দেবাশীষ দেব
অজিত নাইনান একটা জিনিস বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে হিউমারই হোক অথবা থিম, কার্টুনিস্টের ড্রয়িং একেবারে নির্ভুল হতে হবে, একইসঙ্গে দৃষ্টিনন্দন হতে হবে। সেটাই পাঠক বা দর্শকের মন জয় করার একমাত্র উপায়
অজিত নাইনানের পুরো নাম হল অজিত নাইনান ম্যাথিউ, অজিত কেরলের খ্রিস্টান। অজিতের কাজ আমি প্রথম দেখি যখন আমি কার্টুন আঁকতে শুরু করি, তখন থেকে। সেটা ১৯৮০ সাল। অজিত নাইনান আর আমি একই বয়সি। ওঁর চলে যাওয়ার পরে আমি দেখলাম যে আমাদের দুজনের বয়সই আটষট্টি বছর। অর্থাৎ অজিত নাইনান খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাজের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এবং নিজের প্রতিভাবলে খুব অল্প বয়সেই ভারতবর্ষের একজন প্রথম সারির কার্টুনিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। অজিত নানারকমের কাজ করেছেন সারাজীবন। আমি প্রথম তাঁর কাজ দেখি ‘টার্গেট’ ম্যাগাজিনে। ‘টার্গেট’ ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের ম্যাগাজিন ছিল, ছোটদের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন, এখন আর প্রকাশিত হয় না। তাতে অজিত নাইনান নিয়মিতভাবে একটা কমিক স্ট্রিপ আঁকতেন, নাম ছিল— ডিটেকটিভ মুচওয়ালা। ছোটদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল এই চরিত্রটি। অজিত’স ওয়ার্ল্ড বলে আরেকটা স্ট্রিপও ওখানে নিয়মিত বেরোত। তাতে ছোটদের উপযোগী ছোট ছোট কার্টুন প্রকাশ পেত। অজিত’স ওয়ার্ল্ড আমার খুব ভাল লেগে গেল। সেইসময় আমি ‘ম্যাড ম্যাগাজিন’ খুব দেখতাম, কিনতাম। ওখানে সের্গিও আরাগোনেস বলে এক মেক্সিকান শিল্পী কার্টুন আঁকতেন। তাঁর কার্টুনগুলো ছিল যাকে বলে self-explanatory, ছবিগুলোর সঙ্গে কোনও কথা বা ক্যাপশন থাকত না, তার দরকারও হত না। অজিত’স ওয়ার্ল্ড-এর কার্টুনগুলোও অনেকটা সেরকমই ছিল। একটা পৃষ্ঠায় ছোট ছোট করে অনেকগুলো কার্টুন থাকত। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, কী অসাধারণ সব আইডিয়া ছিল ভদ্রলোকের।
অজিত নাইনানের কাজের আরও একটা বৈশিষ্ট্য আমার খুব ভাল লাগত, খুব পরিষ্কার ড্রইং ছিল অজিতের। ব্যাপারটা এইরকম, যেমন আমার যদি ক্রাফটের ওপর দক্ষতা থাকে, তাহলে আমি খুব কম কথায় অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে পারি। অজিত নাইনানের ড্রইং-এর সেই ক্ষমতা ছিল। খুব কম রেখায় সঠিক এক্সপ্রেশন ফুটিয়ে তুলতে পারতেন অজিত। আমার সমবয়সী হলেও বলতে বাধা নেই আমি অজিতের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। একটা দারুণ বৈশিষ্ট্য ছিল ওঁর কার্টুনে, একটি প্রধান চরিত্রকে ঠিক মাঝখানে রেখে অন্যান্য তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বের বা সহায়ক চরিত্রগুলোকে চারপাশে ছড়িয়ে দিতেন নিজের আঁকায়। এটা ছিল অজিত নাইনানের সিগনেচার স্টাইল। এই স্টাইলটা পরবর্তীকালে ইন্ডিয়া টুডে-তে থাকাকালীন অনেকভাবে ব্যাবহার করেছেন তিনি। যেমন, অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর একটা ক্যারিকেচার আঁকা হচ্ছে। তাঁকে মাঝখানে রেখে চারিদিকে ছোট ছোট নানা অ্যাক্টিভিটি হচ্ছে। অজিত নাইনানের আঁকার এই স্টাইলটা আমার খুব ভাল লেগেছিল। আমার কাজেও এই স্টাইল আমি কখনও কখনও ব্যবহার করেছি।
অজিত নাইনান অনেকটা সময় ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। ইন্ডিয়া টুডে অজিতকে সেন্টারস্টেজ বলে একটা কলাম দিল। অজিত সেখানে চুটিয়ে রাজনৈতিক কার্টুন করতে লাগলেন। সেখানে বেরোতে লাগল রাজনৈতিক নেতাদের একের পর এক ক্যারিকেচার, অজিত নাইনানের আরেকটা জোরের জায়গা ছিল এই ক্যারিকেচার। আমাদের দেশে ক্যারিকেচার আঁকার যে ধ্রুপদী স্টাইল রয়েছে, যা আর কে লক্ষ্মণ থেকে শুরু করে মারিও মিরান্ডা বা একেবারে আমাদের ঘরের রেবতীভূষণ অনুসরণ করে এসেছেন, এখনকার সময়ে উদয় দেবও অসাধারণ সব ছকভাঙা কাজ করছে, অজিতও ছিলেন সেই ঘরানারই শিল্পী, একদিকে তিনি সেই ঘরানাটা ধরে রেখেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর নিজের স্টাইল সেই ক্যারিকেচারকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, আর কে লক্ষ্মণ তুলি দিয়ে কাজ করেছেন, ফলে তাঁর পক্ষে এতটা ডিটেলিং সম্ভব ছিল না, কারণ তুলি অপেক্ষাকৃত মোটা ও ভোঁতা হয়। অজিত নাইনান পেন অ্যান্ড ইঙ্ক-এ কাজ করেছেন, ফলে তাঁর পক্ষে ছোট ছোট অনেক ডিটেইলিং করা সম্ভব হয়েছে। আমি শুনেছি, অজিত সোনিয়া গান্ধি বা অটলবিহারী বাজপেয়ির ক্যারিকেচার আঁকছেন, একেবারে কিছু না দেখেই মন থেকে এঁকে দিচ্ছেন, কোনও ফটোগ্রাফ রেফার করার দরকার হচ্ছে না। মনে পড়ছে, যখন পোখরানে স্মাইলিং বুদ্ধ বিস্ফোরণটি ঘটানো হল, তখন বাজপেয়িকে অজিত নাইনান হাসিমুখ বুদ্ধের মতো করে এঁকেছিলেন। ব্রিলিয়ান্ট কাজ! সব মিলিয়ে, অজিত নাইনানকে তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন ক্যারিকেচারিস্ট বললে এক বিন্দু অত্যুক্তি করা হবে না। ব্যক্তিগতভাবে, অজিতের রাজনৈতিক কার্টুনগুলো ছাড়াও ওঁর আঁকা সামাজিক বা দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে করা কার্টুনগুলো আমার বেশি ভাল লাগে। আর অজিতের কার্টুনগুলোর আরেকটা বড় গুণ— প্রত্যেকটি কার্টুন সহজবোধ্য।
একটা সময় অজিত ইন্ডিয়া টুডে থেকে টাইমস অফ ইন্ডিয়া-য় চলে এলেন। দৈনিক সংবাদপত্রে ম্যাগাজিনের চেয়ে আরও অনেক বেশি এক্সপোজার পাওয়া যায়, প্রতিদিন আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে নিজের কাজ পৌঁছে দেওয়া যায়, একজন কার্টুনিস্টের জন্য তা অত্যন্ত সুবিধেজনক। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-য় অজিত পকেট কার্টুন করতেন। আমি দেখতাম ছোট্ট একটা জায়গায় কী অসামান্য ডিটেলিং-এর কাজ। মূল ক্যারেক্টারের পেছনে একটা ট্রাক্টর, একটা ট্রেন, অথবা একটা গাড়ি— কি দারুণ মুনশিয়ানার সঙ্গে গোটা বিষয়টা ফুটিয়ে তুলতেন অজিত, কিন্তু তার ফলে গোটা ছবিটা কখনও ভারী হয়ে যায়নি। পুরো ছবিটায় একটা মিষ্টত্ব থাকত, এক ধরনের কোমলতা থাকত, সেটা কীরকম তা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। শুধু অজিতের কার্টুনের হিউমারটুকু শুধু নয়, কম্পোজিশনটাও দেখতে ভাল লাগত। ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করত। এগুলো আমি আমার মতো করে আত্মীকরণের চেষ্টাও করেছি। সব মিলিয়ে, অজিত নাইনান আমাদের সময়ের সেরা কাজটা করে দিয়ে গেছেন।
দুঃখের বিষয়, আমার অজিত নাইনানের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দেখা হল না। ওঁর কাজের প্রতি আমার ভাল লাগাটা জানানোর ইচ্ছে ছিল। দিল্লিতে গেলে ওঁর সঙ্গে দেখা করব, উদয়ের সঙ্গে এ নিয়ে কথাও হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সেটা হয়নি। এই আক্ষেপটা থেকেই গেল। তবে শেষে একটা কথাই বলার, যে অজিত নাইনান একটা জিনিস বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে হিউমারই হোক অথবা থিম, কার্টুনিস্টের ড্রয়িং একেবারে নির্ভুল হতে হবে, একইসঙ্গে দৃষ্টিনন্দন হতে হবে। সেটাই পাঠক বা দর্শকের মন জয় করার একমাত্র উপায়। অজিত নাইনান চোখে আঙুল দিয়ে এটা আরেকবার আমাদের দেখিয়ে দিলেন।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত