সঞ্জয় পান্ডে
উত্তরপ্রদেশ সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত উন্নত মানের কর্মসংস্থান, দক্ষতা–উন্নয়ন, শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো— যাতে মানুষ নিজেদের স্থানেই কাজের সুযোগ পান এবং অভিবাসনের প্রয়োজন কমে আসে। কিন্তু সরকারের অগ্রাধিকার এখনও মূলত ইউপিকে একটি আধ্যাত্মিক পর্যটন কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলাতেই কেন্দ্রীভূত। সেই কারণেই মহাকুম্ভ ও দীপোৎসবের মতো অনুষ্ঠানগুলোকে রাজ্য-পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে
উত্তরপ্রদেশে দীপোৎসবের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে, যখন কেবল ১.৭১ লাখ প্রদীপ জ্বালানো হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর এই আয়োজন আরও বৃহৎ ও ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠেছে, এবং ২০২৫ সালে এর সংখ্যা বেড়ে ২৬.১৭ লাখে পৌঁছেছে। অযোধ্যায় এ বছরের দীপোৎসব ২০২৫-এ সরযু নদীর ঘাট ও তীরে প্রায় ২৬,১৭,২১৫টি প্রদীপ একসঙ্গে জ্বালিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়া হয়েছে। এই আয়োজনটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াধীন। এই উপলক্ষে ২,১২৮ জন ভক্ত একসঙ্গে আরতি ও প্রদীপ প্রজ্বলনের সমান্তরাল অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন, যা আরেকটি রেকর্ড হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রায় ৩৩,০০০ স্বেচ্ছাসেবক এবং হাজার হাজার ভক্ত অংশ নেন।
বিজেপি সরকারের মতে, দীপোৎসবের উদ্দেশ্য অযোধ্যাকে একটি বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় পর্যটনস্থলরূপে উপস্থাপন করা। ড্রোন শো, লেজার লাইটিং, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও প্রযুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে “নব-অযোধ্যা”, “ধর্মীয় পর্যটন” এবং “সংস্কৃতি-উন্নয়ন”-এর প্রতীক হিসেবে অযোধ্যার ব্র্যান্ডিং করে স্থানীয় অর্থনীতি ও সেবা-ক্ষেত্রকে লাভবান করার দাবি করা হচ্ছে। এর মধ্যে পর্যটন উদ্যোগ, হোটেল-আবাসন, স্থানীয় সেবা-উদ্যোগকে শক্তি দেওয়া, অযোধ্যায় রিয়েল এস্টেটের মূল্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়া, কুম্ভার পরিবার ও হস্তশিল্প-কারিগরদের কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস পাওয়ার দাবিও অন্তর্ভুক্ত আছে।
কিন্তু এই একই মুদ্রার অন্য পাশও আছে। সমালোচনাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার জন্য অযোধ্যার দীপোৎসব সম্পর্কিত গত বহু বছর ধরে যেসব বাজেট-বরাদ্দ বা ব্যয়ের তথ্য রয়েছে, সেগুলির সম্পূর্ণ বা বছর-পর্যায়ের স্পষ্ট ও বিস্তৃত পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে উপস্থাপিত হয়নি। তাহলে কি উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে এই ক্ষেত্রের অর্জন সত্যিই প্রশংসনীয়? করদাতাদের টাকায় এবং সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত এমন আয়োজনগুলো প্রচার করলে উত্তরপ্রদেশের সমস্যাগুলো মিটে যাবে? এ-ধরনের প্রশ্ন উঠছে। এই অদ্ভুত রেকর্ডগুলো দিয়ে উত্তরপ্রদেশ কী করবে? এই অনুষ্ঠানগুলিতে কত ব্যয় হচ্ছে এবং অযোধ্যা শহরকে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা কি গোটা উত্তরপ্রদেশকেও হচ্ছে— এরকম অনেক প্রশ্ন অনুত্তরিত রয়ে গেছে।
একদিকে এই ধরনের অনুষ্ঠানে অগণিত ব্যয় করে কোনও রেকর্ড গড়া এবং নিজের প্রকৃত অবস্থার মুখ ঢেকে রাখা নিজেই এক ধরনের বৈপরীত্য। উত্তরপ্রদেশ এমন একটি রাজ্য, যা তার বিশাল সক্ষমতার বিপরীতে দারিদ্র্য, নিম্ন সাক্ষরতা, খারাপ স্বাস্থ্য এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে পিছিয়ে আছে। এটি শুধু ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় নয়, বরং বিশ্বব্যাপী অনেক উন্নয়নশীল দেশেরও পিছনে। এমন পরিস্থিতিতে বাজেট ও সম্পদের বড় অংশ এই ধরনের অনুষ্ঠানে ব্যয় হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় উন্নয়নের মতো মৌলিক ক্ষেত্রগুলিতে মনোযোগ কমে যেতে পারে। “রেকর্ড গড়া”-র প্রবণতা যেন কখনও উন্নয়নের অগ্রাধিকারকে পশ্চাৎপটে ফেলে না দেয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
উত্তরপ্রদেশ (ইউপি), ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য, তার বিশাল জনসংখ্যা (প্রায় ২৪ কোটি)-র কারণে বৈশ্বিকভাবে পাকিস্তান বা ব্রাজিলের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সূচকে এটি ভারত এবং বিশ্বের অন্যতম পশ্চাৎবিত্ত অঞ্চল হিসেবে গণ্য। নীতি আয়োগ, রঘুরাম রাজন কমিটি (২০১৩) ও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইউপি BIMARU (বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ) গোষ্ঠীর অংশ, যা ভারতের সামগ্রিক উন্নয়নকে পিছিয়ে দেয়। কিছু সূচকে ইউপির অবস্থান উপ-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলির (যেমন মালি) সঙ্গেও তুলনীয় বা আরও খারাপ। ২০২৫ পর্যন্ত সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান[1] কিছু উন্নতি দেখালেও, ইউপি এখনও বহু ক্ষেত্রে নিম্নস্তরে অবস্থান করছে। নিচে সেই প্রধান ক্ষেত্রগুলির বিশ্লেষণ করা হল, যেখানে উত্তরপ্রদেশ পিছিয়ে আছে, এবং যেসব কারণ দীর্ঘদিন ধরে সরকারের নজর এড়িয়ে গেছে।
দারিদ্র্য ও বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের (MPI) পর্যালোচনায় দেখা যায়, উত্তরপ্রদেশে ২২-২৫ শতাংশ জনসংখ্যা (প্রায় ৫ কোটি মানুষ) বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে বসবাস করে। এতে পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছতা-সহ মৌলিক ক্ষেত্রগুলি অন্তর্ভুক্ত। নীতি আয়োগের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইউপি ভারতে বিহার (৩৩ শতাংশ) ও ঝাড়খণ্ড (২৮ শতাংশ)-এর পরে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক MPI-তে ইউপি নিচের ২০ শতাংশ রাজ্যের মধ্যে পড়ে, যা এটিকে মালি ($২,২৪৬ PPP)-র মতো দেশের কাছাকাছি নিয়ে আসে। গ্রামীণ অঞ্চলে পরিস্থিতি আরও খারাপ, যেখানে পরিষ্কার পানীয় জল ও বিদ্যুৎ পর্যন্ত খুবই সীমিত মানুষ ব্যবহারের সুযোগ পান।
২০২৪ সালে ইউপির মাথাপিছু আয় ₹৯৩,৪২২ (NSDP), যা জাতীয় গড় ₹১.৭ লক্ষের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কম। এটি ভারতের নিচের দিকের পাঁচ রাজ্যের[2] মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ক্রয়ক্ষমতা সমতায় (PPP) এই আয় ২,২৫২ মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিকভাবে নিম্ন-আয়ের দেশগুলির সমতুল্য। ২০১২ সাল থেকে আয় দ্বিগুণ হলেও বৃদ্ধির হার অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ধীর, ফলে ইউপি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে।
রাজ্যের সাক্ষরতার হার ৬৭.৭ শতাংশ, গ্রামীণ অঞ্চলে যা ৬০ শতাংশেরও নিচে। এটি ভারতের নিচের ১০ রাজ্যের মধ্যে পড়ে, যেখানে জাতীয় গড় ৭৪ শতাংশ। বিশেষত নারী-সাক্ষরতায় ইউপি ২৮তম স্থানে, যা BIMARU রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। শিক্ষার মানও নিচু, এবং স্কুল ড্রপআউট হার (বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে) জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি।
উত্তরপ্রদেশে শিশুমৃত্যু হার (IMR) প্রতি ১,০০০ জীবিত জন্মে ৬৪ এবং মাতৃমৃত্যু হার (MMR) প্রতি লক্ষ জন্মে ১৬৭। এটি ভারতে সবচেয়ে খারাপ IMR–এর মধ্যে এবং তৃতীয়-খারাপ MMR–এর (বিহার ও আসামের পরে) তালিকায় রয়েছে। এই সংখ্যাগুলি অনেক আফ্রিকান দেশের (যেমন মালি, চাদ) তুলনাতেও খারাপ। NFHS-৫ (২০১৯–২১) অনুযায়ী, টিকাদান ও পুষ্টিহীনতা গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও গভীর সমস্যা। উপরন্তু, কোভিড-১৯ সময়কালে ইউপিতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১,৭৪৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে, যা রাজ্যের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা নির্দেশ করে।
ইউপিতে বেকারত্বের হার ৭–৮ শতাংশ (NSSO ২০২৩), যা জাতীয় গড় ৬ শতাংশের তুলনায় বেশি। প্রায় ৫০ লক্ষ শ্রমিক কর্মসংস্থানের জন্য অন্যান্য রাজ্যে (মহারাষ্ট্র, গুজরাত, দিল্লি) অভিবাসন করেন। BIMARU রাজ্যগুলি ভারতের ৪৫ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করলেও, জাতীয় GDP–তে এদের অবদান মাত্র ৮–৯ শতাংশ। ইউপির অর্থনীতি প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষিনির্ভর, কিন্তু কম উৎপাদনশীলতা ও বন্যা-খরার মতো সমস্যাগুলি এই ভিত্তিকে আরও দুর্বল করে তুলেছে।
উত্তরপ্রদেশে অবকাঠামো, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায়, অত্যন্ত দুর্বল। বৈশ্বিকভাবে মুক্তস্থানে শৌচের মোট ৬০ শতাংশ ঘটনার স্থান ভারত, এবং এর বড় অংশই উত্তরপ্রদেশে ঘটে। স্বচ্ছ ভারত মিশন–এর পরও গ্রামীণ স্বচ্ছতায় অগ্রগতি ধীর। রাজ্যের সড়ক ঘনত্ব জাতীয় গড়ের তুলনায় কম, এবং দেশের ১০১টি আকাঙ্ক্ষী জেলার মধ্যে ৬টি (শ্রাবস্তি, বলরামপুর, সিদ্ধার্থনগর, চন্দৌলি, ফতেহপুর ও বহরাইচ) উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত। বিশেষত পূর্বাঞ্চলীয় উত্তরপ্রদেশ আরও পিছিয়ে আছে।
গঙ্গা নদীর দূষণও অত্যন্ত উচ্চস্তরে, এবং গঙ্গা পরিষ্কার প্রকল্প কার্যত ব্যর্থ বলা যায়। কৃষি— যা প্রায় ৭০ শতাংশ জনসংখ্যার আয়ের উৎস— কম উৎপাদনশীলতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমাগত সংকটে পড়ছে। প্রতি হেক্টরে ফলন জাতীয় গড়ের তুলনায় কম, এবং বন্যা-খরার পুনরাবৃত্ত ক্ষতি রাজ্যের অর্থনীতিকে প্রতি বছর দুর্বল করে তুলছে। এই সব কারণ উত্তরপ্রদেশকে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে গভীর ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশে অপরাধের হার, বিশেষত পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা (২০১৪ সালে ৩৬৫), ভারতের মধ্যে সর্বাধিক। জাতি ও ধর্মীয় সংঘাতও এখানে নিত্যনৈমিত্তিক। NCRB ও NHRC–র তথ্য অনুসারে, ইউপির ৭৫টি জেলায় শাসন ও উন্নয়নের বণ্টন অত্যন্ত অসম। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
সব বিজেপি ও RSS নেতার মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রতি তীব্র ঘৃণার মনোভাব লক্ষ করা যায়। কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত রাজ্য কেরলের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশকে কোনও দিক থেকেই তুলনা করা যায় না। কেরল সরকার জননিরাপত্তা ও সামাজিক সেবাকে গুরুত্ব দেয়— এটাই কেরলের অগ্রগতির প্রধান কারণগুলির একটি। ২০২২ সালের UNDP–র উপ–জাতীয় তথ্য অনুযায়ী, কেরলের মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) ০.৭৫৮, যা ভারতীয় রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং “উচ্চ মানব-উন্নয়ন” শ্রেণিভুক্ত। অপরদিকে, উত্তরপ্রদেশের HDI ০.৬০৯ (৩৬টি রাজ্যের মধ্যে ৩৪তম), যা “মাঝারি মানব উন্নয়ন” শ্রেণিতে পড়ে। উভয় রাজ্যের HDI–তে ০.১৪৯-এর পার্থক্য একটি সুস্পষ্ট বৈষম্য নির্দেশ করে।
কেরলে উত্তরপ্রদেশের দীপোৎসবের মতো কোনও বিশ্বরেকর্ড নেই। তবু দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো কেরলও স্পষ্টভাবে উত্তরপ্রদেশের তুলনায় অনেক উন্নত পারফরম্যান্স করছে, কারণ এর HDI স্কোর ও উপ-উপাদানগুলো উত্তরপ্রদেশের তুলনায় যথেষ্ট উচ্চ। কেরলের পারফরমেন্স রাজ্যকে বৈশ্বিকভাবে মধ্য-আয়ের দেশগুলির (যেমন মেক্সিকো বা চিন) সমতুল্য অবস্থানে তুলে এনেছে, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের পারফরমেন্স দক্ষিণ এশিয়ার নিম্ন ও মধ্য-উন্নয়ন স্তরের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
কেরল ও উত্তরপ্রদেশের মধ্যে এই ব্যবধানের পেছনে নীতিগত অগ্রাধিকার, সম্পদ বণ্টন এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি পার্থক্য রয়েছে। কেরলের গড় জীবন-প্রত্যাশা ৭৩.৪৩ বছর, যা উত্তরপ্রদেশের তুলনায় প্রায় আট বছর বেশি। এর অন্যতম কারণ ১৯৭০-এর দশক থেকে কেরলে গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ধারাবাহিক বিনিয়োগ— প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, উচ্চ টিকাদান হার এবং মাতৃ-শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি। উত্তরপ্রদেশ, তার বিশাল জনসংখ্যা (২৪ কোটিরও বেশি) ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কারণে, কুপুষ্টি, গ্রামীণ এলাকায় দুর্বল স্বচ্ছতা এবং অসম স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। এর ফলেই শিশুমৃত্যু হার বেশি এবং গড় আয়ু তুলনামূলকভাবে কম।
কেরলের সাক্ষরতার হার ৯৬ শতাংশেরও বেশি, এবং এর গণশিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। বিনামূল্যের মধ্যাহ্নভোজ কর্মসূচি ও লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতিগুলি বিশেষত মেয়েদের নামভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে, যার ফলে গড় ও প্রত্যাশিত শিক্ষাবর্ষ দুটোই বেশি। বিপরীতে, উত্তরপ্রদেশে গ্রামীণ অঞ্চলে নামভুক্তির ঘাটতি (বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে), শিক্ষকের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে শিক্ষাগত অর্জন কেরলের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
উভয় রাজ্যের মাথাপিছু আয় শিল্পায়িত রাজ্যগুলির (যেমন মহারাষ্ট্র) তুলনায় কম, কিন্তু কেরল তার বৈশ্বিক প্রবাসী শ্রমশক্তির (বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলিতে) প্রেরিত রেমিট্যান্স এবং পর্যটন খাত থেকে উল্লেখযোগ্য সুবিধা পায়। তদুপরি, কেরলে আয়ের বণ্টন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সমান। অপরদিকে, উত্তরপ্রদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি ও অসংগঠিত শ্রমের উপর নির্ভরশীল, যেখানে দারিদ্র্যের হার (প্রায় ৩০ শতাংশ, কেরলের ০.৫ শতাংশের তুলনায়) এবং অসমতা দুটোই বেশি।
কেরল মডেল সামাজিক কল্যাণকেন্দ্রিক উন্নয়ন কৌশলের এক উজ্জ্বল উদাহরণ, যা তীব্র শিল্পায়ন ছাড়াও মানবসম্পদে ধারাবাহিক বিনিয়োগ, অসমতা হ্রাস এবং সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা গঠনের মাধ্যমে সফল হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কিছু অগ্রগতি করেছে— যেমন আয়ুষ্মান ভারত-সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচির মাধ্যমে— তবে তার বিশাল জনসংখ্যা ও সীমিত সম্পদের কারণে এই প্রচেষ্টা এখনও বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়ন করা কঠিন।
২০২৩ সালে ভারতের জাতীয় HDI ০.৬৮৫–এ পৌঁছেছে; কিন্তু কেরল ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলির মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট করে দেয় যে পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতে লক্ষ্যভিত্তিক নীতি ও সংস্কারের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার— উভয় রাজ্যেই ‘ট্রিপল ইঞ্জিন সরকার’ থাকলেও— এই দুই রাজ্যই কর্মসংস্থানের জন্য গণ-নিষ্ক্রমণের ক্ষেত্রে (migrant-sending) ভারতের মধ্যে শীর্ষ দুটি রাজ্যের অন্যতম। গ্রামীণ এলাকা ও কম-বিকশিত জেলাগুলিতে স্থায়ী ও মানসম্মত কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে অন্য রাজ্য বা মহানগরে চলে যাচ্ছেন। ইউপির অধিকাংশ শ্রমিক অর্ধদক্ষ বা অদক্ষ শ্রেণির, ফলে তাঁদের আয়ও অনিশ্চিত ও অস্থির। পরিবারের দায়ভার, সীমিত স্থানীয় সুযোগ এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না পাওয়ার আশঙ্কা— এই সব কারণেই লক্ষ লক্ষ মানুষ গত দুই দশকে উপসাগরীয় দেশগুলিতে কাজের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন। যদি রাজ্যের ভিতরে পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হত, তাহলে এত বড় সংখ্যক মানুষ বিদেশমুখী হতেন না। তাঁদের মধ্যে অনেকে উচ্চশিক্ষিত, প্রতিভাবান তরুণ— যাঁরা দক্ষতা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশে নিজেদের জন্য ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন না। এই নিষ্ক্রমণের প্রবণতা সমাজে সুযোগের অসমতা, অপ্রতুল সম্পদবণ্টন এবং অমসৃণ উন্নয়নের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত— যা নীতি–সংস্কারের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।
এমন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত “উন্নত মানের কর্মসংস্থান, দক্ষতা–উন্নয়ন, শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ” বাড়ানো— যাতে মানুষ নিজেদের স্থানেই কাজের সুযোগ পান এবং অভিবাসনের প্রয়োজন কমে আসে। কিন্তু সরকারের অগ্রাধিকার এখনও মূলত ইউপিকে একটি আধ্যাত্মিক পর্যটন কেন্দ্ররূপে গড়ে তোলাতেই কেন্দ্রীভূত। সেই কারণেই মহাকুম্ভ ও দীপোৎসবের মতো অনুষ্ঠানগুলোকে রাজ্য-পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়— এই দিকনির্দেশেই কি উত্তরপ্রদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে? আপাতত দীপোৎসবের মতো বিশ্বরেকর্ডের উল্লাসে ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার আনন্দে মেতে থাকুন।
[1] NITI Aayog MPI ২০২৩, RBI ২০২৪।
[2] বিহার, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড, মণিপুর ও উত্তরপ্রদেশ।

