Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ইলোটিং বিলোটিং সই লো

শুভ্র মৈত্র

 

রাজা সেদিন বেরিয়েছিলেন পথে। ঠিক পথে নয়, পথে বেরোলে তাঁকে দেখে ফেলার ঝুঁকি ছিল বুঝেই নিয়েছিলেন জঙ্গল-অরণ্য ঘেরা, খানাখন্দে ভরা সেই পাকদণ্ডী, যেখানে সহসা কেউ যাওয়ার সাহস করে না। ধরাচুড়ো খুলে রেখেছিলেন, সাময়িক দৃষ্টিবিভ্রমের সুযোগ নেওয়ার জন্য। তবু নেননি রাজপথ। রাজা জানেন দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক প্রয়াসের পরেও তাঁর প্রজাদের সকলে দৃষ্টিতে স্বচ্ছতা হারায়নি।

রাজা সেদিন প্রাসাদ থেকে বেরনোর সময় নিশ্চিত হয়েছিলেন দ্বাররক্ষীরা সকলে গভীর ঘুমে নিমগ্ন থাকবে। বেছে নিয়েছিলেন রাত্রির তৃতীয় প্রহর। অনুচর তাঁকে জানিয়েছিল, এই সময়েই প্রহরা খানিক শিথিল হয়।

প্রাসাদের যে সিংহদুয়ার বন্ধ হয় সূর্যাস্তের সঙ্গে, তার অনতিদূরে যে পরিচারকদের জন্য একটি পথ সংরক্ষিত, যার মাধ্যমে প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণের জন্য নিচু করতে হয় মাথা, রাজার অজ্ঞাত ছিল না তা। তাই নিষ্ক্রমণের সময় বাধা পাননি রাজা। মাথা নিচু করা তাঁর অভ্যাসে ছিল না বলে জনগণের ধারণা। সকলের অগোচরে সেই বিশ্বাস কিছুমাত্র আহত হয়নি।

এই প্রায়ান্ধকার প্রত্যুষে রাজাকে স্বাগত জানানোর জন্য পথে কেউ ছিল না। যে চতুষ্পদের দল অনভিপ্রেত অতিথির উপস্থিতি জানান দেয়, যে সশস্ত্র প্রহরীর ওপর নগরের রাত্রিকালীন সুরক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত, এই লগ্নে সকলেই ক্লান্ত নিদ্রায় বিভোর। রাজার অনুমান আরও একবার অব্যর্থ প্রমাণিত হয়।

এই নগরের সুদৃশ্য ইমারতসারির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন রাজা। দেখলেন নিদ্রাপ্লুত দম্পতি, শুয়ে আছে পাশাপাশি শবাধারের মতো। এরা অনুগ্রহপুষ্ট, রাজতন্ত্রে নিরাপদ, অর্থের বিনিময়ে আলস্য ক্রয় করে। নিজেদের স্বাস্থ্যব্যতিরেকে কিছুতে তারা বিচলিত হয় না। রাজস্তুতিতে বৃন্দগান এদের প্রবৃত্তিতে আছে। রাজতন্ত্রে কখনওই এরা দুশ্চিন্তার উদ্রেক করেনি।

নগর অতিক্রম করে অগ্রসর হন রাজা। চোখে পড়ে ভাঙা কুটির, অযত্নে রচিত এক নিরাভরণ যাপনচিত্র। রাজার স্মরণে আসে, অনুকম্পা ভিক্ষা করতে এসেছিল ওরা। আর তুলেছিল সেই বঞ্চনার ইতিহাস, আবহমানের সেই ভাষা রাজার বিরক্তি সঞ্চার করেছে কেবল। নগরে ওরা বিসদৃশ, সৌন্দর্যায়নের প্রকল্প রূপায়ণে ওদের বিচ্ছিন্ন করা জরুরি। ওরা তবু আছে, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যরক্ষার প্রয়োজনে। রাজার ঔদার্য ওদের ওপর নিপীড়ন নামায় না। প্রাসাদ নির্মাণে ওরা শ্রম দেয়, ভূমি কর্ষণ করে তুলে আনে শস্য, নগরের চাহিদাপূরণে রত থাকে, রাজপথ চলাচলের যোগ্য করে তোলে, নয়নাভিরাম উদ্যানে জলসিঞ্চনের দায়িত্ব ওদের, শকট চালনা করে, নাগরিক ও বর্জ্য বহন করে সেই শকটে, নগরকে পুরীষমুক্ত করার ভার ওদের ওপরেই ন্যস্ত। সূর্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ওদের, তাই এই কুটিরের প্রাণীরা ইতোমধ্যেই ঘরছাড়া।

ক্ষুধা ও পরিপাকশক্তি বৃদ্ধির জন্য পদসঞ্চার করে যারা, তারা উত্তরাধিকারসূত্রে রাজমিত্র। ক্ষুধানিবৃত্তির কারণে চলনের অভ্যাস যাদের, তারা শুধু রাজার ভ্রূকুঞ্চন ঘটায়।

ক্রমশ রাজপ্রাসাদের সুউচ্চ চূড়া অদৃশ্য হয়। সেখানে সূর্যের প্রথম কিরণ এক মোহাচ্ছন্নতা তৈরি করে। সে দৃশ্য উপভোগ করে মুগ্ধ দর্শকের দল। রাজার এহেন বিলাসে অভিরুচি নেই। তাই তিনি ভিন্নপথে অগ্রসর হন। এই বনাঞ্চল রাজার অপরিচিত নয়। অমাত্য সংসর্গে এ ভারি মনোরম হয়ে ওঠে। নিজের হাতে হরিণের মুখে শস্যদানা তুলে দেওয়া যায়। এই মুহূর্তে সেই সুরক্ষা নেই। বনচর প্রাণীরা নিজেদের খাদ্যের সন্ধানে ব্যস্ত। কেউ সংগ্রহ করে জ্বালানি। সংঘাত যা কিছু তা নিজেদের মধ্যে মেটায়। ভ্রূক্ষেপ করে না কোনও আদালতের। আর অপরিচিত অবয়ব যতক্ষণ নিরাপত্তার বিঘ্ন না ঘটায়, তার প্রতি দৃষ্টিপাত নেহাৎ কালক্ষেপ এই ব্যস্ত অনুপলে।

জলের সন্ধানে ওরা সুদীর্ঘ পথ হাঁটে। শীর্ণকায় ঝর্ণার অপুষ্টি রাজাকে উদ্বিগ্ন করে, কিন্তু ভীতির সঞ্চার হয় না ওদের চোখে। স্বাভাবিক হিসেবে গৃহীত এই ব্যবস্থায় ওরা ব্যস্ত রসদ সংগ্রহে। এতদিন রাজা অনুগ্রহপুষ্ট প্রাণীর মুখে জয়ধ্বনি শুনেছেন শুধু, আলাপচারিতায় কান পাতা তাঁর সংবিধানের বিরুদ্ধে যায়।

এখন জল-খাদ্য-জ্বালানির প্রাত্যহিক ব্যস্ততার মাঝেও ওদের কথোপকথন কানে আসে। ওরা সাম্প্রতিক সংবাদ নিয়ে চর্চা করে। যে-বৃদ্ধার এই মুহূর্তে নিজের শরীরের মতো শুকনো পাতা কুড়োতে নিচু হওয়ার কথা ছিল, তিনি এখন গাছের সঙ্গে শব্দবিনিময়ে ব্যস্ত। যে-পুরুষের সন্ধান ছিল পশুমাংসের, সে এই মুহূর্তে এক ভীত শ্বাপদের সাথে উদ্বেগ বিভাজনে নিবিড়। যে-কানে এতদিন জয়ধ্বনি ছাড়া অন্য কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, রাজার সেই শ্রবণে উঠে আসে ওদের এই অজীর্ণ বাসভূমি ত্যাগের আশঙ্কা। রাজসভা থেকে সংবাদ এসেছে এই চরাচরে অধিবাসের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। ওরা ঔরস চেনে, তার চেয়ে অনেক বেশি জানে গর্ভ। নিজেদের সংবেদে কোনও প্রশ্নের ধারাপাত জানা ছিল না ওদের।

রাজার পরিকল্পনায় উন্নয়ন ছিল, ছিল ভবিষ্যতের কাছে অমরত্বের প্রত্যাশা। তাই অবাঞ্ছিতদের বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, অতীত যাদের বর্ষার মেঘের মতো ছায়াঘন, ভবিষ্যৎ যাদের পড়ে থাকা নুড়িপাথরের মতো অবহেলাময়, তাদের বর্তমানে কোনও অধিকার নেই। রাজার জানা আছে বলপ্রয়োগে অকারণে রক্ত ঝরে। শান্তির পূজারী ভাবমূর্তিতে কালি ছেটে। তাই আনা হয়েছে আইন, চাওয়া হয়েছে অস্তিত্বহীন ভূতের প্রমাণপত্র। গাছের সঙ্গে আত্মীয়তা ওদের, কাগজের সঙ্গে বৈরিতা। এই অব্যর্থ কৌশলের সাফল্য সম্পর্কে রাজা চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী। এই সমবেত উদ্বেগ তাঁকে প্রার্থিত দৃশ্যের তৃপ্তি দেয়।

ভীত দৃষ্টিতে সেই প্রাণীকুল একবার তাকায় মাটির দিকে, একবার সবুজ অরণ্য আসে গোচরে। নিজেদের কর্কশ হাতের স্পর্শ আছে এই নগরের প্রতিটি ইমারতে, প্রতিটি ধূলিকণা চেনে তাদের শরীরের গন্ধ। নিজেদের অবিচ্ছেদ্য ভাবার কুসংস্কার ছিল ওদের। জানা ছিল না কী ভঙ্গুর এই সংযোগ! দৈনন্দিনের রসদ সংগ্রহের মাঝে ওদের মুহূর্তেক স্তব্ধতা চোখে পড়ে। ওরা বিচলিত। ওদের সন্তান, যারা ক্ষুন্নিবৃত্তির কারণে শৈশবেই পিতামাতার সঙ্গী হয়, উপকরণের সঙ্গেই বিনোদনের নানান উপাদান সংগ্রহ করে। এই মুহূর্তে রাজার দৃষ্টির সামনে ওরা ব্যস্ত এক আজব খেলায়, ‘ইলোটিং বিলোটিং সই লো, রাজামশাই একটি প্রমাণ চাইল…’। রাজা অনুধাবন করেন, এই সম্প্রদায়ে শৈশব বড় ক্ষণস্থায়ী, জ্যেষ্ঠের সঙ্গে বয়ঃকনিষ্ঠের দূরত্ব নামমাত্র। অনুমোদন এক্ষেত্রে সামগ্রিক স্থিতির পক্ষে বিড়ম্বনার। এদের বিতাড়নের অপরিহার্যতা আরও তীব্রতর অনুভূত হয়। সাফল্য অনতিদূরে, প্রত্যক্ষ করেন রাজা।

ওদের দৈনন্দিনতায় নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদন এবং নগরের পরিষেবা ভিন্ন কিছু ছিল না। দিনান্তে ক্লান্তি নিরসনের উপায় হিসাবে ছিল নেশা ও যৌনতা। উচ্ছ্বাস এবং যন্ত্রণায় ওরা চিৎকার করে, সঙ্গমে শীৎকার গোপন করতে শেখেনি। উপহাস এবং নিপীড়ন ওদের কখনও বিচলিত করে না। শুধু বাস্তুচ্যুত হওয়ার অর্থ ওদের অধরা। আবহমানের চেনা অরণ্যে এই প্রথম ভয় গ্রাস করে ওদের।

যূথবদ্ধতা তাদের প্রবৃত্তিগত, আশঙ্কা কেবল ঘনত্ব বৃদ্ধি করে। বেলা বাড়ছে, সূর্যের বর্ধমান তাপ ওদের অসহ নয়, ভূমি থেকে ছিন্ন হওয়ার উদ্বেগে শরীরে ঘামের সঞ্চার হয়। উষ্ণীষহীন রাজার সামনে উদ্বেগ ক্রমশ ঘন করছে এই প্রাণীকুলের সমাবেশ। যে শর্ত তাদের জন্মস্থানের সঙ্গে অচ্ছেদ্য করে তুলবে, বয়ঃবৃদ্ধরা তাকে জটিল এবং পূরণের অযোগ্য মনে করে, যুবকের দল ক্রোধ এবং উপেক্ষার রঙে আঁকতে চায়। উচ্চারণ করতে চায় এই দেশের সচলতায় ওদের অপরিহার্যতা। সাময়িক কলরব ওঠে, দুশ্চিন্তা কিছুমাত্র লাঘব হয় না। পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতা থেকে ওরা জানে বিভাজনের মতো অমোঘ অস্ত্র রাজার তূণে আছে, যার সাফল্য প্রশ্নাতীত। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্বরে অবগাহন করতে চেয়েছিল যারা, অভিজ্ঞরা তাদের নিরস্ত করে পরিণামের কথা বলে। ওরা আবার এক অনিশ্চিতির গহ্বরে প্রবেশ করে। এ সবই রাজার অনুমেয় ছিল, শুধু রমণীর দলের মুখাবয়বে কাঙ্ক্ষিত ভীতি দৃশ্যমান নয়। নারীকে আনত চোখেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন রাজা। এই রমণীকুলের সংস্কৃতির অভাব তাঁকে পীড়া দেয়।

ক্রমে শিথিল হওয়ার কথা ছিল ওদের, হতাশা বিচ্ছিন্ন করতে পারত। তবু রাজার বিস্মিত চোখে ধরা পড়ে সংখ্যায় বাড়ছে এই অবাঞ্ছিতের দল। প্রত্যাশা ছিল স্বার্থপরতার, প্রত্যাশা ছিল ক্লীবত্বের। তবু ওরা সংঘবদ্ধ হয়। আর বৃদ্ধি পায় ওদের সংখ্যা। পুরুষ-নারী-শিশু-জরাগ্রস্ত বৃদ্ধনির্বিশেষে ওরা ধীরে ধীরে জড়ো হতে থাকে। রাজা উঁকি মেরে খুঁজতে থাকেন নেতৃত্ব, কেউ নেই সেই স্থানে। শুধু পরাজয়ের অনুভূতি ওদের একাত্ম করেছে। এখনও পর্যন্ত রাজা স্বয়ং চক্ষুগোচর হননি তাদের। নইলে ওরা দেখতে পেত সাফল্য উপভোগের প্রত্যাশায় পথে বেরিয়েছিলেন রাজা। যে সাফল্য ক্রমে একা করেছে রাজাকে।

এক অজানা সংশয়ে ভুরু কুঞ্চিত হয় রাজার। বিদ্রোহের অমূলক ভয় থেকে তিনি মুক্ত। শুধু অন্য একটা আশঙ্কা তাঁকে গ্রাস করে। এতগুলি কণ্ঠ বিয়োজিত হলে তাঁর নামে প্রিয় জয়ধ্বনির তীব্রতা ক্ষয়িষ্ণু হবে। রাজা অস্থির হয়ে ওঠেন। উদ্বেগ সংক্রামিত হয়, রাজার জানা ছিল না।

আর উজ্জ্বল রাজতন্ত্রে অনভিপ্রেত ফ্যাকাশে অবাঞ্ছিতের দল, যাদের হাত তাদের মাথাকে চালনা করে, বুঝতে ব্যর্থ হয়, নিজের ভাবমূর্তিতে বন্দি রাজা আসলে এই প্রত্যুষে কাঁদতে চেয়েছিলেন।