দিলীপ ঘোষ ও মেরিন মুখোপাধ্যায়
ভারতের জন্য এ বছরটি গর্বের— এবারই প্রথম ভারত প্রথম সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২৫-এ ১০০টি অগ্রগণ্য দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে। ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৯৯তম। গত বছর অবস্থান ছিল ১০৯তম, আর ২০২৩ সালে ছিল ১১২তম। অর্থাৎ তিন বছরে ভারতের অবস্থান স্পষ্টভাবে উন্নত হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে— এই উন্নয়নের সুফল কি সবার জীবনে সমানভাবে পৌঁছেছে? বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর অর্ধেক আকাশ (শিশু ও নারীরা) এই উন্নতির কতটা স্বাদ পেয়েছেন? এই নিবন্ধে আমরা খুঁজে দেখব সেই দিকটাই
২৪ জুন ২০২৫— প্রতি বছরের মতো এবারও প্রকাশিত হল সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২৫। প্রতি বছরের মতো এবারও এসডিজি ট্র্যান্সফর্মেশন সেন্টার এবং ডাবলিন ইউনিভার্সিটি প্রেস বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যে অগ্রগতির হিসেব তুলে ধরেছে এই প্রতিবেদনে।[1]
ভারতের জন্য এ বছরটি গর্বের— এবারই প্রথম ভারত প্রথম ১০০টি অগ্রগণ্য দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে। প্রতিবেদনে অংশগ্রহণকারী ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৯৯তম। গত বছর (২০২৪) অবস্থান ছিল ১০৯তম, আর ২০২৩ সালে ছিল ১১২তম (১৬৬টি অংশগ্রহণকারী দেশের মধ্যে)। অর্থাৎ তিন বছরে ভারতের অবস্থান স্পষ্টভাবে উন্নত হয়েছে— যা স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যে অগ্রগতিরই ইঙ্গিত দেয়।
তবে এখানেই প্রশ্ন ওঠে— এই উন্নয়নের সুফল কি সবার জীবনে সমানভাবে পৌঁছেছে? বিশেষ করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর অর্ধেক আকাশ (শিশু ও নারীরা) এই উন্নতির কতটা স্বাদ পেয়েছেন? এই নিবন্ধে আমরা খুঁজে দেখব সেই দিকটাই।
খেয়াল রাখতে হবে নারী-পুরুষের সাম্যের জন্য একটি বিশেষ বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি ৫) থাকলেও, শিশুদের জন্য আলাদা তেমন কোনও লক্ষ্য নেই। তাই শিশুদের উন্নয়নের চিত্র দেখতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে এসডিজি ১ থেকে ৫ পর্যন্ত— দারিদ্র্য দূরীকরণ, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য, মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং লিঙ্গসমতার দিকে।
সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক, এই পাঁচটি এসডিজি[2]-র মূল লক্ষ্য কী।
সারণি ১: পাঁচটি এসডিজি লক্ষ্যের মূল ভাবনা, প্রধান দিক ও বর্তমান চ্যালেঞ্জ
২০২০ সালে, ভারতের সংসদের একক বা নিম্নকক্ষে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ২৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১৫ সালের ২২ শতাংশ থেকে কিছুটা বেড়েছে। ১৩৩-টি দেশ ও এলাকার তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদে নারীদের এখন আরও ভালো প্রবেশাধিকার রয়েছে, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থায় ৩৬ শতাংশ নির্বাচিত আসন রয়েছে।[3] অন্যদিকে আবার অন্তত ২০ কোটি মেয়ে এবং মহিলা ‘নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতি এবং ছেদন’-এর মতো ক্ষতিকারক প্রথার শিকার হয়েছে।
এরপর এক-একটি এসডিজি-র ভিতরে ঢুকে অন্বেষণ চালানোর আগে আমরা দেখে নেব, জাতিসংঘের এই বাৎসরিক প্রতিবেদনে, গত পাঁচ বছরে এই পাঁচটি লক্ষ্যমাত্রায় ভারতের সার্বিক অবস্থা কেমন ছিল। তার জন্য কোনও সূচকভিত্তিক ধারণার মধ্যে না গিয়ে আমরা সার্বিক অবস্থান (স্ট্যাটাস) বুঝব একেকটি এসডিজি-র রঙের মাধ্যমে, আর তার অভিমুখ (ট্রেন্ড) বুঝব তার সার্বিক দিকচিহ্নের মাধ্যমে। সারণি ২ দ্রষ্টব্য।
সারণি ২: ভারতে পাঁচটি এসডিজি-র সামগ্রিক অবস্থা (২০২১ থেকে ২০২৫)[4]
ওপরের সারণি ২ থেকে এটা স্পষ্ট যে পাঁচটির মধ্যে অন্তত তিনটি উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি ২, ৩ আর ৫-এ), দেশ ধারাবাহিকভাবে গত পাঁচ বছর ধরে বেশ সংকটজনক অবস্থায় (স্ট্যাটাসে) আছে। আর দুটিতে (এসডিজি ১ এবং ৪-এ) গুরুতর না হলেও চ্যালেঞ্জ আছে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর। এর মধ্যে এসডিজি ২ অর্থ্যাৎ ক্ষুধানিবারণে অগ্রগতির অভিমুখও (ট্রেন্ড) গত পাঁচ বছর ধরে একেবারে থেমে আছে। এসডিজি ৩, ৪, ৫-এ অগ্রগতি খুবই ধীর (গত তিন বছরে); শুধুমাত্র দারিদ্র্য দূরীকরণের ১-নম্বর এসডিজি-তে শেষ তিন বছরে উন্নতির অভিমুখ অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে সন্তোষজনক।
বোঝাই যাচ্ছে যে দেশের নারী, শিশু উন্নয়নের লক্ষ্যে এগোনোর, অবস্থা বা অভিমুখ মোটেই সার্বিকভাবে সন্তোষজনক নয়।
এ তো গেল রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের ছবি। দেশের অভ্যন্তরেও বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীল উন্নয়নের মাপকাঠিগুলোতে দেশের আর রাজ্যগুলির অবস্থা নিয়মিত মেপে থাকে দুটি সংস্থা— একটি জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি সংস্থার (UNDP) সঙ্গে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের পরিবর্তিত সংস্থা নীতি আয়োগ;[5] আরেকটি বাৎসরিক প্রতিবেদন নিয়মিত বের করছেন ভারত সরকারের স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেনশ্ন মন্ত্রক।[6]
এর মধ্যে নীতি আয়োগের প্রতিবেদনটিতে আগে আসব। এই প্রতিবেদনে ১৭টি স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অনুযায়ী একটি সমন্বিত সূচক (overall index) তৈরি করা হয়, যেখানে দেশ এবং প্রতিটি রাজ্যের অগ্রগতিকে ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। প্রতিটি এসডিজি (SDG)-র জন্যও আলাদা আলাদা একেকটি সমন্বিত সূচক (index for that particular SDG) তৈরি হয়, যাতে দেখা যায় কোনও রাজ্য বা দেশ কতদূর এগিয়েছে (আবারও ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে)।
এই ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে মাপা অগ্রগতিকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়—
- ০ থেকে ৪৯: অভিলাষী (Aspirant)
- ৫০ থেকে ৬৪: সক্রিয় (Performer)
- ৬৫ থেকে ৯৯: অগ্রণী (Forerunner)
- ১০০-য় ১০০: সফল (Achiever)
এই এসডিজি-ভিত্তিক সমন্বিত সূচকের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশ ও রাজ্যগুলি সামগ্রিকভাবে উন্নতি করলেও, এসডিজি–১ (দারিদ্র্য দূরীকরণ)-এ অনেক রাজ্যই এখনও মাত্র “সক্রিয়” পর্যায়ে, অর্থাৎ ১০০-র মধ্যে ৬৪-এর কম নম্বর পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গও তাদের মধ্যে একটি।
এরপর এসডিজি–২ (ক্ষুধা নিরসন)[7]-এ নীতি আয়োগের প্রতিবেদনের চিত্রটি আরও উদ্বেগজনক। সর্বশেষ প্রতিবেদনে গোটা দেশের এই দুই নম্বর এসডিজি-র সমন্বিত সূচকে প্রাপ্ত নম্বর ৫২ (১০০-র মধ্যে)। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্যের অর্জিত নম্বর ৬৪-র নিচে, এমনকি কিছু রাজ্যে তা ৪৯-এরও নিচে। এই সূচকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল শিশু অপুষ্টি। দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে খর্বকায় (stunted) শিশুর হার কমছে খুব ধীরে— ২০১৮ সালে তা ছিল ৩৮.৪ শতাংশ, ২০২৩-২৪-এও নেমে মাত্র ৩৫.৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে তো উল্টে বেড়েছে— ২০১৮-তে ছিল ৩২.৫ শতাংশ, ২০২৩-২৪-এ দাঁড়িয়েছে ৩৩.৮ শতাংশ। দেশে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার হারও বেড়েছে। ২০১৮ সালে তা ছিল ৫০.৩ শতাংশ, ২০২৩-২৪-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২.২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৮-তে এই হার ছিল ৫৩.৬ শতাংশ, আর ২০২৩-২৪-এ তা বেড়ে ৬২.৩ শতাংশে পৌঁছেছে— যা জাতীয় গড়ের চেয়েও খারাপ।
এসডিজি-৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ)-এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হল পরিবারের মাসিক ব্যয়ের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে খরচের অনুপাত।[8] ২০২৩-২৪ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে এই হার ১৬.৯ শতাংশ, যা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কেরালা ও অরুণাচল প্রদেশ যৌথভাবে শীর্ষে (১৭ শতাংশ)।
এসডিজি–৪ (গুণগত শিক্ষা)-এর চিত্রও আশাব্যঞ্জক নয়। অন্তত ছয়টি রাজ্যে[9] এই এসডিজি-র সমন্বিত সূচকের মান ১০০-র মধ্যে ৫০-এর নিচে। পশ্চিমবঙ্গের এই এসডিজি-তে স্কোর ৬০— অর্থাৎ এখানেও ৬৪-র নিচে। দেশের সামগ্রিক স্কোরও ৬৪-র নিচে।
এসডিজি–৫ (লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন)-এর অবস্থাও উদ্বেগজনক। ২০১৮ সালে জন্মের সময় নারী-পুরুষ অনুপাত ছিল ৮৯৮, যা ২০২৩-২৪-এ কিছুটা বেড়ে ৯২৯ হয়েছে। তবুও প্রতি ১০০০ পুত্রসন্তানে ৭১ জন কন্যা কম। মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও স্পষ্ট— ২০২৩-২৪ সালে দেশের গড় হিসেবে একজন মহিলা একজন পুরুষের মজুরির মাত্র ০.৭৬ অংশ পান। পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাত আরও কম, মাত্র ০.৬৫। ফলত, এই এসডিজিতে দেশের ১২টি রাজ্য (পশ্চিমবঙ্গ-সহ) ও ২টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সূচক মান ৫০-এর নিচে। সার্বিকভাবে গোটা দেশেরই নারীর ক্ষমতায়নের সূচকে ১০০-র মধ্যে স্কোর ৫০-এর নিচে। এছাড়া নারী-পুরুষের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের অনুপাতও অত্যন্ত কম— মাত্র ৪৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন পুরুষশ্রমিকের বিপরীতে কেবল ৪৮ জন মহিলা শ্রমবাজারে যুক্ত।
সারসংক্ষেপে, ২০২৪ সালের নীতি আয়োগের এসডিজি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে— ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি করলেও, ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও লিঙ্গসমতায় এখনও অনেকটা পথ হাঁটা বাকি।
এর পরে আমরা দেখে নেব ভারত সরকারের স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেনশ্ন মন্ত্রক যে বাৎসরিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে, সেটি। এই প্রতিবেদনটি রাজ্যভিত্তিক অবস্থান দেয় না; শুধু দেশের সার্বিক অবস্থাটি একেকটি এসডিজি ধরে, আর তার নিচে টার্গেটগুলি ধরে, একে একে সেই টার্গেটভিত্তিক সূচকের[10] মানগুলি দেয়। এই প্রতিবেদনের সর্বশেষ ২০২৫-এর প্রকাশনাটি থেকে আমরা যা পাচ্ছি, সেগুলো এরকম—
এসডিজি-২ (ক্ষুধা নিরসন)-এ ২০১৫-১৬ থেকে ২০২৪-২৫-এ আরও বেশি বেশি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তার আওতায় এলেও, এখনও ৩২.১০ শতাংশ পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের বয়স অনুপাতে ওজন কমই রয়ে যাচ্ছে। আর তার ওপরে নতুন শঙ্কা বয়স অনুপাতে অতি-পুষ্টির ফলে বেশি ওজনের মেদবহুল শিশুর সংখ্যা দেশে বাড়ছে— ২০১৫-১৬-তে ২.১ শতাংশ থেকে ২০১৯-২১-এ ৩.৪ শতাংশ। গর্ভবতী হন বা না হন, দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতা বাড়ছে। এমনকি ৬ থেকে ৫৯ মাসের শিশুদের মধ্যেও উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে রক্তাল্পতা।[11]
এসডিজি–৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ)-এ দেখা যাচ্ছে, ভারতে সংক্রামক, মাতৃত্বজনিত, নবজাতক ও পুষ্টিজনিত রোগের (CMNND)[12] প্রকোপ অল্পবিস্তর কমে এলেও, গত কয়েক বছরে উদ্বেগজনকভাবে প্রায় সমস্ত বয়সের জনসংখ্যার মধ্যে— বিশেষ করে কমবয়সীদের মধ্যে— বাড়ছে হৃদরোগ ও হৃদয়জনিত সমস্যা, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও ক্রনিক শ্বাসতন্ত্রের রোগের মতো নানা অসংক্রামক রোগ[13] (সারণি ৩)।
সারণি ৩: ভারতে অসংক্রামক রোগবৃদ্ধি এবং তার ফলে মৃত্যু (সবরকম মৃত্যুর শতাংশ হিসেবে। ২০১৫ থেকে ২০২০। এসডিজি সূচক ৩.৪.১)
এছাড়াও, দেশে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে বয়ঃসন্ধিকালীন (১৫-১৯ বছরে) মাতৃত্বের হার। ২০১৫-তে যা ছিল ১১.১ শতাংশ, ২০১৭-তে সেটা উঠে যায় ১৩ শতাংশে; ২০২১-এ আবার এসে দাঁড়ায় ১১.৩ শতাংশে।
এসডিজি–৪ (গুণগত শিক্ষা), যা কিনা সঠিক মানের শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রার এসডিজি, সেখানে একেবারে শুরুতেই ২০১৭ আর ২০২১-এর মধ্যে একটা তুলনায় দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় শ্রেণিতে পাঠরত মাত্র ৪৮.৩ শতাংশ ছাত্র বা ছাত্রী ভাষাশিক্ষায় দেশের নির্ধারিত মান অনুযায়ী ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করেছে। সেটিই ২০২১-এ নেমে আসে ৩৯ শতাংশে। অঙ্কশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশে ৫৩.৯ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র/ছাত্রী এই ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করেছিল ২০১৭-তে। সেটি ২০২১-এ আরও নেমে যায় ৪৩ শতাংশে। পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণির জন্যেও এই ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনকারী ছাত্র/ছাত্রীর শতাংশ কমেছে। নিচের সারণি ৪ দ্রষ্টব্য।
সারণি ৪: তৃতীয়, পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণির কত শতাংশ ছাত্র/ছাত্রী জাতীয়স্তরে নির্ধারিত মানে ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করেছে (এসডিজি সূচক ৪.১.১)
ওপরের সারণি থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চোখে পড়ে— একই বছরে শ্রেণি যত উপরের দিকে গেছে, অর্থাৎ ক্লাস যত বড় হয়েছে, ততই ভাষা ও অঙ্ক— দুই বিষয়েই দক্ষ শিক্ষার্থীর শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ, ছোট ক্লাসে যতজন ছাত্রছাত্রী ভাষা ও অঙ্কে দক্ষ, বড় ক্লাসে সেই সংখ্যাটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
আরও একটি দিক থেকে দেখা যায়, দুটি বছরের মধ্যে তুলনায় (২০১৭ ও ২০২১), সব শ্রেণিতেই অঙ্কের দক্ষতা কমেছে ভাষার তুলনায় বেশি। অর্থাৎ, অঙ্কে দুর্বল হয়ে পড়ছে আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী।
এছাড়া আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল— ২০১৫-১৬ থেকে ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে প্রাথমিক, উচ্চ-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নির্দিষ্ট বয়সের শিক্ষার্থীদের নিট ভর্তির হার (Net Enrolment Ratio) ধীরে ধীরে কমে গেছে। এর মানে, প্রাথমিক স্তরে যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের সবাই উচ্চ-প্রাথমিক অবধি পৌঁছচ্ছে না; উচ্চ-প্রাথমিকের সবাই মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না।[14] সারণি ৫ দ্রষ্টব্য।
সারণি ৫: প্রাথমিক, উচ্চ-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির হার
এই আশঙ্কা আরও স্পষ্ট হয়, যখন আমরা পরের সারণিটি দেখছি (সারণি ৬)। সেখানে দেখা যাচ্ছে— প্রাথমিক স্তর শেষ করেছে যেসব ছাত্রছাত্রী, তাদের মধ্যে সেই বছর প্রাথমিকের শেষ শ্রেণিতে যতজন থাকা উচিত ছিল, তাদের ৮৫.৪ শতাংশ মাত্র উপস্থিত ছিল। অর্থাৎ, পুরো প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের প্রায় ১৫ শতাংশ ঠিকমতো শেষ ক্লাসে পৌঁছায়নি। আর মাধ্যমিক স্তরে পরিস্থিতি আরও খারাপ— যতজন ছাত্রছাত্রী সেই বছর মাধ্যমিকের শেষ শ্রেণিতে থাকা উচিত ছিল, তার মাত্র ৬৩.৮ শতাংশ পৌঁছেছে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মাধ্যমিক শেষ করতে পারছে না। এই হিসেবটি শুধুমাত্র ২০২৩-২৪ সালের। কিন্তু সারণিটি ২০১৭-১৮ থেকেই দেওয়া হল।
সারণি ৬: প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া কত শতাংশ ছাত্র/ছাত্রী, প্রাথমিক, উচ্চ-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে
সবশেষে আমরা দেখব লিঙ্গসমতার এসডিজি-৫টিকে। মন্ত্রকের ওই একই ২০২৫-এর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মহিলাদের ওপর পণজনিত অত্যাচারের ঘটনা বেড়েছে। ২০১৫ সালে প্রতি লক্ষ মহিলার ওপর এ-ধরনের ঘটনা ছিল ২.৯০, আর ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ৩.১০।[15] মহিলাদের ওপর সাধারণ অপরাধও বেড়েছে— ২০১৫ সালে প্রতি লক্ষ মহিলার ওপর এ-জাতীয় ঘটনা ছিল ৫৪.২৩টি, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬.৩৮টি।[16] শিশুদের ওপর অপরাধের ক্ষেত্রেও খারাপ চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কন্যাশিশুদের ওপর যৌন অপরাধের অনুপাত বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে শিশুদের ওপর হওয়া মোট অপরাধের ৩৪.৮৩ শতাংশ ছিল কন্যাশিশুদের ওপর যৌন অপরাধ, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯.২২ শতাংশ।[17]
আমাদের রাজ্যে নারী-শিশুদের এসডিজি-র লক্ষ্যমাত্রাগুলিতে পৌঁছতে কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে কথা বলার আগে, আমরা একবার দেখে নেব, নারী-শিশু উন্নয়নের কয়েকটা প্রচলিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে দেশের এবং রাজ্যের অবস্থাটা কীরকম; পাশাপাশি ভারতের দুটি রাজ্য কেরালা আর তামিলনাডু আর দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ মালদ্বীপ আর শ্রীলঙ্কায় ওই একই সূচকগুলি কীরকম।
রেখচিত্র ১ – মাতৃমৃত্যুর অনুপাত (পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
ওপরের রেখচিত্র-১ অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত (Maternal Mortality Ratio) বর্তমানে ১০৪, যা ২০২৫ সালের নির্ধারিত লক্ষ্য (<৭০, যা কিনা রাজ্যের শিশুদের জন্য কর্মপরিকল্পনা-২তে প্রকাশিত[18]) ও ভারতের গড় (৮৮) দুইয়ের তুলনাতেই বেশ বেশি। ভারতের এসডিজি ২০৩০-এর লক্ষ্য একে ৭০-এর নিচে রাখতে বলছে। তুলনামূলকভাবে, তামিলনাড়ু (৩৫) ও কেরালা (৩০)-র সাফল্য উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিকভাবে মালদ্বীপ (৩১.৮) ও শ্রীলঙ্কা (১৮.৩২)-তে এই অনুপাত অনেকটাই কম।
রেখচিত্র ২ – সদ্যোজাতর (জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে) মৃত্যুহার (পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
ওপরে রেখচিত্র ২-তে কয়েকটি রাজ্য ও দেশের নবজাতকের মৃত্যুহারের (Neonatal Mortality Rate) তুলনা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান হার ও ২০২৫ সালের লক্ষ্য— উভয়ই ১৩। ভারতের গড় নবজাতক মৃত্যুহার ১৯, যা এসডিজি ২০৩০-এর লক্ষ্যমাত্রা (<১২) থেকে অনেকটাই বেশি। তামিলনাড়ুর হার ৯, আর কেরালার হার মাত্র ৪— যা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। আন্তর্জাতিক তুলনায়, মালদ্বীপ (৪.০৯) এবং শ্রীলঙ্কা (৪.২৮)-তেও এই মৃত্যুহার অনেক কম।
রেখচিত্র ৩ – পাঁচ বছরের নীচে শিশুদের মৃত্যুহার (পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
রেখচিত্র ৩-এ দেখছি প্রায় একই রকমের চিত্র। পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুদের মৃত্যুহারের এই চিত্রটিতে বিভিন্ন রাজ্য ও দেশের তুলনা দেখানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মৃত্যুহার এবং ২০২৫ সালের লক্ষ্য— উভয়ই ২০। ভারতের গড় মৃত্যুহার ৩১, যা দেশের এসডিজি ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা (≤২৫) থেকে অনেকটাই বেশি। তামিলনাড়ুর হার ১৪ এবং কেরালার হার মাত্র ৮— যা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। আন্তর্জাতিক তুলনায়, দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ (৫.৭) ও শ্রীলঙ্কা (৬.১)-র শিশুমৃত্যুহার অনেক কম।
স্বাস্থ্যের পরে পুষ্টির ক্ষেত্রে আমরা দেখব চারটি সূচক— (ক) পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুদের মধ্যে বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা (স্টান্টিং); (খ) পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুদের মধ্যে উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন (ওয়েস্টিং); (গ) ৬ মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার; এবং (ঘ) ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার। তার জন্য পরের চারটি রেখচিত্র ৪-ক, ৪-খ, ৪-গ ও ৪-ঘ।
রেখচিত্র ৪-ক: পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুদের মধ্যে স্টান্টিং (শতাংশে; পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
এই চিত্রে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ‘স্টান্টেড’ তথা খর্বকায় বা বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতার শিশুদের শতাংশ হার দেখানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান হার (৩৩.৮ শতাংশ) ভারতের গড় (৩৫.৫ শতাংশ)-এর কাছাকাছি ও ২০২৫-এর লক্ষ্যের (১২.৫ শতাংশ) থেকে অনেক বেশি। তামিলনাড়ু (২৫ শতাংশ) ও কেরালার হার (২৩.৪ শতাংশ) অপেক্ষাকৃত কম। আন্তর্জাতিক তুলনায়, শ্রীলঙ্কা (১০.১ শতাংশ) ও মালদ্বীপ (১৪.২ শতাংশ)-এর হার ভারতের তুলনায় অনেক কম।
রেখচিত্র ৪-খ: পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুদের মধ্যে ওয়েস্টিং (শতাংশে; পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
চিত্র অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন (wasted)-এর হার বর্তমানে ২০.৩ শতাংশ— যা নির্ধারিত ২০২৫-এর লক্ষ্য ১৪ শতাংশ থেকে অনেকটাই বেশি; এমনকি ভারতের বর্তমান সামগ্রিক হার ১৯.৩ শতাংশের চেয়েও বেশি। তামিলনাড়ু (১৪.৬ শতাংশ) ও কেরালা (১৫.৮ শতাংশ)-র হার কিছুটা কম এবং লক্ষ্যসীমার কাছাকাছি। তুলনায় শ্রীলঙ্কা (৯.৩ শতাংশ) ও মালদ্বীপ (৯.১ শতাংশ)-এর হার বেশ কম।
রেখচিত্র ৪-গ: ৬ মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার (শতাংশে; পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
রেখচিত্র ৪-গ থেকে দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমবঙ্গে ৬-৫৯ মাস বয়সী শিশুর মধ্যে রক্তাল্পতার (anemia) হার বর্তমানে ৬৯ শতাংশ— যা নির্ধারিত ২০২৫-এর লক্ষ্য (৪০ শতাংশ) ও ভারতের বর্তমান গড়ের (৬৭.১ শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি। তামিলনাড়ুতে এই হার ৫৭.৪ শতাংশ এবং কেরালাতে ৩৯.৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিকভাবে, শ্রীলঙ্কা (২৫ শতাংশ) ও মালদ্বীপ (৩৮ শতাংশ)-এর শিশুদের মধ্যে রক্তস্বল্পতার হার অনেক কম।
রেখচিত্র ৪-ঘ: ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার (শতাংশে; পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
ওপরের চারটি রেখচিত্র থেকেই এটা স্পষ্ট যে ভারতে অপুষ্টির চিত্রটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ভারতে অপুষ্টির হার, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কয়েকটি রাষ্ট্রের তুলনায় অনেকটাই বেশি। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের হাল আরও বিশেষভাবে খারাপ— জাতীয় গড়ের থেকে অনেকটাই নিচে।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, এজেন্সির একটি বড় সূচক মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে। আমাদের পরের রেখচিত্র ৫-এ আমরা তুলে ধরেছি, ভারতে আর দেশের কয়েকটি রাজ্যে কম বয়সে বিয়ের ছবিটা। এখানেও ভারত পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি কয়েকটি দেশের থেকে। আর এখানেও পশ্চিমবঙ্গের গড়, দেশের জাতীয় গড়ের থেকে খারাপ।
রেখচিত্র ৫: ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মহিলাদের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ের হার (শতাংশে; পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাডু, ভারত, ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ)
পশ্চিমবঙ্গে ২০-২৪ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সের আগেই বিবাহিত হওয়ার হার বর্তমানে ৪১.৬ শতাংশ। যা ভারতের গড়ের (২৩.৩ শতাংশ) থেকে অনেক বেশি এবং তামিলনাড়ু (১২.৮ শতাংশ) ও কেরালার (৬.৩ শতাংশ) থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। আন্তর্জাতিক তুলনায়, শ্রীলঙ্কা (৯.৮ শতাংশ) এবং মালদ্বীপ (২.২ শতাংশ)-এর হার খুব কম।
আমাদের শেষ দুটি রেখাচিত্র নারী এবং শিশুদের ওপর সংগঠিত অপরাধের ওপর। দেশে এবং রাজ্যগুলিতে এই ধরনের অপরাধের সংখ্যা এবং হার কিন্তু বাড়ছে। একেবারে হালের (অক্টোবর ২০২৫-এ প্রকাশিত) জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর প্রতিবেদন বলছে, গতবারের তুলনায় শিশুদের ওপর ঘটে যাওয়া অপরাধ বেড়েছে ৯.০১ শতাংশ। আর সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল ২০২৩-এ এই দেশে মহিলাদের ওপর ঘটা ধর্ষণ-জাতীয় যৌন অপরাধের ৯৭.৫ শতাংশ ঘটেছে মহিলা-র চেনা কোনও পুরুষের দ্বারা।[19] তেমনিভাবে ওই সময়ে ঘটে যাওয়া শিশুদের ওপর পক্সো অপরাধের মধ্যে ৯৬.৬ শতাংশ ঘটেছে শিশুটির চেনা কোনও লোকের দ্বারা।[20]
এই দুইরকম অপরাধ নিয়ে আমাদের পরবর্তী দুটি রেখচিত্র ৬ক আর ৬খ, যেখানে ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর প্রতিবেদনগুলি থেকে মহিলা এবং শিশুদের ওপর হওয়া অপরাধের হারগুলি (দেশের এবং কয়েকটি রাজ্যের) একেকটি রেখচিত্র দিয়ে দেখানো হয়েছে।
রেখচিত্র ৬-ক: মহিলাদের ওপর হওয়া অপরাধের হার (২০১৬ থেকে ২০২৩)
রেখচিত্র ৬-খ: শিশুদের ওপর হওয়া অপরাধের হার (২০১৬ থেকে ২০২৩)
চিত্র ৬খ অনুযায়ী ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার (Rates of Crimes against Children) ক্রমশ বেড়েছে, বিশেষত কেরালায়, যেখানে হার ৩০.৮ থেকে ৬২.৮-এ পৌঁছেছে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের গড় হার তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থেকেছে— ২০২৩ সালে যথাক্রমে ২৯.৫ ও ৩৯.৯। তামিলনাড়ুতেও ধাপে ধাপে বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে— ১৪.১ থেকে ৩৩.৭, ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত।
তেমনি চিত্র ৬ক অনুযায়ী, নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার (Rates of Crimes against Women) ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ক্রমশ বেড়েছে। কেরালায় হার সবচেয়ে বেশি, ২০১৬ সালের ৫৪.৯ থেকে ২০২৩ সালে ৮৬.১-এ পৌঁছেছে। পশ্চিমবঙ্গে হার উচ্চ থাকলেও ২০২৩-এ কিছুটা কমে ৭১.৩-তে এসেছে, যদিও সেটি ভারতের গড় (৬৬.২) থেকে বেশি। তামিলনাড়ুতে এই হার তুলনামূলকভাবে কম— ২৩.২ (২০২৩)। ভারতের সার্বিক হারও বেড়েছে, তবে কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম।
দুটি ক্ষেত্রেই এই হার মাপা হয়, প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় কটি অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে তার ওপর। দুটি ক্ষেত্রেই (শিশু বা মহিলা) দেখা যাচ্ছে এই অপরাধের হার কিন্তু রাজ্যস্তরে বা সমগ্র দেশের ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বমুখী। আরও দেখার এই যে পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের ওপর এই ধরনের অপরাধের হার, দেশের গড় হারের চেয়ে বেশি। শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের হার দেশের হারের চেয়ে কম। কিন্তু দেশের নানারকম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে থাকা রাজ্য কেরালাতেও দুটি হার এত বেশি কেন, আমাদের ভাবতে হবে সে কথাও।
সমাধানের পথ: রাষ্ট্র আর সমাজ
এখনও পর্যন্ত দেখা তথ্যগুলো থেকে এটা ক্রমশ বোঝা যায় যে নারী, শিশু উন্নয়নের নানান বিষয় ও তার থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলি বহুস্তরীয় এবং কখনও বেশ জটিল এবং গভীর। দেশের জন্য যেহেতু এসডিজি-র একেকটি লক্ষ্যমাত্রা টার্গেট হিসেবে ধার্য করা থাকে, সাধারণত তাই এই বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে নারী ও শিশু বিষয়ক কেন্দ্রীয় কর্মসূচিগুলির কথায় বা একস্তরীয় বিশ্লেষণে, গোটা দেশকে একটি একক হিসেবে ধরে। কখনও কখনও যে রাজ্যগুলির অবস্থান অপেক্ষাকৃত ভালো তাদের কথাও বলা হয়, কিন্তু সরকারের তথাকথিত ‘তৃতীয় স্তর’-গুলির ভূমিকার কথা এই বিষয়ের অ্যাকাডেমিক আলোচনায় খুব একটা দেখি না। কিন্তু এই সমস্যাগুলির যা ধরন, তাতে রাজ্যে বা কেন্দ্রের রাজধানী থেকে নিয়ন্ত্রিত কর্মসূচি এগুলির সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয় না। সরকারের যে স্তরটি সমাজের সবচেয়ে কাছাকাছি, সেই গ্রামীণ ও নগরাঞ্চলের স্থানীয় সরকারকে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে এই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে। তাই সমস্যাগুলির এই স্বল্পালোচিত দিক নিয়েই আমরা এখন চর্চা করতে চাইছি। তাছাড়া দেশের সমস্যাগুলির স্থায়ী সমাধান অনেকাংশেই স্থানীয় উন্নয়ন, স্থানীয় সরকারের হাতে— এই ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়ে ২০২৩-২৪ থেকে সারা দেশেই কার্যকর হয়েছে স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যের স্থানীয়করণ বা লোকালাইজিং এসডিজি। একেকটি পরিবার, জনগোষ্ঠী, গ্রাম বা জেলার স্থানীয় উন্নয়নই যে দেশকে বৃহত্তর উন্নয়নের রাজপথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে লোকালাইজিং এসডিজি সেই ভাবনারই ফলশ্রুতি। এসডিজি-র এই স্থানীয়করণের কাঠামোয় দেশের লক্ষ্যমাত্রাগুলিকে মাথায় রেখে স্থানীয় স্তরে কীভাবে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক (থিম্যাটিক) পরিকল্পনা করা যায়, আর বিভিন্ন সেইসব থিমের মধ্যে কীভাবে শিশুবান্ধব, নারীবান্ধব গ্রাম/অঞ্চল গড়ে তোলা যায়, সেইসবেরও একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালার মতো স্থানীয় সরকার নিয়ে অগ্রণী কয়েকটি রাজ্যে এই কাঠামো বলবৎ হওয়ার আগেও অবশ্য নারী, শিশু উন্নয়নের কাজ অনেকটাই করা গেছিল সরকারের এই তৃতীয় স্তরকে কাজে লাগিয়ে। এই সুযোগে তাই স্থানীয় সরকারের হাতে নারী ও শিশুকেন্দ্রিক সমস্যাগুলির স্থানীয় সমাধান কী ছিল বা আছে, সেদিকটাও আমরা তুলে ধরব এই পরিসরে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো
পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গোড়া থেকেই নারী ও শিশু উন্নয়ন একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে স্বীকৃত ছিল— এমনকি ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের আগেই। পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী গ্রাম পঞ্চায়েতের দায়িত্ব ও কর্তব্য ১৯ ও ২০ ধারায় নির্ধারিত হয়। ১৯ ধারায় বলা হয়েছিল, প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতকে একটি পাঁচ বছরের মেয়াদি পরিকল্পনা ও একটি বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে; আর ২০ নং ধারায় “নারী ও শিশু উন্নয়ন”কে অন্যান্য কাজের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। একইভাবে, পঞ্চায়েত সমিতির (ধারা ১০৯) এবং জেলা পরিষদের (ধারা ১৫৩) ক্ষেত্রেও নারী ও শিশু উন্নয়ন সংক্রান্ত দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা হয়।
১৯৭৮ সাল থেকেই গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন পঞ্চায়েতগুলির হাতে ন্যস্ত হয়। পরবর্তীতে (১৯৯২-এ) ৭৩-তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে স্থানীয় স্বশাসন আরও শক্তিশালী হয়, এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৪৩জি ও ১১তম তফসিল অনুযায়ী ২৯টি বিষয় পঞ্চায়েতের কার্যক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যেও একটি বিষয় সরাসরি নারী ও শিশুর উন্নয়ন সংক্রান্ত, আর একাধিক বিষয় পরোক্ষভাবে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এমনকি সংবিধান সংশোধন যখন হল, তখনও, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে অন্তত দুটো উপসমিতি আর উপরের দুটো স্তরে চারটি করে স্থায়ী সমিতি গঠনের মাধ্যমে নারী, শিশু উন্নয়নের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়াই ছিল।[21]
এই দায়িত্বগুলি কার্যকরভাবে বণ্টনের জন্য ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে রাজ্য সরকার তিনটি কার্যপরিকল্পনা মানচিত্র (Activity Map) প্রকাশ করে, যাতে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে উল্লম্ব ক্ষমতা-বিন্যাস এবং বিভিন্ন দপ্তরের আনুভূমিক দায়িত্ব বণ্টন স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়। একই সঙ্গে, রাজ্যে বড় জনসংখ্যার কারণে গ্রামসভাকে ভেঙে সংসদ বা বুথভিত্তিক গ্রাম সংসদ (Gram Sansad) গঠন করা হয়, এবং গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দিয়ে আর নির্ধারিত কাজগুলি সঠিকভাবে রূপায়িত হচ্ছে কিনা দেখার জন্য জেলা পরিষদ পর্যায়ে বিরোধী দলনেতাকে চেয়ারম্যান করে জেলা কাউন্সিল (District Council) গড়ে তোলা হয়।
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতব্যবস্থার আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল রাজ্য অর্থ কমিশনের (State Finance Commission) গঠন, তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি ও মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ, এবং স্থায়ী সমিতিগুলির সম্প্রসারণ। জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিতে মোট দশটি স্থায়ী সমিতি (Standing Committee) গঠিত হয়, যার মধ্যে অন্তত চারটি[22] নারী ও শিশু-সংক্রান্ত কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতে পারে।
২০০৩ সালে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে পাঁচটি উপ-সমিতি (Sub-Committee) গঠন করা হয়, যার মধ্যে “নারী, শিশু উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ উপ-সমিতি” এবং “শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য উপ-সমিতি” সরাসরি নারী ও শিশুর কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারে। একই বছরে পঞ্চায়েত আইন সংশোধন করে বুথ বা সংসদ স্তরে জনগণের উন্নয়নে অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দিয়ে গঠিত হয় গ্রাম উন্নয়ন সমিতি[23] এবং ব্লক ও জেলাস্তরের উন্নয়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে নিচের স্তরের পঞ্চায়েতগুলির অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে গঠিত হয় ব্লক সংসদ ও জেলা সংসদ।
স্থানীয় উন্নয়ন যাতে ওপরের স্তরের সরকারের দানের বা স্কিমের মুখাপেক্ষী না হয়, তাই গ্রাম পঞ্চায়েতের কর আরোপের ক্ষমতা[24] এবং তিন স্তরের পঞ্চায়েতেরই অ-কর রাজস্ব আদায়ের অধিকার ১৯৭৩ সালের আইনেই নির্ধারিত ছিল।[25] পরবর্তীতে ২০০৩ সালের মডেল উপ-আইন, ২০০৬ সালের আইনি সংশোধন আর ২০০৭-এর পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত (গ্রাম পঞ্চায়েত হিসেব, নিরীক্ষা ও বাজেট) রুলের মাধ্যমে এই কর ও অ-কর দুইরকম রাজস্ব সংগ্রহেই আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সংক্ষেপে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গে নারী ও শিশু উন্নয়ন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অংশ, তার গোড়ার কথা ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য পঞ্চায়েত’, আর তার আইনি স্বীকৃতিতেই নিহিত— এটি কোনও পরবর্তী বা অধুনা সংযোজন নয়, এমনকি ভারত সরকারের আজকের পঞ্চায়েতের যে অভিমুখ তার অনেক আগেই, পঞ্চায়েত আইনের শুরু থেকেই একটি মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃত।
নিচের স্তর থেকে পরিকল্পনায় নারী ও শিশু
আইনের ১৯ নং ধারা অনুযায়ী, পঞ্চায়েতের একেবারে নিচু স্তর থেকে পরিকল্পনা তৈরির চর্চা পশ্চিমবঙ্গে অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।
এই রাজ্যে পরিকল্পনা-ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ হয় ১৯৮৪-৮৫ সালে— যখন (সারা দেশে সর্ব প্রথম) জেলাস্তরে পরিকল্পনা রচনা, রূপায়ণ, তদারকি ও মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে একটি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। এই কাঠামোর অঙ্গ ছিল— ব্লকস্তরে ব্লক প্ল্যানিং কমিটি, জেলাস্তরে ডিস্ট্রিক্ট প্ল্যানিং কমিটি এবং এই দুই কমিটির ঊর্ধ্বে ডিস্ট্রিক্ট প্ল্যানিং অ্যান্ড কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল।
ওই সময়েই ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি মেদিনীপুরের পঞ্চাশটি গ্রামে গ্রামবাসীরা নিজেরাই গ্রাম-পরিকল্পনার উদ্যোগ নেয়। রাজ্য যখন বাকি জেলাগুলির পরিকল্পনা, ব্লক-পরিকল্পনা পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত করার কথা ভাবছে, মেদিনীপুর জেলা পরিষদ আইআইটি খড়্গপুরের তৎকালীন গ্রাম উন্নয়ন কেন্দ্রের সহায়তায় সিদ্ধান্ত নেয় সেই জেলায় সেইসব ব্লক-পরিকল্পনা তৈরি হবে গ্রামবাসীদের দ্বারা গ্রাম-পরিকল্পনার ভিত্তিতে। সেই মেদিনীপুর মডেলের গুরুত্ব হচ্ছে একই পরিকল্পনা কাঠামোর মধ্যে— (১) চলতি অবস্থায় এখনই কী করা যায় তা পরিকল্পনার আওতায় এনে করে ফেলা; আর (২) চলতি অবস্থাকে সাম্যের দিকে, প্রকৃত উন্নয়নের দিকে পরিবর্তিত করতে পারলে কী কী করা সম্ভব সেটা পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ হয়ে ওঠে, আর সরকারি সাহায্য-নির্ভর পরিকল্পনার অভিমুখ পাল্টে সেটি মানুষের পরিকল্পনায় রূপান্তরিত কীভাবে করা যায়। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে মানুষের অংশগ্রহণ উল্টে গিয়ে হয়ে সেটা হয়ে ওঠে মানুষের কাজে সরকারের অংশগ্রহণ। এই পরিকল্পনাগুলির মধ্যে আঁউরাই গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিকল্পনাটি পরে প্রকাশিত হয়।[26] সেই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য যদিও দারিদ্র্য দূরীকরণ[27] সেখানেও কিন্তু এলাকার গরিব দুঃস্থ পরিবারগুলির শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, পানীয় জলের ব্যবস্থা, ধূমহীন চুল্লি, গ্রামীণ ডিসপেনসারি, শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য শিল্পের মাধ্যমে শ্রমশক্তিতে নিয়োগ, আর মহিলাদের সংগঠন[28], মহিলাদের আর গরিব পরিবারগুলিকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ, শিশুশিক্ষা আর তার জন্যে গ্রামের বিদ্যালয়গুলিতে সহায়তা ও নির্মাণ, গ্রামীণ পাঠাগার তৈরি— এমন সব কাজ ধরা হয়েছিল। এমনকি এলাকার শিশুদের পুষ্টির জন্য শিশু বিকাশ প্রকল্পের কথাও ভাবা ছিল সেই পরিকল্পনায়।[29] গ্রামের বর্তমান অবস্থা কীরকম আর কোথায় যেতে হবে, এই সংক্রান্ত একটি ভূমিকা[30] এই খসড়া পরিকল্পনার একটি সম্পদ। মনে রাখতে হবে গ্রাম-পরিকল্পনায় নারী, শিশু উন্নয়নের এই ভাবনা কিন্তু ১৯৯২-এর পঞ্চায়েত আইন সংশোধনীর[31] আগের ঘটনা— আর তাই সেই সময়ে নারী, শিশু উন্নয়ন নিয়ে ভাবনার বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন উপসমিতির জন্ম হয়নি।
এরপর ১৯৯৯-২০০০ সালে শুরু হয় পার্টিসিপেটরি গ্রাম পঞ্চায়েত প্ল্যানিং-এর জন্য (PGPP বা সহভাগী গ্রাম পঞ্চায়েত পরিকল্পনা) কনভার্জেন্ট কমিউনিটি অ্যাকশন (CCA) বা সমন্বিত জন-উদ্যোগ, যা পুরুলিয়ার কাশিপুর, জলপাইগুড়ির মাল, নদীয়ার হরিণঘাটা আর তৎকালীন মেদিনীপুরের শালবনি— এই চারটি ব্লকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়,[32] এবং স্থানীয় স্তরে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি নতুন মডেল তৈরি করে। ২০০১ সালে এই উদ্যোগকে আরও বড় পরিসরে প্রয়োগ করা হয়। এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য ছিল গ্রাম সংসদ স্তরে গণউদ্যোগ সৃষ্টি করে গ্রামবাসীদেরকে গ্রামোন্নয়নের জন্য পরিকল্পনার কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং তার ভিত্তিতে গ্রাম পঞ্চায়েত পরিকল্পনা ও পঞ্চায়েত সমিতির পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এই সময়েও সিসিএ পদ্ধতির মাধ্যমে বিপুল স্থানীয় তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে নারী ও শিশু উন্নয়নের অনেকগুলি দিক উঠে এসেছিল।[33]
ইতিমধ্যে ৭৩-তম সংবিধান সংশোধনের ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সকল স্তরের মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে ‘গ্রামসভা’ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ করে ‘গ্রাম সংসদ’ তৈরি করা হয়েছে। ২০০৩-এ পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইনকে পুনরায় সংশোধন করে গ্রাম সংসদ স্তরে ‘গ্রাম উন্নয়ন সমিতি’ গঠন[34] এবং তাকে সংসদ স্তরের পরিকল্পনা রচনা ও রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; গ্রাম পঞ্চায়েত-স্তরে উপসমিতিগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবে গঠন করে তাদের পঞ্চায়েতস্তরের বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের স্থায়ী সমিতিগুলিকে সেই সেই স্তরের বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনা রচনা ও রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই আবহাওয়ায় ২০০৫ সালে চালু হয় DFID-র সহায়তায় গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি (SRD বা Strengthening Rural Decentralisation Programme), যা পশ্চিমবঙ্গের বিকেন্দ্রীকৃত পরিকল্পনার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর মূল লক্ষ্য ছিল গ্রাম সংসদ-ভিত্তিক ও উপ-সমিতিভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার প্রক্রিয়া গড়ে তোলা। প্রচলিত পরিকাঠামোগত উন্নয়নের বাইরে সাক্ষরতা, শিশুশিক্ষা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধান, লিঙ্গবৈষম্য, জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন, স্বনির্ভর দল গঠন, নারী ও শিশু উন্নয়নের মতো উপেক্ষিত বিষয়গুলিকে পরিকল্পনায় জোর দেওয়া আর মানুষের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা ছিল এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। পঞ্চায়েতের বিশেষ করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আর কর্মীবৃন্দের নানা বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারী ও শিশুদের সপক্ষে পঞ্চায়েতের পরিকল্পনায় ঠাঁই পাওয়া এবং রূপায়িত হওয়া রাজ্যব্যাপী অগুনতি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এই কর্মসূচির সম্পদ হয়ে আছে।
এই গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচিরই ধারাবাহিকতায় ২০১০-১১ সাল থেকে চলছে ইনস্টিটিউশনাল স্ট্রেংদেনিং অব গ্রাম পঞ্চায়েত প্রোজেক্ট (ISGPP), যার উদ্দেশ্য গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিকল্পনা, বাজেট প্রণয়ন ও তদারকির সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। পঞ্চায়েতের প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলেও, গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির মতোই পরিকল্পনায় নারী-শিশু উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই কর্মসূচিতে। অধুনা প্রচলিত (চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সময় থেকে) দেশব্যাপী গ্রাম পঞ্চায়েত উন্নয়ন পরিকল্পনায় (পরে পঞ্চায়েত উন্নয়ন পরিকল্পনায়) সহায়তা দেওয়া এই কর্মসূচির একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির শুরু থেকে ইনস্টিটিউশনাল স্ট্রেংদেনিং অব গ্রাম পঞ্চায়েত প্রোজেক্টের এই সময়ের মধ্যে ক্ষেত্রভিত্তিক পরিকল্পনা (sector-based planning) একটি নিয়মিত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়, যেখানে পাঁচটি উপ-সমিতি ও সাতটি পরিকল্পনা-ক্ষেত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন খাতের মধ্যে সমন্বয় ও স্থানীয় অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটত। নারী ও শিশুবিষয়ক উন্নয়ন শুধুমাত্র সেই সাতটি ক্ষেত্রের একটি ছিল তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে গ্রাম থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত একটি ধারাবাহিক কাঠামোও সে সময়ে তৈরি করা হয়েছিল।
চিত্র ১ – গ্রাম সংসদ পরিকল্পনার সাতটি ক্ষেত্র
চিত্র ২ – গ্রাম পঞ্চায়েতের পাঁচটি উপসমিতি ও সংসদের সাতটি ক্ষেত্রভিত্তিক পরিকল্পনার সমন্বয়
তবে গ্রাম পঞ্চায়েতের মতো ব্লক ও জেলা স্তরে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনও দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠেনি— কেরালা-সহ ভারতের কোনও রাজ্যেই এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
চতুর্দশ অর্থ কমিশন: খেলার নিয়ম বদলে গেল
চতুর্দশ অর্থ কমিশন (২০১৫–২০২০) পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। এর ফলে গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে সরাসরি অর্থ পৌঁছাতে শুরু করে, ব্লক বা জেলাস্তরকে পাশ কাটিয়ে। বরাদ্দের ৯০ শতাংশ ছিল মৌলিক অনুদান এবং ১০ শতাংশ কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে। এতে গ্রাম পঞ্চায়েত জল, আলো, নিকাশি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক পরিকাঠামো নিয়ে নিজস্বভাবে পরিকল্পনা করতে পারে। তবে এই কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের টাকা পেতে গেলে ২০১৫ সাল থেকে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতকে বছরে একটি গ্রাম পঞ্চায়েত উন্নয়ন পরিকল্পনা (GPDP) তৈরি করতেই হয়— যেখানে গ্রামের মানুষ নিজেরাই অগ্রাধিকার ঠিক করে এবং বিভিন্ন উৎসের তহবিল একত্রিত করে পরিকল্পনা গড়ে তোলে। কমিশন জবাবদিহিতা আরও জোরদার করে— নতুন অনুদান পেতে হলে অন্তত ৮০ শতাংশ তহবিল খরচ ও নিজস্ব আয় বছরে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি বাধ্যতামূলক। এতে স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। সব মিলিয়ে, চতুর্দশ অর্থ কমিশন গোটা দেশের গ্রামীণ স্বশাসনে নিচু স্তর থেকে পরিকল্পিত উন্নয়নের এক নতুন ধারা গড়ে তোলে, যা কিনা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে খুব নতুন নয়— বরং ১৯৮০-র দশক থেকে এ-রাজ্যে চালু অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার ধারার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মিশে যায়।
কিন্তু তার ফলে ‘নারী ও শিশু উন্নয়নে’ স্থানীয় সরকারের ভূমিকায় কোনও বদল এল কি? সেটা বোঝার জন্য আমাদের কিছু পরিকল্পনা হাতেকলমে দেখা দরকার। সে জন্য ২০১৭-১৮[35] থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত[36] বীরভূম জেলার খয়রাশোল ব্লকের ১০-টি গ্রাম পঞ্চায়েতের বার্ষিক পরিকল্পনাগুলি আমরা এবার দেখব।
মোটামুটি একই ছাঁচে ঢালা— বস্তুত, সারা দেশের জন্যই একটিই ধাঁচা— এই বার্ষিক পরিকল্পনাগুলি এখন অন্তত কমবেশি কুড়িটি বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রে বিভক্ত। যথা, বয়স্ক ও বিকল্প শিক্ষা, কৃষি, পশুপালন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য বিধান, ভূমিসংস্কার, বাজার ও মেলা, ক্ষুদ্র বনজ সম্পদ, রাস্তা, গ্রামীণ আবাস, সামাজিক বনসৃজন, সমাজকল্যাণ, জল সংরক্ষণ, পিছিয়ে পড়া ও কমজোরি জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, এবং সর্বশেষ নারী ও শিশু উন্নয়ন। নীচের সারণি ৭-এ চতুর্দশ অর্থ কমিশনের মেয়াদকালে নারী ও শিশু উন্নয়ন খাতে কত টাকা বাজেটে ধরা হয়েছে তার চিত্রটি দেওয়া হল।
সারণি ৭: ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০— বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতে পরিকল্পনা খাতে নারী-শিশু উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ[37]
ওপরের সারণিটি তৈরি হয়েছে যে পরিকল্পনাগুলি থেকে, সেগুলি দেখলে বোঝা যাবে, গ্রাম পঞ্চায়েত বার্ষিক পরিকল্পনাগুলি এখন একটি ধাঁচা-নির্ভর, যেখানে নারী ও শিশু উন্নয়ন একটি বিষয় বা ক্ষেত্র। সারণি থেকে এটা স্পষ্ট যে এই বিশেষ বিষয়টির ওপর বরাদ্দ গোটা পরিকল্পনার বাজেটের সাপেক্ষে কিন্তু খুবই কম। এবং শুধু তাই নয়, পরিকল্পনাগুলি দেখলে বোঝা যাবে নারী ও শিশু উন্নয়ন খাতের কাজ প্রায় সবকটিই আসলে কোনও না কোনওভাবে পরিকাঠামো সংক্রান্ত ব্যয় বা খেলাধুলো অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসর্বস্ব ব্যয়— যার মধ্যে আছে খেলার মাঠের সংস্কার, পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠান মঞ্চের সংস্কার, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সংস্কার বা তার পাঁচিল নির্মাণ, মহিলাদের জন্য স্নানঘাট নির্মাণ বা সংস্কার, শিশুদের জন্য উদ্যান বা পার্ক নির্মাণ, স্কুলে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে মেয়েদের আলাদা শৌচালয়; অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মেঝে সংস্কার; বিভিন্ন সচেতনতা বৃদ্ধির ইভেন্ট, এবং খুবই অল্প স্বনির্ভর দলের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ-জাতীয় মেয়াদি সুফলের কাজ খুবই কম। অর্থের জোগান আসছে (ধরা হয়েছে) ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প থেকে, কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের টাকায়, আইএসজিপিপি প্রোগ্রাম থেকে, আর খুবই অল্প নিজস্ব তহবিল থেকে।
অবশ্যই ওপরে লেখা কুড়িটি ক্ষেত্র-বিশিষ্ট পরিকল্পনায়, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা-সংক্রান্ত বাজেট এবং কাজও ধরা আছে, এবং তার অনেকগুলিই হয়তো নারী, শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষাখাতেই ব্যয় হবে। এখানে শুধু ‘নারী শিশু উন্নয়ন’ বলে চিহ্নিত ক্ষেত্রটির ব্যয়বরাদ্দ তুলে ধরা হল। আর খেয়াল রাখতে হবে এই বিশ্লেষণ শুধুমাত্র পরিকল্পনা ধরে করা হয়েছে, তার কতটুকু রূপায়ণ হয়েছে, তার হিসেব এখানে নেই।
পঞ্চদশ অর্থ কমিশন: স্থানীয় কাজের পরিকল্পনা ও লোকালাইজিং এসডিজি
পঞ্চদশ অর্থ কমিশন (২০২১-২০২৬) আগের কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের শর্ত— অর্থাৎ বাধ্যতামূলক গ্রাম পঞ্চায়েত বার্ষিক পরিকল্পনা রচনা ও কেন্দ্রীয় পোর্টালে আপলোড করার বিষয়টি বজায় রাখল। তার সঙ্গে পঞ্চায়েতের প্রাপ্ত তহবিলের খরচের নিয়মে কিছু বদল আনল। শর্ত ছিল— পঞ্চায়েতের প্রাপ্ত তহবিলের ৬০ শতাংশ শর্তসাপেক্ষ তহবিল— তার ৫০ শতাংশ খরচ করতে হবে স্বাস্থ্যবিধান এবং কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার খাতে, আর বাকি ৫০ শতাংশ খরচ করতে হবে পানীয় জল, নলবাহিত জলের ব্যবস্থা, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, সৌরশক্তি ব্যবহার করে জল সংরক্ষণ আর জল পুনর্ব্যবহারের কাজে। ৬০ শতাংশ এইভাবে ব্যবহারের পর, বাকি ৪০ শতাংশ নিঃশর্ত তহবিল যা খরচ করতে হবে— অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে, এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের বিভাগগুলির সঙ্গে আলোচনা করে, এলাকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, শিশুদের টিকাকরণ, রাস্তা, রাস্তার আলো, সৌরশক্তি-নির্ভর আলো, গ্রাম পঞ্চায়েত কার্যালয় ইত্যাদির নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে, গ্রামীণ বাজার নির্মাণে, শিশু উদ্যান খাতে, গ্রামীণ গ্রন্থাগার খাতে, পঞ্চায়েত কার্যালয়ে শিশু ও নারীবান্ধব ঘর তৈরিতে; এলাকায় শ্মশান/কবরস্থান নির্মাণ আর রক্ষণাবেক্ষণে, বিদ্যুৎ বিল দিতে আর খেলাধূলা আর ব্যায়ামের সরঞ্জাম কিনতে।
এ ছাড়া, এই অর্থ কমিশনের মধ্যবর্তী বছর ২০২৩-২৪ সাল থেকে আরেকটি নতুন ঘটনা ঘটল দেশের ও স্থানীয় উন্নয়নের মেলবন্ধনের জায়গায়। যেখানে স্থানীয় উন্নয়ন আর স্থানীয় পরিকল্পনাকে জাতিসংঘ-ঘোষিত স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যের (Sustainable Development Goals) সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হল। ২০২১ সাল থেকে ভারত সরকার, বিশেষ করে পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রক (Ministry of Panchayati Raj – MoPR), এই উদ্যোগ চালু করেছে যাতে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতের উন্নয়ন পরিকল্পনা, রূপায়ণ আর অগ্রগতি, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা যায় বা দেশের উন্নয়নের কতটুকু স্থানীয় উন্নয়নের প্রভাবে হল তা বোঝা যায়। অর্থাৎ, স্থানীয় শাসন এখন থেকে আর কেবল প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ নয়, বরং বৈশ্বিক উন্নয়ন-ভাবনার এক অন্তর্গত অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
এই উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে তিন স্তরের সূচককাঠামো— গ্লোবাল ইন্ডিকেটর ফ্রেমওয়ার্ক (Global Indicator Framework – GIF)[38], এর পরে ভারতের ন্যাশনাল বা জাতীয় ইন্ডিকেটর ফ্রেমওয়ার্ক (National Indicator Framework – NIF)[39] এবং অক্টোবর ২০২১-এ প্রথম প্রকাশ পেল লোকাল ইন্ডিকেটর ফ্রেমওয়ার্ক (Local Indicator Framework – LIF) যা দিয়ে স্থানীয় উন্নয়নকে ওই বৈশ্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে মাপা হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ে কমবেশি ২৩১টি সূচক থাকলেও, জাতীয় স্তর পেরিয়ে, স্থানীয় স্তরে ২০২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ৫৭৭।[40] এর মাধ্যমে ১৭টি স্থিতিশীল উন্নয়ন-লক্ষ্যের মধ্যে ১৬টি লক্ষ্য গ্রাম পঞ্চায়েত পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ১৬টি লক্ষ্য স্থানীয় স্তরে রূপ নিয়েছে নয়টি স্থানীয় বা লোকাল থিমের,[41] যার মধ্যে দুটি— শিশু-বান্ধব পঞ্চায়েত (থিম ৩) ও নারী-বান্ধব পঞ্চায়েত (থিম ৯) আমাদের এই লেখায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। শিশুদের জন্য নির্ধারিত ৮৫টি স্থানীয় সূচক চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়ানো— বেঁচে থাকা (সার্ভাইভাল), বিকাশ (ডেভেলপমেন্ট), সুরক্ষা (প্রোটেকশন) ও অংশগ্রহণ (পার্টিসিপেশন); আর নারীর জন্য নির্ধারিত ৫১টি সূচক ঘিরে আছে তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রকে।[42]
এর ফলে ২০২৩-২৪ সাল থেকে সারা দেশে চালু হয়েছে থিমভিত্তিক গ্রাম পঞ্চায়েত উন্নয়ন পরিকল্পনা (Thematic Gram Panchayat Development Plan – Thematic GPDP), যার ভিত্তিতে প্রতিটি পঞ্চায়েত একটি বা দুটি থিমে সেই বছরে তাদের উন্নয়ন অগ্রাধিকার নির্ধারণ করছে। পরের বছর থেকে শুরু হয়েছে আরও বিস্তৃত পঞ্চায়েত উন্নয়ন পরিকল্পনা (Panchayat Development Plan – PDP), যা কিনা হচ্ছে পঞ্চায়েতের সবকটি স্তরকে বার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় এনে।
পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সময়কালে গ্রাম পঞ্চায়েত বার্ষিক পরিকল্পনার রূপ কিছু বদলাল কি না, নারী-শিশু উন্নয়নে কোনও বিশেষ ধারা তৈরি হল কি না, আমরা দেখে নেব, আগে দেখা বীরভূম জেলার, খয়রাশোল ব্লকের ওই ১০-টি গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকেই— পরবর্তী বছরগুলিতে। পরের সারণি দ্রষ্টব্য।
সারণি ৮: ২০২০-২১ থেকে ২০২৫-২৬— বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতে পরিকল্পনা খাতে নারী-শিশু উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ[43] (পরিকল্পনার জন্য মোট বরাদ্দের শতাংশে)
ওপরের সারণি-৮ থেকে এটা স্পষ্ট যে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের মেয়াদকালে যেমন দেখেছিলাম, পঞ্চদশ কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের সময়কালেও এই নারী ও শিশু উন্নয়ন বিষয়টির ওপর বরাদ্দ গোটা পরিকল্পনার বাজেটের শতাংশের সাপেক্ষে খুব বেশি বাড়েনি। এবং শুধু তাই নয়, পরিকল্পনাগুলি খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে নারী ও শিশু উন্নয়ন খাতের কাজ প্রায় সবকটিই আগের মতোই আবারও কোনও না কোনওভাবে পরিকাঠামো সংক্রান্ত ব্যয় বা খেলাধুলোর অনুষ্ঠান, সরঞ্জাম অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসর্বস্ব ব্যয়। অনেক পঞ্চায়েত নারী ও শিশু উন্নয়ন খাতে ঠিক কী কাজ করা যায় ভাবতে না পেরে, শুধুমাত্র ‘নারী ও শিশু উন্নয়ন’ এই বলে কিছু টাকা ধরে রেখেছে। ব্যতিক্রমীদের মধ্যে শুধুমাত্র ২০২১-২২-এ বর্রা গ্রাম পঞ্চায়েতে দেখা গেল নিজস্ব তহবিল ব্যয়ে এলাকার নিরক্ষর মহিলাদের সাক্ষর করার প্রশিক্ষণ দিতে, অপুষ্ট শিশুদের পরিপূরক পুষ্টি প্রদানের মতো কাজ নিতে। অবশ্য ২০২৩-২৪, ২০২৫-২৬-এ লোকপুর, ২০২৪-২৫-এ বাবুইজোর আর হজরতপুর পঞ্চায়েতেও পরিপূরক পুষ্টি প্রদান পরিকল্পনায় ছিল। ২০২২-২৩-এ সেই বর্রা পঞ্চায়েতেই দেখা গেল এলাকার দুঃস্থ, সহায়-সম্বলহীন মহিলাদের খাদ্যসুরক্ষা দিতে আর প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দিতে বরাদ্দ রাখতে, এলাকার গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের বই কিনে দিতে। ২০২২-২৩-এ খয়রাশোল পঞ্চায়েত এলাকার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে দিয়েছে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন, পানীয় জলের ফিল্টার, আলো আর পাখার সংস্থান। ২০২৪-২৫-এ বর্রা পঞ্চায়েত এলাকার গর্ভবতী মায়েদের জন্য রেখেছে পরিপূরক পুষ্টি— নাক্রাকোন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতও এই কাজটি রেখেছে এই বছরে। বর্রা রক্তাল্পতা স্ক্রিনিং-এর জন্য রেখেছে রক্তপরীক্ষার খরচ, ব্যবস্থা রেখেছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের— যেটা নাক্রাকোণ্ডা পঞ্চায়েতও রেখেছে— আর কিছু জরুরি ওষুধের। স্বনির্ভর দলের সঙ্গে রেখেছে প্রচারাভিযান— এলাকায় শিশুশ্রম আর কম বয়সে বিয়ে আটকানোর জন্য। ২০২৫-২৬-এ বর্রা পঞ্চায়েত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিশুদের জন্য ওজন-যন্ত্র কিনে দেওয়ার টাকা বরাদ্দ করেছে; অভিবাসী পরিবারগুলির খবর রাখার জন্য ভেবেছে ট্র্যাকিং রেজিস্টারের কথা। কয়েকটি পঞ্চায়েত এলাকার মহিলাদের নারী আদালত ও আইনি পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা পরিকল্পনায় রেখেছে। কয়েকটি পঞ্চায়েত অপুষ্টি দূরীকরণে পরিপূরক পৌষ্টিক আহারের ব্যবস্থা রেখেছে।
২০২৪-২৫ থেকে প্রায় সব গ্রাম পঞ্চায়েতেই এলাকার স্বনির্ভর দলের ফেডারেশনের তৈরি গ্রামের দারিদ্র্য দূরীকরণ পরিকল্পনা বা Village Poverty Reduction Plan (VPRP)-র সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটা চেষ্টা লক্ষ করা যায়; এবং পরিকল্পনায় VPRP-র সঙ্গে নানারকম প্রচারাভিযান— যেমন, নারীপাচার, শিশুপাচার, শিশুশ্রম, কম বয়সে বিয়ে, পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি; দেওয়াললিখনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, পুষ্টি, ওষুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদির বিতরণ সংক্রান্ত উল্লেখ দেখা যায়। অনেকেই ভেবেছেন পঞ্চায়েতে, সরকারি দপ্তরে শিশুবান্ধব ঘরের কথা— কিন্তু স্বনির্ভর দলের সঙ্গে সমন্বয়ের সেইসব উদ্যোগ সফল হয়েছিল কিনা, যেহেতু রূপায়ণের কোনও প্রতিবেদন আমাদের হাতে নেই, তাই সে কথা জানা গেল না। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ থেকে লোকালাইজিং এসডিজি বা বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার স্থানীয়করণের যে উদ্যোগ স্থানীয় থিমের মাধ্যমে পঞ্চায়েতে নেওয়া হচ্ছে, তার কারণেও নারী-শিশু উন্নয়নে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও জোয়ার আসতে এই পরিকল্পনাগুলিতে দেখা গেল না— বাজেটে নারী ও শিশু উন্নয়ন খাতে সামান্য বেশি বরাদ্দ রাখা ছাড়া। ২০২৩-২৪, ২০২৪-২৫, ২০২৫-২৬ এই তিন বছরেই খয়রাশোলের প্রায় সবকটি পঞ্চায়েতেই সঙ্কল্প[44] নেওয়া হয়েছে লোকাল বা স্থানীয় থিম-৬য়ে, যা কিনা একেবারেই গ্রামীণ পরিকাঠামো সংক্রান্ত কাজের থিম। ব্যতিক্রম ২০২৪-২৫-এর বর্রা গ্রাম পঞ্চায়েত, যারা সে বছর ‘নারীবান্ধব পঞ্চায়েত’ (থিম-৯) সংক্রান্ত সঙ্কল্প নিয়েছিল।
বিশ্বের উন্নয়নকে স্থানীয়করণের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওই স্থানীয় ইন্ডিকেটর ফ্রেমওয়ার্কের তালিকা থেকে নিয়ে সমন্বিত সূচকের (ইন্ডেক্স) ভিত্তিতে পঞ্চায়েত উন্নয়ন সূচক (Panchayat Development Index – PDI) বা অধুনা পঞ্চায়েত অগ্রগতি সূচক (Panchayat Advancement Index – PAI), যা স্থানীয় পর্যায়ে কর্মদক্ষতা ও অগ্রগতি মাপার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে। গত বছরে দেশের পঞ্চায়েতগুলিকে নিয়ে শেষতম প্রতিবেদনে নারী ও শিশু-কেন্দ্রিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে ১৫টি শিশুবিষয়ক ও ২১টি নারীসংক্রান্ত স্থানীয় সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয় শাসনের গুণমান ও সাফল্য পরিমাপের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এই “পঞ্চায়েত অগ্রগতি সূচক” (Panchayat Advancement Index – PAI) চালু করেছে। প্রথম পর্যায়ে, অর্থাৎ PDI/PAI 1.0 সংস্করণে, ৫১৬টি সূচক ব্যবহার করে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার চেষ্টা হয়েছিল। পরবর্তী সংস্করণ PDI/PAI 2.0–এ সূচকের সংখ্যা কমে হয়েছে ১৫০, যা পারফরম্যান্স মূল্যায়নকে সঠিক মানের স্থানীয় তথ্য পাওয়া, না-পাওয়ার ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। এই সূচকগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন পঞ্চায়েতের কর্মদক্ষতা, অগ্রগতি ও ফলাফলকে তথ্যনির্ভরভাবে পরিমাপের চেষ্টা করা হচ্ছে— যদিও বাস্তবে এই মূল্যায়ন কতটা নির্ভরযোগ্য বা ফলপ্রসূ হচ্ছে, তা এখনও বিতর্কিত। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু ২০২২-২৩-এর PDI/PAI 1.0 সংস্করণে, যা ২০২৪-২৫এ প্রকাশিত হয়েছে, অংশগ্রহণ করেনি।
তবে আগেকার ক্ষেত্রভিত্তিক বার্ষিক পরিকল্পনা থেকে আজকের থিমভিত্তিক বার্ষিক পরিকল্পনার উদ্যোগ যতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বাস্তবে তার প্রয়োগে ততটাই জটিলতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রথমত, কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি টেমপ্লেট-নির্ভর পরিকল্পনা কাঠামো অনেক সময় স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে এত বড় দেশের উন্নয়নের আর অগ্রাধিকারের বৈচিত্র্যও তাতে ধরা পড়ে না, আর বহু গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিকল্পনা কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবায়ন স্তরে তা কার্যকর রূপ নেয় না।
দ্বিতীয়ত, সূচক-ভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থায় তথ্য সংগ্রহের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে— অনেক জায়গায় তথ্য অনুমাননির্ভর বা অসম্পূর্ণ।
তৃতীয়ত, পঞ্চায়েতস্তরে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা না থাকায় সূচকগুলির ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
চতুর্থত, নারী ও শিশুবান্ধব সূচকগুলির বাস্তব রূপায়ণে বিভাগীয় দপ্তরগুলির সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারী ও শিশুবিকাশ দপ্তরের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকায় একই তথ্য বা কর্মসূচি একাধিক সংস্থায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত, স্থানীয় সূচকগুলির যে অভিমুখ সেগুলি অনেকটাই বিস্তৃত এবং উন্নয়নের উচ্চতম স্তর আউটকাম বা এমনকি ইম্প্যাক্ট-কেন্দ্রিক। কিন্তু মন্ত্রকের টেমপ্লেট-নির্ভর পরিকল্পনা কাঠামোয়, পঞ্চায়েতগুলি একেকটি লোকাল/স্থানীয় থিমে কী কী কাজ ধরতে পারবে সেগুলিও ঠিক করা আছে— লক্ষ করলেই দেখা যাবে সেই কাজগুলি নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, জিনিস কেনাকাটা (প্রোকিওরমেন্ট), ফেসিলিটি তৈরি ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ— যেগুলি বড়জোর উন্নয়নের অনেক নিচের ধাপ আউটপুটটুকু সুনিশ্চিত করে।
এছাড়া, অনেক রাজ্যে পঞ্চায়েতি রাজ দপ্তর ও লাইন ডিপার্টমেন্টগুলির মধ্যে “কনভার্জেন্স” (Convergence) বা সমন্বয়ের ঘাটতি এই উদ্যোগের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপোষণ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রক্রিয়াটিকে আরও ধীরগতি করে তুলেছে। অনেক সময় থিমভিত্তিক পরিকল্পনা “উপরের নির্দেশ অনুযায়ী ফর্ম পূরণের কাজ”-এ সীমাবদ্ধ থাকে, যেখানে প্রকৃত জনঅংশগ্রহণ বা গ্রামসভার ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন থেকে প্রাপ্ত টাকা খরচের চাপও অনেক সময়ে বাকি উন্নয়নের অগ্রাধিকারকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে।
পরিকল্পনার সমন্বয় ও সংহতকরণের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। বিভিন্ন দপ্তরের পরিকল্পনা ও তহবিলকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত গ্রামীণ বিকাশ কাঠামো তৈরি করার যে উদ্দেশ্য (যা জেলা পরিকল্পনা কমিটির লক্ষ্য ছিল), তা বাস্তবে খুব কমই অর্জিত হচ্ছে। পঞ্চায়েতের হাতে প্রকৃত অর্থনৈতিক ক্ষমতা বা “রিসোর্স এনভেলপ” (Resource Envelope) অত্যন্ত সীমিত এবং দিনদিন আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। নারীবান্ধব বা শিশুবান্ধব পঞ্চায়েত থিমে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলির[45] তহবিলের উপর গ্রাম পঞ্চায়েতের সরাসরি কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে তারা এই সম্পদগুলো তাদের পরিকল্পনায় কার্যকরভাবে একীভূত করতে পারে না। এমনকি স্থানীয় স্বনির্ভর দলগুলির সংগঠন সংঘ বা ফেডারেশনের[46] জীবিকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে এলাকার দারিদ্র্য দূরীকরণের পরিকল্পনাও (VPRP) গ্রাম পঞ্চায়েতের আওতার বাইরে। অথচ বিষয়টি লোকাল থিম নম্বর ১— দারিদ্র্যমুক্ত ও সম্প্রসারিত জীবিকা-সম্বলিত পঞ্চায়েতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
এর আগে উল্লেখ করেছিলাম রাজ্য সরকার ২০০৫ থেকে ২০০৭-এর মধ্যে তিনটি “অ্যাক্টিভিটি ম্যাপ” (Activity Map) প্রকাশ করেছিলেন, যার মাধ্যমে দায়িত্ব বণ্টন কিছুটা স্পষ্ট করা হয়েছে; এ ছাড়াও ডিভোলিউশনের ফলে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের আগামী রূপরেখা কেমন হবে— বিশেষ করে তার কাজ Core Function, Assigned Function আর Own Function-এর ভিত্তিতে— আর তার ফলে বিভাগীয় দপ্তরগুলি পঞ্চায়েতের সঙ্গে কীভাবে দায়িত্ব বন্টন করবে, আর তার জন্য আইনে, সরকারি নির্দেশনামায় কী কী বদল দরকার, তার জন্য পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতের একটি রোডম্যাপ ডকুমেন্ট তৈরি এবং প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু সেটি হওয়া সত্ত্বেও, বাস্তবে “তিন এফ” (Funds, Functionaries and Functions)-এর সঠিক এবং সম্পূর্ণ হস্তান্তর এখনও ঘটেনি। এর ফলে পরিকল্পনা প্রণয়নে সমন্বয়ের পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতা থেকেই গেছে। আর তাই নারী-শিশু উন্নয়নের কাজ, যা-র অনেকগুলির সমাধান স্থানীয় সরকার করে দিতে পারত, এবং দেশের উন্নয়নকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত, সেখানেও খামতি থেকে যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে একটি গঠনমূলক আর্থিক সংস্কারের (Structural Financial Reform) প্রস্তাব এসেছে— রাজ্য বাজেটে একটি পৃথক “পঞ্চায়েত সেক্টর উইন্ডো” (Panchayat Sector Window) তৈরি করা।[47] এর মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন খাতের অর্থ সরাসরি পঞ্চায়েতের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হবে, যা বিকেন্দ্রীকরণকে আরও কার্যকর করতে পারে। এই কাজটিও এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
স্থানীয়ভাবে কোনও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে না, এমন কিন্তু নয়। উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় দেখা গেল প্রধান-সাহেব বিশেষ চিন্তিত ও উদ্যোগী হচ্ছেন কম বয়সে বিয়ে আটকানোর জন্য; কোনও জেলার পঞ্চায়েতের নারী-শিশু উন্নয়ন উপসমিতির সঞ্চালিকা এলাকার কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করছেন তাদের সমস্যা বোঝার জন্য; কোনও পঞ্চায়েত নিজস্ব তহবিল থেকে আলো, পাখার ব্যবস্থা করেছে এলাকার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে; কোনও পঞ্চায়েত স্বাস্থ্যবিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ে বরাদ্দ করছে অ্যানিমিয়া টেস্টিং কিটের; অনেক পঞ্চায়েত থিমের সঙ্কল্পের বাইরে গিয়ে আলাদা করে অঙ্গীকার করছে এলাকাকে শিশুশ্রম মুক্ত করার; অনেক পঞ্চায়েতে তৈরি হয়েছে শিশু-বান্ধব ঘর; অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিয়ম করে গ্রামস্তরের শিশু সুরক্ষা কমিটির মিটিং ডাকছেন; এলাকার অতি দুঃস্থ পরিবারগুলিকে অন্ন সংস্থান দিচ্ছে অনেক পঞ্চায়েত; ২০২২-২৩-এ মুর্শিদাবাদের ২১-টি ব্লক থেকে শিশু-কিশোর-কিশোরীরা তাদের দাবিসনদ পেশ করে পঞ্চায়েত-কে, যেখান থেকে তৈরি হয় ব্লক প্ল্যান অফ অ্যাকশন ফর চিল্ড্রেন; শিশু-পুষ্টি মাপতে প্রয়োজনীয় ওজনযন্ত্র খারাপ হয়ে যাওয়ায় রাজ্যের অনেক পঞ্চায়েত সরাসরি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে কিনে দিচ্ছে ওজনযন্ত্র; কোনও পঞ্চায়েত সঙ্কল্প নিচ্ছে এলাকাকে শিশু-অপুষ্টি মুক্ত করার; লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের চিহ্নিত করে পঞ্চায়েত তাদের জন্য বিশেষ কোচিং সেন্টার চালাচ্ছে, এলাকারই শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীকে ভাতা দিয়ে; সুন্দরবন অঞ্চলে একাধিক প্রধান এগিয়ে এসেছেন জলে ডুবে শিশুমৃত্যু ঠেকাতে; কর্মরতা মায়েদের শিশুদের সুরক্ষা দিতে তাঁরা চালাচ্ছেন ক্রেশ; বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতার দেওয়াললিখন হয়েছে প্রচুর… কিন্তু সার্বিকভাবে পঞ্চায়েতকে নারী-শিশু কল্যাণমুখী হতে এখনও পেরোতে হবে অনেকটা পথ। যেখানে নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা ও কল্যাণ প্রকৃত অর্থে সুরক্ষিত থাকে সেখানে গ্রাম পঞ্চায়েত কেবল প্রশাসনিক সংস্থা নয়, বরং এক সমন্বিত সামাজিক উন্নয়নের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, ।
শেষ পর্যন্ত, বিকেন্দ্রীকরণ আর ফলে স্থানীয় উন্নয়নের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের যোগ তখনই সত্যিকার অর্থে সফল হবে, যখন গ্রাম পঞ্চায়েত নিজের গ্রামের পরিকল্পনা নিজেরাই করতে পারবে— উপর থেকে নির্দেশিত টেমপ্লেটে নয়, বরং স্থানীয় বাস্তবতা, চাহিদা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। সূচকনির্ভর পরিকল্পনা তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন তা হবে স্থানীয় স্বশাসনের হাতিয়ার, কেবলমাত্র রিপোর্ট পাঠানোর আবশ্যিকতা নয়।
শহুরে পরিসর— আইনি কাঠামো ও সীমাবদ্ধতা
গ্রাম ছেড়ে এবার আসা যাক শহরে। এই রাজ্যে নগর স্থানীয় সংস্থার (Urban Local Bodies – ULBs) সংখ্যা কমবেশি একশো উনপঞ্চাশটি— তার মধ্যে ৭টি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, ১১৮টি মিউনিসিপ্যালিটি, ২১টি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, আর ৩টি নোটিফায়েড এরিয়া অথরিটি রয়েছে। রাজ্যে চার রকম আইনের দ্বারা এই নাগরিক স্থানীয় সরকারগুলি পরিচালিত হয়। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের নগর স্থানীয় সংস্থাগুলির আইনি পরিসর, কাঠামো ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী ও শিশুর উন্নয়ন সেখানে প্রায় উপেক্ষিত। West Bengal Municipal Act (1993), West Bengal Municipal Corporation Act (1990, 1994, 2006), Kolkata Municipal Corporation Act West Bengal, 1980 (সংশোধিত 2023) এবং Howrah Municipal Corporation Act, 1980, (সংশোধিত 2019)— এই সব কটি আইনেই মূল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নাগরিক পরিষেবা, অবকাঠামো ও প্রশাসনিক কার্যাবলিতে; সামাজিক কল্যাণ, বিশেষ করে নারী ও শিশুর উন্নয়ন, সেখানে প্রাধান্য পায়নি।
প্রথমত, ওয়েস্ট বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট, ১৯৯৩-এ ৬৩ নম্বর ধারায় ৫০টি কাজের কথা আছে যেগুলি বাধ্যতামূলক; ৬৪ নম্বর ধারায় ৪০টি কাজের কথা আছে যেগুলি ঐচ্ছিক। আর ৬৫ নম্বর ধারায় ১৭টি কাজের উল্লেখ আছে সেগুলি উপরের স্তরের সরকার থেকে হস্তান্তরিত। মহিলা ও শিশুদের জন্য কিছু ঐচ্ছিক কাজের (discretionary function) উল্লেখ আছে ৬৪ নম্বর ধারায়। কিন্তু সেগুলি বাধ্যতামূলক (obligatory function) নয়। ৬৩ আর ৬৫ নং ধারায় শুধুমাত্র মহিলা আর শিশুদের জন্য কিছু নেই। এরপর, ওয়েস্ট বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন অ্যাক্ট, ২০০৬। এ আইনের ৯৭ নম্বর ধারায় আছে ৫১টি বাধ্যতামূলক দায়িত্ব, ৯৮ নম্বর ধারায় ৪২টি দায়িত্ব ঐচ্ছিক; আর ধারা ৯৯তে ১৬টি দায়িত্ব রাজ্য চাইলে হস্তান্তরিত করতে পারে। এখানে শুধুমাত্র শিশুর জন্ম নথিভুক্তকরণই তার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, বালওয়াড়ি, ক্রেশ তার কাছে ঐচ্ছিক (বাধ্যতামূলক নয়)। স্বাস্থ্য আর পরিবার কল্যাণ সেখানে হস্তান্তরিত দায়িত্ব (transferred function)। এরপর কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন অ্যাক্ট ওয়েস্ট বেঙ্গল, ১৯৮০। এখানে ২৯ নম্বর ধারায় ২৭টি বাধ্যতামূলক কাজ; ৩০ নম্বর ধারায় ১৯টি ঐচ্ছিক কাজ। শুধুমাত্র শিশুর জন্ম নথিভুক্তকরণ তার বাধ্যতামূলক কাজের আওতায়। প্রাক-প্রাথমিক আর প্রাথমিক শিক্ষা তার ঐচ্ছিক বিষয় (বাধ্যতামূলক নয়)। সবশেষে হাওড়া মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন অ্যাক্ট, ১৯৮০। এর কোনওটারই কোনও উল্লেখ নেই। সেখানে সে Core Municipal and Civic Functions নিয়েই ব্যস্ত।
ভারতে গ্রামীণ স্বশাসনের জন্য আইনি রূপরেখার অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল নাগরিক স্থানীয় স্বশাসন আইন— মাদ্রাজ মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট, ১৯১৯। মাদ্রাজ মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নাগরিক স্থানীয় সরকার— গঠিত হয়েছিল সেই ১৬৮৮ সালে। আধুনিক ভারতে গ্রামীণ এলাকার জন্য যেমন সংবিধানের ৭৩তম সংশোধন, তেমনি শহুরে এলাকার জন্য ৭৪তম সংবিধান সংশোধনী আইন। গ্রামীণ এলাকার জন্য যেমন ২৪৩জি অনুচ্ছদের একাদশ তফসিল; তেমনি শহুরে এলাকার জন্য অনুচ্ছেদ নম্বর ২৪৩ডব্লু, আর তার মধ্যে দ্বাদশ তফসিল। দ্বাদশ তফসিলে আছে ১৮টি বিষয়, স্থানীয় সরকারকে রাজ্য সরকার যা দায়িত্ব হস্তান্তরিত করতে পারে— কিন্তু সেখানেও অনুপস্থিত নারী ও শিশু উন্নয়ন জাতীয় কোনও বিষয়।
এমনকি ২০১৩ সালের Service Level Benchmarking Report-এও নারী ও শিশু সম্পর্কিত কোনও সূচক রাখা হয়নি। ফলে আইনি কাঠামো থেকেই এই দুটি শ্রেণি প্রশাসনিকভাবে প্রান্তিক অবস্থায় রয়ে গেছে।
এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে গত দুই দশকে দ্রুত নগরায়ণ ঘটেছে এবং ঘটছে। বর্তমানে রাজ্যের প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করে; ULB-র সংখ্যা আগেই লিখেছি ১৪৯, যার মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় সর্বাধিক ULB, এবং কলকাতা ভারতের আটটি বৃহত্তম শহরের মধ্যে দ্বিতীয়। সেন্সাস টাউনের সংখ্যা ২০০১ সালের সংখ্যা ২৫৫ থেকে ২০১১ সালে বেড়ে হয় ৭৮০, যদিও এর জন্য কোনও আলাদা স্থানীয় সরকার নেই। অর্থাৎ শহরায়ণের গতি অত্যন্ত দ্রুত। ফলে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক নারী ও শিশু এখন নাগরিক শাসনের আওতায় এলেও, তাদের প্রয়োজন নীতিনির্ধারণ আর তার ফলে তাদের জন্য বাজেট-বরাদ্দ এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি।
কলকাতায় দেখা যায়, শহরাঞ্চলের আইসিডিএস কেন্দ্রগুলি প্রায়ই ক্লাবঘর বা ধার করা জায়গায় চলে, এবং অনেক জায়গায় একাধিক কেন্দ্র একই ভবন ভাগ করে নেয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র (UPHC/HWC) স্তরের পরিষেবা দুর্বল, রেফারেল ব্যবস্থা কার্যত অকার্যকর, ফলে মানুষ সরাসরি বড় হাসপাতালে চলে যান, আর ভিড় বাড়ে মেডিকেল কলেজগুলিতে। ওয়ার্ড-স্তরের শিশু সুরক্ষা কমিটিগুলি (WLCPC) জনঘনত্ব আর বিপুল জনসংখ্যার কারণে কার্যকরভাবে এলাকার শিশুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে না; তাই বিশেষজ্ঞরা বসতি-স্তরে পৃথক কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। কোভিড-কালে লকডাউনের ফলে, শিশুরা ব্যাপক হারে রুটিন টিকাকরণ না পাওয়ার ফলে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে ছোট ছোট সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে— যা শহুরে জনস্বাস্থ্যের দুর্বলতা প্রকাশ করে।
এছাড়া শহরে এখনও গ্রামীণ এলাকার মতো কোনও Localised Sustainable Development Goal (LSDG) বা স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার স্থানীয়করণের কাঠামো নেই। স্থানীয় উন্নয়নের দায়িত্ব কতটা স্থানীয় সরকারের, আর কতটা রাজ্য সরকারের— সেই পুরনো ফান্ড, ফাংশন, ফাংশনারি প্রশ্নের উত্তর বা স্থানীয় সরকারের অধিক্ষেত্র (jurisdiction) কোথায় শেষ, আর কোথায়ই বা রাজ্য সরকারের দায়িত্ব শুরু— সেই principle of subsidiarity এখনও স্পষ্ট নয়। ২০২১ সালে একবারের জন্যই একটি নাগরিক এসডিজি সূচক (urban SDG Index)-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে নীতি আয়োগ। সেখানে দেশের চারটি মেট্রোপলিসের (কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাই) মধ্যে এসডিজি ১ (দারিদ্র্য), ২ (ক্ষুধা), ৩ (সুস্বাস্থ্য), ৪ (শিক্ষা) ও ৫ (লিঙ্গসমতা)-র সমন্বিত সূচকে কলকাতার ক্রম এসেছিল চতুর্থ।
শুধু যে ফাংশন বা কাজ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে তাই নয়, ফান্ড অর্থাৎ অর্থনৈতিক দিক থেকেও ULB-গুলি সমস্যায় রয়েছে। অধিকাংশ সংস্থার নিজস্ব রাজস্ব (Own Source Revenue) সংগ্রহ খুবই কম; বকেয়া ঋণ, ইউজার চার্জ আদায়ে ব্যর্থতা এবং ফাংশনারি অর্থ্যাৎ মানবসম্পদের সংকট তাদের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে রাজ্য সরকারকে ঘন ঘন আর্থিক সহায়তা বা বেইল-আউট দিতে হয়, কিন্তু তাতে স্থায়ী সমাধান হয় না। কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের নিঃশর্ত তহবিলের একটি বড় অংশ রাজ্য সরকার ধরে রেখে বিদ্যুৎ বা অন্যান্য বকেয়া মেটাতে ব্যবহার করে, ফলে আর্বান লোকাল বডির আর্থিক স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়ে। তাই নারী-শিশু উন্নয়ন, সামাজিক শ্রীবৃদ্ধি দূরে থাক, তার রোজকার নাগরিক পরিষেবা দিতেই হাঁসফাঁস অবস্থা।
সব মিলিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের নগর স্থানীয় সংস্থাগুলি আজ এক দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থায়— একদিকে দ্রুত নগরায়ণ ও জনসংখ্যার চাপ, অন্যদিকে সীমিত আর্থিক ও প্রশাসনিক সামর্থ্য। নারী ও শিশুকেন্দ্রিক উন্নয়নের নীতির অভাব, অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার অভাব ও সামাজিক সুরক্ষার অভাব এই ভারসাম্যহীনতাকে আরও বাড়িয়েছে। শহরের আকাশরেখা যেমন প্রতিদিন উঁচু হচ্ছে, তেমনি তার সামাজিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে। আগামী দিনের নগর-শাসনের চ্যালেঞ্জ তাই শুধু পরিকাঠামো নয়— বরং নারী, শিশু ও সব স্তরের মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার মানবিক দিকটিও সমানভাবে গুরুত্ব পেতে হবে।
অন্যান্য আর্থিক সংকট
শহরাঞ্চলের স্থানীয় সংস্থাগুলি শুধু সাধারণ রাজস্ব ঘাটতির জন্যই নয়, আরও কিছু দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক সমস্যার জন্যও ভুগছে। এর অন্যতম কারণ হল কেন্দ্রীয় সরকারি সম্পত্তির ওপর বকেয়া সার্ভিস চার্জ এবং রাজ্য সরকারি দপ্তরগুলির কাছ থেকে আদায় না হওয়া সম্পত্তি কর (Property Tax)।
উদাহরণ হিসেবে কল্যাণী পৌরসভাকে ধরা যায়।[48] এখানে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি মেডিকেল কলেজ ও একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মতো বড় রাজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে পৌরসভা আলোকসজ্জা, বর্জ্য অপসারণ-সহ নানা পরিষেবা দেয়, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলি পৌরসভাকে কোনও কর প্রদান করে না। ফলে পৌরসভার আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়।
আরেকটি সমস্যা হল, আর্থিকভাবে দুর্বল বহু পৌরসভাকে নিজেদের তহবিল থেকে স্বাস্থ্য সাব-সেন্টার, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র (PHC) এবং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের (AWC) মতো দপ্তরনির্ভর পরিষেবার আংশিক অর্থ দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, পৌরসভা চিকিৎসক বা কর্মীদের পুরো বা আংশিক বেতন পর্যন্ত বহন করছে। এটি পঞ্চায়েতব্যবস্থার একেবারে বিপরীত ছবি, কারণ গ্রামীণ এলাকায় এসব পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির অর্থেই চলে।
এর পাশাপাশি, নাগরিক পরিষেবা ও উন্নয়নমূলক খরচের তুলনায় প্রশাসনিক ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে, ফলে বাজেট ঘাটতি আরও গভীর হচ্ছে। অনেক সময় রাজ্য সরকারকে এ-ব্যাপারেও “বেল আউট” দিয়ে পৌরসভাগুলিকে আর্থিক সহায়তা করতে হয়।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হল উচ্চতর সরকার থেকে তহবিল প্রবাহের অনিশ্চয়তা। অর্থ কখন এবং কত পরিমাণে পাওয়া যাবে, তা জানা না থাকায় পৌরসভা ও পঞ্চায়েত— দু-ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা তৈরি ও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক ফারাক হয়ে যায়, বা উন্নয়নকার্যে ব্যয় বিলম্বিত বা জটিল হয়ে পড়ে। এর ফলে স্থানীয় শাসনের কার্যকারিতা ও উন্নয়ন উভয়ই বাধাগ্রস্ত হয়। পৌরসভা কিংবা পঞ্চায়েত সত্যি সত্যি তাদের দেয় আবশ্যিক নাগরিক পরিষেবা সামলে অন্যান্য উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা করতে পারে কিনা, বা পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়িত করতে পারে কিনা এই নিয়ে সন্দেহ তাই বাড়তেই থাকে।
পঞ্চদশ অর্থ কমিশনে ‘স্বাস্থ্য’[49]
পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রথমবারের মতো গ্রামীণ ও শহুরে স্থানীয় সংস্থাগুলির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার স্বাস্থ্যখাতে নির্দিষ্ট বা “টায়েড” অনুদান বরাদ্দ করে। পশ্চিমবঙ্গও এই জাতীয় পরিকল্পনার অংশ ছিল, যেখানে জনসংখ্যা ও শহুরে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী অনুদান নির্ধারিত হয়। শহরে এর মূল উদ্দেশ্য দুটি— শহুরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির (UPHC) পরিকাঠামো শক্তিশালী করা এবং স্বাস্থ্য ও সুস্থতা কেন্দ্র (HWC) স্থাপন করা, বিশেষত শহুরে বস্তি-অঞ্চল ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের জন্য।
তবে এই অনুদান কার্যকর করতে স্থানীয় সংস্থাগুলিকে কয়েকটি পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়— নিজস্ব এলাকার “গ্যাপ অ্যানালিসিস” করা, জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে বার্ষিক ও পাঁচ বছরের মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা, এবং পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। এই সমন্বিত প্রয়াসের ধারণাই হল Convergent Community Action, যেখানে নারী ও শিশুর উন্নয়নকে যদি একটি লক্ষ্যমাত্রা ধারা যায়, তাহলে সেই দায়িত্ব কোনও বিশেষ বা আলাদা দপ্তরের নয়, বরং রাজ্য সরকারের বহু বিভাগ ও স্থানীয় সংস্থার/সরকারের যৌথ দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। এর চারটি ভিত্তি— উত্তম সমন্বয় (Coordination), উত্তম অভিসারণ (Convergence), উন্নত সম্পদ বরাদ্দ (Resource allocation), এবং কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ (Devolution)।
এই ধরনের সমন্বিত পরিকল্পনার দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি হল জেলা পরিকল্পনা কমিটি (DPC), যার আইনগত কাঠামো তৈরি হয় West Bengal District Planning Committee Act, 1994-এর মাধ্যমে। একই বছরে স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করে প্রতিটি স্তরের গ্রামীণ ও নাগরিক স্থানীয় সংস্থার (পঞ্চায়েত এবং পুর/পৌরসভা) পাঁচ বছরের মেয়াদি পরিকল্পনা (perspective plan) এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বার্ষিক পরিকল্পনা (annual plan) তৈরি বাধ্যতামূলক করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল নিচু স্তর থেকে উঠে আসা, স্থানীয় চাহিদাভিত্তিক সহভাগী বিকেন্দ্রীকৃত পরিকল্পনা প্রণয়ন। কলকাতা অঞ্চলের জন্যও Kolkata Metropolitan Planning Committee Act, 1994 চালু হয়,[50] যাতে মহানগর (কলকাতা মেট্রোপলিটান এরিয়া) এলাকার সমস্ত স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনাকে একত্রিত করা যায়। জেলা পরিকল্পনা কমিটি বা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং কমিটির কাজই ছিল জেলার সমস্ত আলাদা আলাদা পরিকল্পনাগুলি একত্রিত করে জেলার একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি করা যাতে জেলার সব গ্রাম পঞ্চায়েত, সব পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, জেলার যত পৌর ও পুরসভা বা নিগম আছে; এমনকি জেলায় খরচ হওয়া রাজ্যের বিভাগীয় দপ্তরগুলির তহবিল পর্যন্ত সেই একটি পরিকল্পনায় থাকে। বাস্তবে, জেলা পরিকল্পনা কমিটির হাতে তদারকির ক্ষমতা ও আর্থিক জোর না থাকা, নিচের স্তরের স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনার সঙ্গে ওপরের স্তরের স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা সমন্বয় না হওয়া, রাজ্য সরকারের বিভাগীয় দপ্তরগুলির স্কিম আর প্রোগ্রামভিত্তিক পরিকল্পনা ও খরচ পঞ্চায়েত বা পৌরসভাগুলির বাজেটের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত না হওয়া, পরিকল্পনা-খাতে রূপায়ণ বাবদ টাকা কবে পাওয়া যাবে নিশ্চিতভাবে না জানা, ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের স্তরভিত্তিক অ্যাক্টিভিটি ম্যাপের পাশাপাশি বিভাগীয় দপ্তরগুলি তাকে মান্যতা না দেওয়া[51] এই ভাবনাকে থমকে দিয়েছে একেবারে।
এ ছাড়াও অন্যান্য অসুবিধাগুলি এরকম— কেন্দ্রীয় জাতীয় স্তরের ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রামগুলি[52] চলে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপক সংস্থাগুলির মাধ্যমে (State, District, Block level Mission/Programme Management Units) যেখানে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা প্রায় শূন্য। শহরে একাধিক বিভাগীয় দপ্তরগুলির নিয়োজিত একাধিক এজেন্সি বিষয়ভিত্তিক আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করে,[53] একে অপরের সঙ্গে আলোচনা না করে, বা স্থানীয় সরকারকে অন্ধকারে রেখে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এখনও অনেকটাই প্রশিক্ষণের অভাব আছে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে— তাঁরা কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীল; স্থানীয় স্তরে সঠিক গুণমানের তথ্যের অভাব বড় বেশি; বিভাগীয় দপ্তরগুলি থেকে সেরকম সাহায্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। এবং ক্রমশ যত দিন যাচ্ছে বিষয়ভিত্তিক বিশেষায়ন (specialisation) এমন দিকে যাচ্ছে যে সবাই তার তার বিষয়ের জেলা পরিকল্পনার রচনাতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন— যথা জেলা স্বাস্থ্য পরিকল্পনা, জেলা পরিবহন পরিকল্পনা, জেলা জল বিভাজিকা পরিকল্পনা, জেলা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা ইত্যাদি।
এইভাবে দেখলে এই প্রত্যেকটি বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ আমাদের একটি উল্লম্ব কাঠামোর দিকেই নিয়ে যায় (vertical structure); অথচ নারী, শিশুর উন্নয়ন-স্বার্থে পরিকল্পনার চাহিদা একটি আনুভূমিক সমন্বিত (horizonal integration) দৃষ্টিভঙ্গি।
আশার কথা, এই কাঠামোকে আর একবার চেষ্টা করে পুনরুদ্ধার করতে গত ৪ জুন ২০২৫ তারিখে রাজ্য পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে একটি নতুন নির্দেশিকা জারি হয়,[54] যাতে জেলা পর্যায়ে একটি District Annual Plan তৈরির কথা বলা হয়। এতে রাজ্যের ৫৪টি বিভাগ ও ৮টি সেক্টর ধরে পরিকল্পনা প্রণয়ন হবে, যেখানে জেলার সমস্ত পঞ্চায়েত, পৌরসভা ও প্রশাসনিক দপ্তর— সবাই অংশ নেবে। আপাতত ২০২৪-২৫-এ জেলাতে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, শিল্প, পরিবেশ ও সুস্থায়ী উন্নয়ন, শিক্ষা, পরিকাঠামো, গ্রামোন্নয়ন ও সুশাসন— এই আটটি সেক্টরে আর বিভাগীয় দপ্তরগুলির সেই সেই সেক্টরে কাজের বা অবস্থার একটি হালনাগাদ, গোটা জেলার সমস্ত স্থানীয় সরকারগুলি ধরে একটি প্রোফাইলিং, এবং ২০২৫-২৬ জেলায় বিভাগীয় দপ্তরগুলি কী কী বড় কাজ নেবে, আর তার বাজেটই বা কী, সমস্ত স্থানীয় সংস্থাগুলির বাজেটই বা কী— এই নিয়ে হবে প্রতিবেদন।
খেয়াল রাখতে হবে, পঞ্চায়েত, ব্লক, জেলা বা রাজ্যস্তরে যা-ই পরিকল্পনা হোক না কেন, শুধু নারী ও শিশু উন্নয়নেই সেটি সীমাবদ্ধ থাকবে না। বাস্তবে অনেক সময় বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। তাই ভাবনাতেও সমন্বয় আনতে নারী ও শিশু উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন ও কর্মসংস্থান— সব ক্ষেত্রেই পরিকল্পনার ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। কারণ, শুধু শিশুদের জন্য স্বর্গ তৈরি করতে গিয়ে সমাজের অন্য অংশকে উপেক্ষা করা যায় না।
নারী ও শিশু উন্নয়নের প্রচলিত ধারণায়, মনে হয় তিনটি বিভাগীয় দপ্তরের কাজ এটি। নারী ও শিশু উন্নয়ন, এবং সমাজকল্যাণ বিভাগ; স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ; এবং স্কুলশিক্ষা বিভাগ। কিন্তু অন্য বিভাগগুলির কি এ ব্যাপারে কিছুই করার নেই? ২০২৫-২৬-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থ দপ্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। চাইল্ড অ্যান্ড জেন্ডার বাজেটিং রিপোর্ট ২০২৫-২৬। তাতে দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকারের অন্তত ১৮টি দপ্তর, মহিলাদের জন্য বেশ কিছু কাজের প্রস্তাবনা নিয়েছে যেগুলি ১০০ শতাংশ মহিলাদের জন্য। ৪৯টি দপ্তর এমন কিছু কাজ ধরেছে যার উপভোক্তা ৩৩ থেকে ৯৯ শতাংশ মহিলারা। আর ২৯টি দপ্তর শিশুদের জন্য কাজ করার প্রস্তাবনা দিয়েছে। টাকার অঙ্কে এগুলি, যথাক্রমে— প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা আর প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এখনও এটি আক্ষরিক অর্থে প্ল্যান-বাজেটের আকার নেয়নি। অর্থ্যাৎ নারীদের ও শিশুদের জন্য কোনও রাজ্যব্যাপী নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে এই চাইল্ড অ্যান্ড জেন্ডার বাজেটিং রিপোর্ট তৈরি হয়নি। বরং এটি সমস্ত বিভাগীয় দপ্তর যাদের নারী ও শিশুদের জন্য কিছু না কিছু প্রোগ্রাম আছে, সেই সব হিসেবের খাতগুলিকে (হেড্স অফ অ্যাকাউন্টস) একত্রিত করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে।
অতএব, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আজকের মূল বার্তা স্পষ্ট— সমন্বিত ও যুক্তিনির্ভর পরিকল্পনাই সময়ের দাবি, যেখানে বিকেন্দ্রীকরণ ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব।
তাই রাজ্যস্তরীয় একটি মেয়াদি ভাবনার অঙ্গীকার (Vision Document) এবং রাজ্যস্তরীয় একটি পরিকল্পনা যাতে নারী, শিশু উন্নয়ন হবে সমন্বিত উন্নয়ন চিন্তার একটি অধ্যায়— অর্থাৎ, উন্নয়নের অন্যান্য সব কটি বিষয়ও যেখানে বিদ্যমান থাকবে— তেমনটি কি আমরা আশা করতে পারি না?
[1] Sachs, Jefrrey D; Lafortune, Guillaume; Fuller, Grayson & Iablonovski, Guilherme. Financing Sustainable Development to 2030 and Mid-Century. Sustainable Development Report 2025. Paris: SDSN, Dublin: Dublin University Press. 2025.
[2] Sustainable Development Goal (SDG).
[3] পশ্চিমবঙ্গে নারীদের জন্য স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধিত্বের সংরক্ষণ ৫০ শতাংশ।
[4] ২০২১ – Sachs, J., Kroll, C., Lafortune, G., Fuller, G., Woelm, F. The Decade of Action for the Sustainable Development Goals: Sustainable Development Report 2021. Cambridge: Cambridge University Press. Pg 248.
২০২২ – Sachs, J., Lafortune, G., Kroll, C., Fuller, G., Woelm, F. From Crisis to Sustainable Development: the SDGs as Roadmap to 2030 and Beyond. Sustainable Development Report 2022. Cambridge: Cambridge University Press. Pg 236.
২০২৩ – Sachs, J.D., Lafortune, G., Fuller, G., Drumm, E. Implementing the SDG Stimulus. Sustainable Development Report 2023. Paris: SDSN, Dublin: Dublin University Press, 2023. Pg 274.
২০২৪ – Sachs, J.D., Lafortune, G., Fuller, G. The SDGs and the UN Summit of the Future. Sustainable Development Report 2024. Paris: SDSN, Dublin: Dublin University Press. Pg 236.
২০২৫ – Sachs, J.D., Lafortune, G., Fuller, G., Iablonovski, G. Financing Sustainable Development to 2030 and Mid-Century. Sustainable Development Report 2025. Paris: SDSN, Dublin: Dublin University Press. Pg 216.
[5] এ যাবৎ চারটি প্রতিবেদন তারা বের করেছে— SDG India Index (and Dashboard) [Baseline Report 2018 and then 2019-20, 2020-21 and 2023-24].
[6] Sustainable Development Goals – National Indicator Framework, Progress Report – 2021, 2022, 2023, 2024 and 2025.
[7] এসডিজি-২— অপুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা আর সুস্থায়ী কৃষির এসডিজি।
[8] Monthly per capita out-of-pocket expenditure on health as a share of Monthly Per capita Consumption Expenditure (MPCE).
[9] ওড়িশা, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, অসম।
[10] ন্যাশনাল ইনডিকেটর ফ্রেমওয়ার্ক থেকে বাছাই করা সূচক নিয়ে।
[11] ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২১-এর মধ্যে।
[12] CMNND – Communicable, Maternal, Neonatal and Nutritional Diseases.
[13] NCD – Non-Communicable Diseases.
[14] Sustainable Development Goals, National Indicator Framework, Progress Report, 2025, MoSPI, Government of India. Pg-73.
[15] Sustainable Development Goals, National Indicator Framework, Progress Report, 2025, MoSPI, Government of India. Pg-77.
[16] পূর্বোক্ত।
[17] পূর্বোক্ত। পৃঃ ৭৮।
[18] State Plan of Action for Children II, West Bengal.
[19] TABLE 3A.4: Offenders Relation to Victims of Rape (Section 376 IPC) – 2023, Pg 229; Chapter 3A – Crimes Against Women (States and UTs), Crime in India 2023, Vol. I, NCRB, Ministry of Home Affairs, Government of India.
[20] TABLE 4A.10 Offenders Relation to Child Victims of POCSO Act (Section 4 & 6) – 2023, Pg 372, Chapter 4A – Crimes Against Children (States and UTs), Crime in India 2023, Vol. I, NCRB, Ministry of Home Affairs, Government of India.
[21] গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে— নারী, শিশু উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ উপসমিতি, এবং শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য উপসমিতি; পঞ্চায়েত সমিতি আর জেলা পরিষদ স্তরে— শিশু ও নারী উন্নয়ন জনকল্যাণ ও ত্রাণ স্থায়ী সমিতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, তথ্য ও ক্রীড়া স্থায়ী সমিতি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ স্থায়ী সমিতি, খাদ্য ও সরবরাহ স্থায়ী সমিতি— নারী-শিশু উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে পারে।
[22] আগেই উল্লিখিত। দ্রষ্টব্য, টীকা ১৮।
[23] পঞ্চায়েত আইনের ১৬ক ধারায়।
[24] ৪৬ নং ধারায়।
[25] গ্রাম পঞ্চায়েত-এর ৪৭ ধারায়, পঞ্চায়েত সমিতি-র ১৩৩ ধারায় আর জেলা পরিষদ-এর ১৮১ ধারায়।
[26] গ্রামবাসীদের তৈরি গ্রাম-পরিকল্পনা (পরিকল্পনা আন্দোলনের কর্মীদের ব্যবহারের জন্য তিনটি দলিল)। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। জুলাই ২০০২।
[27] তাই সেই পরিকল্পনার মূল উপাদানগুলি ছিল কৃষি উন্নয়ন, শিল্পোন্নয়ন, মজুরি বৃদ্ধি, নিম্নতম মজুরি আইন চালু, মাছ চাষ, পশুপালনের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি, খাস জমি বন্টন, জমির সমতলিকরণ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের দ্বারা কৃষিতে সহায়তা, দারিদ্র দূরীকরণে সহায়তাকারী ছোট পরিকাঠামো নির্মাণ, গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ, দুর্যোগকালে সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা।
[28] একে স্বনির্ভর দলের পূর্বসুরি ভাবাই যেতে পারে।
[29] এই পরিকল্পনার পরবর্তীতেই সরকার দ্বারা আইসিডিএস চালু হওয়ার কারণে, এই কাজটি আর করা হয়নি।
[30] আজকের সিচ্যুয়েশন অ্যানালিসিস।
[31] ৩২ক ধারা। এখানেই প্রথম উপসমিতির কথা ভাবা হয়।
[32] হওয়ার কথা ছিল গোটা রাজ্যেই, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। পরে ২০০২-তে বর্ধমান জেলার ছয়টি ব্লক ‘গ্রামবাসীদের দ্বারা গ্রাম পরিকল্পনা বা GDGP’ নামে যোগ হয়।
[33] পরে যদিও নানা কারণে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
[34] পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইনের ১৬ক ধারায় গ্রাম উন্নয়ন সমিতি এবং তার বিষয়ভিত্তিক কার্যকরী সমিতির গঠন বিষয়টি এখনও বিদ্যমান। যদিও ২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে পঞ্চায়েতব্যবস্থায় এর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
[35] এই বছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের ই-গ্রাম স্বরাজ পোর্টালে গ্রাম পঞ্চায়েত প্ল্যান তোলা বাধ্যতামূলক হয়, এবং পাবলিক ডোমেইনে পরিকল্পনাগুলি পাওয়া যেতে থাকে।
[36] চতুর্দশ অর্থ কমিশনের মেয়াদ।
[37] তথ্যসূত্র: eGram Swaraj Portal, GoI.
[38] এটি আগেই ছিল; যে যে সূচক দিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থাগুলি সদস্য দেশগুলির উন্নয়ন বাৎসরিকভাবে মাপে; এবং এই তালিকাটি প্রতি বছর প্রকাশিত হয়।
[39] এটি ভারত সরকারের নীতি আয়োগ আর মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন যুগ্মভাবে প্রতি বছর ২৯ জুন প্রকাশ করে এবং বিগত বছরে দেশের অগ্রগতি মেপে থাকে।
[40] তথ্যসূত্র: Panchayat Development Index Committee Report, June 2023: Local Indicator Framework (Localisation of Sustainable Development Goals), Ministry of Panchayati Raj, Government of India Vol. I & II.
[41] এটি নির্ধারণ করা হয়েছে একাধিক এসডিজি নিয়ে একটি স্থানীয় থিম; আবার একাধিক থিমের কাজের প্রভাব একাধিক এসডিজি-তে— এমনভাবে।
[42] পরবর্তীকালে, বর্তমানে অবশ্য এই থিমভিত্তিক সূচকগুলির সংখ্যা অল্পবিস্তর কমেছে— তথ্য পাওয়া না-পাওয়ার ভিত্তিতে, বা সমন্বিত সূচক (ইন্ডেক্স) তৈরির সুবিধার্থে।
[43] তথ্যসূত্র: eGram Swaraj Portal, GoI.
[44] একটি বা দুটি লোকাল থিমে জোর দিয়ে পরিকল্পনা করার আর বার্ষিক বাজেটের নিঃশর্ত তহবিলের অন্তত ২৫ শতাংশ সেই থিমে খরচ করার সঙ্কল্প।
[45] যেমন, এ-রাজ্যে কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্কিম ফর অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস, সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প, মা ও শিশু স্বাস্থ্যের একাধিক স্কিম, এমনকি বিদ্যালয় শিক্ষা প্রভৃতি।
[46] এমন ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম পঞ্চায়েত পিছু একটি করে আছে।
[47] রাজ্যের প্রথম অর্থ কমিশনেরও এমন সুপারিশ ছিল।
[48] সূত্র: রাজ্যের চতুর্থ অর্থ কমিশনের প্রতিবেদন।
[49] IMPLEMENTATION OF 15TH FINANCE COMMISSION (FC-XV) – HEALTH GRANTS THROUGH LOCAL GOVERNMENTS, Ministry of Health & family Welfare, Government of India (31.08.2021).
[50] কার্যকর হয় ২০০১ সালে।
[51] অর্থাৎ পঞ্চায়েতের বাজেটের মধ্যে দিয়ে তাদের টাকা খরচ না করা; এবং পঞ্চায়েতে সেই কাজগুলির জন্য প্রশিক্ষিত কর্মীদল বা মানবসম্পদ না দেওয়া।
[52] জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, গ্রামীণ জীবিকা মিশন, আইসিডিএস ইত্যাদি।
[53] Environment Management Plan, Housing and Habitat Plan ইত্যাদি।
[54] No. 1/15/PLNG/2025 dated 4.6.2025 on Preparation of District Annual Plan 2025-26 (Government of West Bengal).

