মহেশ রাউত
টিআইএসএস প্রাক্তনী মহেশ রাউত একজন অধিকারকর্মী। তিনি মূলত আদিবাসী এবং প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে কাজ করতেন। তাঁর কাজের মূল এলাকা ছিল মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলি। কুখ্যাত ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় মহেশ ২০১৮-র জুনে গ্রেপ্তার হন এবং এখনও জামিন পাননি। এই মামলায় তিনি কনিষ্ঠতম অভিযুক্ত। বর্তমান নিবন্ধটি আউটলুক পত্রিকায় গত ১৭ মে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।
মহারাষ্ট্রের নবি মুম্বইয়ের খারঘরে অবস্থিত তালোজা কেন্দ্রীয় কারাগারে মূলত মুম্বই মহানগর এলাকার বিভিন্ন আদালতের (যেমন মুম্বই, থানে, কল্যাণ, পনভেল ও বেলাপুর আদালত) অধিক্ষেত্রভুক্ত বিচারাধীন পুরুষ বন্দিদের রাখা হয়। ভারতের বহু কারাগারের মতোই তালোজাও মারাত্মকভাবে অতিরিক্ত ভিড়াক্রান্ত— এর অনুমোদিত ধারণক্ষমতার প্রায় তিনগুণ বন্দি এখানে ঠাসাঠাসি করে থাকে। তালোজার বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আমি ‘ইয়ার্ড ০৩’-এ (যা ‘বাবা ব্যারাক’ নামে পরিচিত) আবদ্ধ ছিলাম— এখানে ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সি পুরুষ বন্দিদের জন্য পৃথক ব্যারাক রয়েছে। এখানকার তরুণ বন্দিদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে দেখে আমার কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। সে-কারণেই তাদের কারাবাসের পেছনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে আমি অনুসন্ধিৎসু হয়েছিলাম। এদের অনেকেই আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবার থেকে এসেছে— আইনি সাহায্যের খরচ বহন করতে অক্ষম, কিংবা দীর্ঘদিন তাদের আদালতে হাজিরও করানো হয় না। যাঁরা কোনওভাবে আইনজীবী নিয়োগ করতেও পারেন, প্রায়শই সে-জন্য তাদের বড়সড় আর্থিক ত্যাগস্বীকার করতে হয়। এমনও দেখা গেছে, টাকা পাওয়ার পর কিছু আইনজীবী আর যোগাযোগ রাখেন না, ফলে বন্দিদের পরিবার আদালতে মামলার অগ্রগতির খবর থেকেও সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকে।
তালোজা কারাগারে বিচারাধীন বন্দি অবস্থায় আমার পরিচালিত এই গবেষণায় তথাকথিত আইনি ‘সংস্কার’-এর ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়েছে, বিশেষ করে ২০১২ সালের শিশুদের যৌন অপরাধ থেকে সুরক্ষা আইন (POCSO আইন)-এর প্রয়োগকে কেন্দ্র করে। সমীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং সহবন্দিদের বয়ান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মাধ্যমে POCSO আইনের বাস্তব প্রয়োগের প্রভাব উন্মোচিত হয়েছে। গবেষণার ফলাফল দেখায়, সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত শ্রেণি, জাত, লিঙ্গ ও ধর্মগত বৈষম্যের প্রেক্ষিতে এই আইন প্রায়শই প্রতিশোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে যে শোষণমূলক ও পশ্চাদমুখী সামাজিক কাঠামো ভাঙার উদ্দেশ্যে আইনটি প্রণীত হয়েছিল, এর প্রয়োগ বাস্তবে সেগুলিকেই আরও শক্তিশালী করছে।
আনুষ্ঠানিক সমতা ও প্রকৃত (বাস্তবিক) সমতার মধ্যে থাকা গভীর ফাঁক এই গবেষণায় ধরা পড়েছে, যে সমতা আজও বহু প্রান্তিক সম্প্রদায়ের নাগালের বাইরে। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ও বৈষম্যের কাঠামো ভাঙতে আইনি প্রক্রিয়াগুলির ব্যর্থতা প্রমাণ করে দেয়— প্রকৃত ন্যায় ও সাম্যের পথে এখনও কত বাধা অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। POCSO আইনের প্রয়োগ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণায় দেখা গেছে, আইনগত সংস্কারের যে আদর্শ প্রচারিত হয়, বাস্তব জীবনের প্রয়োগে তা কতটা বিপরীত এবং আমাদের চরম বৈষম্য-নির্ভর সমাজে তার কার্যকারিতা কতটা সীমিত।
বাবা ব্যারাকের ভিতর
স্থানীয় ভাষা ও আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমার পরিচিতির কারণে সহবন্দিরা প্রায়ই চার্জশিট পড়তে বা আবেদনপত্র খসড়া করতে আমার সাহায্য চাইত। এই যোগাযোগ আমাকে বন্দিদের বাস্তব জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য নিতে সাহায্য করেছে— বিশেষত ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সি সেইসব বিচারাধীন বন্দিদের, যারা POCSO আইনের অধীনে অভিযুক্ত। এই অভিজ্ঞতাগুলিই আমাকে বিষয়টি নিয়ে আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের দিকে নিয়ে যায়।
তালোজায় বিচারাধীন বন্দি হিসেবে গবেষণা চালানো সহজ ছিল না— চলাফেরা ও তথ্য সংগ্রহে নানা বিধিনিষেধ ছিল। অধিকাংশ চার্জশিট অভিযুক্তদের পরিবার বা আইনজীবীর কাছেই থাকত, ফলে আমি তথ্য সংগ্রহ করেছি শুধুমাত্র সেইসব চার্জশিট থেকে যেগুলো আমার নাগালের মধ্যে ছিল।
গবেষণাটি মূলত ‘ইয়ার্ড ০৩’-কে কেন্দ্র করে করা হয়েছিল, যেখানে মোট ৫৭৩ জন বন্দি ছিল; তাদের মধ্যে ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সি বন্দির সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। তথ্য সংগ্রহ তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়—
নমুনা A (মোট নমুনা): ৫৭৩ জন বন্দিকেই অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্রাথমিক সমীক্ষা, যেখানে অপরাধের ধরন, কারাবাসের মেয়াদ, সামাজিক পরিচয় এবং মামলার অবস্থা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
নমুনা B: ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সি ১৭৯ জন বন্দির মধ্যে থেকে যথেচ্ছভাবে নির্বাচিত ৮৮ জনের সঙ্গে গঠনমূলক ও খোলামেলা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়; এতে তাঁদের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, মামলার বিবরণ ও কারাজীবনের অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নমুনা C: মোট নমুনা থেকে ৯০টি POCSO মামলার তথ্য সংগ্রহ করা হয়— যার মধ্যে মামলার বিবরণ, সামাজিক অবস্থান এবং মামলার বর্তমান অবস্থা সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সমীক্ষা (নমুনা A) চলাকালীন দেখা যায়, মোট বন্দিদের মধ্যে একশোরও বেশি ব্যক্তি POCSO আইনের অধীনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফলে মোট নমুনা থেকে বিশেষভাবে POCSO-অভিযুক্ত বন্দিদের উপর আরও বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। নমুনা C-র তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে গঠনমূলক সাক্ষাৎকার, দলগত আলোচনার সেশন এবং চার্জশিট বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
সমীক্ষার ফলাফল
বহু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এই সমীক্ষার ফলাফল নিজেই একটি স্বতন্ত্র কেস স্টাডি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নানাবিধ সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে সমীক্ষা সম্পূর্ণ করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে— ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার শেষে পাওয়া প্রধান কয়েকটি ফলাফল নিম্নরূপ:
বিচারাধীন বন্দিদের পরিসংখ্যান
মোট ৫৭৩ জন বন্দির মধ্যে ৯৪ শতাংশই বিচারাধীন বন্দি। এই পরিসংখ্যান গোটা ভারতের প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ— ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া ২০২২ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ বন্দিই বিচারাধীন। মহারাষ্ট্রে এই হার আরও বেশি— রাজ্যের মোট কারাবন্দিদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই বিচারাধীন।
১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সি বন্দিদের বিবরণ
প্রায় ৪২ শতাংশ বন্দির বয়স ছিল ১৮ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে, গড় বয়স ২১.১ বছর। সম্পূর্ণ নমুনার গড় বয়স ছিল ২৭ বছর।
নমুনা B-র মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ বন্দি ১৪ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই কাজ শুরু করেছিল, আর ৭৭ শতাংশ ১৮ বছর হওয়ার আগেই জীবিকানির্বাহে যুক্ত হয়েছিল। তাদের শিক্ষার স্তরও অত্যন্ত নিম্ন— ৭৮ শতাংশ দশম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়নি এবং মাত্র ০.১ শতাংশ উচ্চশিক্ষা নিচ্ছিল বা সম্পন্ন করেছিল।
নমুনা B-র পরিবারের গড় সদস্যসংখ্যা ছিল ৫.৩ জন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দি এক বা উভয় অভিভাবককে হারিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৪৫ শতাংশের পরিবারের মাসিক আয় ছিল ২০,০০০ টাকার নিচে।
অপরাধের বণ্টন
মোট নমুনার মধ্যে হত্যার হার ছিল ২৪.৯ শতাংশ, এবং নমুনা B-তে ১৫ শতাংশ। POCSO-অভিযুক্ত অপরাধ মোট নমুনার ১৭.৫ শতাংশ এবং নমুনা B-তে ১৯.৬ শতাংশ। ডাকাতি/ডাকাতির চেষ্টা মোট নমুনার ১১.৪ শতাংশ এবং নমুনা B-তে ১৭.৭ শতাংশ। হত্যা-চেষ্টার হার মোট নমুনার ১০.৯ শতাংশ এবং নমুনা B-তে ১৮.২৫ শতাংশ। চুরি-সম্পর্কিত অপরাধ মোট নমুনার ১০.২ শতাংশ এবং নমুনা B-তে ১৯.৬ শতাংশ।
কারাবাসের মেয়াদ ও মামলার অবস্থা
নমুনা A: গড় হিসেবে বন্দিরা ২৮.৬ মাস কারাগারে কাটিয়েছেন। ৫২ শতাংশের বেশি বন্দি এক বছরের বেশি সময় কারাবাসে ছিলেন, এবং ৭ শতাংশ বন্দি পাঁচ বছরের বেশি সময় আটক ছিলেন। ৮০.৮ শতাংশ বন্দির ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের পরীক্ষা তখনও শুরু হয়নি। ৬৩ শতাংশ মামলার চার্জ যদিও গঠন করা হয়েছে, তবুও দুই বছরের বেশি সময় ধরে বিচারে কোনও অগ্রগতি ঘটেনি।
POCSO মামলা-নমুনা C: POCSO আইনের ৩৫(২) ধারায় বলা আছে, বিচারপ্রক্রিয়া যতদূর সম্ভব এক বছরের মধ্যে শেষ করা উচিত। কিন্তু এই গবেষণার তথ্য একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতা তুলে ধরে। পর্যবেক্ষণ করা ৯০টি POCSO মামলার মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশ বন্দি এক বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন, আর প্রায় ১০ শতাংশ বন্দি তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক ছিলেন।
বিচারাধীন ৯০টি POCSO মামলার অবস্থান নিম্নরূপ:
- কোনও অগ্রগতি হয়নি: ৪৮টি মামলা (৫৩.৩ শতাংশ)
- শুধু চার্জ গঠন হয়েছে, তারপর আর কোনও অগ্রগতি নেই: ১৮টি মামলা (২০ শতাংশ)
- সাক্ষী পরীক্ষা চলছে: ৯টি মামলা (১০ শতাংশ)
- চূড়ান্ত পর্যায়ে: ২টি মামলা (২.২ শতাংশ)
- অবস্থা অজানা: ১৩টি মামলা (১৪.৪ শতাংশ)
আইনি প্রতিনিধিত্ব
নমুনা A: মোট বন্দিদের মধ্যে ৪২ শতাংশের কোনও আইনজীবীই ছিল না। যাঁদের আইনি প্রতিনিধি ছিল, তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ বন্দি আইনজীবী পরিবর্তন করেছেন— মূলত আইনজীবীর মামলার কাজে কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া, অতিরিক্ত আর্থিক দাবি তোলা বা যোগাযোগের অভাবের কারণে। কয়েকজন অভিযুক্ত একাধিকবার আইনজীবী বদলেছেন।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় আদালতের নির্ধারিত তারিখে বন্দিদের হাজির না করানো— মোট ৫৮ শতাংশ বন্দিকে এক বছর ধরে আদালতে তোলা হয়নি; যাঁদের তোলা হয়েছে, তাঁদেরও অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটি তিনবারের কম ঘটেছে।
POCSO মামলা-নমুনা C: পর্যবেক্ষণ করা ৯০টি POCSO মামলার মধ্যে ৫২ জন (৫৮ শতাংশ) অভিযুক্তের আইনি প্রতিনিধি ছিল। এঁদের মধ্যে ৩৫ জন (৩৯ শতাংশ) ব্যক্তিগত আইনজীবী নিয়োগ করেছিলেন, আর ১৭ জন (১৯ শতাংশ) জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ (DLSA) বা প্রয়াস (একটি এনজিও)-এর মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পেয়েছিলেন।
অবশিষ্ট ৪৮ জন (৪২ শতাংশ) অভিযুক্তের কোনও আইনি প্রতিনিধি ছিল না; তাঁরা পরিবার, অন্যান্য বন্দি বা DLSA-র মাধ্যমে কোনও আইনজীবী ধরার চেষ্টা করছিলেন।
জামিনের আবেদন
নমুনা B: প্রায় ৫৫ শতাংশ বন্দি আর্থিক অসুবিধা বা পারিবারিক সহায়তার অভাবে কখনও জামিনের আবেদনই করেননি। যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের শুনানি প্রায়ই দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয়েছে— অনেক জামিনের আবেদন ১৮ থেকে ২৪ মাস ধরে মুলতুবি ছিল। নিম্ন আদালতে জামিন নাকচ হলে অধিকাংশ অভিযুক্ত আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেননি।
POCSO মামলা-নমুনা C: পর্যবেক্ষণ করা ৯০টি POCSO মামলার মধ্যে মাত্র ৩৩ জন অভিযুক্ত (৩৬.৬ শতাংশ) জামিনের আবেদন করেছিলেন, আর ৫৭ জন (৬৩.৩ শতাংশ) কখনও জামিনের আবেদনই করেননি। এই ৩৩টি আবেদনের মধ্যে মাত্র ৪টি (১২ শতাংশ) ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর হয়েছে। বাকি ২১টি আবেদন (৬৪ শতাংশ) নিম্ন আদালতেই খারিজ হয়, এবং তার মধ্যে মাত্র ৯ জন (৪৩ শতাংশ) পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করেন। এই ৩৩টি আবেদনের মধ্যে ৮টি (২৪ শতাংশ) এখনও মুলতুবি রয়েছে।
পরিবার ও যোগাযোগ (নমুনা B)
প্রায় ১০ শতাংশ বন্দির পরিবার জানতই না যে তাঁদের আত্মীয় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে, কারণ অভিযুক্তের সঙ্গে পরিবারের কোনও যোগাযোগের তথ্য ছিল না।
দীর্ঘমেয়াদি কারাবাসের প্রভাব (নমুনা B)
প্রায় ৬০ শতাংশ বন্দি তামাকজাত দ্রব্য সেবন করত, এবং তাঁদের মধ্যে ৫৩.৫ শতাংশ এই অভ্যাসটি কারাগারে এসে শুরু করেছে।
POCSO আইনের অধীনে রোমান্টিক সম্পর্ক-সংক্রান্ত মামলা
১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সি বন্দিদের (মোট ১৭৯ জন, নমুনা B) মধ্যে ৯০ জন (৫০ শতাংশ) POCSO আইনের অধীনে গ্রেপ্তার হয়েছিল। এই ৯০ জনের মধ্যে ৫২ জন (৫৮ শতাংশ) দাবি করেছে, তারা রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িত ছিল। এই দাবি সমর্থন করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল— এই ৫২টির মধ্যে ৫০টি (৯৬ শতাংশ) মামলায় এফআইআর দায়ের করেছেন মেয়েদের পরিবারের সদস্যরা; মাত্র ২টি (৪ শতাংশ) মামলায় মেয়েটি নিজে এফআইআর করেছে। ক্রিমিনাল প্রোসিডিউর কোডের ১৬৪ ধারা অনুযায়ী বিবৃতিতে ৭ জন মেয়ে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে তারা রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িত ছিল। এই ৫২টি ‘রোমান্টিক সম্পর্কে’র মধ্যে ১৩টি (২৭ শতাংশ) ক্ষেত্রে মেয়েদের বয়স ছিল ১৬ বছরের ওপরে এবং ২১টি (৪০ শতাংশ) ক্ষেত্রে ১৫ বছরের ওপরে। এই ৫২টি মামলার মধ্যে ৭৯ শতাংশই ছিল আন্তঃধর্মীয় বা আন্তঃজাতিগত সম্পর্ক। এমন সম্পর্কগুলোতে মেয়েদের পরিবারের তরফে তীব্র বিরোধিতা ও সহিংসতা দেখা যায়, যার ফলশ্রুতিই হল এফআইআর ও গ্রেপ্তারি।
আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কগুলির মধ্যে ৭৩.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ছেলেরা ছিল মুসলমান বা অন্য কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, আর মেয়েরা ছিল হিন্দু। আন্তঃজাতিগত সম্পর্কগুলির মধ্যে ৭৭.২ শতাংশ ক্ষেত্রে ছেলেরা তথাকথিত নিম্ন জাতিভুক্ত এবং মেয়েরা তুলনামূলকভাবে উচ্চ সামাজিক মর্যাদার পরিবারের ছিল।
সাগরের কথা
সাগরের (নাম পরিবর্তিত) গল্প এই প্রবণতার একটা মর্মস্পর্শী দৃষ্টান্ত। ওর বয়স ছিল ২২ বছর, দলিত, POCSO-র অধীনে কিডন্যাপিং এবং যৌন নির্যাতনের মামলায় বন্দি ছিল সে। বাবা মারা গেছিলেন, সেই তার মা আর ছোট ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে থাকত, আর সংসার চালানোর জন্য যা কাজ পেত, করত। সাগর পূর্বার (নাম পরিবর্তিত) প্রেমে পড়েছিল। পূর্বার বয়স ছিল ১৭ বছর, এবং সে তথাকথিত উঁচু জাতের মেয়ে— মারাঠা। যেহেতু তাদের সম্পর্কটি আন্তঃজাতিগত, তাই পূর্বার বাবা-মা সেই সম্পর্ক মানেননি। এই নিয়ে বাড়িতে মেয়েটির ওপর অত্যাচার হয়, এবং শেষমেশ সে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে সাগরদের বাড়িতে এসে ওঠে। সাগর আর তার মা তাকি বাড়ি ফিরে যেতে পরামর্শ দেয় এবং সাগর তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে যায়। সেখানে পূর্বার পরিবারের লোকেরা তার ওপর চড়াও হয়, মারধর করে, এবং শেষমেশ পুলিশে ধরিয়ে দেয়। মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটে এর পরে। নিজের এবং নিজের পরিবারের ওপর লাগা এই কলঙ্কের বোঝা, এবং সে-নিয়ে কিছু না-করতে পারার অসহায়তার দরুন সাগর জেলেই আত্মহত্যা করে।
POCSO মামলা থেকে পাওয়া তথ্য
POCSO আইনের উদ্দেশ্য হল শিশুদের যৌন অপরাধীদের হাত থেকে রক্ষা করা, তবে কিশোর-কিশোরীর রোমান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আইনটির কঠোর প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। কিশোর বয়সে রোমান্টিক সম্পর্ক ব্যক্তিত্বের স্বাধিকার, আত্মসম্মান ও মানসিক সুস্থতার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ভারতের গভীরভাবে প্রোথিত সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক নীতি এই ধরনের সম্পর্ককে দৃষ্টান্তমূলকভাবে দণ্ডিত করে, বিশেষ করে যখন তা ধর্ম বা জাতের গণ্ডি পেরিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে POCSO আইন প্রায়শই সামাজিক বিভাজন আরও গভীর করতে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— ভারতে সহমতের বয়স সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে, সেই সময়কার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী। ১৯৪০ সালে এটি ছিল ১৬ বছর। পরে ২০১২ সালে POCSO আইনের মাধ্যমে সহমতের বয়স ১৮ বছরে বৃদ্ধি পায়।
বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীদের জড়িত POCSO মামলার সংখ্যাবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সাংবিধানিক আদালতগুলি সহমতের বয়স পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, Ashik Ramjan Ansari বনাম স্টেট অফ মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য (২০২৩) মামলায় বোম্বে হাইকোর্ট জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটিকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেছে যে, রাষ্ট্রকে এমন কিশোর-কিশোরীদের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা থেকে বিরত থাকতে হবে, যারা সম্মতিপূর্ণ ও অ-বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। আরও সাম্প্রতিক, Shyam Singh বনাম রাষ্ট্র (২০২৫) মামলায় দিল্লি হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ করেছে যে “কিশোর-কিশোরীদের তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে এবং সম্পর্ক গড়ে তুলতে অপরাধ করার ভয় দ্বারা তাড়িত হওয়া উচিত নয়” এবং “আইনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শোষণ ও নির্যাতন রোধ করা, প্রেমকে শাস্তি দেওয়া নয়।”
সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণ
POCSO মামলাগুলির বিশ্লেষণ এই গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হিসেবে উঠে এসেছে, যা এই বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রতিটি তথ্যবিন্দুই স্বতন্ত্র গবেষণা ও আলোচনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
POCSO আইন এমনভাবে কার্যকর হয় যে এটি মেয়েদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভুক্তভোগী হিসেবে ধরে নেয়, যা পিতৃতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক কুপ্রথাগুলিকেই আরও দৃঢ় করে। এই পক্ষপাতের ফলে ছেলেরা—এমনকি নাবালকরাও— অসামঞ্জস্যভাবে অপরাধী হিসেবে পরিগণিত হয়, যদিও তাত্ত্বিকভাবে POCSO আইন লিঙ্গ-নিরপেক্ষ। এছাড়া, আইনটি জাতি ও সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যও বজায় রাখতে প্রকারান্তরে সাহায্য করে। আইনের সীমিত ধারণক্ষমতার ফলে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরদের আচরণ ও রোমান্টিক সম্পর্কের বাস্তবতাকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। এটি সম্মতিপূর্ণ কর্মকাণ্ডকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এবং যারা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করে, প্রান্তিক সম্প্রদায়ের সেইসব ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়।
ডঃ বিআর আম্বেদকর তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ Annihilation of Caste-এ আন্তঃবিবাহবাধ্যতার (endogamy) মাধ্যমে জাতিভিত্তিক শ্রেণিকাঠামো রক্ষার ভূমিকা তুলে ধরেছেন। বাস্তবে POCSO আইন প্রায়শই এই কাঠামো রক্ষার একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, এমনকি যুবসমাজের প্রেমকেও শাস্তি দেয়, যা সামাজিক নিয়ম ও ধারা অমান্য করে। আদালতের পর্যবেক্ষণেও এই প্রবণতা প্রতিফলিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, Atul Mishra বনাম স্টেট অফ উত্তরপ্রদেশ (২০২২) মামলায় সর্বোচ্চ আদালত কিশোর-সম্পর্ক বোঝার জন্য “জৈব-সামাজিক (bio-social) দৃষ্টিকোণ” গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছে, এবং স্বীকৃতি দিয়েছে যে এই সম্পর্কগুলো “সংবেদনশীল, অপরিপক্ব, কিন্তু অবশ্যই পাপ বা কলঙ্কিত নয়।”
নিজস্ব সুরক্ষা বিধি থাকা সত্ত্বেও, POCSO আইনের প্রয়োগ প্রায়শই পশ্চাদমুখী সামাজিক নীতি শক্তিশালী করছে, যাতে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষজন। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হলে নীতিগত সংস্কারের প্রয়োজন, যা কিশোর-সম্পর্কের সঠিক ব্যাখ্যা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক ও বয়সভিত্তিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নেবে এবং এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতি প্রতিরোধ করবে।
লেখকের নোট: তালোজা কারাগারের সমস্ত বন্দিদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ— তাঁরা তাঁদের মামলা এবং এবং অভিজ্ঞতার কথা আমাকে জানিয়ে আমার উপলব্ধি গভীরতর করতে প্রচুর সাহায্য করেছেন। আমার সমস্ত বিকে-১৬ সহবন্দিদেরও আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই— তাঁদের মূল্যবান তথ্য এবং পরামর্শ আমার গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার সাথী, পরিবার-পরিজন এবং বন্ধুরা— যাঁরা তাঁদের সমর্থন, যত্ন, ভালোবাসা এবং মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন—তাঁদেরকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।

