাবে। বেরিয়ে আসা যাবে পৃথিবীব্যাপী ধান, গম, ভুট্টাচাষের দাসত্ব থেকে। সেই সঙ্গে স্থানীয় ভিত্তিতে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে শক্তি ও জলের মান ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও স্থানীয় সরকারেরই থাকবে। সুতরাং দিল্লির পার্লামেন্ট বড় না করে, পঞ্চায়েতের পুনর্নির্মাণে মন দেওয়া বেশি জরুরি। দেশের ধীমান সরকারি অফিসারদের পাঠানো দরকার আরও তৃণমূল স্তরে, কেন্দ্রে নয়।
প্রশ্ন— শহরাঞ্চলে কী হবে, যেখানে উৎপাদনের সুযোগ নেই?
পরিকল্পনামাফিক করলে নিজেদের চাহিদার বাইরেও উদ্বৃত্ত হবে না বলে মনে হয় না। সেখানে কিছু শহরকে দত্তক নেবে কাছাকাছি কিছু উৎপাদক অঞ্চল। এতে মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্য জ্বালানি খরচ কমে আসবে কারণ খাবারের ধরন ও পরিবহনব্যবস্থা বদলে যাবে। খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি যে পরিবেশবান্ধব হতেই হবে, সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না আর। তাই জমির চাহিদা ও জমির উপর চাপও কমে আসবে।
পরিবেশ ট্যাক্স, অর্থাৎ দূষণ করলে (বা এমন খাবার খেলে, কাপড় পরলে— যা পরিবেশবান্ধব নয়) যে ট্যাক্স দিতে হবে, সেই ট্যাক্স থেকে পরিবেশবান্ধব উৎপাদকের জন্য সরাসরি ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কৃষককে ভর্তুকির নামে আসলে সার কোম্পানিকে দেওয়া ছদ্ম ভর্তুকির এই বর্তমান ব্যবসাটি ছুড়ে ফেলা দরকার। ভাবতে পারলে অনেক কিছুর প্রয়োজনও ধীরে ধীরে কমে আসবে, উৎপাদনের পরিমাণও কমিয়ে ফেলা যাবে— কারণ প্রয়োজনের বাইরের খাবার ও পণ্য তৈরি করার দরকার হবে না আর।
প্রাথমিক উৎপাদনের বাইরে কী রইল? আর সব শিল্প। প্রতিটির মধ্যে প্রযুক্তিগত টানাপোড়েন রয়েছে— হাতে চালানো তাঁতের চেয়ে মেশিন-তাঁত দ্রুত কাজ করে। জুতো, কাগজ, বাসনপত্র অনেক দ্রুত ও নিখুঁত করা যায় কারখানায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় এইসব জিনিস ছাড়া— ডাক্তারি জিনিসপত্র, গাড়ি, ফ্রিজ, টেলিভিশন— ইত্যাদিগুলি বড় কারখানাতেই হবে— এ-ব্যাপারে দ্বিমত নেই। তবে এই কারখানাগুলিরও আরও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে আসা দরকার, এবং উৎপাদনের একটা ঊর্ধ্বমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া দরকার, না হলে কারও কারও মুনাফা বাড়তে থাকবে অনির্দিষ্টভাবে। সেখান থেকে আসবে একচেটিয়া আগ্রাসন। ঊর্ধ্বমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে যদি নীচের স্তরে কারিগরি দক্ষতা বাড়ানো যায়, তবে বড় কারখানার উপর চাপও কমবে। হয়তো একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির রোজগার কমবে, কিন্তু দেশের সার্বিক রোজগার এতে কমবে না, বরং বৈষম্য কমবে। প্রযুক্তিগত উন্নতি হলে কিছু শৈল্পিক পদ্ধতি হারিয়ে যাবেই, অথবা তার উন্নতিসাধন হবে— কিছু করার নেই। যেমন আমরা আর হাড়ের ছুঁচ কী করে বানাতে হয় জানি না, আর শিখতেও চাই না।
এখানে বাজারচলতি যে-ধারণাটাকে প্রতিরোধ করতে চাইছি, তা হল স্কেলের ধারণা। বাজার বিশ্বাস করে স্কেলে— সরকারও। কারণ একটা বিশাল স্কেলে একরৈখিকভাবে ঘটনাগুলো ঘটলে তাতে মুনাফা বেশি, তা ম্যানেজ করায় সুবিধা। কিন্তু এই ‘স্কেল’ বৈচিত্র্যের ধারণার বিপরীত, মানুষের অংশগ্রহণের পরিপন্থী। তাই সবাইকে একইরকম খেতে হবে, একইরকম পরতে হবে— এইরকম একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে। হাল আমলে বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থার বাজার দখল পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটার চালচিত্রই বদলে দিয়েছে। এসেছে এক নতুন জমানা। সারা পৃথিবীতে ব্যবসার শিকড় ছড়িয়ে একদিকে যেমন ছোটখাটো সমস্ত ব্যবসা গিলে ফেলছে, অন্যদিকে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া শুরু হয়েছে যে ‘উন্নত’ দেশের যাপনটাই সঠিক। এবং এই তো তোমার পাশের শপিং মলেই পাওয়া যাচ্ছে নাম করা সব ব্র্যান্ড— কীসের অপেক্ষা? একচেটিয়া মালিকানার সঙ্গে এই ব্যবসাগুলি সরকারি মদতে দেশে দেশে কারখানাও খুলছে, যাতে বাজার আর উৎপাদনের দূরত্ব কমিয়ে এনে মুনাফা বাড়ানো যায়। আপনি ভাববেন ভালোই তো— দেশে চাকরি তৈরি হচ্ছে, কিন্তু আসলে দেশজ শিল্পের বারোটা বাজছে। মুনাফার কেন্দ্র আরও ঘন হচ্ছে, কারণ বহুজাতিক সংস্থারা মুনাফা কিন্তু নিয়ে যাচ্ছে আসলে নিজের ঘরেই। এ-জন্যেই একইরকম বিজ্ঞাপনের রমরমা দরকার পৃথিবীজুড়ে যাতে মনে হয়— ওই পানীয়টা না খেলে আমার জীবনই বৃথা!
স্কেলের এই একরৈখিক ধারণার বিপরীতে আমাদের স্থানীয় উৎপাদন ও বাজারের ধারণা। বড় স্কেলে না গেলে কোনও ধারণাকেই গতি দেওয়া যায় না, কিন্তু বড় স্কেলে পৌঁছানোর একটা রাস্তা হল অনেক ছোট ছোট কাজকে একসঙ্গে জুড়ে একটি ‘বড়’ তৈরি করা— যেমন একটি ফানেলের মধ্যে দিয়ে নানা জিনিস একসঙ্গে ঢাললে সব এক হয়ে এক জায়গায় গিয়ে পড়ে।
অনেক ছোট কাজের একসঙ্গে আসা জরুরি— ছোট কাজগুলো একলা একলা বড় হয়ে ওঠার চেয়ে। এমনকি শহরেও। যখন আমরা বিকল্প কাজগুলোর প্রচার ও প্রসার করি, যতই ভালো উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, সেখানে যদি মতবাদ ছড়িয়ে যাওয়ার বদলে কোনও একজনের প্রচার বেশি হয়, তাহলে কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। কর্পোরেট ফান্ডে করা মেলা, বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়া মেলা, ফ্লেক্সে মুড়ে দেওয়া মেলা, বৈভবের প্রচারমুখী মেলা— আজকাল ‘বিকল্প’ হিসাবেও এই একই মডেল চলে।
এইসবের বাইরে, যখন সকলের আর্থিক ও কায়িক অংশগ্রহণে কিছু গড়ে উঠছে, তা একরৈখিক স্কেলের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। কলকাতায় ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’ নামে এমন একটি পরিসর গড়ে উঠেছে যেখানে কোনও বিজ্ঞাপন নেই, ফান্ড নেই, প্যান্ডেল নেই, ফ্লেক্স নেই— অথচ মেলামেশা আছে, বৈচিত্র্য আছে, এবং সবটাই একটা কাঙ্ক্ষিত স্কেলে। সবাই নিজের সাধ্য অনুযায়ী অর্থ ও শ্রম দিচ্ছেন, মুনাফাটুকুও নিজের মতো বুঝে নিচ্ছেন— এটা কোনও একক খাতে গিয়ে পড়ছে না। এই ধারণাটাই ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন। ছড়ানোটাই আসল স্কেল, তাকে কুক্ষিগত করে রাখা নয়।
এই সব ছোটখাটো কাজের মধ্যে দিয়ে মূলত তিনটি বড় ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছি—
১) আমরা পৃথিবীর সম্পদের ওপর নির্ভর করে অনন্ত উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারব,
২) পুঁজি বাড়ার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই,
৩) জাতীয় অর্থনীতির পরিমাণগত সম্প্রসারণের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা, যাকে গোদা বাংলায় জিডিপি বলে।
এই সব কাজ— উৎপাদন ও উৎপাদকদের এক জায়গায় করা, স্থানীয় খাদ্যব্যবস্থা ও স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষদের এক জায়গায় করা, বাজার ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকে স্থানীয় স্তরে নামিয়ে আনা,
তাদের জ্ঞান ও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানকে এক জায়গায় এনে মেলানো— সব কিছু করতে হবে একসঙ্গে, এক জায়গায়।
এই বাজি লড়তে রাজি কে কে?