Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে— পর্ব ৮ (দ্বিতীয়াংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ছায়াপাখি

দুই.

সময়ের পলি চেনাকে অচেনা করিয়ে দেয়। কিছুই আর আগের মতো নেই। তিন বছর বাদে এসেছে। তাই বলে এত বদল! নিজের পাড়া বলে চেনা যাবে না? যে-রাস্তার প্রতিটা খানাখন্দ প্রাত্যহিক অনায়াসে টপকে যাওয়া যেত, এখন প্রয়োজন প্রতি পদক্ষেপে সতর্কতা। অবশ্য আগে বেশি রিকশা আর সাইকেল ছিল। এখন এদিক-ওদিক অটো, গাড়ি বা জিপের দখলে রাস্তা। আগাছাঘেরা বাগানওয়ালা একতলা বাড়ির ভাগের আলো কেড়ে নেওয়া ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট। সদ্য কিছু গজিয়ে ওঠা দোকানে কচি গোঁফ। কোনও পুরনো দোকান আবার হারিয়ে গেছে। লোকেরাও। যেমন শশীদার সেলুন। শশীদার কাছে চুল কেটেছে টানা কত বছর। এরকম ধবধবে সাদা পোশাকে হীরক আর কাউকে চুল ছাঁটতে দেখেনি। উড়ন্ত কাটা চুলকে চ্যালেঞ্জ জানানো সাদা পাঞ্জাবি, গলার পিছনে পুরু সাদা পাউডার, সাদা ঢোলা পাজামা। চুল কাটতে কাটতে মুখ চলত অফুরন্ত। বাবা কেমন আছেন? অতীনের দিদিটা কি আর বিয়েই করল না? তোদের পাশের বাড়ির কণা কি শ্বশুরবাড়ি থেকে একেবারেই চলে এল? থুথু ছিটত না একটুও।

অনভ্যস্ত চোখ আনাচেকানাচে খুঁজেও সেলুনটার হদিশ করতে পারল না। বন্ধ হয়ে অন্য কোনও দোকান হয়েছে বুঝি। আর শশীদা? দুটো দোকান বাদেই শাড়িঘর। চেনা নাম দেখে ঢুকে পড়ল হীরক। দোকানে সাদা ফরাসে বাবু হয়ে বসে আছে— অরূপদা না? মাথার চুল একটাও নেই আর। কিন্তু পুরু সাদাকালো গোঁফ। চেহারাটা বেশ গোল হয়ে গেছে। ইতস্তত পায়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিল হীরক।

—হীরু? হীরক? টাল খেতে খেতে উঠে দাঁড়াল অরূপদা। চিনতে পেরে পানের দাগলাগা ঠোঁট ছাপিয়ে সোনাবাঁধানো দাঁতে আলো ঝিলিক দিল। কতদিন বাদে দেখলাম তোকে।
—কেমন আছ? দোকান তো বেশ ভালোই চলছে! কিছু বলতে হয় বলে দিল হীরক।
—কোথায়? শাড়ি পরা দিন-কে-দিন কমে যাচ্ছে। তবু এটায় বাবার দোকান মনে করে বসি। আমার আসল দোকানটা হল ফ্যাশন হাউজ, দেখবি সিটি সেন্টারের সবচেয়ে বড় দোকান। সব মডার্ন ডিজাইন। ইংলিশ। ওখানে বিকেলে যাই।
—শশীদার দোকানটা?
—শশীদার স্ট্রোক হয়ে ডানদিকটা পড়ে গেল রে। দু বছর। ছেলেরাও তো এই লাইনে আসেনি। তাই দোকানটা বেচে দিল। ডিভিডির দোকানটা দেখছিস না? অরূপদা দোকানের দরজা দিয়ে উল্টো ফুটের সিনে ওয়ার্ল্ড দেখাল। ওটাই।
—তোমার ছেলে মেয়ে?
—সবাই বড় হয়ে গেল রে। একই ছেলে। নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিলাম, ফ্যাশন হাউজটা ও-ই দেখে। গর্বের হাসি ছড়াল অরূপদার গোঁফের আনাচেকানাচে। তোর?
—পড়াশোনা করছে। পরে কথা হবে অরূপদা। বাজার দেখতে বেরিয়েছিলাম। মা বসে আছে আমি মাছ কিনে নিয়ে যাব বলে। তোতনকে কোথায় পাওয়া যাবে জানো?
—ও তো দোকান তুলে দিয়েছে বহু বছর। এখন পাখির ছবি তুলে বেড়ায়। দেখি না আর আজকাল।

মার কাছে বাজারের ব্যাগটা নামিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তোতনের বাড়ি চলে এল হীরক। ভাগ্যিস। তোতন ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে ফেলে বেরোবার তোড়জোড় করছিল।

হীরককে এতদিন বাদে দেখে তোতন খুব খুশি। ওরে বাবা, তুই তো অমাবস্যার চাঁদ রে। কতদিন বাদে দেখা বল তো! ভালো আছিস তো?

শুকনো হাসি ছাড়া কী উত্তর ছিল হীরকের কাছে? সত্যিই তো দেশে এলেও কখনও ছোটবেলার পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। যে দৌড়ের মধ্যে থাকে।

—ভালো আছি রে। তুই কেমন আছিস?
—তোফা! এখন পুরোদস্তুর পাখিওয়ালা, দোকান-টোকান তুলে দিয়েছি।
—সেটা কেমন? অরূপদা বলছিল, তখন পাত্তা দেয়নি।
—পাখির ছবি তুলি, ওদের গান রেকর্ড করি। একটা মিউজিক কম্পোজ করেছি বিভিন্ন পাখির শিস জুড়ে জুড়ে। তোর সময় হলে একদিন শোনাব তোকে। বলতে বলতে মনে পড়ে গেল তোতনের শানু আর হীরক তো খুব বন্ধু ছিল। জানিস তো, তোর বন্ধু শানুর সঙ্গে তো ওইভাবেই দেখা হয়েছিল একদিন। গড় জঙ্গলে।
—জানিস তুই শানুর খবর?
—তেমন কিছু তো জানি না রে। কেন, আবার কিছু হয়েছে? মানে ওর বাবার কেসটার পর?
—না, না ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই, তাই খোঁজ নিচ্ছি।
—তোর কথা বারবার বলছিল, মানে ওই কেসটা হওয়ার আগে। তারপর তো… ওর বাপটা শিওর হারামি ছিল। শানুটাকে দেখে এত কষ্ট হত রে হীরু।

শানুকে দেখে অন্তত আর একজন লোক কষ্ট পেত সেটা হীরককে একটা অদ্ভুত শান্তি দিল।

—এখন কোথায়?

ভুরু কুঁচকাল তোতন। সেটা তো জানি না রে। আমার সঙ্গে সেরকম ইয়ারি তো ছিল না। তোর বন্ধু বলেই চিনতাম। একদিন জঙ্গলে লেংটি পরে ঘুরে বেড়াতে পেলাম ওকে। কেমন একটা কষ্ট হল মাইরি। ওকে নিয়ে একদিন পাখি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তার কদিন বাদেই এই কেলো।

—তারপর? তারপর কোথায় গেল?
—দ্যাখ যতটুকু জানি শানুকে প্রথমে পুলিশ জেলে নিয়ে যায়। আমি খবর পেয়ে একবার দেখতে যাই। পুলিশ ধারেকাছে ঘেঁষতে দিল না। শানুর মাকে পেয়েছিলাম। কী করবে বুঝতে পারছিল না। আমাকে পাঠাল বসিপোতায় ওর কাকা আর পিসিকে খবর পাঠাতে। গেছিলাম। মানুষ বিপদে পড়লে এইটুকু তো করতেই হয়।
—তারপর?
—ভালো লোক। আমি জানাতেই ওরা চলে আসে। শানুর কাকা একসময় নকশাল করত জানতিস কি?

শানুর পরিবারের অত খবর হীরক জানে না।

—ভদ্রলোক ভালো। শানুর বাপের মতো পোঁদভারি নয়। আজকাল পলিটিক্সে নেই, কিন্তু সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের দরজা ওর কাছে অচেনা নয়। তাই ভড়কি খায়নি একদম। উনি এসে ছেলে পাগল দেখিয়ে কেস বন্ধ করান। তারপর শানু আর মা ওদের সঙ্গেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।
—ঠিকানা আছে?
—ওই যে বললাম, বসিপোতা। হাওড়া গিয়ে লোকাল ট্রেনে উত্তরপাড়া। সেখান থেকে অটো ধরে বলবি রঘুনাথপুর বাজার। ওখান থেকে মিনিট পাঁচেক। গ্রামেগঞ্জে অত ঠিকানা লাগে না। আমিও তো গেছিলাম শুধু গ্রামের নাম নিয়ে। ওখানে কুমারেশ বসু বললে এক ডাকে চেনে লোকে।
—বলছিস? অতদূর গিয়ে তারপরে খুঁজে না পেলে মুশকিল। হীরক হিন্দমোটরে কদিন চাকরি করেছে, একেবারে অজানা নয় এলাকাটা।
—আমি ফ্রি থাকলে তোর সঙ্গে চলে আসতাম। বসিপোতায় নানান জাতের পাখি দেখা যায়। ওই সন্ধানেও গেছি অনেক। কিন্তু আমার এখন পাখি নিয়ে একটা কাজ চলছে। কদিন ব্যস্ত। ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হন্ডায় উঠে স্টার্ট দিল তোতন। সময় থাকলে বলিস একদিন বসা যাবে। পুরনো দিনের কথা হবে। তোকে পাখির ডাক শোনাব।

তোতন চলে গেল। পরদিন ভোরে হীরক এক্সপ্রেস ধরে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিল চুঁচুড়ায় জিনিদের বাড়িতে উঠবে। কিন্তু সেখানে গেলে আবার অনেক কথা। ওদের জানানোও হয়নি। একা এসেছে জানলে কী না কী ভাববে। তাই হাজরার মোড়ে একটা হোটেলে উঠল। ওখান থেকেই ট্যাক্সি নিয়ে নিল, বাসের ভিড় আর লোকাল ট্রেন সামলাতে পারবে না।

তোতন ঠিকই বলেছিল। কুমারেশবাবুর নাম বলতেই বাড়ির খোঁজ পেয়ে গেল।

বহুদিন বাদে এরকম গ্রামে পা দিল হীরক। দেখতে গেলে সেভাবে কোনও গ্রামে যায়নি কখনও। এখানে ঠান্ডাটা কিছুটা বেশি। শীতকালে অনেক জমিই পড়ে থাকে, চাষ হয় না। ফুলকপির ক্ষেত পার করে গেল কয়েকটা। অনেকটা জায়গা নিয়ে ওদের বাড়িটা। যেভাবে এল ফেরার জন্য আবার গাড়ি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। হীরক ড্রাইভারের সঙ্গে সারা দিনের কড়ারে থেকে যাওয়ার রফা করল।

শানুর মার সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল আমেরিকা যাওয়ার আগে। সন্ধ্যার আলোয় দাঁড়ানো সেই বিষণ্ণ প্রতিমা সে ভোলেনি। মধ্যে আর দেখা হয়নি। তবু বাড়ির বাইরে বাগানে যখন ওঁকে পেল, চিনতে কোনও অসুবিধা হয়নি।

বাগানে সারি দিয়ে গোলাপের গাছ। সুতপা বেছে বেছে গোলাপ তুলছিল। এখন বিয়ের মরশুম। গোলাপের খুব চাহিদা। একটু বাদে এসে ঝুড়ি বোঝাই করে নিয়ে যাবে। মায়ার বয়স হয়েছে, অত আর পারে না। এখানে বাস উঠিয়ে চলে আসার পর এই কাজগুলো সুতপা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। মায়ারও কাজ কমে, সুতপারও সময় ভালো কাটছে। কোনওদিন এসব করেনি সুতপা। বরাবর শহরের মেয়ে। এখন গরুর দুধ দোয়াতেও শিখে গেছে। এখানে জীবনের ছন্দ অন্যরকম, কিন্তু শান্তি নিবিড়। সবচেয়ে বড় নিশ্চিন্তি শানু। সুতপা যখন হীরককে দেখে চোখ তুলল সেই নিরাপত্তার ছাপ খুব স্পষ্ট বোঝা গেল।

—ও মা, হীরু যে। কী কাণ্ড। তুই আমাদের খোঁজ কেমন করে পেলি?
—শানুর সঙ্গে দেখা করতে খুব মন টানছিল কাকিমা। তোতনের কাছে খবর পেলাম তোমরা দুর্গাপুর ছেড়ে এখানে এসে আছ। তাই খোঁজ করতে করতে এসে পড়লাম।
—খুব ভালো করেছিস হীরু। হাসিতে মুখ ভরে গেল সুতপার।
—তোমরা কেমন আছ কাকিমা?
—অনেক ঝড় গেল রে। গত পনেরো-কুড়ি বছর শুধু ছেলেটার জন্য কেঁদেছি। থেমে থেমে বলছিল সুতপা। স্বামীর অসময়ের মৃত্যুর মতো দুঃখের সঙ্গে বর্তমানের বেঁচে থাকার নিশ্চিন্তির সমন্বয় করানো খুব মুশকিল। সে-কথা টেনেই বলল সুতপা, ওর বাবাকে তো আর ফিরে পাব না। যে যাওয়ার সে তো যাবেই। কপালের লিখন। কিন্তু শানু এখন ভালো আছে, সুস্থ হয়েছে অনেক। আগের মতো হঠাৎ হঠাৎ পাগলামিটা কমে গেছে রে। আমার আর কী চাই। ছেলে ভালো থাকলেই আমি ভালো।

তার মানে শানু ভালো আছে। অনেকদিন বাদে একটা মনের মতো খবর পৌঁছাল হীরকের কানে।

—কোথায় আছে শানু? আমি যে ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
—সে তো করবিই। বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিস? এখন কি দুর্গাপুর থেকে এলি তুই?
—হ্যাঁ, সকালে বেরিয়েছি। সেরকম কোনও কষ্ট হয়নি আসতে। শানু কি বাড়িতে নেই?
—ওর কাকা এখানে একটা স্কুল চালায় তো। সেখানে পড়ায় এখন শানু। বেশি দূরে নয়। আমি কাউকে দিয়ে খবর পাঠাচ্ছি। ও শুনলেই ঠিক দৌড়ে চলে আসবে। বাড়ির ভিতরে আয় না, বাইরে কেন দাঁড়িয়ে থাকবি? আসলে কি জানিস এই সময়টা বাড়িতে কেউ থাকে না। শানুর কাকিমা আবার একটা হেলথ সেন্টার চালায়, শানুর বউও যায় হাতে হাতে জোগান দিতে। বাড়িতে এখন শুধু আমি আর ওর পিসি।

শানুর বউ? বিয়ে করেছে? এরকম খবরটা তাকে তো কেউ দেয়নি। এমনকি তোতন অবধি জানে না। সেই অবাক ভাবটা হীরকের কথায় চাপা থাকল না। শানুর বিয়ের খবর তো জানতাম না। আমাকে কেউ বলেনি কাকিমা।

সুতপা স্থির চোখে তাকাল হীরকের দিকে। আমরাই কিছু চাউর করিনি। নোংরা লোকের নোংরা কথায় বড় ভয় হীরু। কত কষ্টে সব কিছুর আঁচ থেকে ছেলেটাকে বের করে এনেছি। সুতপার কথায় পিছল জমিতে পা টিপে টিপে চলার সাবধানতা। তুইও কাউকে কিছু বলিস না। তোর বাড়িতেও না বললে ভালো। কীভাবে কোন কথা ছড়ায় তার তো কোনও ঠিক নেই। দুঃখের দিনে কাউকে তো পাশে পাই না, কিন্তু বদনাম করতে একশো লোক জুটে যাবে।

শানুর বিয়ে হয়েছে এ তো আনন্দের কথা। লুকানোর কী আছে বুঝতে পারল না হীরক। হবে হয়তো গরিব কোনও গ্রামের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে, ছেলে পাগল সে-কথা ছড়াক সেটাই চায় না কাকিমা। মুখে বলল, একদম চিন্তা কোরো না কাকিমা। আমি শানুর ভালো ছাড়া আর কিছুই চাই না। একবার বলে দিয়েছ। আমি দুর্গাপুরে কাউকে কিছু জানাব না, আমার মাকেও না।

সুতপা নিশ্চিন্ত হল। এতদূর থেকে এসেছিস। মুখে হাত পায়ে দুটো জল ঢাল। বারান্দায় এসে বস। তোর ড্রাইভারকেও আসতে বল। আমি চা বানিয়ে দিই। দুটো মুড়ি দেব তোকে? ঘরে ভাজা মুড়ি, বাগানের মটরশুঁটি দিয়ে। ভালো লাগবে।

—চা বাদে খেলেও চলবে কাকিমা। বলছিলে কাউকে পাঠিয়ে শানুকে ডেকে আনাবে। একবার দেখবে সেটা?
—হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক। দ্যাখ আসল কথাটাই ভুলে গেছিলাম। আমি আগে সেই ব্যবস্থা করি। সুতপা রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। ওদিকে তাকিয়ে হীরকের মনে হল কাকিমা ভালো আছে। হাঁটার মধ্যে বেঁচে থাকার উদ্যম।

খুব শান্ত জায়গাটা। বাজারের কাছ দিয়ে একটু ঘিঞ্জি থাকলেও এদিকটা একদম ফাঁকা ফাঁকা। সার সার দিয়ে চাষের জমি। কলাবাগান। পুকুর। একটু দূরে দূরে একেকটা বাড়ি। সব বাড়ি পাকাও নয়। টালির চাল। দেশে থাকতে এরকম কোনও জায়গায় হীরক আসেনি। হিন্দমোটরে চাকরি করত, সেটা এখান থেকে কাছেই। কিন্তু কখনও গ্রামের দিকে আসা হয়নি হীরকের। এখানে আওয়াজ বলতে শুধু পাখির ডাক। ছোট ছোট অনেকরকমের পাখি এদিক-ওদিক পোকা খুঁটে খাচ্ছে। পাখি অত চেনে না হীরক। হিন্দমোটরের বাসায় থাকতে যাযাবর পাখিদের আসতে দেখেছে। শীতকালে বিলের চারপাশে ভিড় করে আসত। সে একদম হাজারে হাজারে। এখানকার পাখিরা মেঠো। দূর থেকে আসেনি। দূরে কোথাও যায় না। এদের ছোট ছোট উড়ান। চড়ুই শালিখ ছাড়াও আরও অনেক ছোট ছোট পাখি দেখল হীরক। একটা বোধহয় মুনিয়া। তোতন নাকি পক্ষীবিশারদ। ও থাকলে চিনিয়ে দিত। কিন্তু চিনতে না পারলেও আনন্দ নেওয়ায় কোনও বাধা নেই। হীরক বাড়ি ছাড়িয়ে আল ধরে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেল। আমেরিকায় থেকে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখেছে হীরক। তার নিজের শহরেই প্রতিটা বাড়ির সামনে সুন্দর সাজানো বাগান, মরশুমি ফুলের ঝাড়, কেয়ারি করা লন। তার সঙ্গে এই অবিন্যস্ত প্রকৃতির তুলনা করা যায় না। তবু এ সুন্দর নিজের মতো করে। বোধহয় গতিহীনতা একটা বড় কারণ। এতক্ষণ এসেছে। মেঠো পথ দিয়ে দুই-একজন হেঁটে গেছে। একবার একজন গেল সাইকেলে। আমেরিকার গ্রামের পথেও হেঁটে যাওয়া লোক পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই পথ ধরে সাঁই সাঁই করে গাড়ি চলে যায়। লম্বা মোটরচালিত পাইপের জালি দিয়ে ক্ষেতে জল ছড়ানো চলতে থাকে। কোনও সময়েই মনে হয় না এই পৃথিবীর থেকে আলাদা হয়ে আছি কোনওভাবে। এইখানেই হয় তো বসিপোতার মতো জায়গার স্বাতন্ত্র্য, শান্তির নিবিড়তা। হীরক ভালোভাবেই জানে একটু ভিতরে ঢুকলেই জানা যাবে গ্রামের ভিতরের কোন্দল, হানাহানি। কিন্তু সেগুলো এই শীতের সকালে বসিপোতাকে ছুঁতে পারছিল না। বসিপোতার ঝকঝকে নীল আকাশ, হলুদে সবুজে বিস্তৃত মাঠ হীরকের মনে শান্তির পরশ আনছিল।

—হীরু! হীরু!

পিছন থেকে ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শানু। পরনে সেই পাজামা, তার উপরে একটা সবুজ কলাপাতা রঙের ফতুয়া। সামনে আসতে আগের শানুর সঙ্গে পার্থক্যটা বুঝতে পারল। জামাকাপড় ওর মুখের মতোই পরিষ্কার। উসকোখুসকো দাড়ির জঙ্গল নেই। নোঙর বাঁধা চোখ। নেই হারিয়ে যাওয়ার ত্রাস। মুখে আগের মতোই হাসি, কিন্তু বিহ্বলতা নেই। শানুর ভরাট গলা গমগম করে উঠল। তুই এসেছিস হীরু, আমি তো ভাবতেও পারছি না।

হীরক খুব ভয় পাচ্ছিল শানু যদি তার অনুযোগ দিয়ে শুরু করে। যদি বলে তুই আজ এলি হীরু, এতদিন বাদে? যখন তোকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তোকে কোথাও কেন পাইনি? সেসব কিছুই বলল না শানু। দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল হীরুকে।

সব সময় কথা মুখে হয় না। শরীরের ভাষা আছে। মনে আছে আগেরবার শানু হীরককে জড়িয়ে ধরেছিল। তার মধ্যে একটা জাপটে ধরা আবেগ ছিল। জলের গভীরে ডুবতে ডুবতে প্রাণপনে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়ার মতো। ওর বুকের মধ্যে অশান্ত হৃদয়ের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছে হীরক। আজকের জড়ানোয় সেই অস্থিরতা ছিল না। ছিল বেঁচে থাকার সজীব আশ্বাস।

—কেমন আছিস শানু?

প্রথম সকালের ট্যাপের জলের মতো অফুরান হাসি শানুর মুখে। কীরকম দেখছিস?

শানুর চোখ চকচক করছিল। আগে পৌষের সকালের মতো কুয়াশা ঘেরা চোখে থাকত অনিশ্চয়তা। ঘনঘন চোখ পিটপিট করাটা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছিল। আজকের তাকানোর মধ্যে নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়ার ভরসা উঁকি দিচ্ছিল।

—আমার জীবনের রংগুলো অনেক পালটে গেছে রে হীরু। সবুজ রংটা বেশি পাচ্ছি স্বপ্নে।

আলের ধারে বসল দুজনে। শুনলাম বিয়ে করেছিস।

—হ্যাঁ, দ্যাখ পাগলেরও বিয়ে হয় বল? আমার একটা ছেলেও আছে।
—বলিস কী? কাকিমা বলল না তো একবারও। এত দ্রুত এরকম পরিবর্তনে চমকে যাচ্ছিল হীরক। একসঙ্গে যেন অনেক কিছু বদলে গেছে শানুর জীবনে।
—আসলে ছেলে শিউলির আগেই ছিল। শিউলি আমার বউ। বিয়েতে যৌতুক পেয়েছি বলতে পারিস। শানুর হা হা হাসি খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াল অনেকক্ষণ। সুকুর বয়স এখন দশ। ওর জন্যেই তো আমার শিউলির সঙ্গে দেখা। আমার ছেলেই আমার ঘটকঠাকুর। খুব ভালোবাসে আমায়।
—আর শিউলি?

শানুর মুখে লজ্জাজড়িত হাসি দেখে খুব মজা পাচ্ছিল হীরক। শানুর জীবনে যে এমন পরিবর্তন আসতে পারে সেরকম আশা করেনি একদম। বুকের থেকে একটা ভার নেমে যাচ্ছিল। নিজের পাপবোধ, পলাতক অতীতের অনুতাপ এক ঝটকায় অনেকখানি হালকা হয়ে গেল। সেই আবেগে হঠাৎ শানুর দুটো হাত জড়িয়ে ধরল হীরক। তোর জন্যে আমি কিছুই করতে পারিনি রে শানু। কিন্তু তুই ভালো আছিস দেখে আমার বুকের মধ্যে যে কী করছে! তোকে বলে বোঝাতে পারব না।

শানুর মুখে আবার সেই অনাবিল হাসি। তোদের মতো দুই-একজন মাঝে মধ্যে কথা বলতিস বলেই তো বেঁচে ছিলাম হীরু। হাসিটা চোখে ধরা থাকলেও গলার স্বরে হারানো সময়ের ছোঁয়া লাগল এবার। মনে আছে হীরু, ছোটবেলায় আমরা এক ধরনের ছবিতে ধাঁধা খেলতাম, শুকতারায় খুব দিত? অনেকগুলো পাকানো পাকানো গলি চলে গেছে সেই ছবিতে। তুই পেন্সিল নিয়ে এগোতে এগোতে একবার যদি ভুল পথে চলে যাস আর বেরোবার পথ নেই। সেই ধাঁধায় তো পেন্সিল উঠিয়ে নিয়ে আবার বেরিয়ে আসতাম। কিন্তু জীবনে তার উপায় নেই মোটে। একবার কানাগলিতে ঢুকেছিস তো ব্যস।

বলতে বলতে থেমে গেল শানু। সেই কানাগলিতে ঘুরে বেড়াবার দিনগুলো ওর চোখে ঘন ছায়া নিয়ে এল। ফিসফিস করে বলল, তখন ধাক্কা মেরে ওই কানাগলির পাঁচিল ভাঙতে হয়। আর কোনও উপায় থাকে না।

শানুর নিশ্চয় বাবার কথা মনে পড়ছে। ওর মানসিক অবস্থা কতটা স্টেবল হয়েছে সেটা হীরক জানে না। তাই তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাল। এই গ্রামে এসে তোর বউয়ের ভালো লাগছে?

—মানিয়ে নিয়েছে বেশ। আমার মতো শিউলিও ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমরা চোখবাঁধা দুটো লোক কানামাছি খেলতে খেলতে একে অপরের হাত ধরে ফেলেছি। আমার কাকা খুব ভালো লোক। আমাদের দুজনের মাথাতেই তো কোনও আশ্রয়ের হাত ছিল না। কাকা আর পিসি সেটা করেছে। কাকিও খুব ভালো। শিউলি এখন ওর সঙ্গেই থাকে তো সারাদিন।

শানুর জীবনে হঠাৎ ফিরে আসা এই শান্তির আবাস খুব ভালো লাগছিল হীরকের। যেরকমভাবে ওর জীবন যাওয়ার কথা ছিল, তেমন নিশ্চয় হয়নি। কিন্তু সেই দৌড়টাই কি সব? দৌড়াতে দৌড়াতে জীবনটা যে পিছনে সরে সরে যায়, দু-দণ্ড শ্বাস নেওয়ার অবকাশ দেয় না। যে সুখের জন্য দৌড়, সেটা যদি মাঝপথেই কেউ পেয়ে যায় তাহলে আর কেন দৌড়াবে? শানু যখন হীরককে বলল, তুই কেমন আছিস বললি না তো, তখন এই দৌড় কথাটাই মাথায় এল হীরকের। দৌড়ে যাচ্ছি শানু, সেই যে এক দৌড় শুরু হয়েছিল কোন ছেলেবেলায় সেটাই এখনও চলছে। আমাদের লক্ষ্য যে বহুদূর।

আবার হা হা করে হেসে উঠল শানু। তুই দৌড়াচ্ছিস এখনও? কেমন ছুটিস তুই? আমার ছেলের মতো?

শানুর কথা কখন যে কোনদিকে বাঁক নেয় এখনও সেটা বুঝতে পারল না হীরক। ওর অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে শানু বলল, সুকু খুব ভালো দৌড়ায়। একেবারে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। কালিদা বলে ভালো করে তালিম দিতে পারলে ও নাকি খুব নাম করবে।

—কালিদাটা আবার কে?
—কালিদা হল দৌড়পাগল। আবার হা হা করে হাসল শানু। আমরা সব পাগলগুলো এক জায়গায় এসে জুটেছি রে হীরু। কালিদা সুকুর বাবাকে দৌড় শেখাত। কী কাণ্ড ভাব, স্বপনকে আমি চিনতাম। স্বপন ছিল আমার বাবার আওতার বাইরের জীবনের হাতছানি। বলতে বলতে থমকে গেল শানু। জীবনটা কেমন গোল গোল হয়ে ঘোরে না রে হীরু?
—গোল হওয়াটা বোধহয় খারাপ না। ত্রিভুজ কিংবা সমান্তরাল রেখার চেয়ে বেটার।
—আমি, শিউলি আর স্বপন তো তাহলে ত্রিভুজ হলাম? স্বপন যখন রেলের মাঠে কালিদার কাছে দৌড়াত, আমি দেখতাম। খুব নাম করছিল। সেই সময় ন্যাশানালে পড়ে গিয়ে পা ঘুরে যায়। ব্যস, সব শেষ।
—স্বপনের কী হল?
—বাঁচার রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে অসৎ পথে চলে গেল, মারাও গেল। কিন্তু কালিদা ওদের সঙ্গ ছাড়েনি। ছেলে একটু বড় হতেই বলল, সুকু নাকি একদম ওর বাবার মতো ছুটছে। শিউলি একদম রাজি ছিল না। এক দৌড়ে ওদের জীবন ছারখার হয়ে গেছে, ছেলেটাকে ওই পথে কিছুতেই যেতে দেবে না। আমিও তো দৌড়াতে দৌড়াতে মুখ থুবড়ে পড়া মানুষ হীরক।

রোদ গনগনে হচ্ছিল। এরকম সময়ে আকাশের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হীরক শানুর কাঁধে হাত রাখল। এখন তো উঠে দাঁড়িয়েছিস শানু। জীবনটা পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের মতো। একেকজন একেক মোড়ে গিয়ে হোঁচট খাবে।

—আমার কাকা কী বলল জানিস? দৌড়াতে গিয়ে পড়ে যাবে বলে মানুষ ছুটবে না? সব লড়াইতেই হারজিত আছে। একবার হেরে গেলে যে পরেরবার জেতা যাবে না এমন কেন হবে? প্রয়োজন হলে কৌশল বদলাতে হবে, কিন্তু হেরে গিয়ে বসে পড়ার কোনও অর্থ নেই।
—তোর কাকা তো বেশ জাঁদরেল লোক রে শানু।
—আমাকে অনেক সাহস এনে দিয়েছে। পুলিশের মার খেয়ে আজও ভালো করে হাঁটতে পারে না, শরীরে অনেক অসুখ কাকার। কিন্তু কিছুই দমিয়ে দিতে পারে না লোকটাকে। চোখটা চকচক করছিল শানুর। আমার মাথায় কখনও কখনও সেই ঝড়টা ওঠে রে হীরক। আমি তখন কাকার পাশে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকি।
—তোর জীবনে একটা নতুন ছন্দ এসেছে শানু। সেটা ধরে রাখ।
—ভালো থাকতে খুব ভালো লাগছে রে হীরু। আমি ভালো আছি, মা ভালো আছে, শিউলি ভালো আছে, সুকু ভালো আছে। কালিদাও দুর্গাপুর ছেড়ে বউদিকে নিয়ে এখানে দৌড়ের স্কুল খুলেছে। সবাই ভালো থাকলে নীলটা আস্তে আস্তে রং বদলে সবুজ হয়ে যায় মাথার ভিতরে। সবাই মিলে ভালো থাকতে খুব ভালো লাগে।

বসিপোতার ওই দুপুরে শানুদের সবাই মিলে ভালো থাকাটা হীরককে ছেয়ে যাচ্ছিল। ওরও সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তার জন্য আরও কিছু পথ পরিক্রম করা বাকি।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]