মুসাফির এ মন

নীলাঞ্জন হাজরা

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

‘এটা মসজিদ?!’ এ লেখার জন্য ছবি বাছার সময় আমার প্রাক্তন সহকর্মী অনির্বাণ থ৷ তার এহেন প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য একটুও অবাক হইনি আমি৷ হইনি এই কারণেই যে, ঘন গাছের সারির ফাঁক দিয়ে পিছনের বুক-চিতনো মারগাল্লা পাহাড়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বাড়িটা প্রথম উঁকি দেওয়ায় পাশে বসা পাকিস্তান সরকারের প্রোটোকল অফিসার জফর কুরেশি সাহেব যখন বললেন, ‘ওই তো৷ আমরা এসে গিয়েছি,’ আমার মুখ দিয়েও বেরিয়ে এসেছিল ঠিক ওই দুটো শব্দই৷ বলছে মসজিদ, অথচ গম্বুজ নেই, এমন মসজিদ আমি অন্তত এর আগে জিন্দেগিতে দেখিনি, যদিও শুনেছি আছে তেমন কিছু পূর্ব এশিয়া আর পশ্চিমি দুনিয়ায়! পরেও নিজের চোখে দেখেছি একবারই— ইরানের খোরাসান প্রদেশের ছোট্ট শহর নিশাবুরে৷ সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি ‘মসজিদ চুবি’৷ তার মিনার, মিনবার, মিহরাব সব কিছুই কাঠের৷ তৈরি করতে নাকি লেগেছে ৪০ টন কাঠ৷ সে মসজিদেরও কোনও গম্বুজ নেই৷ কিন্তু ইসলামাবাদের ফয়সল মসজিদের সঙ্গে তার মিল ওইটুকুই৷

স্থাপত্যের নিরিখে ফয়সল মসজিদের সঙ্গে তুলনা চলতে পারে এমন মসজিদ দক্ষিণ এশিয়াতে তো বটেই সারা দুনিয়াতেই বিরল৷ গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার সামনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ৷ ক্যামেরা তাক করে মালুম হয়, এই বিশাল ব্যাপারটার পুরোটাকে এত কাছ থেকে ধরে ফেলার মতো লেন্স আমার কাছে নেই৷ কুরেশি সাহেব জানান, বর্তমানে এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মসজিদ৷ ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল এক নম্বরে৷ কিন্তু হালফিলে একে টেক্কা দিয়েছে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা শহরের হাসান (দ্বিতীয়) মসজিদ, মক্কার মসজিদ-অল-হরম আর মদিনার অল-মসজিদ অল-নবি৷

এক নম্বরেই থাকুক কিংবা চার নম্বরে, ব্যাপারটা বিশাল৷ মিনারগুলো দেখতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই টুপি পড়ে যায়৷ পাকিস্তানি বন্ধুদের আড্ডায় আর পাঁচটা জিনিসের মতো ফয়সল মসজিদ নিয়েও নানা মজার গুজব-চুটকি শোনা যায়৷ ১৯৮০-র দশক৷ মার্কিন-সোভিয়েত ঠান্ডা যুদ্ধ তখনও পুরোদমে চলছে৷ দুনিয়ার যে কোনও দেশে নজর-কাড়া কিছু তৈরি হলেই মহাসন্দেহে হাজির হয়ে যাচ্ছে, হয় সিআইএ, নয়তো কেজিবি৷ ফয়সল মসজিদ তৈরি হওয়ার পরও নাকি সিআইএ জেদ ধরেছিল আম আদমির জন্য খোলার আগে প্রথমে তাদের ঘুরিয়ে দেখাতে হবে জায়গাটাকে৷ সিআইয়ের ঘোর সন্দেহ হয়, ওই ২৯৫ ফুট লম্বা মিনারগুলো নির্ঘাৎ মিসাইল দাগার কোনও একটা বন্দোবস্ত৷ চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের পরই সিআইএ-র ধুরন্ধর চরেরা নিশ্চিত হয়েছিলেন, নাঃ! এটা মসজিদই বটে!

চার মিনারের মাঝখানে একটা বিপুলাকার হল৷ তার ছাদের উচ্চতাও কম নয়— ১৪১ ফুট৷ মেঝের ক্ষেত্রফল ৫৪০০০ বর্গফুট৷ এ প্রার্থনাগৃহের ভিতরেই বসতে পারেন ১০ হাজার মানুষ৷ আরও প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ বসতে পারেন মসজিদের মূল চত্বরে৷ সিআইয়ের গুপ্তচরদের দোষ দেওয়া যায় না— দক্ষিণ এশিয়ার মসজিদের স্থাপত্যের যে ট্র্যাডিশন, তার সঙ্গে এক্কেবারে কোনও মিল নেই ফয়সল মসজিদের৷ সচেতনভাবেই তা থেকে এ মসজিদের নকশাকে আলাদা করেছেন এর স্থপতি ভেদাত ডোলাকে৷ তুরস্কের বিশিষ্ট স্থপতি তিনি৷

আসলে এ মসজিদ বানানোর উদ্যোগ শুরু ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি৷ সবে করাচি থেকে সরিয়ে দেশের রাজধানী হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ঝাঁ চকচকে নতুন শহর ইসলামাবাদ৷ কিন্তু ঐতিহাসিক শহর না হওয়ায়, এখানে নেই কোনও বড়সড় মসজিদ, যেখানে হাজারে হাজারে মানুষ একত্রে প্রার্থনা করতে পারেন৷ কাজেই তেমন কিছু একটা বানানো দরকার। ১৯৬৬ সালে সৌদি আরবের তদানীন্তন রাজা ফয়সল বিন আব্দুল-আজিজ় পাকিস্তান সফরের সময় এই উদ্যোগের পিছনে দাঁড়ান৷ বানাও মসজিদ৷ টাকা আমরা দেব৷

যেমন কথা তেমনি কাজ৷ ১৯৬৮ সালে ইসলামাবাদে মসজিদ তৈরির নকশা জমা দেওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার কথা ঘোষণা করা হয়৷ জমা পড়ে ১৭টি দেশের ৪৩ জন স্থপতির নকশা৷ শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত হয় ভেদাত ডালোকের প্রস্তাব৷ ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরান মিলিয়ে তাক লাগানো তাবড় তাবড় মসজিদ দেখেছি অনেক কটিই৷ লাহোরের বাদশাহি মসজিদই হোক বা দিল্লির জামা মসজিদ, ইস্তানবুলের সুলতান আহমেৎ (‘ব্লু’) মসজিদই হোক বা মশহদের হরম ইমাম রেজা— ফয়সল মসজিদের সঙ্গে কোনওটির মিল নেই বিন্দুমাত্র৷ আসলে মসজিদ বলতে চোখ বন্ধ করলে দক্ষিণ এশীয় কল্পনায় যে ছবি আপনা থেকেই ফুটে ওঠে, ইসলামাবাদের এ মসজিদ তেমন দেখতেই নয়৷ বরং এ মসজিদ ওপর থেকে দেখতে অনেকটা আরবি বেদুইনদের তাঁবুর মতো৷ স্থপতি ডালোকে স্বীকার করে নেন এই মিল৷ তাঁর মতে, এ মসজিদের স্থাপত্য হল ‘perfectly in harmony with the eternal image of the tent’৷ অবিশ্যি তিনি এও জানিয়েছেন যে, মক্কার পবিত্র কাবাই এ ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছে তাঁকে— ‘I tried to capture the spirit, proportion and geometry of Kaaba in a purely abstract manner.’৷ আর মসজিদের সরু সরু চারটি মিনারে তিনি রেখে দেন সাবেকি অটোমান স্থাপত্যের ছাপ৷ দক্ষিণ এশীয় মিনারের থেকে তা একেবারেই আলাদা৷ একে বলে পেনসিল মিনার৷

শুধু বাইরে থেকেই নয়, ফয়সল মসজিদের ভিতরের অনেক কিছুও সাবেকি মসজিদের থেকে একদম আলাদা৷ সবথেকে চোখে পড়ে এর মিহ্‌রাব। কিবলার দেওয়াল থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে এই মিহরাব৷ কিবলা হল মসজিদের সেই দিকের দেওয়াল, যে দিকে মক্কা, আর মিহ্‌রাব হল সেই দেওয়ালে একটি খাঁজ, যা দিয়ে বোঝা যায় এটিই কিবলা, প্রার্থনার সময় বসতে হবে এদিকে মুখ করেই, এটিই মসজিদের মধ্যে মক্কার নিকটতম বিন্দু৷ এই মিহ্‌রাবটির ডিজাইন করেন বিশিষ্ট পাকিস্তানি শিল্পি ইসমাইল গুলগি৷ মিহ্‌রাবটি যেন একটি খোলা বই৷ সেই খোলা বইয়ের পাতায় প্রাচীন কুফি লিপিতে সোনালি অক্ষরে উৎকীর্ণ করা হয়েছে কোরানের অল রহমান সুরা৷ অক্ষরগুলি আঁকার পরিবর্তে পেটানো পিতল ব্যবহার করেছেন শিল্পী গুলগি৷ দু পাতার মাঝখানের ‘স্পাইনে’ ঝলমলে নীল ল্যাপিস লাজুলিতে লেখা ‘আল্লাহ্’৷

ফয়সল মসজিদের মিহ্রাব

চোখ আটকে যায় মিনবারের উপরে ল্যাপিস ল্যাজুলির অনবদ্য সূক্ষ্ম লিপিতে উৎকীর্ণ কোরাণের অল-ফাতিহা সুরা-তে। মিনবার হল সাধারণত কাঠের তৈরি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্ম যেখানে বসে ইমাম মসজিদের জমায়েতকে বাণী দেন, ইংরেজিতে যাকে বলবে ‘pulpit’। সম্পূর্ণ আলাদা রকমের এই মিহ্‌রাব আর মিনবার ছাড়াও এ মসজিদের ভিতরে চোখ কাড়বেই মিনবারের উল্টোদিকের ‘মুয়জ্জিন মেহফিলি’৷ এইখানে নতজানু হয়েই মসজিদের মুয়জ্জিন উচ্চকণ্ঠে তাঁর প্রার্থনা আবৃত্তি করেন৷ ফয়সল মসজিদে এই মুয়াজ্জিন মেহফিলিতে খচিত আছে পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক চিত্রশিল্পী প্রয়াত সৈয়দ সাদকেন আহমদ নকভির ক্যালিগ্রাফির একটি বিশাল মিউরাল৷ ১৯৮৮ সালে ফয়সল মসজিদ তৈরি শেষ হয়৷ সাদকেন মারা যান ১৯৮৭ সালে৷ এই মিউরালই ছিল তাঁর শেষ বড় কাজ৷

হিসেব করে দেখা যায় অত্যাশ্চর্য এই মসজিদ তৈরিতে খরচ পড়বে ৩,৫০,০০,০০০ ডলার৷ কিন্তু পাকিস্তানে বানানো হবে মসজিদ, সৌদি আরব তার টাকা দেবে কেন? বিশেষ করে সৌদি আরব যখন গভীরভাবে বিশ্বাস করে ইসলামের সালাফি ব্যখ্যায়? প্রশ্নটি আলোচনা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক কিশ্বর রিজভি তাঁর বই ‘The Transnational Mosque: Architecture and Historical Memory in the Contemporary Middle East’-এ৷ আসলে, জানাচ্ছেন অধ্যাপক রিজভি, সালাফি মতবাদ আর সৌদি আরবের আধুনিক মসজিদ স্থাপত্যের মধ্যে একটা অন্তর্লীন টানাপড়েন রয়েছে৷ সালাফি মতবাদ মূলগতভাবে স্থাপত্যের উদ্‌যাপনের বিরোধী৷ রিজভির ভাষায়, ‘Indeed, the fear is of the monument itself. In the Salafi doctrine that underline Wahhabism, history is an abstraction – reduced to acts and words – that seldom gives importance to material evidence lest it distract from the purity of the belief.’ সহজ ভাষায়, স্থাপত্যশিল্পের সৌন্দর্য মন কেড়ে নিলে ঈশ্বরের প্রার্থনায় তা নিবিষ্ট হতে পারে না। একইভাবে, কোনও ব্যক্তির স্মৃতিও স্থাপত্যের মাধ্যমে উদ্‌যাপিত হলে তা ঈশ্বরের সঙ্গে মনের সরাসরি যোগসূত্রের পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে৷ সেই কারণেই, রিজভি জানাচ্ছেন, ঊনবিংশ শতকের গোড়ায় মদিনার বিখ্যাত জন্নত অল-বাকি কবরস্থানের বহু ঐতিহাসিক কবর ধ্বংস করে দেওয়া হয়৷ ধ্বংস করে দেওয়া হয় প্রোফেট মহম্মদের স্ত্রীদের এবং তাঁদের সঙ্গীদের স্মৃতিসৌধগুলি৷ এমনকী ভেঙে ফেলা হয় প্রোফেটের কন্যা ফতিমার মসজিদটিও৷

১৯৩২ সালে সরাসরি ব্রিটিশ মদতে তৈরি নয়া সৌদি রাজতন্ত্রের আমলেও আজ অবধি এই নীতি অপরিবর্তিত৷ রিজভির ভাষায়, ‘Several monuments associated with the early history of Islam… are consistently demolished or built over.’ আর সৌদি আরবের এই সালাফি বিশ্বাসের সঙ্গে সে দেশের মসজিদ-কূটনীতির টানাপোড়েনটাও সেখানেই৷ ইসলামাবাদের ফয়সল মসজিদ এই মসজিদ-কূটনীতির, এবং সালাফি বিশ্বাসের সঙ্গে সে কূটনীতির টানাপোড়েনের একটি অসাধারণ আদর্শ উদাহরণ৷ সে মসজিদ বানাতে অর্থের পরোয়া করেনি সৌদি আরব৷ পরোয়া করেনি এই কারণেই যে সালাফি বিশ্বাস যাই হোক না কেন বিশ্বজুড়ে মসজিদ তৈরিতে সাহায্য করা সৌদি কূটনীতির অপরিহার্য অঙ্গ৷ কেন? উত্তর খুঁজে অধ্যাপক রিজভি জানান, ‘National mosques provide an important opportunity for states to monumentalise their political identity. The Kingdom of Saudi Arabia is no different, despite Salafism’s rejection of commemorative architecture. Indeed, the government not only developed a mosque-building project…, but also deemed it necessary to utilize mosques as a way to export their worldview abroad.’

মসজিদের অপূর্ব সব কাজের কথা ভাবলে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন খোঁচা দিতেই থাকে— এই যে মিহ্‌রাব, মিনবার, কি সাদকেন-এর অতুলনীয় মিউরাল সমৃদ্ধ মুয়জ্জিন মেহফিলি-এর সঙ্গে সৌদি আরবের ‘এক্সপোর্ট’ করতে চাওয়া সালাফি বিশ্ববীক্ষার বিস্তর গরমিল নেই কি? এ মসজিদের অন্দরসজ্জায় নিযুক্ত দুই বিশিষ্ট পাকিস্তনি শিল্পীই যে শিয়া মুসলমান ছিলেন, সৌদি মসজিদ-কূটনীতির আলোচনা প্রসঙ্গে তাও মনে করিয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক রিজভি! জটিল নানা ধর্মীয় ব্যাখ্যার কুল পাই না আমি৷ হয়তো পেতেও চাই না৷ আমার আগন্তুক চোখ শুষে নিতে থাকে তার শিল্পসাজ৷

ফয়সল মসজিদের অন্দর বাইরের এই সব অসাধারণ শিল্পকর্ম দেখতে দেখতে তাক লেগে যায়৷ কুরেশি সাহেবের মৃদু তাড়ায় মালুম হয় খেয়ালই করিনি কখন সময় চলে গিয়েছে৷ তবু বিস্তীর্ণ সবুজ ময়দান, ঘন গাছের সারি আর মারগাল্লা পাহাড়ের বুকে স্ফটিক ধবধবে জ্যামিতিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সময় কোথায় যেন কী একটা খুব খালি খালি নেই৷ ঠিক সে মুহূর্তে বুঝতে পারি না৷ অনেক অনেক পরে বুঝি এ মসজিদের চারপাশ বড্ড তকতকে৷ মুসলমান সমাজ-সংস্কৃতির কেন্দ্রে যে বাজার, ফয়সল মসজিদ ঘিরে তার কোনও অস্তিত্ব নেই৷ টুপি-চাদর-বাসন-কোসন-জুতো-ফুলের ডালি আরও অজস্র পসরা নিয়ে বসা দোকানদারদের চিৎকার নেই, বিশাল পরোটা আর ঘি চুবচুবে রঙিন হালুয়ার বিপুল থালা সাজিয়ে হালুইকর নেই, রিকশার প্যাঁকপ্যাঁক নেই, কাবাবের ধোঁয়াটে সুবাস নেই৷ ফয়সল মসজিদ দারুণ ঝকঝকে বটে, গমগমে নয়৷

 

(ক্রমশ)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...