রাজা ও কাঠবিড়ালি

শুভ্র মৈত্র

 

রাজপথ এই ফেরিওয়ালাদের আগেও দেখেছে। ঝোলা কাঁধে নিয়ে হাঁটে। ক্লান্তি এবং অভ্যাস মেখে হাঁটে ওরা। পরিচিত গলায় শুনিয়ে দেয় ওদের আসার কথা। শহরের কুকুরের দল, যারা অপরিচিত গন্ধে ঘেউ ঘেউ করত, তারা এখন ওদের পিছু নেয় না। এই ফেরিওয়ালাদের চিনে ফেলেছে না-মানুষেরাও।

তখনও রোদের তন্দ্রা কাটেনি। পূব আকাশে লাল আভা ছড়িয়েছে শুধু। পিঁপড়ের মতো বেরিয়েছিল ওরা গর্ত থেকে। ওদের সবার ভিন্ন নাম আছে সে-জগতে। কেউ পরিচিত ছিল সন্তানের পিতা হিসেবে। কেউ বা পূর্বজর সন্তান হয়ে। নারীরা জানে তাদের পুরুষের জন্য খানিক ভাবনা বেঁধে দিতে হয় পোশাকের ভাঁজে, অতিরিক্ত ভার বহনে তাদের ক্লান্তি আসে। এই নগরের পশ্চিম প্রান্তে যে সকল অবিন্যস্ত তেঁতুল-শিমুল গাছ আছে, তাদের কাছে ফুল বা ফলের প্রত্যাশা করে না কেউ, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া গাছেরা শুধু প্রথম সূর্যের আলো মাথায় ধরে রাখে।

সেই আলো ওদের শরীরে লাগে। ওরা বেরিয়ে আসে সারি বেঁধে। শৃঙ্খলা ওদের জন্মগত, অনুধাবন ওদের প্রতিবর্তে থাকে। ওরা কেউ সারি ভাঙতে শেখেনি। একজন বাহকের হাতে অন্যের পসরা ওঠে না, ঘন সন্নিবেশে চলন তাদের, তবু ঘর্ষণজাতীয় কোনও শব্দ জন্ম নেয় না সেই হাঁটায়। ওরা জানে এই নাগরিক সমাহারে ওরা স্বাগত নয়, সন্দেহ এবং শীতলতা ওদের আজীবনের প্রাপ্য। নগর মানুষের পথ তবু ওদের চিরন্তন অভিলাষের জায়গা, ওরা হেঁটে নিতে চায় সড়ক, উপসড়ক, অন্ধ গলি। অসংস্কৃত পদক্ষেপে।

***

 

রাজপথে আজ ব্যস্ততার অভিসার। মধ্যরাত থেকেই সাজানো হয়েছে তোরণ, ফুল দিয়ে গাঁথা হয়েছে অসংখ্য মালা। ধূলামলিন পথ ধোয়ানোর জন্য নদী থেকে আনা হয়েছে জল, পথের পাশে শুয়ে থাকা উদাসীন পাকুড়গাছ যা ছায়া দিতেও অপারগ, আজ সেজে উঠেছে রঙিন ফুলের সাজে। ভিন্ন মাতার আত্মজকে শরীরে ধারণের লজ্জা তাকে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত করে না।

পসারিরা এই সকালে তাদের বিপণী খোলেনি, নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তার পাশে। সঙ্গে আছে স্ত্রী-পরিবার। সকলেই এই উৎসবরঙে অবগাহন করতে চায়। তাদের অবয়বের উজ্জ্বলতা আসন্নের বার্তা বয়ে আনে। পূব থেকে গড়িয়ে আসা এই রাজপথে মেলে দেয় দৃষ্টি, যতদূর যায়। রাজা আসছেন আজ এই পথ ধরে।

এ-নগর তাঁর পায়ের ছোঁয়া পায়নি দীর্ঘদিন। তাঁর স্পর্শের আকুতি নিয়ে যুবতী বৃদ্ধা হয়েছে। বৃদ্ধের বাসনা পূর্ণ হওয়ার আগে মৃত্যু এসেছিল। তবু নাগরিকরা তাঁর অভাব অনুভব করেনি, তাঁর পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি বিস্তৃত আছে এই ভূখণ্ডে। তাঁর ধ্বনিত প্রতিটি উচ্চারণ অনুরণিত হয় আবালবৃদ্ধবনিতার স্বরে। শুধুমাত্র রক্তমাংসের রাজশরীর দর্শনের জন্য এই অপেক্ষা। তিনি আসবেন এ পথে আজ। শুধু এই বার্তাটাই জড়ো করেছে ওদের, যাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। নিজেদের দৈনন্দিন জীবন ছেড়ে অপেক্ষা করতে কিছুমাত্র মনোকষ্ট গ্রাস করেনি এই অপেক্ষমান জনতাকে।

***

 

এই পেশায় পরিবর্তন এক প্রাচীনতম সত্য। ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ফেরিওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ আগে স্বপ্ন বিক্রি করত। অনাবাদের যে-বছরে পাখিরা ছেড়েছিল এই গাছের ডেরা, ওরা হাঁক দিয়েছিল বর্ষা আসবে। আলোর পাতায়, গাছের মাথায় বর্ষা। বৃষ্টি-ব্যাপারীদের কাছে বিনিময়ের মুদ্রা নিয়ে এসে দাঁড়ায় নিদাঘে দগ্ধ নাগরিক, দরদাম করে, তারপর ঘরে নিয়ে যায় বৃষ্টির মেঘ।

ওরা জেনেছিল আলোর আধিক্যে অবয়ব হারানোর শঙ্কা গ্রাস করে। আতঙ্কিত ইমারত নিজের নগ্নতা ঢাকতে চায়। কৃত্রিম আলোর তীব্রতায় যখন অসহায় দেখায় প্রাচীন বটগাছটাকে, আবডাল খুলে যায় টিয়া-ময়নার গেরস্থালির, তখন ওরা ঝোলায় নিয়েছিল অন্ধকার, হরেক কিসিমের অন্ধকার। যে অন্ধকার গাঢ়, নিশ্ছিদ্র, ব্যক্তিগত কোনও পরিসরে ঢুকতে দেয় না আলো। হাঁক দিয়েছিল ওদের শেখা ছন্দে। কী আশ্চর্য, অট্টালিকায় আলোর বৃত্তে যাপন করা গ্রহীতাদের চাহিদাতেও ছিল সেই অন্ধকার। দিনান্তে গুনেছিল মুদ্রা, ফেরিওয়ালার আবশ্যিক প্রাপ্তি হিসেবে।

***

 

বৃদ্ধ রবি নাটুয়া শ্রোতা খুঁজে পায় এই রাজপথে। বয়স হয়েছে, এখন আর রং মাখতে পারে না মুখে, শুধু বচনেই খেদ মেটায়। অপেক্ষমান জনতার শ্রবণে কোনও ক্লান্তি নেই। শুরু করে বৃদ্ধ কোনও ভনিতা ছাড়াই, ‘এই রাজার প্রপিতামহ ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। এই রাজত্বের ভিত গেঁথেছিলেন তিনি। সন্তান এবং পৌত্রের মধ্যে বীজ বপন করেছেন সেই সাম্রাজ্যের। যে স্বল্পমেয়াদে তারা হারিয়েছিল সিংহাসন, তখনও প্রত্যয় ছিল প্রত্যাবর্তনের।’ বর্তমান রাজার আগমনের দিকে চেয়ে থাকা মানুষ বিশ্বাস করেছিল রবি নাটুয়ার সেই কথন। আসলে বিশ্বাস করতেই চায় তারা।

এ এক অমৃত মুহূর্ত। রাজা স্বয়ং তাঁর প্রান্তদেশের সীমানা বীক্ষণে আসছেন। সীমান্তবাসী অপলকে দেখবে তাদের রক্ষককে, উপচারে ভক্তি এবং ভীতি তাদের সুদীর্ঘকালের পুঁজি। নাটুয়া বর্ণনা করে চলেছিল, ‘যোগ্য উত্তরপুরুষ বটে আমাদের মহারাজ। দক্ষিণ সীমান্তে প্রজাবিদ্রোহের কালে তাঁর দার্ঢ্য প্রত্যক্ষ করেছিল সবাই। বিদ্রোহীরা সংখ্যায় হ্রাসমান হয় দ্রুত, অধিকার জাতীয় অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করার আগেই জিহ্বা হারায় তারা। ধন্য ধন্য করেছিল সকলে মহারাজের। যে সামান্য রক্তপাত দেখেছিল সেই বিদ্রোহ, তা শুধু সাদাকালো জীবন রঙিন করার বাসনায়। রক্ত সর্বদাই রঙের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য।’

মহারাজের যে হাস্যমুখ পথের পাশে শোভা বাড়ায়, উপস্থিত মানুষ কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়ে সেই মুখের সঙ্গে বৃদ্ধের বর্ণনা মেলাতে গিয়ে। নিয়মতন্ত্রে বাঁধা তারা সবাই, এগিয়ে গিয়ে দেখার অনুমতি নেই। নিজেদের নির্ধারিত স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকে তারা, রাস্তার দিকে নিষ্ঠাবান দৃষ্টিতে তাকায়, দেখা যাচ্ছে কি, অজস্র মানুষের শোভাযাত্রায় পেছনে এক রাজরথ?

***

 

যে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ বেশি আলো দেয়, ফেরিওয়ালাদের জানতে হয়, চাহিদা-জোগানের প্রাগৈতিহাসিক সূত্র। নগরের মানুষ উপেক্ষা করতে জানে, নগরবাসের আবশ্যিক শর্ত সেটা। ফেরিওয়ালাদের অভ্যস্ত গলার ডাক কেউ শোনে, কেউ শোনে না। কেউ ডেকে বসায় বাড়ির দরজায়, ভেতরে নিয়ে যায় না, দরজার কাছেই ঝুলি খুলতে বলে, নেড়েচেড়ে দ্যাখে, দরদাম করে। ওরা আপ্রাণ বোঝায় পণ্যের গুনাগুণ, বলে ওদের চলাফেরা নিত্যদিনের, তাই প্রবঞ্চনার ভয় অমূলক। তারপর কেউ কেনে, কেউ কেনে না। প্রত্যাখানে অভ্যস্ত ফেরিওয়ালার দল আবার ধরে এ গলি, সে গলি। সঙ্গে ভাঙা গলায় পরিচিত ডাক।

পণ্যের চাহিদা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন, জানে তারা। যে পুরুষ খোঁজে নারীর রূপসজ্জা, নিজেদের চাহিদা অনুসারে সাজাতে চায় নারীকে, ফেরিওয়ালা তার জন্য পৌরুষের অভিজ্ঞান ফেরি করে। যে নারী নিজেকে পুরুষের কাছে মোহময়ী করে তুলতে চায়, ফেরিওয়ালা তার জন্য প্রসাধন নিয়ে আসে। পণ্যের গুণাবলি বর্ণনা করে, বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হয় সেই বর্ণনা। গত ঋতুতে ভিন্ন প্রসাধনের জন্যও ছিল তাদের গলায় ছিল বিশ্বাসের ছাপ।

ফেরিওয়ালারা জানে, শিশুরা ক্রেতা হিসেবে নির্ভরযোগ্য। নাগরিক শিশুদের অভিলাষ পূরণে নারীপুরুষ সীমানা লঙ্ঘনে সঙ্কোচ করে না। তাই শিশুদের জন্য ওরা রঙিন পসরা ঝোলায় ভরে, হাঁক দেয়, ‘বিকেল চাই বিকেল, খেলার মাঠ…’

***

 

নগরের সীমানায় প্রবেশ করেছে রথ। দাঁড়িয়ে থাকা রাজার মুখে স্মিত হাসি। পথের ধারে অপেক্ষমান মানুষ প্রণাম করছে দূর থেকে। কাছে যাওয়ার নিয়ম নেই। দূর থেকেই রাজা ছুঁড়ে দিচ্ছেন হাসি, বরাভয়। জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয় আকাশ। ওদের কোনও চাহিদা নেই, স্বচক্ষে রাজদর্শনের অধিক কোনও প্রাপ্তির কথা জানে না ওরা। বাতাসে ভেসে বেড়ায় সমৃদ্ধির কথা, সুরক্ষার কথা, রাজার অবয়বে এক যুগপুরুষের আবির্ভাবের কথা। ওরা জানে এই দর্শন ওদের সৌভাগ্য বয়ে আনে, পূর্বজরা যে সুখে বঞ্চিত। নাগরিকের দল পরম যত্নে রেখে দিতে চায় সেই স্মৃতি পরবর্তী প্রজন্মকে বর্ণনা করার জন্য।

ওরা জানে রাজা পরম করুণাময়। তাঁর হাত থেকেই নির্গত হয়েছে যাবতীয় সুখ। ক্ষুধা এবং ক্লান্তির প্রাগৈতিহাসিক সমীকরণ বদলে দিতে পেরেছেন তিঁনি। সম্মোহিত মানুষ জেনেছে সময়ের দাবি, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ। তারা ফুল ছোড়ে রথের দিকে, রাজার শরীর পর্যন্ত পৌঁছোয় না, প্রহরীরা সেই ফুল সরিয়ে নেওয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

যে শিশুটি প্রহরা মানেনি, ছুটে গেছিল রথের কাছে, রাজা তাঁকে স্নেহ বর্ষণ করেছেন, একটি মালা দিয়েছেন ছুড়ে তার দিকে। দিগ্বিজয়ের হাসিতে ভরেছিল শিশুর মুখ। তার অজ্ঞাত ছিল শৃঙ্খলাভঙ্গের এ চিত্রনাট্য পরিকল্পিত। রাজার শিশুপ্রেমী ভাবমূর্তি প্রচারের প্রয়োজনে। সহস্র করতালির মাঝে পথপার্শ্বে অপেক্ষমান মানুষ ঈর্ষাতুর চোখে তাকিয়েছিল শিশুর পিতার দিকে।

***

 

ফেরিওয়ালার দল আসে পশ্চিম প্রান্ত থেকে। পূবপ্রান্তের খবর তারা জানে না। দৈনন্দিনের অভ্যাসে এসেছিল। নগরের মানুষকে রাজপথের দুধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও কিছুমাত্র সন্দেহ জাগেনি তাদের মনে। তারা জানে, ওদের গন্তব্য রাজপথ থেকে নেমে যাওয়া সড়ক, উপসড়ক। নাগরিকের বাসভূমিতে। ব্যস্ত সড়কে তাদের আহ্বান হারিয়ে যায় যানবাহনের শব্দে। রাজপথে মাথা নিচু করে হাঁটা অভ্যাস তাদের। এদিনের অপেক্ষমান জনতা আরও সঙ্কুচিত করেছে, ওরা জানে এই অভ্যর্থনা ওদের প্রাপ্য নয়।

আনত দৃষ্টি পথের শরীরে নিবদ্ধ ছিল, তাই ফেরিওয়ালাদের চোখে পড়েনি, রথ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। দেহরক্ষীর দল শশব্যস্ত হয়ে ঝাঁপাতে চেয়েছিল এই অনভিপ্রেতদের ওপর। রাজা দূরদর্শী। তাঁর পিতা, পিতামহরা তাঁকে সেই প্রজ্ঞা দিয়েছেন বংশানুক্রমে। সহস্র চোখের সামনে কোনও অবাঞ্ছিতের প্রশ্রয়দান তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি ইঙ্গিতে বিরত করেন প্রহরীদের। ভীত চমকিত ফেরিওয়ালারা রাজার মুখোমুখি। নিজের প্রাসাদের বাগানে কাঠবিড়ালিদের রোজ সকালে বাদামের টুকরো ছুড়ে দেন রাজা। তারা দ্রুতপায়ে এসে মুখে তুলে নেয়, আর চকিতে করে স্থানত্যাগ। এত বছরেও ওদের ভয় দূর করতে ব্যর্থ তিনি। এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়ানো সেই কাঠবিড়ালির দল। অভ্যস্ত স্মিত হাসিতে রাজা জানতে চান তাদের পরিচয়।

—রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের বাসিন্দা আমরা। এই নগরে আসি নিজেদের পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে।
—আমি ওদের দিয়েছি প্রয়োজনীয় যা কিছু। ওদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, ওদের ক্ষুধার উপশম। ওদের উপাসনাস্থল। ওরা সুরক্ষিত আমার ছত্রছায়ায়। আর কী চায় ওরা? তোমাদের ঝুলিতে নতুন কোন সামগ্রী?

ভীরু সঙ্কুচিত ফেরিওয়ালার দল, যাদের দেখে রাজার প্রাসাদের কাঠবিড়ালির কথা মনে পড়ে, জানায়, ওরা এখন ঘুম ফেরি করে। নিজেদের নিয়মেই ওরা জেনে ফেলে, বৈভবের এ নগরে ঘুম বড় চাহিদার বস্তু। এই মানুষগুলি সারাদিন উপার্জন করে, রাত্রি হলে আয়োজন করে বিশ্রামের। তারপর নিত্যনতুন ভয় ওদের চেপে বসে। খননের ভয়, পতনের ভয়। সঙ্গম-ইচ্ছু দম্পতির বিছানা শবাধারের মতো নীরব থাকে সারারাত। আপ্রাণ ঘুমোতে চাওয়া মানুষের কানে আসে অপার্থিব শব্দ। আতঙ্কের প্রহর কাটে, আবার ভোর হয়, ঘুমহীন চোখে আবার যোগ দেয় ওরা উৎপাদনে। উৎকর্ণ কানে অপেক্ষা করে সেই ডাকের, ‘ঘুম চাই ঘুম…’।

***

 

এ চাহিদা রাজার অজ্ঞাত। এ ভাষা তাঁর অশ্রুত। অপরিসীম প্রচেষ্টার পরেও তাঁর ভুরু কুঞ্চিত হয়, প্রহরীরা সচকিত হয়ে ওঠে। কর্তব্য নির্ধারণে তারা পারঙ্গম। কিন্তু বলপ্রয়োগের আগে রাজার ইঙ্গিতের অপেক্ষা করা তাদের স্বভাব।

শুধু কাঠবিড়ালির দল অনুধাবন করে এ-উৎসবভূমি তাদের জন্য নয়। তারা নেমে আসে রাজপথ থেকে। নগর অভিমুখে না গিয়ে গাঁয়ের পথে ফিরতে হয়। এমত গাঁয়েই বাস ওদের। নগর ওদের ঠিকানা জানে না, জানতে নেই, নগর শুধু পণ্য চেনে। দিনের আলোয় ওরা জমিতে থাকত সবাই। এ-বছর দুঃসহ খরা ওদের বাধ্য করেছে নিজেদের জমিটুকু বেচে দিতে। এখন জমিতে মাটি ফুঁড়ে জল বেরোয়, পাইপে ছড়িয়ে পড়ে। এত জল বন্দি ছিল মাটির নিচে! নিজেদের ছিল যতদিন, ততদিন এই জমি স্বাদ পায়নি জলের। ওদের মধ্যে কেউ কেউ মাঠে যায়, নিজেদের জমি, যা আর নিজেদের নেই, ওরা ঘন্টা পিছু নিরেন দিয়ে পায় পান্তা আর পোড়া লঙ্কার ঝাঁঝ। এখন শ্বশুরবাড়িতে পাঠানো মেয়ের গলায় গয়না দ্যাখে, শোনে ও-বাড়িতে মেয়েকে নতুন নাম দিয়েছে ওরা, সে নামেই ডাকে সবাই। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পথ মাড়ায় না, তবে মনে মনে বলে, সুখে থাকিস মা।

এই জমিতে যত্নের জৌলুসে বেড়ে ওঠা সবজির কানেকানেও সে কথা বলে তারা। সারাদিন কাজের শেষে জমা হয় পুঁজি, ভাগ করে নেয় যে যার মতো। সার সার পিঁপড়ের মতো ফিরে যায় নিজেদের ডেরায়। তারপর আল দেওয়া জমির মতো একা পড়ে থাকে খোলা চোখে। ঘুমোতে ভয় পায় ওরা। আর অভিমানে যারা তাকায়নি পেছন দিকে, তারা আর মাটির সাথে কথা বলে না। ওরা রাত শেষে অপেক্ষা করে সকালের, বেরিয়ে পড়ে, ফেরি করে ঘুম। দীর্ঘদিনের খরা প্রথমে শুকিয়েছে ওদের জমি, ওদের শরীর, তারপর ওদের মন। কেমন আছে এই প্রশ্ন ওদের অভিধান থেকে নির্বাসন নিয়েছে বহুদিন।

ঘুম ফেরি করে, যে ঘুমে ছায়া পড়ে সব বিষাদে। অভ্যাস বশে ডাক দেয় ‘ঘুম চাই ঘুম…’।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...