শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
এই নিবন্ধের নির্বাচিত অংশটি লেখকের মানুষ সমাজ প্রকৃতি: একটি দেশকালিক বীক্ষণ বই থেকে নেওয়া।
উত্তর আমেরিকায় কালো মানুষকে নিচু চোখে দেখার এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। হলিউডের সিনেমায় অন্তত একটি কালো মানুষের সাম্মানিক উপস্থিতি দিয়েই সাদা ও কালো মানুষের মধ্যের সাম্যকে প্রামাণ্য হিসেবে ধরতেন বহু গুণীজন। সম্প্রতি কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডকে হাঁটুর জোরে পিষে তিলে তিলে নৃশংস হত্যার মধ্যে দিয়ে বাস্তবের কদর্য কঙ্কালটি তাদের কাছে ধরা পড়েছে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের একেবারে নীচের স্তরে থাকা কালো মানুষদের অবস্থান আসলে জিনের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত একথা জেনেটিক নিয়ন্ত্রণবাদে বিশ্বাসী মতাদর্শীরা অনেকদিন ধরে বলে এসেছেন। তাঁদের মতে, জিন বলছে যে বুদ্ধিতে, সৃজনশীলতায় কালো মানুষ বরাবরই খাটো। এর সপক্ষে আজগুবি এবং হাস্যকর সব তথ্যও তারা পেশ করেছেন।
জেনেটিক নিয়ন্ত্রণবাদের সপক্ষে চলতে থাকা হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের সময় থেকেই উল্টোদিকে আরও একটি গবেষণার ধারা তার জায়গা মজবুত করে। নাম এপিজেনেটিক্স (Epigenetics)। এপিজেনেটিক্স তত্ত্ব অনুযায়ী ডিএনএ শৃঙ্খল না বদলেও পরিবেশ বিশেষ কিছু জিনকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করে জিনের কার্যকলাপ এবং তার বহিঃপ্রকাশকে (expression) প্রভাবিত করতে পারে। অতএব এপিজেনেটিক্স বলল যে মানুষের বিকাশে শুধুমাত্র জিন নয়, পরিবেশের প্রভাবও অনস্বীকার্য। জিনের নিয়ন্ত্রণে একজন ধনকুবের সাদা মানুষের সন্তানের মধ্যে পরিবেশ নিরপেক্ষভাবে ধনকুবের হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল একথা জিন নিয়ন্ত্রণবাদীরা বলে এসেছেন। এপিজেনেটিক্সের তত্ত্ব অনুযায়ী সেই প্রতিভাশালী ধনকুবেরের জীবনধরণ, খাদ্যাভাস অর্থাৎ বাহ্যিক প্রভাব তার বিশেষ কিছু জিনকে নিস্ক্রিয় বা সক্রিয় করে তুলতে পারে।এই সক্রিয় জিনটি ক্যানসার সংক্রান্তও হতে পারে। এই পরিবর্তনটির তার সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা অন্তত শারীরিকভাবে সন্তানের বিনাযুদ্ধে ধনকুবের হয়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনাকে তাই খারিজ করে। প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন বিতর্কে একতরফা জিনের দাপটকে ভালোরকম চ্যালেঞ্জ করে এপিজেনেটিক্স শেষ পর্যন্ত জেনেটিক নিয়ন্ত্রণবাদের সর্বজনীন গ্রাহ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে বিজ্ঞানী মহলে বেশ জনপ্রিয় হয়। এমন সময়ে জেনেটিক নিয়ন্ত্রণবাদের প্রবক্তা হিসেবে উইলসন সাহেবের উত্তরসূরিরা এই জনপ্রিয়তায় গা ভাসিয়ে একেবারে চুপ করে যাবে তা তো আর হয় না! প্রকৃতিগতভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা অপরিবর্তনীয় এবং এইটি হল শ্রেষ্ঠ— এমন চিন্তাধারার সমর্থনে সুচতুর কৌশলে বিজ্ঞানকে জুড়ে দেওয়ার দায়িত্ব যেসব প্রথিতযশা মানুষেরা আনন্দের সঙ্গে নিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হার্ভার্ডের অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার (Steven Pinker)। বেশ কিছু জনপ্রিয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বইয়ে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে মানুষের স্বভাব ও আচরণের সিংহভাগ ঠিক করে দেয় বিবর্তনমূলক মনস্তাত্ত্বিক অভিযোজন (evolutionary psychological adaptation)। ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘The Blank Slate’ বইতে তিনি বললেন যে, মানুষের মন যদি একটা সাদা খাতার মতো হয় তাহলে সহজেই সেখানে স্বার্থপ্রণোদিত রচনা লিখে মনকে খেয়ালখুশিমতো প্রভাবিত করে ফেলা যায়। বিপজ্জনক পরিণাম হিটলার পরিচালিত জার্মানি এবং লেনিন পরবর্তী রাশিয়া। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। ‘The Better Angels of Our Nature’ ও ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘Enlightenment Now’ বই দুটিতে তিনি জীববিদ্যা এবং মনস্তত্ত্ব সংক্রান্ত তত্ত্বের সাহায্যে বলেন যে, ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে হিংস্রতার নিরিখে এই সময় হল সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ। মানুষ বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে গড়পড়তায় আগের থেকে অনেক বেশি সুখেই আছে। সমাজের চাকা যেদিকে মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে তাকে বদলানো নেহাতই মুর্খামি এমন চিন্তা পিঙ্কার সাহেবের অনুগামীদের মধ্যে দেখা দিলে তা মোটেই অস্বাভাবিক হবে না।
জীব এবং প্রকৃতির মধ্যের সম্পর্ক সবসময় দ্বান্দ্বিক। মানুষের সামগ্রিক জীবনযাপন শুধু পরিবেশের ওপর নির্ভরশীলই নয় শ্রমের দ্বারা সে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে পরিবর্তনও করতে পারে। লিওনটিন বরাবরই এই বক্তব্যকে সমর্থন করে এসেছেন। এই ভাবনার জনমানসিক প্রভাব আগাম কল্পনা করেই হয়ত তাঁর তীব্র সমালোচনা করে উল্টোদিকের মতাদর্শীরা বলেছেন যে, লিওনটিন এইসব সিদ্ধান্তে এসে তাঁর প্রতিভার অপব্যবহার করছেন। এক বস্তাপচা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবে পড়ে বিজ্ঞানকে ভুল দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
একদিকে আর সি লিওনটিন, স্টিফেন জে গুল্ডের সমর্থকেরা, অন্যদিকে স্টিভেন পিঙ্কার ও রিচার্ড ডকিন্স বাহিনি, বাম ও ডান শিবিরের মধ্যে এই ধরনের সমালোচনা ও প্রতি-সমালোচনা নতুন কিছু নয় কিন্তু জেনেটিক নিয়ন্ত্রণবাদ এবং উইলসন থেকে পিঙ্কার সাহেবের মতবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে নেপোটিসম, হোয়াইট সুপ্রিমেসি, হিন্দুত্ববাদ ইত্যাদির স্বপক্ষে এক বৈজ্ঞানিক ভিত্তির প্রতিষ্ঠা যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ভারতে হিন্দুত্ববাদী মানুষেরাও কৌশলে ডেটা ম্যানুফেকচার (data manufacture) করে অবৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যে আর্যরাই ভারতের আদি নিবাসী। আর্যরা হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সঙ্গে অঙ্গীভূত। অতএব বহিরাগতদের চিহ্নিত করে, তাদের বিতাড়িত করে খাঁটি হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করা মানেই ঐতিহ্য রক্ষা। যে কালো মানুষদের নিয়ে আমেরিকায় এত বৈষম্যসূচক আচরণ কেবলমাত্র সেইসব আফ্রো-আমেরিকান নয়, যেসকল কালো মেয়েরা প্রসাধন মেখে ফরসা হয়ে সামাজিক দৃষ্টি আকর্ষনে বাধ্য হচ্ছেন তারাও শুধু নয়; সাদা, কালো, বাদামি, হলুদ, গায়ের রঙের সমগ্র মানবজাতিরই উৎপত্তি আফ্রিকার একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর থেকে তা আজ অনেকেই জানেন। সারা পৃথিবীর ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে ৬৫০০০ হাজার আগেকার মানুষের অভিবাসনের ওপর। তারই একটি অংশ ভারতে আসে এই অভিবাসনের প্রথম পর্বে। আন্দামানের আদিবাসীরা তারই সাক্ষ্য বহন করে। পরবর্তীকালে ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্রাবিড়দের পূর্বসূরিরা এবং সর্বশেষে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাভাষীর একদল মানুষ ইরান হয়ে ভারতে এসে বৈদিক সভ্যতা গড়ে তোলেন। এদেরকেই মূলত আর্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভাষাতত্ব, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব এবং জিনতত্বের মিলিত গবেষণা থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে যাদের আর্য বলে চিহ্নিত করা হয় দেশকালের বিচারে তারাই সবার শেষে ভারতে এসেছে এবং তারাই প্রকৃত বহিরাগত। বর্তমানে প্রযুক্তি ও জিনতত্ত্বের সর্বাধুনিক প্রয়োগে হরপ্পা সভ্যতার মানুষের দেহাবশেষের কানের অস্থি থেকে পাওয়া ডিএনএ শৃঙ্খলা (DNA sequence) এবং সাম্প্রতিক ৪৪টি জনগোষ্ঠীর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে প্রমাণিত হয়েছে যে ভারতবর্ষে দেশকালের নিরিখে কীভাবে কতরকম ভিন্ন ভৌগলিক অবস্থানের মানুষের সংমিশ্রণ ঘটেছে। অতএব সাদা-কালো থেকে শুরু করে আর্য-অনার্য ও আদিবাসিন্দা-বহিরাগতর মধ্যে ভেদরেখা টেনে খাঁটি রক্তের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা খাঁটি বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। তবু এই বাতুলতা থেমে থাকে না। দিনরাতের চেষ্টায় পুঁজিবাদকে যদি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকাঠামো হিসেবে প্রমাণ করা হয় এবং ফ্যাসিবাদ যদি এমন এক মতাদর্শ হয়ে মানবমনে জায়গা করে নেয় যার অনুমোদন খোদ অলঙ্ঘনীয় প্রকৃতি করে আসছে তবে আগামীর দিনগুলিতে মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব, তাদের মধ্যের সম্পর্ক কী ভয়ঙ্কর হতে পারে তা কল্পনা করাই যায়! রোহিত ভেমুলা, নরেন্দ্র দাভোলকার থেকে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ইতিহাস যে অদৃশ্য সুতোয় জোড়া লেগে আছে ধারালো মাঞ্জার চরিত্রটি আগাম বুঝে নিয়ে বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের ফারাক জনমানসের গভীরতম অঞ্চলে প্রতিস্থাপিত করা একালের এক অপরিহার্য দায়িত্ব। প্রকৃতি এবং প্রতিপালনের মূর্ত দিকটি বুঝে সেইসঙ্গে পুনুরুদ্ধার করা প্রয়োজন মানুষ ও প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া কথোপকথন। শুধু সাম্প্রতিক করোনা নয়, আদতে ভাইরাসের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ওপর বসে রয়েছে সমগ্র মানবজাতি। যে কোনও মুহূর্তে তার বিস্ফোরণ হতে পারে। জানাচ্ছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, মানুষের স্বাস্থ্য অন্য প্রাণীজগত বা সামগ্রিক পরিবেশ থেকে কোনওভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়। একথা বুঝে নেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। অতএব আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন এই বিন্দুগুলির মধ্যে সংযোগ তৈরি করে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতের পৃথিবী আরও অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য। মানুষের জিনের ওপর কর্পোরেট দখলদারি, বৈষম্যকে উৎসাহ দেওয়া গবেষণা, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা এগুলি কোনওটিই আকাঙ্ক্ষিত নয়। এমন হওয়াটাই আসলে এক অপ্রাকৃতিক ব্যাপার। সদিচ্ছা এবং মানবিক মতাদর্শী মানুষের অভাব না ঘটলে মানুষ ও প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক বাঁচিয়ে তোলাই হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের উদ্দেশ্য হতে পারত। নিরন্তর আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আগামীকে বুঝে নিয়ে পৃথিবীকে সকল মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তুলতে বিজ্ঞান কী অপরিসীম ভূমিকা নিতে পারে তা বলাই বাহুল্য। এই মহত্তম কাজে সাধ্যমতো জড়িয়ে পড়া আমাদের গভীরতম আকাঙ্ক্ষায় মিশে যাক। এ ছাড়া আর কি কোনও উপায় আছে!
মানুষ সমাজ প্রকৃতি: একটি দেশকালিক বীক্ষণ
শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ: হিরণ মিত্র
প্রকাশক: সংবর্তক প্রকাশনা
মূল্য- ১৫০/-