আমি কেন অনুবাদ করি, কীভাবে করি

মুম রহমান

 


অনুবাদককে সৎ হতেই হবে। আর সততার সৌন্দর্য আছে। মনে রাখতে হবে লেখাটি আমি নিজে লিখছি না, আরেকজনের লেখাটি আমার ভাল লেগেছে অথবা আমি প্রয়োজন মনে করেছি অন্যদেশের অন্যভাষার মানুষটির এই লেখাটি আমার ভাষায় আমার দেশের লোক পড়ুক— তাই আমি অনুবাদ করেছি। কাজেই বিশ্বস্ততা বড় জিনিস। আর সৌন্দর্য? প্রচুর পরিশ্রম, মেধা আর সততা থাকলে এক সময় সে সুদর্শন হয়ে উঠবেই

 

আমি প্রথম অনুবাদ করি আস্ত একটা বই। শিশুতোষ বইটার নাম ছিল ‘সাদাকো ও সহস্র সারস’। আজ থেকে ১২ বছর আগের কথা, মানে ২০১০ সালে আমি এলিয়ানর কোয়ের ‘সাদাকো ও সহস্র সারস’ নামের বইটা হাতে পাই। তখন আমি একটা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়াই। তাদের লাইব্রেরি বেশ ঋদ্ধ। আমি যেহেতু নাটকের শিক্ষক ছিলাম সেহেতু তুলনায় চাপ কম ছিল। মানে পরীক্ষার খাতা দেখা, প্রশ্নপ্রত্র এইসব ছিল না। ফলে প্রচুর সময় পেতাম আর সময়টা স্কুলের ছিমছাম লাইব্রেরিতে কাটাতাম। সে-সময়েই এক ছাত্রী আমাকে বইটা হাতে তুলে দেয়। তার অনুরোধেই আমি বইটা শুরু করি। এবং প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় টানা পড়ি। আমার পড়ার গতি ভাল, চোখও তখন বেশ ভাল, ফলে একটানে পড়ে উঠি। কিন্তু পড়ে উঠি বলাটা বোধহয় ঠিক হল না, কারণ আমি আসলে বইটা শেষ করে উঠতে পারছিলাম না। আক্ষরিক অর্থেই আমি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম, আমি কাঁদছিলাম চুপেচুপে আর আর বুকের মধ্যে, গলার মধ্যে কী যেন দলা পাকাচ্ছিল নিরন্তর। আমি একটা তীব্র তাড়না অনুভব করতে থাকি। আমি বইটা লাইব্রেরি থেকে আমার নামে উঠিয়ে নিয়ে আসি। ঘটনাক্রমে পরের দিন ছিল স্কুল ছুটি। আমি বইটা নিয়ে বসলাম। জাপানের এক শিশু সাদাকো যে হিরোশিমা বোমা হামলার সময় জন্মায়নি, অথচ যার জন্মের কয়েক বছর পরই শরীরে ক্যান্সার জন্মেছে বোমা হামলার তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কারণে— তার বেদনার্ত গল্প আমি অনুবাদ করতে বসলাম। মাত্র দুইদিনে আমি বইটি অনুবাদ করেছি। বইটি অবশ্য আকারে খুব বড় নয়, পাফিম পেপারব্যাকের বইটি মাত্র ৬৪টি পৃষ্ঠার। কিন্তু আজকের দিনে এসেও আমাকে কেউ যদি বলে ৬৪ পৃষ্ঠা দুইদিনে অনুবাদ করে দিতে, আমি ‘অসম্ভব’ বলেই তাকে বিদায় করব। কিন্তু এই ‘অসম্ভব’ কাজটি করে ফেলেছিলাম আমি অবলীলায়। কেন করেছিলাম? সম্ভবত এইখানে ‘মানুষ কেন অনুবাদ করে’ জিজ্ঞাসার একটা ব্যাখ্যা আছে।

আমরা যে বলি মানুষ সামাজিক জীব, সে কথা শতভাগ সত্য। সুখে, দুঃখে মানুষ ভাগাভাগি করতে চায়। জগতের দু-চারজন মানুষ ছাড়া বাকিরা নিজের আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেয় স্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবেই। আর জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাগ করে নেওয়াটা বোধহয় একটা জরুরি প্রয়োজনীয়তা। ‘সাদাকো অ্যান্ড থাউজেন্ড পেপার ক্রেইন’ একজন আমেরিকানের লেখা বই, সত্য কাহিনি অবলম্বনে লেখা, সে কাহিনি একজন জাপানি মেয়ের। আমি বাংলাদেশের এক লেখক মার্কিন লেখিকার জাপানি মেয়ের গল্প অনুবাদ করে ফেললাম এই ভাগাভাগির আকাঙ্খা থেকেই। বইটা পড়েই আমার প্রথমে অনুশোচনা হল, এমন বই কেন আগে পড়িনি। বইটা তো লাইব্রেরিতে ছিল, কেন খুঁজে পাইনি। তারপরই মনে হল, বাকিদেরও তো এই বইটা পড়া উচিত। বিশেষ করে বাংলার সেইসব পাঠকদের যাঁরা সচরাচর ইংরেজি পড়েন না বা পড়তে পারেন না, তাঁদেরও তো এই বইটা পড়া উচিত। অতএব আমি অতি দ্রুত এক অজানা তাড়নায় অনুবাদ করে ফেললাম। অনুবাদ সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দিক হল এই তাড়না। অন্য ভাষায় লেখা, অন্য সংস্কৃতির যে গল্পটি আমাদের তাড়িত করে আমরা চাই তা বাকিদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে। সাদাকো পাঠের আনন্দ আর সাদাকোর বেদনা আমি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি। তাই আমি ‘সাদাকো ও সহস্র সারস’ অনুবাদ করেছি।

 

এখন আমার অনুবাদ গ্রন্থের সংখ্যা ২১টি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর সবগুলো একই তাড়নায় লিখিনি। কোনও কোনও বই প্রয়োজনেই অনুবাদ করেছি, কোনও কোনও বই ভালবাসায়, কোনও কোনও বই বিরক্তিতে বা অসন্তোষে। আমার দ্বিতীয় অনুবাদ গ্রন্থ ‘অণুগল্প: কাফকা’ অনুবাদ করেছি এক ধরণের বিরক্তি বা অসন্তুষ্টি থেকে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকাল থেকে ইংরেজি বই পড়া শুরু করি। আমি নাটক পড়তাম। তখন যে-সব বিশ্বনাটক আমাদের পাঠ্যসূচিতে থাকত তার সব অনুবাদ বাংলা ভাষায় পেতাম না, আবার পাঠ্যসূচির বাইরেও নাটক পড়তে ইচ্ছে করত। ইবসেনের ‘ডলস হাউস’ বা সফোক্লিসের ‘অয়দিপাউস’ পেয়ে গেছি শম্ভু মিত্রের অনবদ্য অনুবাদে। কিন্তু ইবসেনের বাকি নাটকগুলো, সফোক্লিস বা অন্যান্য ধ্রুপদী গ্রিক নাটকগুলো তো পাওয়া মুশকিল ছিল। যতদূর মনে পড়ে ‘তুলি-কলম’ নামের একটা প্রকাশনী থেকে সুধাংশুরঞ্জন ঘোষের একটা বই পেলাম ‘গ্রিক নাটক সঙ্কলন’। এটা ১৯৯০ সালের কথা। সে সময় ওই বইটাতে ১৪/১৫টা গ্রিক ধ্রুপদী নাটকের অনুবাদ পেয়ে যাওয়া আমার জন্য ছিল সোনার খনি আবিষ্কার। বইটা আমি বগলদাবা করে ঘুরি আর নিজেকে খুব বড়লোক ভাবি। অথচ বইটা পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই। নাটকগুলো আকারে ছোট, ইউনিভার্সিটির বাসে আসা-যাওয়ার পথেই আমি পড়ে ফেলি একেকটা নাটক। কিন্তু স্বাদ লাগে না, তৃপ্তি পাই না। মনে হল, কী যেন নাই। এই ‘কী যেন নাই’ থেকে শুরু হল আমার ইংরেজি পড়া। আমি যেহেতু গ্রিক পড়তে পারি না সেহেতু ইংরেজি অনুবাদগুলো জোগাড় করতে থাকলাম। এখানে একটা মজার বিষয় আছে। আমাদের বাংলাদেশের পুরনো বইয়ের রাজত্ব হল নীলক্ষেত। সেখানে একটা বাংলা বই হয়তো বিশ টাকায় কিনছি। সেটা হয়তো মামুনুর রশীদ বা মনোজ মিত্রের কোনও নাটক কিংবা কোনও একটা অনূদিত নাটক। মজার বিষয় হল, শিশিরকুমার দাশের অনুবাদ করা সফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’ কিনছি বিশ টাকায়, অথচ পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত সফোক্লিসের ‘থেবিয়ান প্লেই’স’ পেয়ে যাচ্ছি সেই বিশ টাকাতেই। মানে একই দামে বাংলা ভাষায় পাচ্ছি একটা অনুবাদ নাটক, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় পাচ্ছি তিনটি অনুবাদ নাটক। এটা আমাকে খুব উপকৃত করল। আমি দেখলাম টমাস মানের কোনও বাংলা অনুবাদের চেয়ে তার ইংরেজি অনুবাদ সহজে পাওয়া যায় আবার দামের হিসেবেও কম পড়ে। আমি ইংরেজি বই কিনতে লাগলাম। আবার দেখলাম হাতে ইংরেজি বই থাকলেও লোকে বেশ সমীহ করে। ইংরেজি টুকটাক বলতে পারলেও একটা গুরুত্ব পাওয়া যায়। এইবার আমি সদস্য হয়ে গেলাম ব্রিটিশ কাউন্সিল আর আমেরিকান কালাচারাল সেন্টারের। সেখানে আমার মনমতো বিখ্যাত লেখকদের বই পাওয়া যায়। আমার চোখের সামনে খুলে গেল ধ্রুপদী সাহিত্য ভাণ্ডার। আমি অভিধান ঘেঁটে ঘেঁটে পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম, যে-করেই হোক ইংরেজি ভাষাটা আমাকে ঠিকঠাক আয়ত্ত করতে হবে, অন্তত গড়গড় করে পড়ে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আরও একটা দিক নিজেকে বোঝালাম, কবে কে কোন ভাষার কোন নাটক, উপন্যাস, গল্প বাংলায় অনুবাদ করবে সে আশায় আমি বসে থাকব? তাহলে তো আমার পড়ার গতি ও আগ্রহটা অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। সেই চিন্তা থেকে আমি নিজেই শুরু করলাম ইংরেজি পাঠ। একে একে গ্রিক নাটকগুলো থেকে শুরু করে ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, মলিয়ের, বার্নাড শ, আর্থার মিলার, এডওয়ার্ড এলবি, টেনিসি উইলিয়ামস পড়তে লাগলাম আমি। আমি আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম আমার অভিধান দেখার হারটাও কমে আসছে। এখন আর পাতায় পাতায় অভিধান ঘাঁটা লাগে না। আবার কোনও কোনও শব্দের ঠিকঠাক মানে না-জানলেও পুরো বাক্যটার অর্থ আমি বুঝতে পারছি এটা অনুধাবন করলাম। এই অনুধাবন আবার আমাকে অনুবাদে তাড়িত করল। এক ভাষার শব্দকে আরেক ভাষার শব্দে, শব্দমালায়, বাক্যে সাজাতে সাহায্য করল। যেহেতু নাটকের ছাত্র ছিলাম, সেহেতু নাটক পাঠটাই শুরুতে বেশি ছিল। আর আপনারা জানেন, নাটক মানেই মূলত সংলাপ, সংলাপ মানেই মুখের ভাষা। কাজেই মুখের ভাষাটাকে আয়ত্ত করা শুরু হল। অন্য আরেকটি ব্যাপার ছিল, সেই যে বিরক্তি, অসন্তোষ, সেটির ফলাফল হিসেবে এল ‘কাফকা’। দুই বাংলাতেই কাফকার সব লেখা অনূদিত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু আমি কাফকা পড়ে আনন্দ পাই না। ইতোমধ্যেই ‘এভরিম্যান’স লাইব্রেরি’ থেকে প্রকাশিত ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘কালেকটেড স্টোরিজ’ আমার সংগ্রহ হয়ে গেছে। আমি বাংলায় কাফকা পড়তে গিয়ে বিরক্ত হলাম। আমার কাছে মনে হত, কাফকা এত নামী একজন লেখক, অথচ তাঁর লেখা পড়তে ভাল লাগছে না? এটা কি আমার রুচির সঙ্কট? আমি কি কাফকা পড়তে বা অনুধাবন করতে সমর্থ নই? এই ভাবনা থেকেই আমি ভিলা এ- এডুইন মুইর, তানিয়া এ-জেমস স্টার্নের অনুবাদ করা গল্পগুলো পড়তে শুরু করলাম। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম, বাংলা অনুবাদ আমি অনুধাবন করতে না-পারলেও ইংরেজি অনুবাদ আমি অনুধাবন করতে পারছি, শুধু তাই নয় গ্যাব্রিয়েল জোসিপোভিকি-র সম্পাদিত এই অনুবাদ গ্রন্থের অনুবাদগুলো আমার ভালও লাগছে। সেই থেকে আমার মনে হল, আদতে আমি যে বাংলা অনুবাদগুলো পড়েছি সেগুলো ঠিকঠাক ছিল না। এই প্রথম অনুবাদের সাবলীলতা, যর্থাথতা আমাকে ভাবাল। ‘সাদাকো’ অনুবাদ করেছিলাম একটা ভাবালুতায়, প্রকাশের তাড়নায়। আর কাফকা অনুবাদ শুরু করলাম অনেকটা ভেবেচিন্তেই। বিবিধ বাংলা অনুবাদ আমাকে যে বিরক্তি আর অসন্তোষ দিয়েছিল তার জবাবেই যেন আমি ‘অণুগল্প: কাফকা’ অনুবাদ করি। অনুবাদকর্ম যে একটা প্রাজ্ঞতার বিষয়, সৃষ্টিশীলতার বিষয় তা আমি কাফকা অনুবাদ করতে গিয়ে টের পেলাম। সেই সঙ্গে এটাও টের পেলাম, শব্দ থেকে শব্দ, বাক্য থেকে বাক্য একভাষা থেকে অন্য ভাষায় আনলেও অনুবাদ সম্পন্ন হয় না। আদতে অনুবাদককে জানতে হয় অন্য সংস্কৃতি, অন্য দেশ, অন্য রাজনীতি এবং অন্য সময়কেও। আমার মাথায় এই ভাবনা এল যে কাফকা কী ভাষায় লিখতেন? অবশ্যই জার্মান ভাষায়। কিন্তু সকল জার্মান লেখকই তো জার্মান ভাষায় লেখেন। যেমন, সকল বাংলা লেখকই তো বাংলায় লেখেন। তাই বলে কি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালিওল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হুমায়ূন আহমেদের বাংলা ভাষা এক? তাদের প্রত্যেকের ভাষাভঙ্গি, মেজাজ, লেখার ধরন তো আলাদা। সবগুলো ভাষা বাংলা হলেও প্রত্যেকটি বাংলারই রয়েছে নিজস্ব ঘরানা। এখন এমন প্রশ্ন আমার মনে হল, ব্রেখট আর কাফকা আর টমাস মান তো একই জার্মান ভাষায় বা একই ভঙ্গিতে লেখেননি। তাহলে আমি তো কেবল তিনমাসের প্রাথমিক একটা ভাষাশিক্ষা কোর্স করেছি, তা দিয়ে কি এদের জার্মান ভাষার তফাত ধরতে পারব? পারার কথা না। তখন আমি যাঁরা ধরতে পারেন তাঁদের লেখা পড়তে শুরু করলাম। অর্থাৎ কাফকার রচনাশৈলী নিয়ে সুবিদিত যে-সব আলোচনা, বিশ্লেষণ আছে সেগুলো পড়তে থাকলাম। আমি মনে মনে কল্পনা করতে থাকলাম কাফকা বাংলা ভাষায় লিখলে ঠিক কোন ধরনের শব্দে লিখতেন, কেমন হত তাঁর বর্ণনাভঙ্গি। আমি এইবার সেটাকে অবলম্বন করে অনুবাদ করতে শুরু করলাম। আমি আবিষ্কার করলাম, শুধুমাত্র বাক্য থেকে বাক্যে অনুবাদ করলেই অনেক সময় অন্য ভাষার পাঠককে মূল লেখার স্বাদ দেওয়া যায় না। সে কারণেই আমি কাফকা অনুবাদের পর থেকে আমার প্রতিটা অনুবাদগ্রন্থে টীকা, টিপ্পনি, দীর্ঘ ভূমিকা এবং লেখক পরিচিতি সংযুক্ত করেছি। আমার মনে হয়েছে এইসব টীকা পাঠককে অপরিচিত মিথ কিংবা প্রতীকির সঙ্গে একাত্ম করতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ মূল টেক্সটের সঙ্গে আমার অনুবাদগ্রন্থে বরাবরই বাড়তি কিছু যোগ হতে থাকল। এই বাড়তি কিছুটা অবশ্যই জোর করে নয়, প্রয়োজনেই যোগ হল।

 

এই যোগ হওয়ার ব্যাপারটি বেশি করে দেখা যায় কবিতার ক্ষেত্রে। আমি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অনুবাদ করেছি কবিতা। সাফো, এমিলি ডিকিনসন, সিলভিয়া প্লাথ, চার্লস বুকোস্কি, রিচার্ড ব্রাউটিগান, লুইস গ্লিক প্রমুখের নির্বাচিত কবিতা নিয়ে আমি আলাদা আলাদা বই করেছি। সেই সব কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে আমি বুঝেছি, এমিলি-র ‘বুনো রাত্রি’ বা সিলভিয়ার ‘এরিয়েল’ কেবল শব্দ ধরে ধরে অনুবাদ করলে হয় না। এইসব কবিতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে শুরু করে, বাক্যের বা শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানেগুলোও পাঠককে ধরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। আর এটা তো জানা কথা, গল্পের, উপন্যাসের সরলতার চেয়ে কবিতা আঙ্গিকগতভাবেই দুরূহ। গল্প, উপন্যাস প্রায়শই কাহিনির আগামাথা ধরে তড়তড় করে এগিয়ে যায়। কাফকা, বোর্হেস-গণ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাঁদের পাঠ করতে গেলে খুব আয়েশি হয় না। মানে খুব আলসে পাঠকের পক্ষে দুপুরের ভাতঘুম দিতে দিতে কাফকা, বোর্হেসের জগতে প্রবেশ করা কঠিন হবে। একই ব্যাপার কবিতার ক্ষেত্রেও। সাফো কিংবা বুকোস্কিকে ভালভাবে অনুধাবন করতে গেলে একজন পাঠককে মূল টেক্সটের বাইরে আরও অনেক কিছু জেনে, বুঝে আসতে হয়। আমি অনুবাদক হিসেবে তাই যেখানেই মনে করেছি, দু-কথা বেশি লিখলে পাঠক উপকৃত হবে সেখানেই টীকা-টিপ্পনি দিয়েছি। সিলভিয়া, এমিলির কবিতার ক্ষেত্রে তো আমি কবিতা ধরে ধরে দীর্ঘ আলোচনাও করেছি যাতে করে পাঠক ভেতরের নির্যাসটা পেতে পারে।

 

এইবার অনুবাদের একটা বড় সঙ্কট নিয়ে কথা বলি। বিশের অধিক অনুবাদ গ্রন্থ করার পর অনুবাদের সঙ্কট ও সম্ভাবনা নিয়ে কিছু বলা যেতেই পারে। অনুবাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি আরামটি হল সৌন্দর্য আর চরিত্রের আলাপ। ওই যে বলেছিলাম, বাংলা ভাষায় লিখলেও রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ বা ‘লিপিকা’ একই ভাষা বা ভঙ্গির কবিতা নয়। সেইটি হল লেখক ও লেখার একটা চরিত্রগত দিক। প্রত্যেক বড় লেখকের একটা নিজস্ব রচনাশৈলী থাকে। কোনও কোনও মহৎ লেখক তাঁর প্রতিটি লেখাতেই আলাদা শৈলী নির্মাণ করেন। আবার কেউ কেউ ভাঙেন। বোর্হেস গল্পকে উপস্থাপন করেন প্রবন্ধের ছদ্মবেশে, প্রচুর ধাঁধা, পুরাণে ভরে দেন গল্পের শরীর। মার্কেজ চলতে চলতে চেনা জগতের ভেতরে অচেনা গলিগুপচি গুঁজে দেন। সিলভিয়া প্লাথ ‘টিউলিপ ফুল’ বা ‘মাশরুম’কে অন্য এক সত্তায় গেঁথে দেন। অবশ্যই অনুবাদকের কাজ হল বিশ্বস্তভাবে লেখকের চরিত্র, সত্তা, রচনাশৈলীকে অনুসরণ করা। বাক্য বা শব্দের ভেতরে অনেক সময় তা না-ও থাকতে পারে। আক্ষরিক অনুবাদ ভয়াবহ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে এটা মাথায় রেখেই অনুবাদককে মূলের বিশ্বস্ত অনুসরণ করতে হবে বলে আমি বিবেচনা করি। এখন সিলভিয়ার কবিতার ‘এরিয়েল’ কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ আমি দেখেছি কিংবা পাওলো কোহেলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’-এর একাধিক অনুবাদ দেখেছি, এককথায় সেগুলো অসৎ। অসৎ এই কারণে যে তাঁরা অক্ষরের বা শব্দের অনুবাদ করেছেন, লেখক ও তাঁর লেখাকে অনুবাদ করেননি। আমি কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে কখনওই মূল কবিতার লাইল বিভাজন, পর্ব বিভাজন অদলবদল করি না। কবি সপ্তম লাইনে যা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন আমাকেও সপ্তম লাইনে তাই বলতে হবে, সেভাবে বলতে হবে। অনেকক্ষেত্রেই অসৎ অনুবাদক নিজের দুর্বলতা ঢাকতে এগুলো গুলিয়ে ফেলেন। কোহেলহোর অনুবাদে দেখি এক-দুই অনুচ্ছেদ বাদ দিয়েছেন, এরিয়েল অনুবাদে দেখেছি কোথাও নিজের মনের মতো লাইন জুড়ে দিয়েছেন বা বাদ দিয়েছেন। হতে পারে, একটি লাইন বা বাক্যের সঠিক অনুবাদ আমি করতে পারিনি, কিন্তু কোনওভাবেই সেটাকে সচেতনভাবে বদলে ফেলা বা বাদ দেওয়া যায় না। এটা অসততা। অনুবাদককে সৎ হতেই হবে। আর সততার সৌন্দর্য আছে। অনেকেই এমন বলেন, কবিতা অনুবাদ ভাবানুবাদ। ঠিক তাই। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে কবিতাটি আমি নিজে লিখছি না, আরেকজনের লেখাটি আমার ভাল লেগেছে অথবা আমি প্রয়োজন মনে করেছি অন্যদেশের অন্যভাষার মানুষটির এই লেখাটি আমার ভাষায় আমার দেশের লোক পড়ুক— তাই তো আমি অনুবাদ করেছি। কাজেই বিশ্বস্ততা বড় জিনিস। আর সৌন্দর্য।

অনুবাদের সৌন্দর্য সম্পর্কে আমার ভাবনাটি হল হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ানের সেই ‘কুৎসিত হাঁসের ছানা’র মতোই। অর্থাৎ আপাত অসুন্দর অনুবাদও ক্রমশ পরিণতির দিকে গেলে সৌন্দর্য পাবে। পরিশ্রমী, সৎ অনুবাদক নিরলস কাজ করলে তাঁর অনুবাদ সুন্দর হবেই। চরিত্রেরও একটা সৌন্দর্য, মাধুর্য আছে। তাই আমরা লেখালেখির ক্ষেত্রেও লেখকের চরিত্র, লেখার চরিত্র নিয়ে কথা বলি। লেখকের মেজাজ, লেখার মেজাজ ধরতে পারলে বাড়তি সৌন্দর্যের প্রয়োজন হয় না। আমি নিজে যতটা পারি মূলানুগ অনুবাদ করি প্রথমে। তারপর দ্বিতীয় পাঠের সময় নানা প্রতিশব্দ বদলাই। এক ‘মেঘ’, ‘বাতাস’-এর বদলে কত শব্দই তো ব্যবহার করা যায়। বারি, জলদ, হাওয়া, সমীরণ ইত্যাদি নানা বিকল্প শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে কবিতা অথবা গদ্যেও ভাষার ব্যঞ্জনা আনতে। আমি যখন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার জাতীয় কবি ম্যাক ডিজ্ডারের ‘স্টোন স্লিপার’ অনুবাদ শুরু করি তখন প্রচুর তৎসম, তদ্ভব শব্দ ব্যবহার করি। কারণ মূলে ম্যাক ডিজ্ডার তাঁর কবিতায় মধ্যযুগের বসনিয়ার আবহ, পুরাণ যেমন ব্যবহার করেছেন তেমনি তাঁর ইংরেজি অনুবাদে ফ্রান্সিস জোন্স মধ্যযুগের ইংরেজি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ মূল টেক্সটের প্রতি বিশ্বস্ততা থেকে আমি কাজ শুরু করি। তারপর সৌন্দর্য নিয়ে ভাবি দ্বিতীয় সম্পাদনায়, কখনও তৃতীয় সম্পাদনায়। সে-সময়ে আমি মূল ভাব আর ভঙ্গি অক্ষুণ্ণ রেখে প্রতিশব্দ নিয়ে কাজ করি, বাক্যের বিন্যাস নিয়ে কাজ করি। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটি কয়েকটা প্রক্রিয়াতেই হয়।

আমার এক বন্ধু ছেলেবেলায় খুব সুদর্শন ছিল না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সুদর্শন হয়ে উঠল। খুব ভাল ছাত্র ছিল। প্রচুর পরিশ্রম করত। সেইসঙ্গে মেধাবীও ছিল। ফলে পাশ করতেই ভাল চাকরি। একে একে পদোন্নতি। নিজের অফিসের কল্যাণে গাড়ি, ড্রাইভার, শেফ সবই পেল। আমি দেখতে থাকলাম তার চলনে, বলনে একটা দৃঢ়তা এল, সে দক্ষ হয়ে উঠল যোগাযোগে, কথায়বার্তায়। ভাল অনুবাদ এমনই। প্রচুর পরিশ্রম, মেধা আর সততা থাকলে এক সময় সে সুদর্শন হয়ে উঠবেই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...