তানিয়া অরোরা
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিভিন্ন শহরে ভাঙচুর অভিযানের তীব্রতা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ এই অভিযানগুলির পক্ষে সাধারণত বে-আইনি নির্মাণ ভাঙা বা বন্যা প্রতিরোধের যুক্তি দেখালেও, বাস্তবে এর ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন— যা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া, আবাসনের অধিকার এবং প্রশাসনের মনোভাব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একই সময়ে, বিচারব্যবস্থাও এই ক্রমবিকাশমান সংকটে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিভিন্ন শহরে ভাঙচুর অভিযানের তীব্রতা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে— লক্ষ্য করা হয়েছে অনানুষ্ঠানিক বসতি, ধর্মীয় স্থল, দোকানপাট, এমনকি বহু পুরনো আবাসিক পাড়াগুলোকেও। পৌর কর্তৃপক্ষ এই অভিযানগুলির পক্ষে সাধারণত বে-আইনি নির্মাণ ভাঙা বা বন্যা প্রতিরোধের যুক্তি দেখালেও, বাস্তবে এর ফলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন— যা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া, আবাসনের অধিকার এবং প্রশাসনের মনোভাব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একই সময়ে, বিচারব্যবস্থাও এই ক্রমবিকাশমান সংকটে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। কিছু আদালত যখন ব্যাপক অনিয়মের যুক্তিতে ভাঙচুরের আদেশকে বৈধতা দিচ্ছে, তখন অন্য আদালতগুলো আইনসম্মত নিরাপত্তা-পদ্ধতি উপেক্ষা, অস্পষ্ট নোটিস জারি এবং পুনর্বাসনের দায় এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে সরকারের পদক্ষেপকে খতিয়ে দেখছে কিংবা থামিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতিবেদনটি দিল্লি, গ্রেটার নয়ডা, জামনগর, থানে এবং পেদ্দাপল্লি-সহ বিভিন্ন শহরে সম্প্রতি ঘটানো ভাঙচুর অভিযানের একটি সংকলন তুলে ধরার প্রয়াস, এবং একই সঙ্গে হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত বিচারব্যবস্থা কীভাবে জমি, আইন ও ন্যায়বিচার সংক্রান্ত এই বহুবিধ, জটিল প্রশ্নগুলির মোকাবিলা করছে তা নিয়েও বিশ্লেষণ করতে চাওয়া হয়েছে।
ভাঙচুর অভিযান
১. অশোক বিহার, দিল্লি: ভোরে ঢুকে পড়ল বুলডোজার
এক ব্যাপক ভাঙচুর অভিযানে দিল্লির উত্তরের অশোক বিহার এলাকায় এক সোমবার সকালবেলায় বিশেষ টাস্ক ফোর্স বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী নিয়ে প্রায় ৩০০-রও বেশি ঝুপড়ি গুঁড়িয়ে দেয়। ১৬ জুন দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ)-এর নেতৃত্বে চালানো এই অভিযানটি মূলত জেলরওয়ালা বাগ এলাকার ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি অঞ্চলে ২০০-রও বেশি কাঠামোর উপর লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়।
দিনের শুরুতেই ভাঙচুর অভিযান শুরু হয়। কর্তৃপক্ষ আশপাশের রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলে এবং একাধিক বুলডোজার ও বিভিন্ন দপ্তর থেকে কর্মী এনে মোতায়েন করে। ডিডিএ-র মতে, এই অভিযান শুধু তাঁদের ঝুপড়িগুলোকেই লক্ষ্য করে চালানো হয়েছিল যাঁদের ইতিমধ্যেই জেলরওয়ালা বাগ এলাকায় in-situ পুনর্বাসন প্রকল্পের অধীনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়েছে, অথবা যাঁদের আবাসন নীতির আওতায় অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়েছে। আধিকারিকদের দাবি, যে-সব বস্তি আদালতের রক্ষাকবচের আওতায় ছিল, সেগুলিকে স্পর্শ করা হয়নি।
সরকারি ব্যাখ্যা: ডিডিএ এই ভাঙচুরকে আইনসম্মত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। তাদের দাবি, ওই একই জায়গায় নির্মিত নতুন ১-বিএইচকে ফ্ল্যাটে ১,০৭৮টি পরিবারকে ইতিমধ্যেই পুনর্বাসিত করা হয়েছে। প্রায় ৪২১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই আবাসন নির্মিত হয়েছে এবং প্রতি ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য যেখানে ২৫ লক্ষ টাকা, সেখানে সেগুলি পুনর্বাসিত পরিবারগুলিকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১.৪ লক্ষ টাকার ভর্তুকিযুক্ত মূল্যে। আবাসনের নীতির ভিত্তিতে ৫৬৭টি পরিবারকে অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
দিল্লি আরবান শেল্টার ইমপ্রুভমেন্ট বোর্ড (ডুসিব)-এর কথায়, যোগ্যতামান ছিল দুটি: ২০১২-২০১৫ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকা এবং পরিচয়ের প্রমাণস্বরূপ নির্ধারিত বারোটি নথির যে-কোনও একটি থাকা— যেমন রেশন কার্ড, বিদ্যুৎ বিল, পাসপোর্ট বা ব্যাঙ্কের পাসবই। অযোগ্য বলে বিবেচিত পরিবারগুলির মধ্যে ছিলেন— যাঁরা আলাদা নথিপত্র ছাড়াই উপরের তলায় বসবাস করতেন, অপ্রাপ্তবয়স্করা, এবং যাঁরা ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারির আগে তাদের ঝুপড়ি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতেন।
কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, ন-টি পরিবার তাদের অযোগ্যতার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন জানিয়ে সফল হয়েছে এবং পরে লটারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁদের ফ্ল্যাটও বরাদ্দ করা হয়েছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিডিএ-র এক মুখপাত্র বলেন, “সবরকম নিয়ম মেনে কাজ করা হয়েছে। আমরা হাইকোর্টের সব স্থগিতাদেশের প্রতি সম্মান দেখিয়েছি। ভাঙচুর কেবল তাঁদের ক্ষেত্রেই হয়েছে, যাঁরা ইতিমধ্যেই পুনর্বাসিত অথবা নীতিমাফিক অযোগ্য বলে চিহ্নিত।”
শত শত পরিবার এখনও গৃহহীন: এই আশ্বাসসত্ত্বেও, ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের বয়ান ও অকুস্থল থেকে পাওয়া রিপোর্টে কিন্তু উদ্বেগজনক চিত্রই ফুটে উঠছে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-সহ একাধিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বহু বাসিন্দা বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও এবং দশকের পর দশক ধরে বসবাস করলেও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছেন। উচ্ছেদ হওয়া এক বাসিন্দার আত্মীয়া রমা দেবী বলেন, “মোটামুটি হাজারটা পরিবার ফ্ল্যাট পেয়েছে। কিন্তু এখনও ৫০০-রও বেশি পরিবার গৃহহীন। আমরা এখানে দশকের পর দশক ধরে আছি— কেউ রাস্তায় হকারি করি, কেউ গৃহকর্মীর কাজ করি। এখন আমাদের উচ্ছেদ করা হল কোনও ক্ষতিপূরণ বা বিকল্প আবাসন ছাড়াই।”
এছাড়াও, অনেকেই নতুন বরাদ্দ হওয়া ফ্ল্যাটগুলির অবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
একই সঙ্গে ভাঙচুর ওয়াজিরপুরে: অশোক বিহার যখন সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে, ঠিক তখনই ওয়াজিরপুরে চলছিল আরেকটি অনধিকার দখল উচ্ছেদ অভিযান। সেখানে রেলপথের ধার ঘেঁষে নির্মিত শত শত ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় রেল। কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল নিরাপত্তার— যেমন, শিশুরা রেললাইনের ধারে বিপজ্জনকভাবে খেলাধূলা করছে, ফলে ট্রেনচালকদের দৃষ্টিবাধার মতো গুরুতর সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই অভিযান ছিল ওই এলাকায় এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ উচ্ছেদ কার্যক্রম।
অশান্তি এড়াতে এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল; মোতায়েন করা হয় পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনীর দুটি কোম্পানি। আধিকারিকরা জানিয়েছেন, এই অভিযানে প্রায় ৩০৮টি ‘অবৈধ’ ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করা হয়েছে।
একটি প্যাটার্ন স্পষ্ট হচ্ছে: অশোক বিহারের ভাঙচুর আসলে দিল্লি জুড়ে চলমান ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযানের একটি উদাহরণ মাত্র। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে একই ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে ভূমিহীন ক্যাম্প, মাদ্রাসি ক্যাম্প, এবং সর্বশেষে প্যাটেল নগরে— যেখানে গত ১১ জুন প্রায় ৪৫০টি ঝুপড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ধারাবাহিক পদক্ষেপকে আবাসন-অধিকার কর্মীরা বর্ণনা করছেন “নগর উন্নয়নের” নামে অপ্রাতিষ্ঠানিক বসতি উচ্ছেদের এক ক্রমবর্ধমান শহরব্যাপী অভিযান হিসেবে।
এই ভাঙচুর অভিযানগুলি তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টি (আপ)-এর নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল সামাজিক মাধ্যমে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন ডিডিএ-র বিরুদ্ধে অভিযোগ হেনেছেন যে তাদের “যেখানে ঝুপড়ি, সেখানেই বাড়ি”-র প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? তিনি এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, “বিজেপি ঠিক কী চাইছে? দিল্লির প্রতিটি বস্তিই মুছে ফেলতে? নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী কেন মিথ্যে কথা বলেছিলেন?”
আপ-এর দিল্লি শাখার প্রধান সৌরভ ভরদ্বাজও একই সুরে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, এটি এক বিশাল বিশ্বাসঘাতকতা ও গণবহিষ্কারের নজির।
ওয়াজিরপুর ভাঙচুরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আপ-এর প্রাক্তন বিধায়ক অখিলেশ পতি ত্রিপাঠীকে পুলিশ আটক করে— যা রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
অর্ডিন্যান্স জারির দাবি কংগ্রেসের, পূর্ব-নজিরের উল্লেখ: হিন্দুস্তান টাইমস-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, দিল্লি কংগ্রেস শহরের বিজেপি প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছে, সমস্ত বস্তি উচ্ছেদ অবিলম্বে বন্ধ করতে একটি অর্ডিন্যান্স আনা হোক। ২০১১ সালে শীলা দীক্ষিতের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের একই ধরনের পদক্ষেপের উদাহরণ টেনে কংগ্রেস নেতারা বলেন, এমন একটি উদ্যোগ মানবিক বিপর্যয় এড়াতে এখন অত্যন্ত জরুরি।
“যেভাবে ২০১১ সালের অর্ডিন্যান্স লক্ষ লক্ষ পরিবারকে গৃহহীন হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল, তেমনই বর্তমান বিজেপি সরকারকেও অবিলম্বে একটি অর্ডিন্যান্স আনতে হবে, যাতে গরিব মানুষদের মাথার উপর ছাদ টিকে থাকে,”— গোবিন্দপুরীতে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেন দিল্লি কংগ্রেস সভাপতি দেবেন্দর যাদব। সেখানে প্রায় ৩৫০টি বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
যাদব আরও অভিযোগ করেন, ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রশাসনিক উদাসীনতার ফলে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করা বহু মানুষকে উপযুক্ততার সমীক্ষা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি বলেন, “৩০–৪০ বছর ধরে যাঁরা এখানে থাকছেন, তাঁদেরও ইচ্ছে করে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ আদালতের রায় ছিল তাঁদের পক্ষে।” তিনি আরও বলেন, “বিজেপি গরিবি দূর করতে চায় না— তারা শহর থেকে গরিবদের মুছে ফেলতে চায়।”
২. জামনগর, গুজরাত: ৭.৭৪ লক্ষ বর্গফুট সরকারি জমি দখলমুক্ত; একটি কাঠামো তদন্তের অধীনে
গুজরাতের জামনগরে ১৫ জুন ব্যাপক ভাঙচুর অভিযান চালানো হয় বচ্চুনগর এলাকায়, যেখানে কর্তৃপক্ষ প্রায় ৭.৭৪ লক্ষ বর্গফুট সরকারি জমি দখলমুক্ত করে, যা নাকি তাদের দাবি অনুযায়ী অবৈধভাবে দখলিকৃত। আনুমানিক ১৯৩ কোটি টাকা মূল্যের এই জমি জামনগর জেলা প্রশাসন ও পুলিশের যৌথ অভিযানের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা হয়, কঠোর নিরাপত্তা ও সুসংগঠিত লজিস্টিক ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে।
ইন্ডিয়া টুডে-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযানের সময় কর্তৃপক্ষ একটি বৃড়সড় নির্মাণের খোঁজ পান, যা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। প্রায় ১১,০০০ বর্গফুট জুড়ে বিস্তৃত এই কাঠামোটি ধর্মীয় স্থানের (দরগা) বৈশিষ্ট্য বহন করে— মার্বেলের মেঝে, একাধিক ঘর এবং বিশেষ ধরনের স্নানাগার-সহ এটি নির্মিত হয়েছিল। অনুমোদনহীনভাবে তৈরি এই মূল্যবান স্থাপনা তৎক্ষণাৎ জেলা প্রশাসনের নজরে আসে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, জামনগরের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট প্রেমসুখ ডেলু জানান, স্থাপনাটিতে বহিরাগতদের প্রবেশ এবং অনুদান দেওয়া নিষিদ্ধ— এমন সাইনবোর্ড থাকলেও, এর নির্মাণে অর্থের উৎস এখনও স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, “স্থাপনাটির ধরন এবং সেখানে কারা যায় বা কারা অর্থসাহায্য করে, সে-সব নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি, এটি ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়াও অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল কি না।”
এই ভবনটির মালিকানা, নির্মাণের বৈধতা এবং কোনও বেআইনি কার্যকলাপের সঙ্গে কোনও সংযোগ আছে কি না— সেগুলি খতিয়ে দেখার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই ভবনটি সরকারি জমির ব্যবহারের জন্য নথিভুক্ত নয়, সরকারি জমি ব্যবহারের জন্য কোনও বৈধ অনুমতিও এটির নেই।
এই অভিযান গুজরাত সরকারের একটি বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ— যার লক্ষ্য রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন জমিতে তথাকথিত ‘অনুমোদনহীন দখলদারি’ অপসারণ করা। জামনগর জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ওই অঞ্চলে সরকারি জমির মালিকানাসংক্রান্ত নথিপত্রের আরও পর্যালোচনা চলছে, এবং ভবিষ্যতে যদি আরও অনিয়ম ধরা পড়ে, তাহলে এই ভাঙচুর অভিযান চালিয়ে যাওয়া হবে।
৩. গোবিন্দপুরী, দিল্লি: তাপপ্রবাহের মধ্যেই ৩০০-রও বেশি ঝুপড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল
গত ১১ জুন ভোরবেলা দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির গোবিন্দপুরীর ভূমিহীন ক্যাম্প এলাকায় বুলডোজার ঢুকে পড়ে। এই ক্যাম্প দীর্ঘদিন ধরেই গৃহহীন মানুষজনের অস্থায়ী আবাস হিসেবে গোবিন্দপুরী অঞ্চলে রয়েছে। দিল্লি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ডিডিএ) পরিচালিত এই ভাঙচুর অভিযান শুরু হয় ভোর ৫টা নাগাদ, যখন অধিকাংশ বাসিন্দা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অভিযান শুরু হয়ে যায়।
দুপুরের মধ্যে, যখন দিল্লিতে লাল সতর্কতা জারি থাকা ভয়াবহ তাপপ্রবাহে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি ছুঁয়েছে, তখন শত শত পরিবার খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে— তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
ডিডিএ-র ব্যাখ্যা: আদালতের নির্দেশ মেনে অভিযান, অধিকাংশ ঘরই নাকি ফাঁকা ছিল: দ্য হিন্দু-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিডিএ দাবি করেছে যে, এই ভাঙচুর সম্পূর্ণভাবে সরকারি জমিতে নির্মিত ৩৪৪টি ঝুপড়ির ‘অনধিকার দখল’ অপসারণের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, ৯ জুন নোটিস জারি করে বাসিন্দাদের তিন দিনের সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল এলাকা খালি করার জন্য।
ডিডিএ আরও জানিয়েছে, এই অভিযান চালানোর বিষয়ে আদালতের কোনও স্থগিতাদেশ ছিল না, এবং ভাঙা কাঠামোর একটি বড় অংশই ছিল নাকি পরিত্যক্ত।
যদিও ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া চিত্র এবং বাসিন্দাদের বয়ান ডিডিএ-র এই দাবি সমর্থন করে না। বহু পরিবারকে দেখা গেছে, নিজেদের ঘর ভাঙা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটোছুটি করে জিনিসপত্র তুলতে— যতটা সম্ভব রক্ষা করতে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অধিকাংশই অভিবসী শ্রমিক ও দৈনিক মজুরিতে কাজ করা মানুষ, যাঁরা এই ক্যাম্পে বছরের পর বছর— কেউ কেউ কয়েক দশক ধরে বসবাস করছেন।
বিজেপি-শাসিত সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আপ-এর: এই ভাঙচুর অভিযানের সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আপ-এর শীর্ষনেত্রী ও দিল্লি বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আতিশি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্তার বিরুদ্ধে আঙুল তোলেন এবং তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এক্স (সাবেক টুইটার)-এ করা একটি তীক্ষ্ণ পোস্টে তিনি লেখেন—
“ভূমিহীন ক্যাম্পে আজ ভোর ৫টা থেকে বিজেপির বুলডোজার চলতে শুরু করেছে। রেখা গুপ্তা, আপনি মাত্র তিন দিন আগেই বলেছিলেন, একটি বস্তিও ভাঙা হবে না। তাহলে এখন এখানে বুলডোজার চলছে কেন?”
ये है भाजपा का असली चेहरा।
गरीबों से वोट लेकर फिर उन्हें ही बेघर कर देना। सुबह 5 बजे बुलडोज़र लेकर भूमिहीन कैंप पहुँची बीजेपी सरकार ने हज़ारों गरीबों के आशियाने उजाड़ दिए। बीजेपी को न गरीबों की परवाह है, न इंसानियत की।
बीजेपी का ‘जहां झुग्गी-वहां मकान’ का वादा अब ‘जहां… pic.twitter.com/GseSRgiz2H
— Atishi (@AtishiAAP) June 11, 2025
আতিশি তার আগের দিনই ভূমিহীন ক্যাম্পে গিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা করতে। সে-সময় তাঁকে পুলিশ আটক করে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে দাবি করা হলেও, পরে পুলিশ সেই আটক করার বিষয়টি অস্বীকার করে।
অভিযোগের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্তা সেই পুরনো কথাই বলেন— রাজ্য সরকার আদালতের নির্দেশে পরিচালিত ভাঙচুর আটকাতে পারে না। তিনি দাবি করেন, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে বাস্তবে উচ্ছেদের আগে ঠিক কতজন বাসিন্দাকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল— সে বিষয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
ভাঙচুরটা ঘটেছে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর ঘোষিত তীব্র তাপপ্রবাহজনিত লাল সতর্কতার মধ্যেই— এ-নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চরম ধিকার উঠেছে। দিল্লির জন্য আইএমডি-র এই লাল সতর্কতায় স্পষ্টভাবে সতর্ক করা হয়েছিল যে, পর্যাপ্ত আশ্রয় না-থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে “তাপজনিত অসুস্থতা ও হিটস্ট্রোকের” ঝুঁকি রয়েছে— সব বয়সের মানুষের জন্যই।
৪. জংপুরা, দিল্লি: ৫০ বছরের পুরনো মাদ্রাজি ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, গৃহহীন হলেন ১৫০-র বেশি পরিবার
গত ১ জুন দক্ষিণ দিল্লির জংপুরায় কয়েক দশকের পুরনো মাদ্রাজি ক্যাম্প নামে পরিচিত এক বসতি গুঁড়িয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। এই উচ্ছেদের ফলে তামিল বংশোদ্ভূত শতাধিক বাসিন্দা গৃহহীন হয়ে পড়েন— যাঁরা ওই ক্যাম্পে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছিলেন।
বর্ষার আগে বন্যার আশঙ্কা দেখিয়ে দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশ দেখিয়ে এই ভাঙচুর চালানো হয়, কারণ এই বসতিটি বারাপুল্লা নালার ধারে অবস্থিত ছিল।
এই বসতি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত শ্রমজীবী এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ৩৭০টি পরিবার বসবাস করত, যারা মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্র এবং কিছু সরকারি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু বুলডোজার যখন গোটা এলাকাকে সমান করে দেয়, তখন উঠে আসে একাধিক প্রশ্ন— পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার আইনি বৈধতা, তার পর্যাপ্ততা ও মানবিকতা নিয়ে। একইসঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়— রাজ্যের এই পদক্ষেপ বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকারকে আদৌ সম্মান করেছে কি না।
সরকারি দাবি বনাম প্রকৃত বাস্তব: এই উচ্ছেদ অভিযানের পর, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্তা সংবাদমাধ্যমে এই অভিযানকে সমর্থন করে বলেন, “কেউই আদালতের আদেশ অমান্য করতে পারে না। ওই ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প বাসস্থান বরাদ্দ করা হয়েছে এবং তাঁদের সেখানে সরানোও হয়েছে।”
তবে সরকারের এই সার্বিক পুনর্বাসনের দাবির সঙ্গে বাস্তব পরিসংখ্যান মেলে না। দ্য ওয়্যার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার দাবি করেছিল, মাদ্রাজি ক্যাম্পের সব পরিবারকেই নারেলা অঞ্চলের ইডব্লুএস (অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণি) ফ্ল্যাটে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শুরুতে ৩৭০টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ১৮৯টি পরিবারের ফ্ল্যাট বরাদ্দ করা হয়। পরবর্তীতে আরও ২৬টি পরিবারকে ঘর দেওয়া হলেও অন্তত ১৫৫টি পরিবার— অর্থাৎ পুরো বসতির ৪০ শতাংশেরও বেশি— কোনও বিকল্প আবাসন পাননি, এবং তাঁরা এখনও গৃহহীন।
এই বাসিন্দারা দশকের পর দশক ধরে ওই বসতিতে বসবাস করলেও আজ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন— এই অমানবিক ঘটনা কিছু গুরুতর প্রশ্ন তুলে দেয় উপযুক্ততার মানদণ্ড, প্রয়োজনীয় নথিপত্র, এবং সর্বোপরি— উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার আইনি বাধ্যবাধকতা নিয়ে। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় ও নীতিমালার ভিত্তিতে এই দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর বর্তায়।
ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষিত: মাদ্রাজি ক্যাম্প ছিল দিল্লির অন্যতম প্রাচীন অনানুষ্ঠানিক বসতি, যেখানে প্রধানত তামিল ভাষাভাষী দলিত ও শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতেন। তাঁদের অনেকে ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে কাজের খোঁজে দিল্লিতে এসে এই বসতি গড়েছিলেন। এত দীর্ঘ সময় ধরে থাকার পরও, বাসিন্দাদের অভিযোগ— তাঁদের যথাযথ পূর্ব-নোটিস দেওয়া হয়নি, এবং পুনর্বাসনের জন্য চালানো যাচাই প্রক্রিয়াটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও অস্বচ্ছ। এর ফলে বহু মানুষ কেবল প্রযুক্তিগত কারণেই অযোগ্য বলে বিবেচিত হন এবং পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত থাকেন।
এই ভাঙচুর অভিযানগুলিতে স্বচ্ছতার অভাব, সব পক্ষের সদর্থক অংশগ্রহণ না থাকা এবং সময়মতো প্রতিকার না থাকায় শহরের গরিব মানুষের আবাসনের অধিকারের প্রশ্ন নতুন করে জোরালো হয়েছে। বিশেষ করে এমন এক নগরে, যেখানে সরকারি আবাসন নীতির ঘাটতি পূরণেই অনানুষ্ঠানিক বসতিগুলি বছরের পর বছর ধরে টিকে আছে।
৫. গ্রেটার নয়ডা, উত্তরপ্রদেশ: ২০-টির বেশি তথাকথিত অনানুষ্ঠানিক বসতি ভাঙার পরিকল্পনা GNIDA-র
গ্রেটার নয়ডা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (GNIDA) তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে ২০টিরও বেশি তথাকথিত অনানুষ্ঠানিক বসতি ও অনুমোদনহীন নির্মাণ উচ্ছেদের জন্য একটি বৃহৎ ভাঙচুর অভিযানের নোটিস জারি করেছে। এই অভিযান ২০২৫ সালের জুনের শেষ বা জুলাইয়ের শুরুতে শুরু হওয়ার কথা, এবং তা জেলা প্রশাসন ও পুলিশের যৌথ তত্ত্বাবধানে চালানো হবে। এতে ব্যবহৃত হবে ভারি যন্ত্রপাতি এবং মোতায়েন থাকবে শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থা।
যেখানে কর্তৃপক্ষ এই অভিযানে জমির ব্যবহারকে “শৃঙ্খলা ও ন্যায্যতার” আওতায় আনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করছে, সেখানে স্থানীয় অধিকারকর্মী ও আবাসন-অধিকার সংগঠনগুলির দাবি— এই উচ্ছেদে পুনর্বাসনের কোনও নিশ্চয়তা নেই এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা আদৌ জেনেশুনে কোনও নিয়ম লঙ্ঘন করেছিলেন কি না, সেই যাচাই প্রক্রিয়াও সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ।
হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদককে GNIDA-র অতিরিক্ত সিইও সুমিত যাদব জানিয়েছেন, ভাঙচুরের জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাঁর কথায়, “নিয়মিত সতর্কতা ও নির্দেশ সত্ত্বেও অবৈধ কলোনিগুলি বেড়েই চলেছে।” তিনি আরও জানিয়েছেন, যেসব নির্মাণকাজ কোনও আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই হয়েছে, সেগুলি উৎখাত করতে earthmover বা ভারী যন্ত্রচালিত বুলডোজার ব্যবহার করা হবে।
বর্তমানে যেসব বসতি ভাঙচুরের মুখে পড়তে চলেছে, সেগুলির অনেকগুলোই গড়ে উঠেছিল সেইসব কৃষিজমিতে— যা ব্যক্তিগত কলোনাইজাররা বেআইনিভাবে বিক্রি করে আবাসিক প্লটে রূপান্তর করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই জমি বিক্রির সময় ক্রেতাদের জানানোই হয়নি যে, সেগুলি শহরের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী বাসজমি হিসেবে অনুমোদিতই নয়।
এইসব এলাকার বাসিন্দারা— যাঁদের অনেকেই জীবনের সব সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছিলেন— এখন স্পষ্ট কোনও বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই উচ্ছেদের মুখে পড়েছেন। একই সঙ্গে প্রতারণামূলক জমি লেনদেনের দায় কার উপর বর্তাবে, সেই জবাবদিহিও অনুপস্থিত।
GNIDA-র দাবি, তারা কৃষকদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করে নির্ধারিত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী পরিকল্পিত নগরোন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ব্যবহার করে— যেখানে রাস্তা, পরিকাঠামো এবং বিভিন্ন ধরনের জমির ব্যবহার (আবাসিক, শিল্প, প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক) নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকে। হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদককে এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেন, “প্লটগুলি অনুমোদিত আবাসস্থল, শিল্প, প্রতিষ্ঠান বা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বরাদ্দ করার জন্য নির্ধারিত। কিন্তু কিছু কলোনাইজার বেআইনি কলোনি গড়ে তুলে এবং ক্রেতাদের ভুল পথে চালিত করে এই প্রক্রিয়াতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে।”
প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি একটি আন্তঃবিভাগীয় স্ট্র্যাটেজিক মিটিঙের পর এই ভাঙচুর অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য— শুধু অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধেই নয়, বরং যাঁরা বেআইনিভাবে কৃষিজমি রূপান্তর ও বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত— সেই জমিমাফিয়া ও দালালদের বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে GNIDA সাধারণ নাগরিকদের জমি কেনার আগে জমির বর্তমান অবস্থান ও ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করার পরামর্শ দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, GNIDA-র ওয়েবসাইট ও ভূমি নথি বিভাগ থেকে জমির মালিকানা ও জমির ব্যবহারবিধি যাচাই করা সম্ভব। তবে সমালোচকদের মতে, এই ধরনের পরবর্তী পর্যায়ের পরামর্শে এখন আর বাস্তব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কম আয়ের বহু মানুষ, যাঁরা প্রতারণার শিকার হয়ে জীবনের সঞ্চয় ঢেলে জমি কিনেছিলেন, তাঁদের সামনে এখন গৃহহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা— এবং এই পরামর্শ তাঁদের সেই দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে পারছে না।
আসন্ন উচ্ছেদ অভিযানটি আসলে একটি বৃহত্তর প্রবণতারই অংশ— যা ভারতের বিভিন্ন শহরে নগরভিত্তিক জমি-বাবস্থাপনায় ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে। দ্রুত নগরোন্নয়নের চাপ এবং জল্পনামূলক রিয়েল এস্টেট বাজার প্রায়শই আবাসন-অধিকার এবং শহরাঞ্চলে ব্যাপক অনানুষ্ঠানিক বসতির বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে।
আদালতে উত্থাপিত ভাঙচুর সংক্রান্ত মামলাগুলি
১. ভূমি মাফিয়া ও বেআইনি নির্মাণ-সংক্রান্ত মামলায় বোম্বে হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট
২০২৫ সালের ১৭ জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বোম্বে হাইকোর্টের একটি অন্তর্বর্তীকালীন রায়কে বহাল রাখে, যে-রায়ে বোম্বে হাইকোর্ট মহারাষ্ট্রের থানে-তে বেআইনিভাবে নির্মিত ১৭টি ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। এই সব ভবন এমন নির্মাতাদের দ্বারা তৈরি— যাঁদের বিরুদ্ধে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে, এবং যাঁরা সংশ্লিষ্ট জমির কোনও মালিকানা বা আইনি অনুমোদন ছাড়াই সেগুলি নির্মাণ করেছিলেন।
ন্যায়পাল উজ্জ্বল ভূঁইয়া ও ন্যায়পাল মনমোহন-কে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ এক ফ্ল্যাটক্রেতার করা বিশেষ অনুমতি আবেদন (Special Leave Petition) খারিজ করে দেয়। ওই আবেদনকারী দাবি করেছিলেন যে, তিনি ও আরও ৪০০-রও বেশি নির্দোষ পরিবার— যাঁরা কোনও বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত নন— তাঁরা গৃহহীন হয়ে পড়ছেন। আবেদনকারী আরও জানান, তিনি একজন প্রবীণ নাগরিক এবং রাজ্যের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের— এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও— পুনর্বাসনের আর্জি জানিয়েছিলেন, কিন্তু কোনও প্রতিকার মেলেনি।
তবে সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করে। সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ— যেসব ভবন ভাঙার আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলি তৃতীয় পক্ষের জমিতে কোনওরকম অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত হয়েছিল। আদালত বোম্বে হাইকোর্টের কড়া অবস্থানকে সমর্থন করে, এবং এই নির্মাণ কার্যক্রমকে “জমি মাফিয়াদের একটি চক্রান্ত” হিসেবে বর্ণনা করে এবং রাজ্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও পরোক্ষ মদতকে তার জন্য দায়ী করে।
LiveLaw-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিচারপতি মনমোহন মন্তব্য করেন: “এই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য হাইকোর্টকে সাধুবাদ জানাই… যখন আন্ডারওয়ার্ল্ডের মদতে এত বড় মাপের বেআইনি নির্মাণ হয়, তখন সেখানে আইনের শাসনের আর কোনও অস্তিত্ব থাকে না। যদি এই ধরনের অসাধু নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এই প্রবণতা চলতেই থাকবে— নিরীহ ক্রেতাদের কাঁধে ভর করে ‘গোরিলা যুদ্ধ’ চলবে। এভাবে চলা উচিত নয়, এটি বন্ধ করতেই হবে।”
বিচারপতি ভূঁইয়া প্রশ্ন তোলেন, কীভাবে মানুষ এমন প্রকল্পে ফ্ল্যাট কিনলেন, যেখানে উপযুক্ত নথিপত্রই ছিল না। তিনি পরামর্শ দেন, ক্রেতারা যদি নিজেদের প্রতারিত মনে করেন, তবে তাঁদের উচিত সংশ্লিষ্ট নির্মাতাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ফোরামে গিয়ে প্রতিকার চাওয়া।
উল্লেখ্য, বোম্বে হাইকোর্ট তাদের ২০২৫ সালের ১২ জুনের রায়ে আবেদনকারীর দুর্দশা স্বীকার করলেও স্পষ্টভাবে মন্তব্য করে: “সরকার ও পুরসভার আধিকারিকদের আশীর্বাদ ছাড়া এ-ধরনের নির্মাণ কখনওই গড়ে উঠতে পারত না… এতটা নির্লজ্জ বেআইনি কাজ কীভাবে এতদিন ধরে চলতে দেওয়া হল, তা সত্যিই বিস্ময়কর— এবং এর ফলে শেষমেশ প্রতারিত হলেন নিরীহ ফ্ল্যাটক্রেতারা।”
হাইকোর্ট তার আদেশে থানে মিউনিসিপাল কর্পোরেশন (TMC)-কে কোনও পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা না করে অবিলম্বে ভাঙচুর শুরু করার ক্ষমতা দিয়েছে— অবৈধতার বহর ও দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধারের জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে।
মূল রিট মামলা হাইকোর্টে দায়ের করেছিলেন এক মহিলা, যিনি নিজেকে দখলকৃত জমির মালিক বলে দাবি করেন, এবং সেখানে পরিকল্পনা আইনের সরাসরি লঙ্ঘন করে ভূমি মাফিয়ারা পাঁচতলা বেআইনি ভবন নির্মাণ করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আবেদনকারীকে তাঁর আবেদন তুলে নিতে এবং হাইকোর্টে ফের যাওয়ার অনুমতি দিয়ে রাখলেও, হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন ভাঙচুরের নির্দেশে হস্তক্ষেপ করেনি। এর মধ্যে দিয়ে বেআইনি নির্মাণ ও তাতে সরকারি মদতের বিরুদ্ধে বিচারবিভাগের কড়া মনোভাবের ছবিটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
২. সুপ্রিম কোর্টে স্থগিতাদেশ: থানের বিতর্কিত দরগা ভাঙচুর ৭ দিনের জন্য স্থগিত, ট্রাস্টকে হাইকোর্টে আবেদন করার অনুমতি
২০২৫ সালের ১৭ জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপে, সুপ্রিম কোর্ট থানে জেলার একটি বিতর্কিত দরগা ভাঙা ৭ দিনের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়। এই সীমিত সময়ের স্থগিতাদেশ পরদেশি বাবা ট্রাস্ট-এর জন্য একটি ছোট্ট হলেও স্বস্তির জানালা খুলে দেয়— যারা দীর্ঘদিন ধরে ওই স্থাপনাটির বৈধতা নিয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বোম্বে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক ভাঙচুর নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করা একটি special leave petition (SLP) শুনানির সময় বিচারপতি সন্দীপ মেহতা ও বিচারপতি প্রসন্ন বি ভারালে-র অবকাশকালীন বেঞ্চ এই অন্তর্বর্তীকালীন রায় দেয়।
এই মামলাটি থানের এক ধর্মীয় স্থাপনাকে কেন্দ্র করে, যা সরকারিভাবে এবং আদালতের নথি অনুযায়ী, মূলত মাত্র ১৬০ বর্গফুট জমির উপর নির্মিত ছিল। তবে অভিযোগ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় পৌর অনুমোদন ছাড়াই সেই কাঠামো ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়ে একসময় প্রায় ১৭,৬১০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে নির্মিত হয়। জমিটি ব্যক্তিমালিকানাধীন, এবং এই বেআইনি সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেন মূল জমির মালিক। ফলে গত দুই দশক ধরে এক দীর্ঘ আইনি লড়াই চলছে, যা একাধিক আদালত ও প্রশাসনিক মঞ্চে বিবেচিত হয়ে আসছে।
সাম্প্রতিক আদেশে বোম্বে হাইকোর্ট ট্রাস্ট এবং থানে পৌর সংস্থা (TMC) উভয়েরই তীব্র সমালোচনা করে। LiveLaw-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, আদালত ট্রাস্টের কার্যকলাপকে “অসাধু” বলে আখ্যায়িত করে এবং পৌর সংস্থাকে “ধোঁয়াশাপূর্ণ হলফনামা” দাখিল করার জন্য অভিযুক্ত করে। আদালতের মতে, ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের আড়ালে স্পষ্ট জমি দখলের যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তাই হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, কাঠামোর সমস্ত বেআইনি সম্প্রসারিত অংশ ভেঙে ফেলতে হবে। TMC-র জমা দেওয়া রিপোর্টে উল্লেখ ছিল যে, এই সম্প্রসারণ কোনও পরিকল্পনা অনুমোদন ছাড়াই ঘটেছে, এবং আগের ভাঙচুর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরও কাঠামোর কিছু অংশ আবার নির্মাণ করা হয়েছিল।
পরদেশি বাবা ট্রাস্টের আপত্তি, খারিজ হওয়া দেওয়ানি মামলার বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল: পরদেশি বাবা ট্রাস্টের পক্ষে উপস্থিত সিনিয়র আইনজীবী হুযেফা আহমদি সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি দেন যে, বোম্বে হাইকোর্ট তাদের ভাঙচুর নির্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিবেচনায় নেয়নি— ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে সংশ্লিষ্ট একটি দেওয়ানি মামলা খারিজ হওয়ার বিষয়টি। আহমদির বক্তব্য, ট্রাস্ট তাদের হলফনামায় হাইকোর্টকে এই দেওয়ানি মামলার বিষয়ে অবহিত করেছিল, কিন্তু আদালত আদেশে সেটির কোনও উল্লেখও করেনি বা সেটি নিয়ে কোনও ব্যাখ্যাও দেয়নি। তিনি দাবি করেন, এই ‘মৌলিক’ বিষয়টি উপেক্ষা করে হাইকোর্ট যেভাবে ভাঙচুরের নির্দেশ দিয়েছে, তা আদেশের ন্যায্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
LiveLaw-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, হুযেফা আহমদি তথাকথিত দখলদারির ব্যাপ্তি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তাঁর যুক্তি, হাইকোর্ট ভুলভাবে ধরে নিয়েছে যে পুরো ১৭,৬১০ বর্গফুট এলাকাই বেআইনি নির্মাণ— যখন বাস্তবে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু মাত্র ৩,৬০০ বর্গফুট জমি। আহমদি আরও অভিযোগ করেন, মূল জমির মালিক ইচ্ছাকৃতভাবে বেআইনি সম্প্রসারণের পরিমাণ অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, এই প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের ভাঙচুরের নির্দেশ রিট পিটিশনের পরিসীমাও ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে, জমির মালিকের পক্ষে বরিষ্ঠ আইনজীবী মাধবী দিবান হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। তিনি যুক্তি দেন, ট্রাস্ট ধর্মের আড়ালে পরিকল্পিতভাবে জমি দখলের কাজে লিপ্ত হয়েছে এবং হাইকোর্ট যে কঠোর মন্তব্য করেছে, তা সম্পূর্ণ যথার্থ। দিবান মিউনিসিপাল ইন্সপেকশন রিপোর্ট ও ঘটনাস্থলের আলোকচিত্র তুলে ধরে দেখান যে, অবৈধ অংশগুলি শুধুমাত্র অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত হয়নি— আগের ভাঙচুর আদেশ থাকা সত্ত্বেও কিছু অংশ ফের নির্মাণ করা হয়েছে, যা সরাসরি আদালত অবমাননার সামিল। তিনি আরও অভিযোগ করেন, ট্রাস্ট বারবার প্রক্রিয়াগত কৌশল অবলম্বন করে ভাঙচুর বিলম্বিত করছে এবং বেআইনি দখলদারিকে আইনি জটিলতার আড়ালে রক্ষা করতে চাইছে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি নিয়ে উদ্বেগ, সীমিত স্বস্তি ট্রাস্টকে: উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর, সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ প্রক্রিয়াগত অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে— বিশেষত পরদেশি বাবা ট্রাস্ট যে দাবি করেছিল, তারা জানানো সত্ত্বেও বোম্বে হাইকোর্ট দেওয়ানি মামলা খারিজের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি। বিচারপতি সন্দীপ মেহতা এই উপেক্ষাকে “বিস্ময়কর” (embarrassing) বলে মন্তব্য করেন এবং বলেন, হাইকোর্ট যদি দেওয়ানি মামলার ফলাফলের বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত থাকত, তাহলে তাদের সিদ্ধান্ত ভিন্ন হতে পারত।
LiveLaw-র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণে মৌখিকভাবে জানায়: “হাইকোর্ট যে দেওয়ানি মামলা খারিজ হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা না করেই আদেশ দিয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে আমরা ট্রাস্টকে রিকল (recall) আবেদন করার অনুমতি দিতে চাই।”
এই অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট পরদেশি বাবা ট্রাস্টকে বোম্বে হাইকোর্টে recall application দাখিল করার অনুমতি দেয় এবং সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ দিতে ভাঙচুর কার্যক্রম ৭ দিনের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়। আদালত স্পষ্ট করে জানায়, তারা এই মুহূর্তে নির্মাণের বৈধতা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না— তাদের হস্তক্ষেপ কেবলমাত্র প্রক্রিয়াগত বিচ্যুতি ও তথ্য উপেক্ষার ভিত্তিতে। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট ইঙ্গিত দেয়, যদি হাইকোর্ট ট্রাস্টের আবেদন গ্রহণ না করে, তাহলে ট্রাস্ট চাইলে আবার সুপ্রিম কোর্টে ফিরে আসতে পারবে। আদালত এটাও স্পষ্ট করে দেয়, এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়কালে (৭ দিন) আর কোনও ভাঙচুরের কাজ চলবে না। তবে নির্মাণের আইনগত অবস্থান, কতটা অংশ বেআইনি নির্মিত, এবং পূর্বে কোনও বৈধ অনুমোদন ছিল কি না— এই সমস্ত বিষয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
৩. বোম্বে হাইকোর্টে SRA প্রোজেক্টের বিরুদ্ধে PIL মামলায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১ লাখ টাকা জরিমানা:
২০২৫ সালের ১৭ জুন, বোম্বে হাইকোর্ট এক জনস্বার্থ মামলায় (PIL) স্বঘোষিত বৈদ্যুতিন সাংবাদিক অঙ্কুশ জয়সওয়ালের বিরুদ্ধে ১ লাখ টাকার জরিমানা ধার্য করে। অঙ্কুশ মুম্বাইয়ের কান্দিভালি (পূর্ব) অঞ্চলে একটি Slum Rehabilitation Authority (SRA) প্রকল্প ভেঙে ফেলার দাবিতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন। আদালত এই মামলা সরাসরি “আইনি প্রক্রিয়ার গুরুতর অপব্যবহার” বলে চিহ্নিত করে এবং তা খারিজ করে দেয় ও জরিমানার নির্দেশ দেয়।
বিচারপতি অলোক আরাধ্যে এবং বিচারপতি সন্দীপ ভি মার্নে-র ডিভিশন বেঞ্চ পর্যবেক্ষণে জানায় যে, অঙ্কুশ জয়সওয়ালের এই জনস্বার্থ মামলা (PIL) প্রকৃতপক্ষে কোনও জনস্বার্থ তুলে ধরে না। আদালত আরও উল্লেখ করে যে, মামলাটি res judicata নীতির আওতায় নিষিদ্ধ— কারণ একই ধরনের একটি আবেদন এই আবেদনকারী আগেই করেছিলেন, যা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অন্য একটি বেঞ্চ খারিজ করে দেয়।
উল্লেখিত যে ভবনটি— যার ছয়টি উইং রয়েছে— Slum Rehabilitation Authority (SRA) প্রকল্পের আওতায় গঠিত বন্দোংরি একতা কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড-এর অংশ। আবেদনকারী অঙ্কুশ জয়সওয়াল অভিযোগ করেন, নির্মাণকাজে একাধিক নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে— যেমন জাতীয় সড়ক থেকে নির্ধারিত দূরত্ব না রাখা এবং নির্মাণ শুরুর আগে প্রয়োজনীয় No-Objection Certificate (NOC) সংগ্রহ না করা।
তবে আদালতের মতে, এসব অভিযোগ পূর্বে বিচারাধীন ছিল এবং ইতিমধ্যেই নিষ্পত্তি হয়েছে। ফলে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা অনুচিত ও অপব্যবহারসুলভ।
তবে LiveLaw-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিভিশন বেঞ্চ এই মামলার কিছু গুরুতর অসঙ্গতি লক্ষ করে—
আবেদনকারী প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার ২২ বছর পরে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন;
তিনি নিজেই ওই SRA-প্রকল্পভুক্ত ভবনে বসবাস করছেন, অথচ সেই ভবনকেই তিনি “বসবাসের জন্য বিপজ্জনক” বলে দাবি করছেন;
এবং যদি আদালত এই আবেদন গ্রহণ করত, তাহলে পুনর্বাসিত বস্তিবাসীরা গৃহহীন হয়ে পড়তেন।
এই প্রেক্ষিতে আদালত স্পষ্ট করে দেয়, এমন জনস্বার্থ মামলা শুধু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই নয়, বরং এটি সেই পুনর্বাসিত মানুষগুলির “সংবিধান-প্রদত্ত বাসস্থানের অধিকার” হরণ করার সামিল, এবং সেটি করা হচ্ছে “জনস্বার্থে”র কথা বলে।
LiveLaw-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলাটি খারিজ করে বিচারপতিরা বলেন:
এই আবেদনে আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার হয়েছে। এটি কোনও প্রকৃত জনস্বার্থ তুলে ধরে না এবং res judicata-র আওতায় পড়ে। একটি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া, যা বহু দশক আগে সম্পন্ন হয়েছে, তাকে বিঘ্নিত করা আদালতের কাজ নয়— আরও বিশেষ করে সেই ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে, যিনি নিজে সেই ভবনটিকেই আক্রমণ করছেন, যেখানে তিনি নিজেই বর্তমানে বসবাস করেন।
আদালত নির্দেশ দেয়, আবেদনকারী পূর্বে যে ১ লক্ষ টাকা জামানত হিসেবে জমা দিয়েছিলেন নিজের সদিচ্ছা প্রমাণ করতে, সেই অর্থ থেকেই জরিমানার টাকা কেটে নেওয়া হবে। এই ১ লক্ষ টাকা মহারাষ্ট্র স্টেট লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি (MSLSA)-র তহবিলে স্থানান্তর করারও নির্দেশ দেয় আদালত।
৪. পেড্ডাপল্লি সরকারি হাসপাতালের পাশে বিপণি কমপ্লেক্স ভাঙচুরে স্থগিতাদেশ তেলেঙ্গানা হাইকোর্টের:
২০২৫ সালের ১৭ জুন, তেলেঙ্গানা হাইকোর্ট একটি অন্তর্বর্তী আদেশে পেড্ডাপল্লি সরকারি হাসপাতালের পাশে অবস্থিত একটি বিপণি কমপ্লেক্স ভাঙার প্রস্তাবিত পদক্ষেপে স্থগিতাদেশ জারি করে। কিশন প্রকাশ ঝাওয়ার, যিনি একটি রিট পিটিশন দায়ের করে দাবি করেছিলেন, রাজ্য প্রশাসনের তরফে তাঁকে যে উচ্ছেদের নোটিস পাঠানো হয়েছে তা বেআইনি, এই স্থগিতাদেশের ফলে সাময়িক স্বস্তি লাভ করেন। আদালতের এই অন্তর্বর্তী আদেশে ওই উচ্ছেদ কার্যক্রম আপাতত স্থগিত থাকল।
বিচারপতি কে শরথ আবেদনকারীর যুক্তি শুনে— যেখানে বলা হয় ভাঙচুরের এই সিদ্ধান্ত ইচ্ছাকৃত ও খামখেয়ালি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কোনও বৈধ আইনি ভিত্তি ছাড়াই গৃহীত— এর ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন।
মামলার প্রেক্ষাপট:
- আবেদনকারী ২০০৭ সালে মেডিকেল দপ্তরের সঙ্গে একটি Build-Operate-Transfer (BOT) চুক্তি সই করেন, যার মাধ্যমে তাঁকে ২৫ বছরের জন্য পেড্ডাপল্লি সরকারি হাসপাতালের পাশে থাকা বিপণি কমপ্লেক্সটি পরিচালনার অধিকার দেওয়া হয়।
- ২০২৫ সালের ২২ মে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবেদনকারীকে চত্বর খালি করার নোটিস পাঠানো হয়।
- আবেদনকারীর আইনজীবী দীপক মিশ্র আদালতে দাবি করেন, এই নোটিসের কোনও আইনি ভিত্তি নেই এবং এটি স্থানীয় বিধায়কের মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে।
- তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে হাসপাতাল ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে ভাঙচুর ও পুনর্নির্মাণের আলাদা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় বিপণি কমপ্লেক্সের কোনও উল্লেখ ছিল না।
আবেদনকারীর যুক্তি:
- নোটিসের কোনও আইনগত ভিত্তি ছিল না— নোটিসে কোনও সরকারি সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক নির্দেশ বা নির্দিষ্ট সরকারি আদেশ উল্লেখ করা হয়নি, যা কমপ্লেক্স ভাঙার নির্দেশকে বৈধতা দিতে পারে।
- বিপণি কমপ্লেক্সটি একটি স্বতন্ত্র কাঠামো— এটি পুরনো হাসপাতাল ভবনের অংশ নয়, যা ভেঙে ফেলে পুনর্নির্মাণ করার জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে।
- উক্ত কার্যক্রম ছিল খামখেয়ালি ও রাজনৈতিক প্রভাবপ্রসূত— এটি BOT (Build-Operate-Transfer)-ভিত্তিক বৈধ লিজ চুক্তির লঙ্ঘন এবং আবেদনকারীর চুক্তিসম্মত অধিকার হরণ।
আদালতের নির্দেশ: বিচারপতি কে শরথের পর্যবেক্ষণ— আবেদনকারী প্রাথমিকভাবে একটি গ্রহণযোগ্য মামলা (prima facie case) প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই ভিত্তিতেই আদালত পরবর্তী শুনানি না হওয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ বা ভাঙচুর স্থগিত করে।
আদালত তার রায়ে জোর দিয়ে বলে, হাসপাতাল পুনর্নির্মাণের অজুহাতে কোনও স্বতন্ত্র ও বৈধভাবে লিজপ্রাপ্ত কাঠামো ভাঙা যাবে না, যতক্ষণ না সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। বিচারপতি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক প্রভাবে প্রদত্ত কোনও মৌখিক নির্দেশ কখনও আইনি চুক্তি বা বৈধ লিজ চুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারে না।
৫. বাটলা হাউস ভাঙার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সুরক্ষা দিল দিল্লি হাইকোর্ট
২০২৫ সালের ১৬ জুন, দিল্লি হাইকোর্ট দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির ওখলার বাটলা হাউস এলাকায় অবস্থিত ছয়টি সম্পত্তি ভাঙচুরের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা প্রদান করে। আদালত এই আদেশ দেয় সেইসব আবাসিকদের আবেদনের ভিত্তিতে, যাঁরা দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (DDA)-র জারি করা উচ্ছেদের নোটিসকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন।
বিচারপতি তেজস কারিয়া নির্দেশ দেন যে, পরবর্তী শুনানির তারিখ পর্যন্ত বর্তমান পরিস্থিতি (status quo) বজায় রাখতে হবে। তিনি দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে (DDA) চার সপ্তাহের মধ্যে তাদের জবাব দাখিল করতে বলেন।
বিতর্কের প্রেক্ষাপট: আবেদনকারীরা— হিনা পারভিন, জিনাত কাওসার, রুখসানা বেগম, নিহাল ফাতিমা, সুফিয়ান আহমেদ, সাজিদ ফখর এবং আরও কয়েকজন— ২০২৫ সালের মে মাসে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (DDA) তরফে বিশেষ করে খাসরা নম্বর ২৭৯-এর আওতায় অবস্থিত সম্পত্তিগুলির জন্য একটি সর্বজনীন ভাঙচুর নোটিস পাওয়ার পর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন।
আবেদনকারীদের মূল যুক্তিগুলি ছিল নিম্নরূপ:
সীমার স্পষ্ট বিভাজনের অভাব (Lack of demarcation): আবেদনকারীদের যুক্তি ছিল, খাসরা নম্বর ২৭৯-এর আওতায় থাকা সব সম্পত্তিই বেআইনি নয় এবং অনেকগুলি সম্পত্তি তো এর বাইরেও। তাঁদের অভিযোগ, DDA কোনও নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করেনি এবং সম্পত্তিভিত্তিক মূল্যায়নও করেনি।
PM-UDAY প্রকল্পের আওতা (PM-UDAY scheme coverage): অনেক আবেদনকারী দাবি করেন, তাঁদের সম্পত্তি প্রধানমন্ত্রী উদয় প্রকল্প (PM-UDAY)-এর আওতায় পড়ে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দিল্লির অবৈধ কলোনিগুলিকে বৈধতার কাঠামোর মধ্যে আনা হয়ে থাকে।
ঐতিহাসিক বসবাসের প্রমাণ (Historic occupancy): উদাহরণস্বরূপ, নিহাল ফাতিমা দাবি করেন যে, তিনি ১৯৮০-৮২ সাল থেকে ওই এলাকায় বসবাস করছেন। তিনি বলেন, তাঁদের বাড়িগুলি বিল্ডারদের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল এবং তার কাগজপত্রও আছে। সেগুলির কয়েকটি উর্দু ও ফারসি ভাষায় হলেও পরে অনুবাদ করা হয়।
DDA-র অবস্থান ও সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স: দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (DDA) স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল আদালতে আবেদনকারীদের রিটের বিরোধিতা করেন। তাঁর যুক্তি ছিল— জমির সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত রিপোর্ট ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে, এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ২০২৫ সালের ৪ জুন ভাঙচুরের নির্দেশ জারি হয়েছে।
তবে হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের ৭ মে, ২০২৫-এর একটি পূর্ববর্তী আদেশের উল্লেখ করে জানায় যে, ওই আদেশে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে বলেছিল যে, জমির দখলকারীরা অবশ্যই উপযুক্ত আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন। এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই হাইকোর্ট নিজস্ব এক্তিয়ারকে বৈধ বলে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বলে যে, এই আবেদনগুলি গ্রহণযোগ্য এবং আদালতের বিষয়টি শোনার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।
আদালত আরও উল্লেখ করে যে, ইশরাত জাহান বনাম DDA-র মামলায় ২০২৫ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট এক আদেশে DDA-কে নির্দেশ দেয় যে, তাদের সীমানা নির্ধারণ এবং প্রস্তাবিত পদক্ষেপ সংক্রান্ত একটি বিশদ হলফনামা জমা দিতে হবে, যার সময়সীমা ছিল তিন সপ্তাহ।
*নিবন্ধটি নিউজক্লিকে গত ১৯ জুন ইংরেজিতে প্রকাশিত

