সাতচল্লিশের পর থেকেই আদিবাসী গণহত্যাগুলি পুঁজিবাদের স্বার্থপূরক

অরূপকুমার দাস

 


শুধু বস্তারের ১৯৬১ ও ১৯৬৬ সালের মারিয়া-মুরিয়া আদিবাসী দেশজ জনজাতির ওপর নৃশংস গণহত্যার ইতিহাস নয়— ১ জানুয়ারি ১৯৪৮ উড়িষ্যার খারসাওয়ান বাজারমাঠে ওড়িশা মিলিটারি পুলিশের দ্বারা শতাধিক আদিবাসী হত্যা, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬০-এ বর্তমান নাগাল্যান্ড রাজ্যের ফেক জেলার মাটিত্থ্রু গ্রামে সেনাবাহিনীর হাতে ৯ জন আদিবাসী হত্যা, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ বিহারের গয়ার হাসপাতালে ১১ জন আদিবাসী মানুষের সামরিক পুলিশের হাতে নিহত হওয়া, ১৯৯৪-এর ২৭ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডের মোকোকচুং-এ সেনা ও আধাসেনার যৌথ অভিযানে ১২ জন নাগা নিহত হওয়া, ৫ মার্চ ১৯৯৫ নাগাল্যান্ডের কোহিমায় সেনাদের নিজেদের কনভয়ের গাড়ির টায়ার ফাটার আওয়াজকে বোমা-হামলার ভ্রমে ৭ জন নিরীহ নাগা আদিবাসীকে গুলি করে মারা— এই ঘটনাগুলোর সংঘটনের কার্যকারণে আপাত-ভিন্নতা থাকলেও, শাসকশ্রেণির ‘দৃষ্টিভঙ্গি’-র সমস্যাই মূল; সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসংশয়ে শ্রেণি-উৎপত্তিজনিত ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা নির্ধারিত

 

বিহার ক্যাডারের আইএএস অফিসার সুধাংশুকুমার চক্রবর্তী তাঁর দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার নির্যাসে আদিবাসী সমাজের জীবন ও সংগ্রামকে ঘিরে একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস রচনা করেন— অরণ্যকন্যা[1], যা ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘চন্দ্রহার ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স’ নামক ছোটনাগপুর অঞ্চলের একটি বৃহৎ বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যা সম্প্রসারণের জন্য সাঁওতাল আদিবাসীদের কয়েকটি পুনর্বাসিত গ্রাম উচ্ছেদের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই উচ্ছেদের পেছনে ছিল সরকারি প্রশাসনের একতরফা, নির্মম সক্রিয়তা।

এই প্রেক্ষাপটে উঠে আসে মিস্টার চৌধুরী নামের একজন প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি প্রশাসন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার পর এক অনাড়ম্বর, মানবিক জীবন যাপন করছিলেন। তিনি আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ান আন্তরিকতার সঙ্গে, তাঁদের আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে সহায়তা করতে থাকেন। কিন্তু উপন্যাসের অন্তিম পর্বে দেখা যায়, এই প্রতিরোধ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও কর্পোরেট শক্তির এক যৌথ অভিযানে নির্মমভাবে দমন করা হয়। বিপুল সংখ্যক পুলিশবাহিনী এনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় সতেরোজন আদিবাসীকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাতজন নারী, এবং নেত্রী পিয়ারী কিস্কুও।

ঘটনার নির্মমতাকে ঘনীভূত করে তোলে রাজ্য পুলিশের ডেপুটি কমিশনার মিস্টার পুরীর ওয়াকিটকি বার্তা—

Please relay message to Special Cell — Special Cell inform Chief Secretary/Commissioner: eighteen rounds fired to disperse violent armed Adivasi mob. Seventeen killed, seven women including ringleader Piyari Kisku. Dead bodies being sent for postmortem.

(মেসেজ স্পেশাল সেল থেকে রিলে করুন— চিফ সেক্রেটারি ও কমিশনারকে জানানো হোক, সশস্ত্র দাঙ্গাকারী সাঁওতালদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ আঠারো রাউন্ড গুলি চালায়। সতেরোজন নিহত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সাতজন মহিলা রয়েছেন, এবং তাঁদের মধ্যে অন্যতম দাঙ্গাকারীদের নেত্রী পিয়ারী কিস্কু। মৃতদেহগুলি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।)

উপন্যাসে বর্ণিত চন্দ্রহার অঞ্চলের গণহত্যার চেয়েও আরও নিষ্ঠুর, নৃশংস ও বর্বর এক আদিবাসী নিধনের ঘটনা ঘটেছিল মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলায়— দুই দফায়, একই মারিয়া-মুরিয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। প্রথমটি ঘটে ১৯৬১ সালের ৩১ মার্চ এবং দ্বিতীয়টি ১৯৬৬ সালের ২৫ মার্চ। এই দুটি গণহত্যার প্রত্যক্ষ বাস্তবায়নের পেছনে ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ— প্রথমবার জওহরলাল নেহরু এবং দ্বিতীয়বার তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল বস্তারের আদিবাসীদের আশ্রয় ও আস্থার কেন্দ্র, রাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেও-কে সরিয়ে দিয়ে এই অঞ্চলের মাটির নীচে থাকা বিপুল খনিজসম্পদকে দেশি শিল্পপতিদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য লুটের ক্ষেত্র করে তোলা। ১৯৬১-র হত্যাযজ্ঞে বারোজন আদিবাসী নিহত হওয়ার পরও যখন দেখা গেল আদিবাসী সমাজ আরও বেশি সংগঠিত হয়ে উঠছে, তখন সরকার কিছুদিনের জন্য পশ্চাদপসরণ করে। কিন্তু পাঁচ বছর পরে, ১৯৬৬ সালে, রাজা ভঞ্জদেও-কে তাঁর অনুগত আদিবাসী জনগণের সঙ্গেই হত্যা করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন পরিবারতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা এক নির্মম বার্তা দেয়— রাষ্ট্র এখন বহুজাতিক পুঁজি ও দেশি শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষার এক বিশ্বস্ত যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

বস্তার ছিল মাটির নীচে লুকোনো অগাধ খনিজসম্পদের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার— যার লোভ সামলাতে পারেননি দেশীয় পুঁজিপতিদের শীর্ষমহল। এই আকর্ষণের মাত্রা বোঝা যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের দপ্তরের তৎকালীন সচিব ভিপি মেননের আত্মকথনাত্মক গ্রন্থ The Story of the Integration of the Indian States-এ উল্লিখিত বক্তব্য থেকে।

সেখানে তিনি লিখছেন—

Bastar was also giving us cause for concern. This state had prolonged spells of minority administration… Immediately before the transfer of power reports were rife that the rich mineral resources of this state were about to be mortgaged to Hyderabad by means of long lease which if true would have been very much prejudice of India… Sardar told him that he would not allow the interests of the people to be bastered away in this manner.

এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে যায়, বস্তারের খনিজসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কায় শেষ-ব্রিটিশ যুগে ও স্বাধীনতার প্রাক্কালে কীভাবে কেন্দ্রীয় প্রশাসন চিন্তিত ছিল। হায়দরাবাদ রেসিডেন্সি ওই সম্পদকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা চুক্তিতে পেতে আগ্রহী ছিল, এবং ব্রিটিশ ‘পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্ট’-ও তা দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য উদগ্রীব ছিল। কিন্তু বল্লভভাই প্যাটেল ও মেনন যৌথভাবে এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন এবং স্পষ্ট জানান— জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সম্পদের লুণ্ঠন হতে দেবেন না।

তবে ইতিহাস দেখায়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ঠিক এই জনগণের স্বার্থকেই উপেক্ষা করে আদিবাসীদের জীবনজীবিকাকে বিপন্ন করে সেই লোভনীয় খনিজসম্পদ পুঁজির অধীন করবার প্রক্রিয়া শুরু হয়— যার অন্যতম নির্মম অধ্যায় ছিল প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেও ও তাঁর জনগণের ওপর সংগঠিত রাষ্ট্রীয় সহিংসতা।

ভিপি মেননের বর্ণনায় আরও স্পষ্ট হয়— ক্ষমতা হস্তান্তরের ঠিক আগেই তরুণ ও প্রশাসনিকভাবে অনভিজ্ঞ মহারাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেওকে যখন সম্পূর্ণ শাসনক্ষমতা প্রদান করা হয়, তখন হায়দরাবাদের প্রতিনিধিরা তাঁকে প্রভাবিত করে বস্তারের খনিজসম্পদ লাভের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এই পরিস্থিতিতে বল্লভভাই প্যাটেল মহারাজাকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান এবং সতর্ক করে দেন— তিনি যেন এই মূল্যবান সম্পদ ‘বেপরোয়াভাবে’ বিলিয়ে না দেন, কারণ ভারত সরকারের পক্ষে তা অত্যন্ত গুরুতর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে।

মেনন উল্লেখ করেন, তাঁদের আশঙ্কা ও সন্দেহের সত্যতা উঠে আসে এক ব্রিটিশ রাজনৈতিক আধিকারিকের পূর্বাভাস থেকে, যিনি বস্তার সংলগ্ন অঞ্চলের পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। ওই আধিকারিক তাঁর চিঠিতে লেখেন—

From the Hyderabad border to Bailadila iron ore areas, it is hardly 100 miles… the local Marias can be easily tempted by plenty of drink and tobacco… Hyderabad… may… encourage infiltration… to carve a slice out of Bastar… inhabited by plastic aboriginals and administered by rulers and their officers whose loyalty to Indian Government is yet to be tested.

এই বিবৃতির মাধ্যমে একদিকে যেমন বস্তারের খনিজসম্পদের প্রতি শাসকশ্রেণির আগ্রহ ও উদ্বেগ ফুটে ওঠে, অন্যদিকে তার চেয়েও গভীরতর হয়ে ধরা পড়ে ব্রিটিশ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রচিন্তার অভ্যন্তরীণ বর্ণবাদ। এখানকার আদিবাসীদের ‘plastic aboriginals’ বলে চিহ্নিত করা তাঁদের প্রতি চরম অবিশ্বাস, অবজ্ঞা ও বস্তারভূমির ওপর একরকম রক্ষাকর্তার অধিকার দাবি করার মানসিকতার ইঙ্গিত দেয়।

মাত্র আঠারো বছর বয়সে মারিয়া-মুরিয়া আদিবাসীদের বস্তার রাজ্যের রাজা হয়েছিলেন প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেও। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই অন্যান্য ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্যের মতো বস্তারকেও অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয় ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে। ১৯৪৭ থেকে শুরু করে ১৯৬৬-র সেই রক্তাক্ত দিন পর্যন্ত, যখন তাঁকে তাঁর প্রজাদের সঙ্গেই হত্যা করা হয়, প্রবীরচন্দ্রকে নানা কৌশলে বিপর্যস্ত ও নিঃস্ব করে ফেলা হয়। এই দীর্ঘ সময়কালের রাষ্ট্রীয় অনাচারের সবিস্তারে বিশ্লেষণে না গিয়ে, ইতিহাসকার তরুণ কুমার ভাদুড়ির বয়ানে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত স্পর্শ করেই সেই নির্মমতার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর ভাষায়—

…স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের মতো বস্তারের নামও স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ভারতবর্ষের ম্যাপ থেকে মুছে গেল। বস্তার হল মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা। … একদিন মধ্যপ্রদেশ গভর্নমেন্ট হিজ হাইনেস প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেও-এর সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাতে সঁপে দিলেন। প্রবীরচন্দ্রের প্রিভি পার্স তখন বছরে প্রায় তিন লাখ। আর ছিল অগাধ সম্পত্তি, হীরে-জহরত। সব গভর্নমেন্ট নিজে হাতে নিয়ে প্রবীরচন্দ্রের জন্য মাসোহারা বরাদ্দ করলেন। গভর্নমেন্ট অর্ডারে বলা হল— ‘He is suffering melancholia and is incapable of managing his property.’[2]

এই পর্যন্ত, তরুণ কুমার লিখছেন— “এ হল ১৯৫০ সালের কথা।”[3]

এর এক দশক পর, ১৯৬০ সালে এসে দেখা যায়, প্রবীরচন্দ্রের প্রতি প্রশাসনিক অসহিষ্ণুতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তরুণ কুমার জানান—

…হঠাৎ মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ কাটজু (কৈলাসনাথ) মহারাজা প্রবীরচন্দ্রকে একটা চিঠি পাঠালেন—

‘Government has taken strong objection to your mode of living and conduct generally and consider that you should leave Bastar district and live for sometime to come at such place outside the district as may be approved by the Government. You are advised to come to see the Chief Minister within a week so that your wishes may be taken into consideration before a decision is taken regarding the place where you are to live. If you do not wish to see the Chief Minister to facilitate the implementation of the decision taken, Government will have no option but to decide on such other measures as might be necessary in the public interest.’[4]

কাটজুর এই আত্মম্ভরী চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন আদিবাসী হৃদয়ের ঈশ্বর, রাজা প্রবীরচন্দ্র। তিনি বিনীত ভাষায় লেখেন যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ কাটজুর পরামর্শ বিবেচনায় নেবেন, তবে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে বলেন যে তাঁকে বস্তার ছেড়ে যাওয়ার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেই খবর ইতিমধ্যেই আদিবাসীদের কানে পৌঁছে গিয়েছে— আর “if the Government is not careful then there will be rebellion.”

রাজা প্রবীরচন্দ্রকে হেয় করতে মুখ্যমন্ত্রী কাটজু যে নেহরুর পূর্ণ মদতেই তৎপর হয়েছিলেন, তা পরিষ্কার হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যে— “বস্তার কোনও সমস্যাই নয়। ছোটখাটো ব্যাপার। জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটই সামলে নেবেন।”

এর পরিণতি এসেছিল নির্মমভাবে। ১৯৬১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, রাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেওকে গ্রেপ্তার করা হয়। আগেভাগেই প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল নরসিংগড় জেল। সেখানেই তাঁকে অন্তরীণ রেখে রাষ্ট্রপতির আদেশে সংবিধানের ৩৬৬ অনুচ্ছেদের ২২ ধারাবলে তাঁকে বস্তারের রাজপদ থেকে অপসারণ করা হয়, এবং তাঁর ছোট ভাই বিজয়চন্দ্র ভঞ্জদেওকে রাজার পদে বসানো হয়। অভিযোগ?— “…that the Maharaja is engaging himself in extremely prejudicial activities …” অর্থাৎ রাজা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত, এই অভিযোগে তিনি ‘রাজার’ উপাধি বহনের অযোগ্য বলে গণ্য হলেন!

প্রবীরচন্দ্রের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণ করে আদিবাসীরা গর্জে উঠল। তাঁরা হাজারে হাজারে জড়ো হলেন লোহাণ্ডিগুডার হাটের আশেপাশে— নরসিংগড় জেলের কাছাকাছি। সংখ্যায় তারা কম করেও দশ হাজার। এ ছিল সশস্ত্র, বিক্ষুব্ধ মারিয়া-মুরিয়া আদিবাসীর ঢল। তাঁদের মুখে একটাই দাবি— “আমাদের মহাপ্রভুকে এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের সামনে এনে দাও, নয়তো আমাদের দেশে মড়ক লাগবে।”

জবাবে জওহরলাল ও কৈলাসনাথ কাটজুর সরকার ‘উপহার’ দিলেন চল্লিশ রাউন্ড গুলি— যার ফল, ১২ জন আদিবাসীর মৃত্যু। তরুণ কুমার ভাদুড়ীর কথায় যেন মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে সেই আদিবাসী গণহত্যার রক্তগোধূলি:

চল্লিশ রাউণ্ড গুলি চলল মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ডের মধ্যে। ধুপধাপ করে মাটিতে রক্তের বন্যা ছুটিয়ে পড়ল বারোটা দেহ। খানিকক্ষণ থরথর করে কেঁপে নিশ্চল হয়ে গেল। লোহাণ্ডিগুডার বুকে ধীরে ধীরে আঁধার নেমে এলো।[5]

মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্ট ১৯৬১ সালের ২৩ এপ্রিল আদেশ দেয় যে বস্তারের আদিবাসী রাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেওকে গ্রেপ্তার ও জেলবন্দি করা— এই দুই সিদ্ধান্তই সম্পূর্ণ ‘অবৈধ’। এই রায়ের ফলে পরদিন, ২৪ এপ্রিল ভোরবেলা, আদিবাসী জনতার হৃদয়ের রাজাকে অবশেষে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় কংগ্রেস সরকার।

কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। প্রবীরচন্দ্রের বিরুদ্ধে একের পর এক ভিত্তিহীন অভিযোগ আনতে থাকে কংগ্রেস সরকার। ফের দুই বছর পর, ১৯৬৩ সালের ৮ মে, বিক্ষোভে ফেটে পড়েন মারিয়া-মুরিয়া আদিবাসীরা। রাজপ্রাসাদ ও সংলগ্ন অঞ্চল ঘিরে তাঁরা শুরু করেন অবস্থান বিক্ষোভ— তির-ধনুক হাতে। তাঁদের দাবি ছিল একটাই— চক্রান্ত করে কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর মাধ্যমে দখল করে রাখা রাজার সম্পত্তি যেন অবিলম্বে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

আন্দোলনের জবাবে বহু আদিবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের চাপে অবশেষে, দু-মাস পরে, ভারত সরকার প্রবীরচন্দ্রের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়।

তবু প্রবীরচন্দ্রকে টার্গেট করার চেষ্টা থামেনি। তাঁর বিরুদ্ধে রীতিমতো বিস্ময়কর অভিযোগ আনা হয়— নরবলিতে ইন্ধন দেওয়ার ষড়যন্ত্র, এমনকি এক ব্যক্তির হাত তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলার অভিযোগেও মামলা রুজু করা হয়।

বস্তারের ইতিহাসে দ্বিতীয়, এবং সবচেয়ে নৃশংস আদিবাসী গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৬৬ সালের ২৫ মার্চ। সেদিন আদিবাসীরা বস্তার রাজা প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জদেওর প্রাসাদে জড়ো হয়েছিলেন নিজেদের নানা সমস্যার কথা জানিয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে। কিন্তু পুলিশ আচমকাই তাঁদের মধ্যে একজনকে জোর করে আটক করতে গেলে সংঘর্ষ বেধে যায়। পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলিতে বহু আদিবাসী আহত হন এবং এক পুলিশকর্মী প্রাণ হারান। এরপর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রাজপ্রাসাদ ঘিরে ফেলে বিশাল বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী, আদিবাসীদের পিছু হঠতে বাধ্য করে ভিতরে। পুলিশ মাইক দিয়ে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। প্রবীরচন্দ্রের পরামর্শে প্রথমে মহিলা ও শিশুরা বেরিয়ে এলে পুলিশ তাঁদের উপরই গুলি চালায়। এতে একাধিক প্রাণহানি ঘটে, এবং বাকিরা আর বেরোতে সাহস পাননি। এরপর হঠাৎ করেই পুলিশ প্রাসাদে ঢুকে পড়ে এবং শুরু হয় নির্বিচার গুলিবর্ষণ। এই গুলিতে রাজা প্রবীরচন্দ্র-সহ শতাধিক আদিবাসী নিহত হন। মৃতদেহ লুকিয়ে রাখা হয়, যাতে পচে যাওয়া অবস্থাতেই উদ্ধার হয় পরে। প্রবীরচন্দ্রের দেহেই ১৩টি গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়। গোপালকৃষ্ণ রায়ের বিবরণ থেকে জানা যায়—

…প্রবীর চেয়েছিলেন সরল, অশিক্ষিত আদিবাসীদের অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। তিনি চেয়েছিলেন আদিবাসীদের ঐতিহ্য বজায় রেখে তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে। তিনি চেয়েছিলেন একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন বস্তারের সামগ্রিক অবস্থা অনুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে আদিবাসী-বিকাশমুখীন একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করুন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যৌথদায়িত্ব নিয়ে সেই পরিকল্পনা রূপায়িত করুন। প্রবীর চেয়েছিলেন, আদিবাসীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের আর্থিক সাহায্যে গড়ে উঠুক এই বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণ কারিগরী শিক্ষাদানই হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যিক কাজ। অরণ্যশিখা মুড়িয়া ও মাড়িয়াদের অরণ্যের অধিকার তিনি দাবী করেছিলেন। সেচ ও পানীয় জল সরবরাহের আধুনিক ব্যবস্থা চালু করারও দাবী জানিয়েছিলেন আদিবাসীদের ‘দেবতা’ প্রবীর ভঞ্জদেও। প্রবীরের এই পরিকল্পনা কদর্য করা হয়েছিল। তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদীর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল তিনি তিনি বস্তারকে নিয়ে একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়তে চাইছেন।

এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় জেলা বস্তার। আয়তনে কেরলের চেয়ে বড়। বনজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ বস্তার। কিন্তু তার ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী তাকে যে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। তদানীন্তন প্রশাসকেরা এ সব কথা ভেবে দেখেননি। তদানীন্তন সরকার ও প্রশাসক তখন প্রবীর-ফোবিয়ায় ভুগছিলেন। প্রশাসকেরা তখন ভুলে গিয়েছিলেন যে, এই প্রবীর ভঞ্জদেও ১৯৪৬ সালে হায়দ্রাবাদের নিজামের লোভ থেকে বস্তারকে রক্ষা করেছিলেন। বস্তারের একটি অংশ কিনে নিতে চেয়েছিলেন নিজাম। কিশোর প্রবীর তখন দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বাধা দিয়েছিলেন। মধ্যপ্রদেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই সেদিন তিনি বস্তারকে রেখেছিলেন। তদানীন্তন রাজনীতিকেরা, তাদের বশংবদ তাঁবেদার আমলা সে সব কথা ভুলে গিয়ে প্রবীরের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ নিয়ে এলেন। তার ফলে সংঘর্ষ হয়ে উঠল অনিবার্য। প্রবীরের হত্যার মধ্য দিয়ে সেই পরিণতি ঘটল। তারিখ ২৫ মার্চ ১৯৬৬ সাল।[6]

গোপালকৃষ্ণ রায়ের বর্ণনায় এই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন—

প্রবীর হত্যার পর আদিবাসীদের রক্তে রঞ্জিত সমগ্র প্রাসাদপ্রাঙ্গণ কার্যত রণ-বিধ্বস্ত। হাজারো পুলিশের রাইফেলের মুখ প্রাসাদের দিকে। মাঝে মাঝে প্রাসাদের অভ্যন্তর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিষাক্ত তীর ছুটে আসছে। আর সঙ্গে সঙ্গে রাইফেল গর্জে উঠছে। মাইকে অনবরত ঘোষণা করা হচ্ছে হিন্দি ও হালবি ভাষায়। … প্রাসাদের ভিতরে মহারাজা প্রবীর ভঞ্জদেওয়ের রক্তাপ্লুত দেহ পড়ে রয়েছে। আগের দিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনি। তারিখ ২৫ মার্চ ১৯৬৬। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হ’ল প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে। প্রবীরের হত্যার খবর কেন চব্বিশ ঘণ্টা গোপন রাখা হয়েছিল কর্তৃপক্ষ তার কোনও কৈফিয়ৎ দেননি। শুধু বলা হয়েছিল বস্তারের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। জেলা প্রশাসন এমনকি ডিভিশনাল কমিশনারকেও প্রবীরের নিহত হবার খবর জানায়নি। ডিভিশনাল কমিশনার বীরভদ্র সিং খবর পেয়েছিলেন ২৬ মার্চ অপরাহ্নে। তিনি জগদলপুরে সার্কিট হাউসেই ছিলেন।

বীরভদ্র সিং সার্কিট হাউস থেকে রাজানুগত সশস্ত্র আদিবাসীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রায় দুশো তীরন্দাজ আদিবাসী প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। পঁচিশে মার্চ সারা দিনরাত যুদ্ধ চলেছিল। একদিকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি, অপরদিকে প্রত্যুত্তরে রাশি রাশি বিষাক্ত তীর। আদিম হাতিয়ারের সঙ্গে আধুনিক অস্ত্রের অসম সংগ্রাম। এ সংগ্রাম স্বাধীন ভারতের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। সরকারী হিসাবে এই অসম যুদ্ধে বারজন আদিবাসী নিহত হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ষোল। বে-সরকারী হিসাবে মৃতের সংখ্যা কয়েক শ। আহতের সংখ্যার হিসাব কেউ রাখেনি। ২৫ মার্চ সকাল থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ২৬ মার্চ কাকভোরে পুলিশ সেই যুদ্ধের বিরতি ঘোষণা করে।[7]

বস্তারের আদিবাসী গণহত্যার ১২ দিন পরে, ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত সিপিআই সাংসদ ভূপেশ গুপ্ত। তিনি এই গণহত্যাকে আখ্যা দেন এক ‘monumental crime’ হিসেবে এবং গভীর বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন—

এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দেশবাসীকে ভবিষ্যতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লজ্জা, বেদনা ও অনুশোচনায় মাথা হেঁট করে থাকতে হবে।[8]

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পরে হবু রাষ্ট্রনায়কদের কথাবার্তা, লেখালেখি ও আচরণে এক ধরনের মনোভাব প্রকাশ পেতে থাকে— যেন আদিবাসীদের ‘উন্নয়ন’ আর কয়েক কদম দূরে মাত্র! কেবল তাঁরা নিজেরা ও তাঁদের দল সাংবিধানিক পথে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করলেই আদিবাসীরা যেন স্বর্গের দরজায় পৌঁছে যাবেন। এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৪৮ সালে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের নেতৃত্বে (তখন বিহারের কংগ্রেস শীর্ষনেতা, পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি) গঠিত হয় ‘ভারতীয় আদিম জাতি সেবক সঙ্ঘ’ নামক একটি বেসরকারি সংগঠন, যার উদ্দেশ্য বলা হয়েছিল— ‘উপজাতি উন্নয়নের’ জন্য কাজ করা। কিন্তু কালের সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্থাই উপজাতি সংক্রান্ত বিষয়ে কার্যত সরকারের ‘এজেন্সি’ হয়ে ওঠে। ললিত প্রসাদ বিদ্যার্থী-র বিবরণ থেকে জানা যায়—

গোড়ার দিকে ১৮টি সংস্থা এর সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং ১৯৫০-এ এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০-এ, আর বর্তমানে (১৯৮৩) প্রায় ৬০০টি সংস্থা এর সঙ্গে যুক্ত। এই অন্তর্ভুক্ত সংস্থাগুলি উপজাতি সমস্যা এবং উন্নয়নমূলক কাজকর্মের ওপর বিভিন্ন পুস্তিকা, পত্রিকা, প্যামফ্লেট এবং বই প্রকাশ করে। উপজাতি সমস্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশাসনিক কমিটি এবং আলোচনাচক্রে এই সমস্ত সমাজসেবীরা বিশেষজ্ঞর কাজ করেন; এমনকি উপজাতি সমস্যা সংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে এঁরা সরকারি প্রতিনিধিত্ব করেন।[9]

এই রচনায় আরও বলা হয়েছে—

ভারতের রাষ্ট্রপতিকে তফসিলি উপজাতিদের স্বার্থরক্ষার্থে সংবিধানগত বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া আছে (ভারতীয় সংবিধান ধারা ৪৬, ৩৩০, ৩৩১, ৩৩২, ৩৩৩, ৩৩৯)। … রাজ্যপর্যায়ে উপজাতি উন্নয়ন এবং তফসিলি উপজাতিদের অধিকার ও সুবিধা রক্ষার সাংবিধানিক রক্ষাকবচ-এর দায়িত্ব রাজ্যপালের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রী এবং উন্নয়ন মন্ত্রী উপজাতি অঞ্চলে বিশেষ প্রকল্প রূপায়নে ভারপ্রাপ্ত। … সংবিধানে আছে পঞ্চাশজন সদস্য নিয়ে উপজাতি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়, তার ভেতর তিন-চতুর্থাংশ তফসিলি উপজাতি অন্তর্ভুক্ত। এর প্রধান উদ্দেশ্য হ’ল উপজাতি সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারকে উপদেশ দেওয়ার জন্য উপজাতি নেতাদের বেশী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা (ভারতীয় সংবিধান, শেডিউল পাঁচ)। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত বলে পরিষদ তার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। … পরিষদের মিটিং খুব কমই হয় এবং ঐ মিটিং-এ কার্যত উপজাতি নেতাদের উন্নয়ন কর্মসূচী সম্বন্ধে বলার কোন সুযোগ থাকে না।[10]

এই পর্যবেক্ষণ প্রকাশের পর প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত। কিন্তু আজও আদিবাসীরা তাঁদের জীবনযাত্রার অভিমুখ নিজেরা নির্ধারণ করতে পারেন না। তার বদলে, সংকীর্ণ দলতন্ত্রের হীনতা ও চৌর্যবৃত্তি— বিভিন্ন শাসকদল (জাতীয় হোক বা প্রাদেশিক) আদিবাসী সমাজের একাংশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছে। ফলে, বাস্তবিক অর্থে আদিবাসী সমাজের সার্বিক ক্ষমতায়ন এখনও অধরাই থেকে গেছে।

ভারতে আদিবাসীদের সঙ্গে আজ যে বিরতিহীন সংঘাত দেখা যায়, তার মূল কারণ হল ‘উন্নয়নের’ নামে তাঁদের বাসভূমি ও জীবিকাভিত্তিগুলোর ধারাবাহিক উচ্ছেদে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা। ১৯৪৭-এর পর দেশের আধা-সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির সময় পর্যন্ত এই সংঘর্ষ মূলত স্থানীয় জমিদার, মহাজন, পঞ্চায়েত-শাসক বা কাঠব্যবসায়ীদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৮০-র দশক থেকে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাঙ্ক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক-এর অনুপ্রবেশ শুরু হতেই রাষ্ট্র নিজেই হয়ে ওঠে উচ্ছেদের সরাসরি নিয়ামক।

এই লগ্নিপুঁজির অগ্রবাহিনী হিসেবে রাষ্ট্র পাঠাতে থাকে আধাসামরিক বাহিনী, যাদের ‘উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের নামে পাহাড়-জঙ্গল দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজধানীতে তখন রাষ্ট্রনায়কেরা ‘অগ্রগামী উন্নয়ন’-এর স্তোকবাক্য শোনাতে শোনাতে সংবিধান বদলাতে থাকেন, যাতে ব্রিটিশ আমল থেকে আদিবাসীদের প্রাপ্ত সাংবিধানিক রক্ষাকবচগুলো ক্রমশ লুপ্ত করা যায়।

ফলে আজকের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসা পুঁজিপতি ও তাদের রাজনৈতিক প্রতিভূদের ‘উন্নয়ন’ নামক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নতুন বৈরী শক্তি হিসেবে নিজেদেরই তৈরি করতে হয়েছে, যাঁদের লক্ষ্য আদিবাসী সমাজের কয়েক হাজার বছরের জীবনযাত্রার ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলা। এই প্রবণতা ১৯৮০-র দশকেই অনুধাবন করেছিলেন ফলিত নৃতাত্ত্বিকেরা। যেমন, ললিত প্রসাদ বিদ্যার্থী ১৯৮৩ সালে তাঁর ‘বিহারে আদিবাসী পুনর্বাসন: একটি প্রশাসনিক ভাঁওতা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন—

নৃতাত্ত্বিকরা, যাঁরা সরকার এবং সমাজসেবীদের কর্মকাণ্ড ও উপজাতিদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তাঁদের কাছে পরিস্থিতি মোটেই আশাব্যঞ্জক ছিল না। চলছিল ‘বন্যদের সভ্য করার’ নামে সরকার ও সমাজসেবীদের স্বৈরতান্ত্রিক কার্যকলাপ এবং স্পষ্টভাবে উপজাতি সংস্কৃতির ক্রমবিলুপ্তি। যদিও ভারতীয় সংবিধানে উপজাতিদের স্বাধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে তা মানা হয় না। বরং সরকারি ও বেসরকারি এজেন্সিগুলির পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবই সর্বদা আধিপত্য বিস্তার করে।

আমি ট্যাক্স-এর (নৃতাত্ত্বিক) মন্তব্যে অনেক সত্য দেখি— যেখানে তিনি বলেন, ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আদতে একদল পিতৃতান্ত্রিক শক্তির হাত থেকে আরেক দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর মাত্র (Act 1956:1971)। এই মনোভাব নিয়েই ‘অসভ্য উপজাতি’দের নিয়ে কাজের ফল আমরা দেখি উত্তর-পূর্ব সীমান্তে নাগা বিদ্রোহে এবং পরে মধ্যভারতে আলাদা উপজাতি রাজ্যের দাবিতে গড়ে ওঠা ঝাড়খণ্ড আন্দোলনে। …

প্রশ্ন জাগে— কেন শুধুমাত্র তথাকথিত পার্থিব উন্নয়নের জন্য উপজাতি গোষ্ঠীর সামাজিক ও ধর্মীয় দিকগুলিকে উপেক্ষা করা হবে? ভারতে ‘পশ্চাৎপদ উপজাতি’ ছাপ লাগানোর মধ্যে দিয়ে তাঁদের স্বাধিকার রক্ষার দাবিকেই ক্রমশ পরিত্যাগ করা হয়েছে।[11]

শুধু বস্তারের ১৯৬১ ও ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসের পর্যায়ক্রমিক মারিয়া-মুরিয়া আদিবাসী দেশজ জনজাতির ওপর নৃশংস গণহত্যার ইতিহাস নয়— ১ জানুয়ারি ১৯৪৮ উড়িষ্যার খারসাওয়ান বাজারমাঠে ওড়িশা মিলিটারি পুলিশের দ্বারা শতাধিক আদিবাসী হত্যা, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬০-এ বর্তমান নাগাল্যান্ড রাজ্যের ফেক জেলার মাটিত্থ্রু গ্রামে সেনাবাহিনীর হাতে ৯ জন আদিবাসী হত্যা, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ বিহারের গয়ার হাসপাতালে ১১ জন আদিবাসী মানুষের সামরিক পুলিশের হাতে নিহত হওয়া, ১৯৯৪-এর ২৭ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডের মোকোকচুং-এ সেনা ও আধাসেনার যৌথ অভিযানে ১২ জন নাগা নিহত হওয়া, ৫ মার্চ ১৯৯৫ নাগাল্যান্ডের কোহিমায় সেনাদের নিজেদের কনভয়ের গাড়ির টায়ার ফাটার আওয়াজকে বোমা-হামলার ভ্রমে ৭ জন নিরীহ নাগা আদিবাসীকে গুলি করে মারা— এই ঘটনাগুলোর সংঘটনের কার্যকারণে আপাত-ভিন্নতা থাকলেও, নৃতাত্ত্বিক ট্যাক্স-কথিত ও ললিত প্রসাদ বিদ্যার্থী-সমর্থিত শাসকশ্রেণির ‘দৃষ্টিভঙ্গি’-র সমস্যাই মূল; সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসংশয়ে শ্রেণি-উৎপত্তিজনিত ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা নির্ধারিত— অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো আদিবাসী নিপীড়ন, নির্যাতন বা হত্যাযজ্ঞে প্রেরিত বাহিনীর সামনের কর্মীটির মধ্যে তা এতটাই পরোক্ষে জারিত যে সে বা তারা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মুহূর্তে কিংবা পরেও এই কার্যকারণ উপলব্ধির স্তরে পৌঁছায় না।

আবার যাঁদের প্রাণ অকালে ঝরে পড়ে এইসব গণহত্যার ঘটনায়, তাঁরাও নিহত হওয়ার সংঘাতে ’৪৭-পরবর্তী ভারতের শ্রেণিসংঘাত বুঝে এগোন না। প্রদীপ ব্যানার্জি ভারতের জাতি সমস্যা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা শীর্ষক প্রবন্ধে এই ব্রিটিশ-পরবর্তী অধ্যায় সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন—

…ভারতবর্ষে জাতি গঠনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি এবং ভারতবর্ষ মূলত একটি বহুজাতি (এবং উপজাতি) অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসাবেই রয়ে গেছে। বিভিন্ন জাতিসত্তাগুলির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মধ্যেও গুরুতর ফারাক রয়ে গেছে। ফলে কিছু জাতিসত্তা নিজেদের অবহেলিত মনে করেছে এবং সেটা মাঝে মাঝে বিদ্রোহের রূপ নিচ্ছে, আবার কিছু জাতিসত্তার নেতৃস্থানীয় লোকজন নিজেদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সুবিধা বজায় রাখতে উগ্র প্রাদেশিকতার আশ্রয় নিচ্ছেন। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়, যাঁরা নিজেদের পিছিয়ে পড়া, উপেক্ষা, শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস বহন করছেন। এই উপজাতিরা মাঝে মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এবং তা করতে গিয়ে প্রায়শই প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছেন।[12]

পৃথিবীব্যাপী পুঁজিবাদ যে ভোগ ও আত্মপরতার জীবনদর্শনকে একমাত্র ধ্রুব সত্য করে তুলছে এবং লোভের বাতাবরণ নির্মাণ করছে, তার ফলে নগরায়ণের প্রতি মোহ মানুষকে এমন এক অসংবেদনশীলতায় ঠেলে দিচ্ছে যে ধনবাদীদের হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র তার প্রশাসন, পুলিশ, বিচারালয়, আইনসভা— সব কিছুই প্রাকৃতিক ভারসাম্যবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত করে তুলছে; কাঞ্চনমূল্যে প্রকাশ্য বা গোপনে কিনে নিচ্ছে রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো। তখন জঙ্গল-পাহাড়ে বাস করা আদিবাসীদের শিকড়চ্যুত করাকে অনৈতিক মনে করাটাও যেন নীতিহীনতার লক্ষণ বলে সমাজে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এই সামাজিক অসাড়তার নাগরিক মনন তৈরিতে ভূমিকা নিচ্ছে খবরের কাগজ, টেলিভিশনের নানা চ্যানেল, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি পুঁজিনিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ডঃ প্রভাত কুমার সরকারের লেখা জঙ্গল আর জংলী প্রবন্ধের সেই চেতাবনি ও প্রত্যয়ের কথা মনে পড়ে—

…বিশ্বের ধনী সমাজ যে আধুনিক সংস্কৃতি প্রচার করছে, তা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের উপর কুঠারাঘাত করছে এবং জংলীদের জঙ্গলচ্যুত বা গৃহহীন করতে রাজনৈতিক বলপ্রয়োগ করছে… আজ ধনতন্ত্রের তাণ্ডবলীলা দেশে দেশে প্রবাহিত হচ্ছে। তাদের ‘জঙ্গল বাঁচাও’ আন্দোলনের হাত থেকে এইসব জংলীদের বাঁচানোর শপথ নেওয়ার দিন এসে গেছে।[13]


[1] চক্রবর্তী, সুধাংশুকুমার। অরণ্যকন্যা। কলকাতা: এস আর পাবলিকেশনস। আগস্ট, ১৯৮৮।
[2] ভাদুড়ি, তরুণ কুমার। হিজ হাইনেস। দেশ। শারদীয়া, ১৩৭১। পৃঃ ১৪৪-১৪৫।
[3] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৪৫।
[4] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৪৭।
[5] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৫৩।
[6] রায়, গোপাল কৃষ্ণ। একটি রাজকীয় প্রেম। শারদীয় আলোকপাত। ১৩৯৭। পৃঃ ১৪।
[7] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৪-১৫।
[8] রাজ্যসভার কার্যবিবরণী। পৃঃ ৫৬০৩-৫৬০৪।
[9] বিদ্যার্থী, ললিত প্রসাদ। বিহারে আদিবাসী পুনর্বাসন: একটি প্রশাসনিক ভাঁওতা। মধ্যাহ্ন। বিশেষ উপজাতি সমাজতত্ত্ব সংখ্যা, ১৯৮২। পৃঃ ৯৫।
[10] পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯৯-১০০।
[11] বিদ্যার্থী, ললিত প্রসাদ। বিহারে আদিবাসী পুনর্বাসন: একটি প্রশাসনিক ভাঁওতা। মধ্যাহ্ন। বিশেষ উপজাতি সমাজতত্ত্ব সংখ্যা, ১৯৮২। পৃঃ ১০২-১০৩।
[12] দেশপ্রেমিক। শারদীয়া ১৩৮৭। কলকাতা। পৃঃ ২৭।
[13] সরকার, ডঃ প্রভাত কুমার। ‘সংবীক্ষণ’ সংকলন ১৪০০। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, সোনারপুর শাখা, স্কখিণ চব্বিশ পরগণা। পৃঃ ১৩০-১৩১।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অত্যন্ত সংবেদনশীল, গুরুত্বপূর্ণ লেখা
    হীরক সেনগুপ্ত

আপনার মতামত...