অভীক ভট্টাচার্য

চারটি কবিতা | অভীক ভট্টাচার্য

চারটি কবিতা

 

রতন ঢাকি ও মউমাছি

ট্রেন থেকে নেমে বাজারে এককাপ চা আর একটা লেড়ো বিস্কুট খেয়ে রতন যখন মাঠের রাস্তা ধরে, ততক্ষণে দিনের আলো কমে এসেছে। কার্তিকের ছোট হয়ে আসা বেলায় গত জন্মের হাওয়া— গায়ে অল্প শীত-শীত করে। অন্যান্যবারের চেয়ে এবার একটু বেশিই হিম পড়তে শুরু করেছে, রতন ভাবে। ঘাসের গায়ে লেগে থাকা শিশিরে তার স্যান্ডেল ভিজে যায়। আর-বছর বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা এত হিম পড়তে দেখেনি মাঠে, রতনের স্পষ্ট মনে আছে। পুজো দেরিতে হল এবার

গেল বছরের সঙ্গে আর একটা তফাত, এবার সে একা। এর আগে বরাবর সে বাবার সঙ্গে ঢাক বাজাতে গেছে। এবার পুজোর মুখে বাবা মরে গেল। আশ্বিনের ঝড়ে মাঝরাতে তাদের চালাটা যখন পড়ে যায়, বাবা সেই ঘরে শুয়েছিল। ঘুমের মধ্যে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। রতন ভেবেছিল, মা খুব কান্নাকাটি করবে। কিন্তু, মা কাঁদেনি। পুকুরঘাটে কপালে কাদামাটি ডলতে-ডলতে শান্ত গলায় কেবল বলেছিল, ওই ঝড়ের মধ্যে অমন মরণ-ঘুম যে ঘুমোতে পারে, তার মরাই উচিত

রতন জানে, মরণ-ঘুম নয়, বাবা আসলে স্বপ্ন দেখছিল। ঢাক বাজানোর স্বপ্ন। বর্ষার পর গ্রামের সবাই যখন সবজিচাষে ব্যস্ত, বাবা তখন প্রতিবছর ভাদ্র মাসে ঢাক মেরামতির কাজে বসত। চালের আড়া থেকে ঢাকটা নামিয়ে ঝেড়ে-মুছে, ছইয়ে ঘি মাখিয়ে, টানাগুলো নতুন করে বেঁধে, রোদ খাইয়ে সেটা থেকে আওয়াজ বের করত। এবারও ঢাকটা নামিয়েছিল, কিন্তু রোদে দিয়ে তার আওয়াজ বের করার আগেই ক’দিন ধরে মেঘ করে রইল খুব। তারপর সেদিন সন্ধে থেকে ঝড়, সঙ্গে আকাশ ছেঁদা করে বৃষ্টি

মাঠের মধ্যে দিয়ে ফিরতে ফিরতে রতন দেখে, গাঢ় সবুজ সর্ষেখেতের মাথায় অল্প-অল্প হলুদের দাগ— ফুল আসতে শুরু করেছে। দুগ্‌গাভাসানের বোল থামলে তবে সর্ষেখেতে ফুল ধরে, বাবা বলত। সেই ফুলের গন্ধ উঠলে আকাশ থেকে হিম নামে, মউমাছিদের ঘুম ভাঙে। আবছা অন্ধকারে মাঠের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে রতন মউমাছিদের খোঁজার চেষ্টা করে। পাতার ওপর ফোঁটা-ফোঁটা হিম ছাড়া আর কিছু তার চোখে পড়ে না

সন্ধের হিমে ঢাকের আওয়াজ বসে যায়, বাবা বলত। কাঁধের গামছাটা দিয়ে রতন ঢাকের ছইটা পরিপাটি করে মুড়ে নেয়

 

শ্রীদাম ও রাধামাধব

একেকদিন রাত্তিরে খুব চাঁদ উঠলে শ্রীদামের বাড়িতে রাধামাধব আসেন

রাত্তিরে নারকেলপাতায় সরসর করে পিছলে যায় জোছনা, সিঁড়িতে তাঁদের পায়ের ছাপ ফুটে ওঠে, ছাদে তাঁদের নুপূরের রুনুঝুনু, বাঁশির সুর শোনা যায়। চরাচরজোড়া সেই লীলার মধ্যে দেখা যায় চাঁদের গা বেয়ে মাখনের মতো জোছনা নেমে এসে তাঁদের মাথার মুকুটে পা ঝুলিয়ে বসেছেন

গোয়ালঘরের ভিতর থেকে সেই বাঁশি শুনে চঞ্চল হয়ে ওঠে তাদের কালীবাছুর, তার মা খুশিতে তাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য অসময়ে বাঁট পেতে দাঁড়ায়। পুকুরের যত ল্যাটামাছ, কইয়ের বাচ্চা, সবাই ঘাটে এসে পাখনা নাড়াতে থাকে

গৃহস্থের ঘরে সেই সময় আলো জ্বালতে নেই। শ্রীদামের বউ মাথায় কাপড় দিয়ে একবাটি দুধ-বাতাসা উঠোনে তুলসিগাছের নীচে রেখে আসে— লীলাখেলার পর যদি তাঁদের খিদে পায়…

সংসারময় অমন ছলোছলো ভক্তিভাবের মধ্যে, তারপর, শ্রীরাধিকার বুকে জামা নেই দেখে লজ্জায় শ্রীদামের বউ জিভ কাটে। কাপড়ের আঁচলটা গায়ে ভাল করে জড়িয়ে নেয়, নিয়ে ঠাকুর-নমো করে

 

পঞ্চানন ও তার লঙ্কাখেত

পঞ্চাননের সামান্য জমি, তাতে এবারের শীতে সে লঙ্কার চাষ দিয়েছে

ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে এইটুকুন লাল-লাল লঙ্কা আকাশের দিকে মুখ করে ফুটে থাকবে, সেই দৃশ্য দেখার তার ভারী সাধ। মনে মনে সেই ছবি দেখতে দেখতে আবেশে তার দুই চক্ষু মুদে আসে

রোজ সকালে পঞ্চানন নিড়ুনি দিয়ে লঙ্কাচারার গোড়ার আগাছা সাফ করে। লঙ্কাগাছের জন্য তার এত ভালবাসা, এত কষ্টে কেনা সার, এত স্নেহমমতা— সব ওই আগাছাগুলো খেয়ে ফেলছে ভাবলেই পঞ্চাননের ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলে যায়, আর তার নিড়ুনির ধারও ততই বেড়ে ওঠে

পোকামারার ওষুধ দেওয়ার দিন সকাল থেকে পঞ্চানন সিংহের মতো গর্জন করতে থাকে। ওইটুকুন পুটপুটে পোকা, অথচ তাদের টিপে মারার জন্য তার কাঁধের পাশ থেকে আরও দশটা হাত গজায়। টিয়েপাখি তার এত পছন্দের, কিন্তু আকাশে টিয়ের ঝাঁক দেখলেই সে লাঠি নিয়ে খেতের দিকে দৌড়য়— চেঁচিয়ে তাদের বাপমা তুলে গাল দিতে থাকে। হুঙ্কার দিয়ে বলে, নির্বংশের ব্যাটা, তোদের মরণ কিসে হয়

তারপর যেদিন পাতার ফাঁকে লাল-লাল ফুটকি দেখা যায় সেদিন ঘুমের মধ্যে পঞ্চানন স্বপন দেখে, তার বড়ভাইয়ের ব্যাটা সব লঙ্কা মহাজনকে বেচে দিয়ে এসেছে, তাকে না-জানিয়ে

ওই অন্ধকার রাতে, কাটারি হাতে পঞ্চানন তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে

 

সলিমভাই ও এনায়েত খাঁ সাহেবের সুরবাহার

বিজাপুর থেকে একশো কিলোমিটার দূরে মিরজ টাউনের রেল জংশন-লাগোয়া কারখানায় বসে আজ সকালে সলিম যখন নতুন সুরবাহারে তার পরাচ্ছিল, তখন হঠাৎই জানলায় একটা চড়ুইপাখি এসে বসে। মুখে খড়কুটো দেখে সলিম টের পায়, পাখিটা জানলার ওপরের ঘুলঘুলিতে বাসা বানানোর তাল করছে। কিন্তু পাখিটাকে সলিম কিছু বলেনি, তাড়ানোরও চেষ্টা করেনি। কারণ, তার দুই হাত আর দুই চোখ তখন সুরবাহারের কানে চুন মাখিয়ে তাতে তার জড়ানোয় ব্যস্ত ছিল। পুবের জানলায় এই সময়টা রোদ আসে বলে খোলা রেখেছিল, না হলে এই উৎপাতটা হত না— কেবল এইটুকু ভেবে, এবং মনে মনে আর কোনওদিন জানলাটা না-খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে ফের কাজের মধ্যে ফিরে যায়

তিনপুরুষ ধরে বাজনা বানিয়ে আসা সলিমের কাছে সুরবাহারে তার পরানোটা অবশ্য কোনও কাজই নয়। গত দশ বছরে একশোর বেশি যন্ত্রে তার পরিয়েছে সে। সলিম জানে, অন্ধকারে চোখ বুজেও এ কাজটা সে অনায়াসে করতে পারে। মিরজের ডাকসাইটে কারিগর, দাদু মাম্মুলাল হোসেন সাহেবের কাছে তার যন্ত্র বাঁধার তালিম। পঞ্চাশ বছর ধরে সেতার আর সুরবাহারের জোয়ারি করে আসা মাম্মুলাল ছিলেন অন্ধ। স্রেফ ঘরজের গায়ে আঙুল বুলিয়ে আর কানে শুনে মাখনের মতো জোয়ারি করতেন। বড়-বড় ওস্তাদদের ঘরে যেত সেসব যন্তর। সলিমকে তিনি হাতে ধরে নিজের বিদ্যা শিখিয়েছিলেন। তুম্বার লাউ-বাছাই থেকে তবলির গায়ের নকশা, তার-গহন আর পরদা বসানো থেকে মোগারার কাজ— সব একার হাতে করতে পারে সলিম। সে কেন খামোখা একটা চড়ুইকে নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করতে যাবে

বিশেষ করে এই কাজটা। সলিম জানে, তার অনেকদিনের স্বপ্ন স্রেফ আগামী দু’ঘন্টার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে সুরবাহারটা সে বানাচ্ছে, সেটা এনায়েত খাঁ সাহেবের যন্ত্রের একেবারে হুবহু জুড়ুয়া। গত শতাব্দীর শুরুতে কলকাতার চিৎপুর রোডে কানাইলাল দত্তের দোকানে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সে যন্ত্র তৈরি করিয়েছিলেন খাঁ সাহেব। কী তার জাফরিদার নকশা, কী খানদানি, ভরাট আওয়াজ! খাঁ সাহেবের এন্তেকালের পর সে যন্ত্র যায় ছেলে ইমরাতের হাতে। সারা জীবন ওয়ালিদের হাতের সেই বাজনা ছাড়া অন্য কোনও যন্ত্র হাতে তোলেননি ইমরাত

গত কয়েকমাস ধরে হাতের অন্য সব কাজ ফেলে এই বাজনাটা বানাচ্ছে সলিম। রেকর্ডের মলাটের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে সমস্ত নকশা হুবহু এঁকেছে। এখন কেবল তার পরানো বাকি। এইটুকু হয়ে গেলে সে সুর মেলাবে। লোককে জানানো আছে, বিজাপুর থেকে কাগজের রিপোর্টার ডেকে এনে ছবি তোলাবে। খবর বেরোবে। দেশের লোক তারিফ করবে। বলবে, মাম্মুলালের নাতির হাত ধরে একশো বছর পর সহি জুড়িদার পেল বাবা এনায়েত খাঁর সুরবাহার

তার বাঁধতে-বাঁধতে সলিম হঠাৎ মুখ তুলে দেখে, চড়ুইটা এখনও ঠায় বসে আছে একই জায়গায়। যেন, একমনে তার কাজ দেখছে। একটু ভাল করে তাকাতেই হঠাৎ মাথার ভেতরে কিসের একটা ধাক্কা লাগে তার

চড়ুইটার চোখের জায়গাদুটো সাদা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...