
স্টেশনমাস্টারের কলম
মাত্র চারশো বছর আগেও ইউরোপে নারীদের চা-পানের অধিকার ছিল না। ১৮৫৯-এর আগে অবধি স্বাধীন ত্রাভাঙ্কোর রাজ্যে নিম্নবর্গের নারীদের স্তন আবৃত রাখার অধিকার ছিল না, নারীকে নিজের দেহের উপরিভাগ বস্ত্রে আবৃত করার অনুমতি পেতে হলে ‘স্তন কর’ দিতে হত। ২০১৭-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ভোটের প্রচারে মেয়েদের প্রতি, এমনকি নিজের দলের নারীদের প্রতিও একের পর এক যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন এবং তার পরেও বিপুল ভোটে জয়ী হন। সে-দেশেই ২০২৩ সালে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী একই পদে একই কাজে পুরুষকর্মী তার নারী সহকর্মীর চেয়ে গড়ে ২৭ শতাংশ বেতন বেশি পেতেন। খোদ শহর কলকাতায় বহু চিকিৎসা-পরীক্ষাগারে ‘ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ আইনত দণ্ডনীয়’ লেখা উজ্জ্বল হোর্ডিং-এর নিচে বসে উপঢৌকনের বিনিময়ে ভ্রূণের লিঙ্গ জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘জয় শ্রীকৃষ্ণ’ বা ‘রাধে রাধে’ জাতীয় সাঙ্কেতিক শব্দে, যাতে ইচ্ছুক পরিবার কন্যাভ্রূণের গর্ভপাত করিয়ে নিয়ে পারেন। যেসব কন্যাভ্রূণ বেঁচে যায়, তাঁদের জীবনও সুরক্ষিত নয়। আমরা যদি এখনও ভুলে গিয়ে না থাকি, ২০২৪ সালে ৯ অগাস্ট রাতে কলকাতারই একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরতা চিকিৎসক হাসপাতালেরই বিশ্রামকক্ষে ধর্ষিতা ও খুন হন। প্রসঙ্গত, আরজিকর-ধর্ষণের পরের কয়েক মাসে আমাদের রাজ্যেই বহু নারীর শ্লীলতাহানি ঘটেছে, যা আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণিবলয়কে আর ততখানি উত্তেজিত করতে পারেনি।
মানবসভ্যতার ইতিহাস এক স্তরে নারীর অধিকার আন্দোলনের চলমান ইতিহাস। আদিম কৌম সমাজে শিকারি-সংগ্রাহক মানবগোষ্ঠীতে পুরুষ ও নারী সহযোদ্ধা হিসেবেই শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন, একসঙ্গে শিকারকে আক্রমণ করতেন, মাংস-ফল-মূল-কন্দ জোগাড় করে দিনশেষে ডেরায় ফিরতেন। আহরিত আহার্য পুরো গোষ্ঠীর প্রয়োজন অনুযায়ী সকলের মধ্যে ভাগ হত। ঠিক যে-সময় সমাজ সাধারণ কৌম সম্পত্তির থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির দিকে যাত্রা শুরু করল, ব্যক্তিগত সম্পত্তির হাত ধরে এল বংশ ও উত্তরাধিকার, ঠিক সেইসময় নারীর ভূমিকায় এক বিরাট বদল ঘটল। শিকার-সংগ্রহ, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রতিরক্ষা— অর্থাৎ বাহির সামলানোর দায়িত্ব নিল পুরুষ। ঘরসংসার অর্থাৎ সম্পদ ও উত্তরাধিকারীর লালনপালনের ভার পড়ল নারীর ওপর। ভূমিকার রদবদলে ঘরের কোণে আবদ্ধ হল আদিম নারী, তার শ্রমের চরিত্র বদলে গেল। নারীকে গৃহকোণে ঠেলে দিয়ে তাকে ক্ষমতাহীন করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া আদিম সময় থেকে শুরু হয়েছিল, হাজার হাজার বছর পেরিয়ে আজও তা জারি আছে। সেই আবদ্ধ জায়গা থেকে বের করে নিয়ে এসে নারীর পুনর্ক্ষমতায়ণ শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক শতক আগে। নারীর সম্মান, সুরক্ষা ও স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম আজ এতখানি ব্যাপক ও সর্বত্রগামী যে তাকে বছরের একটি মাত্র দিনের আধারে ধারণ করা সম্ভব নয়। এই সংগ্রাম প্রতিটি মুহূর্তের। ভারতবর্ষের মতো দরিদ্র ও অসাম্যপীড়িত দেশে এ লড়াই আরও কঠিন। কন্যাভ্রূণের বাঁচার অধিকার, বেড়ে ওঠার প্রতিটি ক্ষেত্রে শিশুপুত্র ও শিশুকন্যার প্রতি সমব্যবহার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি প্রতিটি ক্ষেত্রে পুত্র ও কন্যার সমতা সুনিশ্চিত করা, ঘর ও বাহির— প্রতিক্ষেত্রে লিঙ্গসাম্যের ধারণার বিকাশ, বিদ্যালয়ে ও পরবর্তীকালে কর্মস্থলে মেয়েদের জন্য আলাদা ও পরিষ্কার শৌচাগারের বন্দোবস্ত, কর্মক্ষেত্রে সমকাজে সমবেতন, কাজের জায়গায় ও পথেঘাটে সুরক্ষা, যৌন হেনস্থার প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা, মেয়েদের জৈব-শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলি মাথায় রেখে তাদের সুযোগসুবিধা প্রদান, যেমন— মাতৃকালীন সবেতন দীর্ঘ ছুটি, কড়া হাতে গৃহহিংসা দমন, সম্পত্তি আইনের সুসংস্কার, নারীর প্রয়োজনে সহজ ও সুলভ আইনি সাহায্য, প্রান্তিক ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমজীবী নারীদের শ্রম-অধিকারগুলির পর্যালোচনা, গৃহশ্রমের স্বীকৃতি— নারী অধিকার আন্দোলনের অভিমুখ সর্বত্রগামী ও বহুস্তরীয়। আমাদের দেশের প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি রান্নাঘরই এই লড়াইয়ের গ্রাউন্ড জিরো। গুরুদায়িত্ব প্রত্যেক পুরুষেরও, নিজেদের চেতনার মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লালন করা পুরুষতান্ত্রিকতার আগাছাগুলি খুঁজে বার করে তা নির্মূল করাই তাদের প্রথম কাজ।
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদিবসের এই সার্বিক দ্যোতনার কথা মনে রেখে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম এবারের সংখ্যায় বেছে নিয়েছে কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী নারীর সঙ্কট ও সুরক্ষার প্রশ্নটি। বলাই বাহুল্য, আলোচনার লক্ষ্মণরেখা ছাড়িয়ে কথার পিঠে চড়ে কথা পৌঁছে গেছে বহুদূর। সময় নষ্ট না করে শোনা যাক সেসব কথা। এই সংখ্যায় লিখেছেন যশোধরা রায়চৌধুরী, স্বাতী ভট্টাচার্য, প্রতিভা সরকার, মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়, আইরিন শবনম, চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা ঘোষ, ডালিয়া দত্ত, পৃথা তা এবং দেবাশিস মিথিয়া। এবং এর সঙ্গে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছি রত্না সুদুর্শন ও মালা খুল্লার-এর একটি নিবন্ধের সারাৎসার, লেখকদ্বয়ের অনুমতিক্রমে, যা তাঁরা লিখেছিলেন ভারতের প্রেক্ষিতে ২০২৩-এ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ক্লডিয়া গোল্ডিন-এর শিক্ষা-বিষয়ে। আমাদের সমস্ত লেখকদের মতো তাঁদের কাছেও আমরা ঋণী। আশা করি, লেখাগুলি বছরের একটিমাত্র দিনের বাণিজ্যিক উদযাপনের বাইরে বেরিয়ে নারী অধিকার নিয়ে পাঠিকা ও পাঠককে কিঞ্চিৎ ভাবাবে।
এছাড়া এর মধ্যে আমাদের ছেড়ে গেছেন গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়, টেবিল টেনিস প্রশিক্ষক ভারতী ঘোষ এবং দাবাড়ু বরিস স্প্যাসকি। আমরা এই সংখ্যায় বিনম্র চিত্তে স্মরণ করলাম তাঁদের। স্মরণলেখগুলি লিখেছেন যথাক্রমে শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, মান্তু ঘোষ এবং প্রবুদ্ধ ঘোষ। আর সঙ্গে গল্প কবিতা প্রবন্ধ অন্যগদ্য সবুজ স্লিপার-সহ সমস্ত নিয়মিত বিভাগগুলি রইল যথারীতি।
ভাল থাকবেন। পড়বেন। জানাবেন।
অলমিতি…