Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তেভাগা থেকে ন্যায্য এমএসপি-র আন্দোলন: কৃষকের শোষণ আজও অব্যাহত

দেবাশিস মিথিয়া

 


“লাঙল যার, জমি তার”— তেভাগা আন্দোলনের এই স্লোগান আজও তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ কৃষকের রক্তে বোনা ফসলের উপর তাঁর আইনি অধিকার এখনও প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার এত বছর পরেও চাষির শোষণ অব্যাহত, শুধু শোষণের হাতিয়ারটাই বদলেছে। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই একসময় তেভাগার মাঠে শুরু হয়েছিল, তা আজও চলমান। যতদিন না চাষির প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন এই সংগ্রাম থামার নয়

 

হেই সামালো ধান হো
কাস্তেটা দাও শান হো
জান কবুল আর মান কবুল
আর দেব না আর দেব না
রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো

ভারতীয় জনগণ যখন স্বাধীনতা আন্দোলনের একেবারে শেষ পর্যায়ে, ঠিক তখনই বাংলার কৃষকদের কণ্ঠে এই গানটি প্রতিরোধের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল। এই গানে ফুটে উঠেছে বাংলার শোষিত কৃষকদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং নিজেদের ‘রক্তে বোনা ধান’-এর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প। জোতদারদের চাপানো ‘আধাভাগী’ প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের এক সাহসী সংগ্রাম।

এই ‘আধাভাগী’ প্রথায় উৎপাদিত ফসলের অর্ধেকই তুলে দিতে হত জোতদারদের হাতে। কৃষকরা তাই দাবি তুলেছিলেন— ‘লাঙল যার, জমি তার’, এবং উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ (তেভাগা) কৃষকের প্রাপ্য, আর এক-তৃতীয়াংশ জোতদারের। ১৯৪৬–৪৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন কৃষকসভার ডাকে এই দাবিতে আন্দোলন বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল, যা ছিল ঔপনিবেশিক ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী কৃষক আন্দোলন। এটাই তেভাগা আন্দোলন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় থেকে বাংলায় যে কৃষি-কাঠামো চালু ছিল, এই কৃষক বিদ্রোহ তার মেরুদণ্ড কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

 

ফিরে দেখা

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেছিলেন, তা বাংলার গ্রামীণ সমাজে ভূমিমালিকানায় এক চরম পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছিল। মুঘল আমল পর্যন্ত বাংলার কৃষকরা ভূমির মালিকানা ভোগ করতেন এবং রাষ্ট্রকে কেবল রাজস্ব বা খাজনা দিতেন। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর কৃষকদের সেই জন্মগত দখলিস্বত্ব চলে যায়। জমিদারদের বংশগত ভূস্বামীতে পরিণত করা হয়, যদিও তাদের কাজ ছিল কেবল রাজস্ব সংগ্রহ করা।

মার্কসের মতে, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকের জমির আইনি অধিকার (যা দখলিস্বত্বের চেয়েও গভীর) সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়। এই ভূমি-ব্যবস্থা জমিদারদের কাজে লাগিয়ে কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।” এই আইনি কাঠামোর অধীনে কৃষকরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবেই শোষিত হননি, বরং তাঁরা কার্যত ভূমিদাসে পরিণত হন। এটি তাঁদের সামাজিক মর্যাদা এবং জমির আইনি সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি কেড়ে নেয়। কৃষকের এই চরম অসহায়তাই ভবিষ্যতের বিদ্রোহের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।

 

নতুন শ্রেণির উদ্ভব

জমিদারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রামীণ অর্থনীতিতে ‘জোতদার’ নামে এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়। জোতদাররা জমিদারদের কাছ থেকে জমি লিজ (ইজারা) নিয়ে কৃষিকাজ তদারকি করতেন। এই প্রচলিত ব্যবস্থাকে ‘আধিয়ারি’ বা বর্গা-প্রথা বলা হত। এই প্রথায় জমির মালিকানা না থাকার কারণে ভাগচাষিরা (বর্গাদার) বীজ ও শ্রম-সহ উৎপাদনের সব খরচ বহন করা সত্ত্বেও উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক জোতদারদের গোলায় তুলে দিতে বাধ্য হতেন।

জমিদারি ও জোতদারি প্রথার এই কৌশল ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণ করার সুযোগ করে দেয়। এই শোষণ ছিল আদিম পুঁজিবাদের সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের মিশ্রণ, যেখানে উৎপাদনের ঝুঁকি সম্পূর্ণভাবে চাষির উপর, কিন্তু লাভের একটি বড় অংশ জোতদারের (মধ্যস্বত্বভোগী) পকেটে যেত। আরও ভয়ঙ্কর হল, যখন উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে কৃষককে অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হল। এর ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হতেন, যা তাঁদের সর্বস্বান্ত করে তোলে। একসময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার ও ক্ষেতমজুরে।

 

আন্দোলনের সূচনা, কারণ ও মূল দাবি

জমিদার ও জোতদারদের লাগামহীন শোষণ কৃষকের মনে এক তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। বিশেষত ১৯৪৩ সালের গভীর মন্দা (যা দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের তীব্র মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্যসংকট পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। ১৯৪০ সালের ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলায় মোট ৭৫ লক্ষ কৃষিজীবী পরিবারের মধ্যে ৩০ লক্ষ পরিবারের জমির ওপর কোনও মালিকানা ছিল না; তাঁরা হয় দিনমজুরের কাজ করতেন, নয়তো বর্গাচাষে নিযুক্ত ছিলেন।

এই গভীর আর্থ-সামাজিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে গঠিত ‘ফ্লাউড কমিশন’ বাংলার ভূমি-ব্যবস্থার সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে কৃষকদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাঁদের উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশই বস্তুত কৃষকদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এই আইনি যুক্তির ওপর নির্ভর করেই বাংলার প্রাদেশিক কৃষকসভার কমিউনিস্ট কর্মীরা ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা করেন, যা ১৯৪৭ সালের মার্চ পর্যন্ত চলেছিল। আন্দোলনের মূল দাবিটিই ছিল ‘তেভাগা’— অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ চাষিকে দিতে হবে এবং জমির মালিক পাবে এক-তৃতীয়াংশ।

এই আন্দোলনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলির মধ্যে ছিল—

 

আন্দোলনে মহিলা ও আদিবাসীদের অংশগ্রহণ: তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব

তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মহিলা ও আদিবাসীদের ব্যাপক, জঙ্গি অংশগ্রহণ। ভূমিহীন ও গরিব কৃষক পরিবারের মহিলারা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন, যা ভারতের নারী-আন্দোলনের ভিত্তি প্রশস্ত করেছিল। তাঁরা ‘নারী বাহিনী’ গঠন করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন এবং পুলিশি দমন মোকাবিলা করতে প্রথম সারিতে চলে আসেন। কৃষক রমণীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ শুধু অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের কারণে নয়, বরং জমিদার ও জোতদারদের হাতে যৌন নির্যাতন, নির্বিচারে হয়রানি এবং ধর্ষণের শিকার হওয়ার মতো লিঙ্গভিত্তিক বঞ্চনার বিরুদ্ধেও তাঁরা সক্রিয়ভাবে রুখে দাঁড়ান। তেভাগা আন্দোলন শ্রেণি-শোষণের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিবাদের পাশাপাশি লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল।

আদিবাসী গোষ্ঠী— যেমন জলপাইগুড়ির ওঁরাও ভাগচাষিরা এবং দিনাজপুরে ভুজু টুডুর নেতৃত্বে সাঁওতালদের ‘ধনুক বাহিনী’ এই সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। অর্থনৈতিক দাবির ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমান কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে এই আন্দোলন একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিল, যা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেয়।

আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে স্থানীয় জোতদাররা পুলিশের সহায়তায় কৃষকদের উপর কঠোর দমন-পীড়ন চালায়। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে বহু কৃষক গ্রেপ্তার হন। যদিও আন্দোলনের দাবি তাৎক্ষণিকভাবে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, তবে এটি ভূমি-সংস্কারের দাবিকে রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে এবং ভবিষ্যৎ কৃষক আন্দোলনগুলির জন্য এক শক্তিশালী রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়।

তেভাগা আন্দোলন যদিও স্বল্পকালীন ছিল, তবু সেই আন্দোলন তীব্র দমন-পীড়নের মুখে পড়েছিল। তবে ভারতীয় কৃষিতে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী ও মৌলিক। তেভাগা আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল বর্গাদারদের জমির উপর আইনি দখলিস্বত্ব ও ন্যায্য ভাগ নিশ্চিত করা। এই আন্দোলন পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের ‘অপারেশন বর্গা’-কে অনুপ্রাণিত করে। এই কর্মসূচি ভারতের অন্যতম সফল ভূমি-সংস্কার উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃত, যা প্রান্তিক কৃষকদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দিয়েছিল এবং গ্রামীণ মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে চাষিদের জন্য একপ্রকার ‘নিরাপত্তা জাল’ তৈরি করেছিল।

 

ভূমিদাস থেকে ঋণদাসে রূপান্তর

তবে তেভাগা আন্দোলন থেকে বর্তমান কৃষক-সংকট— এই যাত্রাপথে শোষণের প্রকৃতি শুধু পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু তার মৌলিক লক্ষ্য একই রয়ে গেছে— কৃষকের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মূল্যকে করায়ত্ত করা। আর এই লক্ষ্য এক থাকার ফলেই অতীতের সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ও আধুনিক পুঁজিবাদী শোষণের মধ্যে মূলত কোনও তফাৎ নেই।

আধুনিক পুঁজিবাদী মডেলে কৃষক পরিণত হয়েছে ঋণদাস বা চুক্তিদাসে। কারণ, জমির নামমাত্র মালিকানা থাকলেও কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত পুঁজির বাজারের কাছে সে আজ সম্পূর্ণ অসহায়। চাষের উপকরণ— বীজ, সার, কীটনাশকের জন্য কর্পোরেট কোম্পানি ও ব্যাঙ্কের উপর তার নির্ভরশীলতা তাকে ঋণের এক নতুন ফাঁসে আবদ্ধ করেছে।

১৯৯১ সালে উদারীকরণ নীতি গৃহীত হওয়ার পর (যা আইএমএফ ঋণের শর্তসাপেক্ষে প্রয়োগিত হয়েছিল), রাষ্ট্র ধীরে ধীরে কৃষিখাত থেকে তার সহায়তা গুটিয়ে নিতে শুরু করে। দরিদ্র কৃষকদের জন্য ভর্তুকি কমানো হয়, অথচ কর্পোরেট কোম্পানিগুলির জন্য “প্রণোদনা” (ইনসেনটিভ) আরও বাড়ানো হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার এই পরিবর্তন কর্পোরেট পুঁজিকে কৃষিবাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেয়।

 

শোষণের পদ্ধতিগত তুলনা

এই মৌলিক শোষণের বিরুদ্ধেই বিংশ শতকের তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭) এবং একবিংশ শতকের কৃষক আন্দোলনের (২০২০-২১) মধ্যে কেবল সময়ের ব্যবধান। উভয় আন্দোলনের মূল লক্ষ্য একই— উৎপাদিত পণ্যের ওপর উৎপাদকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা।

তেভাগা আন্দোলনের সময় জমিদার, জোতদার ও মহাজনরা (আধা-সামন্ততান্ত্রিক শোষক) ফসলের ভাগ (আধিয়ারি) ও বেআইনি সেসের মাধ্যমে কৃষককে শোষণ করত। তাঁদের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রধান দাবি ছিল উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ কৃষকের জন্য নিশ্চিত করা। পক্ষান্তরে, আধুনিক সময়ে শোষকের ভূমিকায় এসেছে কর্পোরেট কৃষি-ব্যবসায়ী ও লগ্নি পুঁজি (ফিনান্স ক্যাপিটাল), যাদেরকে নব-উদারবাদী শোষক বলা যায়। এই কর্পোরেট শক্তিগুলি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করে। পাশাপাশি, বীজ, সার ও কীটনাশকের মতো কৃষি-উপকরণের উচ্চমূল্যের ফাঁদে ফেলে কৃষকদের ঋণ ও ক্ষতির জালে আবদ্ধ করে। তাই, এই আধুনিক শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের বর্তমান সংগ্রামের মূল দাবি হল স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নির্ধারণ এবং তার আইনি নিশ্চয়তা। এই দাবি বাস্তবায়িত হলে কৃষকরা বাজারের ঝুঁকি সত্ত্বেও তাঁদের উৎপাদন ব্যয় ও ন্যায্য লাভ নিশ্চিত করতে পারবেন, যা জীবিকা সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সরকার ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নির্ধারণ করে ঠিকই, কিন্তু তা স্বামীনাথন নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কমিশন অন ফার্মার্স-এর সুপারিশের তুলনায় কম। সেই কমিশনের মতে, এমএসপি নির্ধারণ করতে হবে কৃষকের মোট উৎপাদন খরচের (C2) ওপর অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি হারে। এই C2 খরচের মধ্যে কৃষকের সমস্ত আর্থিক ব্যয়, পারিবারিক শ্রমের মূল্য, এবং নিজস্ব জমি ও মূলধনের অনুমিত ভাড়া ও সুদ অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি হিসাবে এই অনুমিত ভাড়া ও সুদ ধরা হয় না।

জমিদারি বা জোতদারি মডেলে কৃষক ছিলেন ভূমিদাস বা আধিয়ার, আর কর্পোরেট মডেলে তিনি পরিণত হয়েছেন ঋণদাস বা চুক্তিদাসে। পূর্বে জোতদার শুধু জমি দিত, আর কৃষক সরবরাহ করতেন সমস্ত কৃষি-উপকরণ; বর্তমানেও কৃষি-উপকরণ কৃষককেই কিনতে হয়, তবে কর্পোরেট শক্তিগুলি এখন সেই উপকরণের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে, অত্যাবশ্যক এই উপাদানগুলি কৃষকদের উচ্চমূল্যে কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে এবং তাঁরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন।

এই দুটি মডেলের (জমিদারি ও কর্পোরেট) মূল মিল হল— উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদিত পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে মালিক বা কর্পোরেটের হাতে। শোষণের ধরনে পরিবর্তন এসেছে: অতীতের প্রত্যক্ষ শারীরিক নির্যাতন আজ আইনি হয়রানি, আর্থিক বিপর্যয় ও মনস্তাত্ত্বিক চাপে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে উভয় পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো শোষকশ্রেণির রক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। সার্বিকভাবে, শোষণের ক্ষেত্র (খোলা মাঠ থেকে বাজারে) ও হাতিয়ার বদলালেও, উৎপাদিত পণ্যের ওপর উৎপাদকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মৌলিক সংগ্রামটি একই রয়ে গেছে।

 

চুক্তিচাষ: কর্পোরেট শোষণের নতুন প্ল্যাটফর্ম

কৃষি সংস্কার আইন, বিশেষত চুক্তিচাষ সংক্রান্ত আইনগুলি, পুঁজি ও প্রযুক্তি বিনিয়োগের সুবিধা দিলেও বাস্তবে এর সমস্ত ঝুঁকি কৃষকের উপরেই স্থানান্তরিত হয়েছে। চুক্তিচাষে যুক্ত ক্ষুদ্র কৃষকরা প্রায়শই বাজারের ব্যর্থতা ও উৎপাদন-ঝুঁকির মুখে পড়েন।

তবে চুক্তি চাষের মূল সমস্যা হল কর্পোরেট কোম্পানিগুলির তথ্যের অপ্রতুলতা ও অস্বচ্ছতা। কৃষকদের অভিযোগ, ফসলের পরিমাণ, গুণগত মান নির্ধারণ কিংবা কোটা স্থির করার সময় কোম্পানিগুলি নিজেদের সুবিধামতো সিদ্ধান্ত নেয়। এই অস্বচ্ছ ও সুযোগসন্ধানী মনোভাব কৃষকদের মধ্যে গভীর অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।

আইনগত লড়াইয়ে একজন ক্ষুদ্র চাষি কখনওই কর্পোরেট কোম্পানির বিরুদ্ধে সমানভাবে লড়তে পারেন না। যেমন দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে, যখন পেপসিকো কোম্পানি গুজরাতের কয়েকজন কৃষকের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করেছিল। এই ঘটনাই প্রমাণ করে যে আধুনিক শোষণে আইন এখন এক শক্তিশালী অস্ত্র, যা পুঁজির পক্ষে থেকে কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া কিংবা তাঁকে আর্থিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করে।

সার্বিকভাবে, শোষণের প্রক্রিয়া জোতদারের “তদারকি” (সরাসরি হস্তক্ষেপ) থেকে পুঁজির “তদারকি” (প্রযুক্তিগত ও আইনি নিয়ন্ত্রণ)-তে রূপান্তরিত হয়েছে।

 

আধুনিক কৃষি সংকট এবং চাষির বর্তমান অসহায়তা

ভারতের বর্তমান কৃষি সংকটের মূলে রয়েছে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে কৃষকের ধারাবাহিক ব্যর্থতা। সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করলেও, এটি কেবল ধান, গম, আখ ও তুলার মতো কয়েকটি ফসলে এবং নির্দিষ্ট কিছু রাজ্যে আংশিকভাবে কার্যকর। বাধ্যতামূলক সংগ্রহ (প্রোকিউরমেন্ট) না থাকায় চলতি এমএসপি ব্যবস্থা চাষিকে নিরাপত্তা দিতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি গবেষণা অনুযায়ী, এমএসপি বৃদ্ধি করা হলেও কৃষকরা খুব কমই তাতে লাভবান হন। কারণ, খোলাবাজারে ব্যবসায়ীরা প্রায়শই এমএসপি-র চেয়ে কম দামে চাষির কাছ থেকে ফসল কেনেন।

এমএসপি ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং কৃষি উপাদানের (বীজ, সার) দামের উপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ কৃষকদের ঋণের বোঝা বহুগুণ বাড়িয়েছে। কৃষি থেকে পর্যাপ্ত আয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় কৃষিকাজ আর জীবিকার একমাত্র উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। ফলে কৃষকরা ক্রমশ অন্যান্য কাজে (কৃষিবহির্ভূত কাজ) ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছেন। যেহেতু কৃষক এখন প্রযুক্তি ও পুঁজির বাজারের উপর নির্ভরশীল, বাজার ব্যর্থ হলে বা ফসল খারাপ হলে ঋণের বোঝা সামলাতে না পেরে তাঁরা চূড়ান্ত অসহায়তায় নিমজ্জিত হন।

 

কৃষক আত্মহত্যার ভয়াবহ পরিসংখ্যান

আধুনিক কর্পোরেট শোষণের চূড়ান্ত ও ভয়াবহ পরিণতি হল কৃষক আত্মহত্যা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে মোট ১১,২৪০ জন কৃষক ও কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৫,৪২০ জন ছিলেন কৃষক এবং ৫,৮২০ জন ছিলেন কৃষিশ্রমিক। আত্মহত্যার এই প্রবণতা এখন এক জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে।

যদিও অঞ্চলভেদে এই সংখ্যার তারতম্য রয়েছে। যেমন, মহারাষ্ট্রে এই হার সর্বাধিক— যেখানে ভারতের মোট কৃষক আত্মহত্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩২.৫ শতাংশ) ঘটে। এর প্রধান কারণ হিসেবে কৃষিঋণ, বাজারের ব্যর্থতা এবং মূল্য নিশ্চয়তার অভাবকে উল্লেখ করা হয়।

অতীতে শোষণের চরম পরিণতি ছিল অনাহার ও দাসত্ব; বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজির চরম শোষণের পরিণতি হল ঋণ ও বাজার ব্যর্থতার ফলে জন্ম নেওয়া চরম হতাশা ও আত্মহত্যা। যে কীটনাশক ব্যবহার করে চাষিরা আত্মহত্যা করছেন, সেই কীটনাশক কিনতে গিয়েই তাঁরা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতীকীভাবে বলা যায়, শোষণের উপকরণই এখন মৃত্যুর উপাদানে পরিণত হয়েছে।

 

তেভাগা আন্দোলনের উত্তরাধিকার

তেভাগা আন্দোলন ভূমিহীন কৃষকদের দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম হিসেবে আজও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। এই আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক বৈষম্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত শোষিত মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ শ্রেণিসংগ্রামকে উসকে দিতে সক্ষম। সমাজবিজ্ঞানীরা এই আন্দোলনকে ‘শ্রেণিচেতনার আদর্শে উদ্বুদ্ধ’ এবং ভারতীয় ইতিহাসে ‘রাজনৈতিকভাবে সচেতন কৃষকের প্রথম বিদ্রোহ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

তেভাগা আন্দোলনের চেতনা স্বাধীন ভারতেও বারবার নানারূপে প্রতিফলিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কৃষক আন্দোলনগুলি— বিশেষত ২০২০-২১ সালের কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলন— প্রমাণ করেছে যে শোষণের কাঠামোগত প্রকৃতি পরিবর্তিত হলেও, কৃষকদের মৌলিক দাবি অপরিবর্তিত থেকেছে: উৎপাদিত পণ্যের ওপর উৎপাদকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অতীতে দাবি ছিল শস্যের ন্যায্য ভাগ (দুই-তৃতীয়াংশ), অর্থাৎ জোতদারের গোলায় তোলা ফসলের ওপর ভাগচাষির অধিকার; আর বর্তমানে দাবি হল ফসলের ন্যায্য মূল্য (এমএসপি-এর আইনি গ্যারান্টি), যা কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাজারে কৃষকের উৎপাদনের ন্যূনতম সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। আধুনিক কৃষক আন্দোলনগুলি কেবল অর্থনৈতিক দাবি নয়, বরং কৃষকের মর্যাদা ও জীবনধারণের অধিকারের এক ধারাবাহিক সংগ্রাম। আধুনিক কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসন জমিদারি শোষণেরই এক নতুন রূপ— যেখানে সরাসরি বলপ্রয়োগের বদলে আইনি জটিলতা, ঋণের ফাঁস ও বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃষকের উদ্বৃত্ত মূল্য শোষিত হয়। কৃষকদের ক্রমবর্ধমান অসহায়তা ও আত্মহত্যার ভয়াবহ পরিসংখ্যান এই কাঠামোগত শোষণের চূড়ান্ত পরিণতি নির্দেশ করে। তবে যেসব অঞ্চলে ভূমিসংস্কার সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, সেখানে কৃষকদের সংকট তুলনায় অনেক কম।

 

যা করণীয়

কৃষকের জীবন ও জীবিকার অধিকার নিশ্চিত না করে কেবল পুঁজি ও প্রযুক্তি বিনিয়োগের মাধ্যমে কৃষিসংকট সমাধান করা সম্ভব নয়। তেভাগা আন্দোলনের উত্তরাধিকার আসলে কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্যের ওপর সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার সংগ্রাম— যা আজও ভারতের কৃষিনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য আদর্শ হিসেবে প্রাসঙ্গিক। বর্তমান কাঠামোগত শোষণ রোধ করতে এবং চলমান কৃষিসংকট নিরসনের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত নীতিগত পদক্ষেপগুলি জরুরি:

এমএসপি-র আইনি গ্যারান্টি: কৃষকদের ফসলের মূল্য নিয়ে বাজারের কারসাজি বন্ধ করতে এবং উৎপাদন খরচ অনুযায়ী ন্যূনতম মুনাফা নিশ্চিত করতে এমএসপি-র আইনি স্বীকৃতি জরুরি।

ভূমি সংস্কারের সম্প্রসারণ: অপারেশন বর্গা মডেলটি দেশের সব রাজ্যে কার্যকর করা উচিত। বিশেষত বর্গাদার বা ভাগচাষিদের দখলিস্বত্ব আইনিভাবে নিশ্চিত করে কৃষকদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দেওয়া আবশ্যক।

চুক্তিচাষে নিয়ন্ত্রণ: চুক্তিচাষ-সংক্রান্ত আইনগুলিতে স্বচ্ছতা, ঝুঁকি বণ্টন এবং কার্যকর সালিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে হবে, যাতে কর্পোরেটদের একচেটিয়া ক্ষমতা ও আইনি হয়রানি রোধ করা যায়।

“লাঙল যার, জমি তার”— তেভাগা আন্দোলনের এই স্লোগান আজও তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ কৃষকের রক্তে বোনা ফসলের উপর তাঁর আইনি অধিকার এখনও প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার এত বছর পরেও চাষির শোষণ অব্যাহত, শুধু শোষণের হাতিয়ারটাই বদলেছে। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই একসময় তেভাগার মাঠে শুরু হয়েছিল, তা আজও চলমান। যতদিন না চাষির প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন এই সংগ্রাম থামার নয়।