পার্থপ্রতিম মণ্ডল
ভবিষ্যৎ দলাই লামার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিব্বত-চিন বিরোধিতা সম্প্রতি আবার বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। চিনের দাবি, বর্তমান চতুর্দশ দলাই লামার পর পরবর্তী পঞ্চদশ দলাই লামা কে হবেন, সেটা তারাই ঠিক করবে। অন্যদিকে, ভারতস্থিত তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের দাবি, বিষয়টি তিব্বতিদের চিরাচরিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্তর্গত— এ নিয়ে চিনের কোনও বক্তব্য থাকতে পারে না। বর্তমান দলাই লামা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, দলাই লামার নির্বাচনের বিষয়টি গেলুক সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী, দলাই লামার দপ্তরের নির্দেশ অনুসারেই হবে। যেহেতু বিষয়টি তিব্বতিদের ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত, সেহেতু এখানে চিনের মতো এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কিংবা তার রাজনীতির কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না।
সাম্প্রতিক এই খবর যখন বহু অতীত বিতর্ক এবং তিব্বত তথা চিনের ইতিহাসের নানা ঘটনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, তখনই হাতে এসেছে সম্প্রতি প্রকাশিত দলাই লামার লেখা Voice for the Voiceless: Over Seven Decades of Struggle with China for My Land and My People বইখানি। কেবল উপরিউক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, আজকের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেও দলাই লামার লেখা এমন একখানি বইয়ের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব কতখানি, তা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করবেন। শুধু তিব্বতি ভাষা-সংস্কৃতিতে আগ্রহী পাঠকের কাছেই নয়, ভূ-রাজনীতিতে আগ্রহী সব পাঠকের কাছেও বইটি যে বিশেষ কৌতূহলের কারণ হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।
আমরা জানি, বিগত শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং বহির্বিশ্বের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিব্বতকে সেইভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। ১৯৪২ সালে তিব্বতের জড়িয়ে পড়ার এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যখন ব্রিটিশ ও চিন সরকার তিব্বতকে অনুরোধ করে— তিব্বত যেন তার ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে তাদের সরবরাহপথের অনুমতি দেয়। ভারত ও চিনের মধ্যে বার্মা হয়ে যে সাপ্লাই রুটটি ছিল, তা জাপান বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। তিব্বত এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। পরে ব্রিটিশ সরকার তিব্বতকে তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে আবার অনুরোধ করলে, তিব্বত রাজি হয় ঠিকই, কিন্তু তা শুধুমাত্র অসামরিক দ্রব্য সরবরাহের জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টি চিনে ক্ষমতায় আসে, এবং চিনের নবগঠিত সরকার স্পষ্ট করে দেয় যে তারা তিব্বতকে চিনের মূল ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। চিনের এই নবগঠিত সরকারের চোখে তিব্বত চিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে আমাদের তিব্বতের সুপ্রাচীন সভ্যতা ও তার সুদীর্ঘ ইতিহাস আলোচনার সুযোগ নেই; থাকলে বোঝা যেত, চিনের এই ধারণা কতখানি ভিত্তিহীন। যাই হোক, চিনের এই হুমকিতে সচকিত হয়ে তিব্বত ১৯৪৯ সালে দেশে কর্মরত সমস্ত চিনা পদস্থ কর্মচারীকে বরখাস্ত করে। তিব্বতের এই পদক্ষেপকে চিন পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও প্রতিবিপ্লবীদের চক্রান্ত বলে ব্যাখ্যা করে। এর অব্যবহিত পরেই, ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর, প্রায় চল্লিশ হাজার চিনা সৈন্য ‘সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও প্রতিবিপ্লবীদের’ হাত থেকে তিব্বতকে মুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে পূর্ব তিব্বতের খাম প্রদেশে আক্রমণ চালায়।
দলাই লামার বইয়ের প্রতিপাদ্য বিষয় এই পরবর্তী ইতিহাস। দলাই লামা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, এল সালভাদর ছাড়া রাষ্ট্রপুঞ্জে আর কোনও দেশ স্বাধীন একটি দেশের উপর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দখলদারির প্রতিবাদ জানায়নি। এই বিষয়ে ব্রিটেনের ভূমিকার তিনি বিশেষভাবে সমালোচনা করেছেন। গ্রেট ব্রিটেন ও রাশিয়া— এই দুই দেশ মধ্য এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে (যা ‘গ্রেট গেম’ নামে পরিচিত) ইচ্ছাকৃতভাবে তিব্বতের আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে ঘোলা করে তোলে। অথচ এর আগে গ্রেট ব্রিটেন তিব্বতকে স্বাধীন দেশ হিসেবেই জানত; এমনকি চিনের আক্রমণ থেকে পূর্ব সীমান্তকে সুরক্ষিত করতে তিব্বতকে তারা অস্ত্রও সরবরাহ করেছিল। এই একই গ্রেট ব্রিটেন আবার সার্বভৌমত্ব ও সুজেরেনটির জিগির তুলে জাতীয়তাবাদী চিনের সঙ্গে এমনভাবে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছিল, যেন তিব্বতের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার যথেষ্ট অধিকার চিনের রয়েছে! মাঞ্চু সাম্রাজ্যের সঙ্গে আধুনিক চিন রাষ্ট্রের মৌলিক তফাতটি তারা যেন বুঝেও বুঝতে চায়নি। যাই হোক, ১৯৫০ সালের ১৭ নভেম্বর মাত্র ষোলো বছর বয়সে অন্তর্বর্তী রিজেন্টদের হাত থেকে তিব্বতের শাসনভার গ্রহণ করেন দলাই লামা। দলাই লামা শাসনভার গ্রহণ করার পর, যখন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে তিব্বতের উপর এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আবেদন জানানো হয়, তখন কোনও সদস্যই তিব্বতের মতো বিচ্ছিন্ন একটি রাষ্ট্রের জন্য চিনের সঙ্গে সংঘাতে যেতে রাজি হয়নি।
এই প্রসঙ্গে দলাই লামা তাঁর বইয়ে তিব্বতের ভৌগোলিক অবস্থানের তাৎপর্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিব্বতের দক্ষিণে হিমালয় পর্বতমালা— যার ওপারে ভারত, নেপাল ও ভুটান; উত্তরে মধ্য এশিয়ার মরুপ্রান্তর— যার পরেই পূর্ব তুর্কিস্তান ও মঙ্গোলিয়া; আর পূর্বদিকে রয়েছে নিম্নভূমি ও ধানের ক্ষেত, যেখানে চিনের নাগরিকেরা বসবাস করেন।
ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি সমসাময়িক ভূ-রাজনীতির তাৎপর্যও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। প্রধান শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে যেসব দেশের সঙ্গে তিব্বতের যোগাযোগ ছিল, তারা প্রত্যেকেই ইতিহাসের এই সংকটজনক সময়ে স্ব-স্ব কারণে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল। গ্রেট ব্রিটেন সবে ভারত ছেড়েছে— দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে তখন তার আর কোনও আগ্রহ নেই। ভারত দেশভাগের ভেতর দিয়ে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং ওই বছরেরই অক্টোবরে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, যার জের চলেছে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। এক যুদ্ধের রেশ কাটতে না কাটতেই আর এক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতায় জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে ভারতের থাকার কথা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিব্বতের ব্যাপারে যতটুকু আগ্রহ, তা কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিজমের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে যা ঘটেছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেন এশিয়ায় না হয়— এই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন চিয়াং কাই-শেকের জাতীয়তাবাদী সরকারকে পরাজয়ের মুখেও মদত দিয়েছিল। এর সঙ্গে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিব্বতের চূড়ান্ত অজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তিব্বতকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন করার ব্যর্থতা।
শেষোক্ত কারণটিকেই দলাই লামা তিব্বতিদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে মনে করেছেন। তাঁর পূর্ববর্তী ত্রয়োদশ দলাই লামাও তিব্বতের এই দুর্বলতা ও আসন্ন বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তিব্বতের অন্তর্বর্তী শাসকেরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। ১৯৫৯ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পরে দলাই লামা ধর্মশালায় নির্বাসিত সরকার গঠন করার পর প্রথম যে কাজটি করেন, তা হল তিব্বতিদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা। এই সংবিধানের ৩৬ নম্বর ধারায় এমনও বলা আছে যে, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য চাইলে দলাই লামার কর্তৃত্বকেও বিলুপ্ত করতে পারেন।
যাইহোক, ১৯৫১ সালের এপ্রিলে দলাই লামা আলোচনার মাধ্যমে কোনও রফাসূত্র খুঁজে বের করতে বেজিং-এ প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। বেজিং পৌঁছনোর কিছুদিন পর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দলাই লামার যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরই সকলকে বিস্মিত করে, পরের মাসে রেডিও পিকিং ঘোষণা করে যে তিব্বতের শান্তিপূর্ণ ‘লিবারেশন’-এর জন্য জনপ্রজাতন্ত্রী চিনের সঙ্গে “তিব্বতের আঞ্চলিক সরকারে”র এক সতেরো-দফা চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। সম্প্রচারে আরও বলা হয়, কয়েকশো বছর ধরে তিব্বতের উপর আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে, এবং সমস্তরকম ছলচাতুরি করে তারা তিব্বতের মানুষকে দাসত্বে আবদ্ধ করে রেখেছে!
প্রতিনিধিদল ফিরে এলে সদস্যদের মুখে প্রকৃত সত্যটি জানা যায়। আলোচনায় বসার আগেই চিন দশ-দফার একটি চুক্তি প্রস্তুত করে রেখেছিল। দলাই লামার প্রতিনিধিরা জানায়, তিব্বত একটি স্বাধীন দেশ, এবং নিজেদের যুক্তির সপক্ষে তারা প্রমাণও পেশ করে। কিন্তু চিন সেই বক্তব্য অগ্রাহ্য করে, দশ-দফা চুক্তিটিকেই সতেরো-দফা চুক্তিতে রূপান্তরিত করে দলাই লামার অনুমতি ছাড়াই প্রতিনিধিদের বাধ্য করে তাতে সই করতে। এমনকি পাঁচ তিব্বতি প্রতিনিধির প্রত্যেকের নামে সিলমোহর তৈরি করে, সেই চুক্তিতে তৎক্ষণাৎ সাক্ষরও করিয়ে নেয়।
প্রশ্ন হল, কী ছিল সেই সতেরো-দফা চুক্তিতে? মূল বক্তব্যগুলি ছিল এরকম— প্রথমত, তিব্বতের জনগণ তাদের মাতৃভূমি জনপ্রজাতন্ত্রী চিনের বৃহত্তর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, তিব্বতের আঞ্চলিক সরকার চিনের মুক্তিবাহিনীকে তিব্বতের ভূখণ্ডে অবাধ প্রবেশের এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা জোরদার করার ক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা করবে। তিব্বতের জন্য যা নির্ধারিত হল তা হল— কেন্দ্রীয় জনপ্রজাতন্ত্রী সরকারের তত্ত্বাবধানে তিব্বতের মানুষ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ভোগ করবেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলাই লামার মর্যাদা, ক্ষমতা ও দায়িত্বে কোনও পরিবর্তন আনবে না। তিব্বতের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথা ও রীতিনীতির প্রতি চিন শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তিব্বতি গুম্ফা ও সন্ন্যাসীরা সুরক্ষিত থাকবেন। কথ্য ও লেখ্য ভাষা এবং স্কুলশিক্ষার মতো বিষয়গুলি তিব্বতের বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী উন্নত করা হবে।
যদিও এই চুক্তি তিব্বতের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তবুও তাতে তিব্বতের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সুরক্ষা ও স্বায়ত্তশাসনের কথাই বলা হয়েছিল। বইয়ের একাধিক জায়গায় দলাই লামা এ-প্রসঙ্গে তাঁর মধ্যপন্থা অবলম্বনের কথা উল্লেখ করেছেন— চিনের বিপুল সামরিক শক্তি, আন্তর্জাতিক উদাসীনতা এবং তৎকালীন বাস্তব পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে যা করা সম্ভব তার উপযোগী এক মধ্যপন্থা। মূল উদ্দেশ্য ছিল, তিব্বতের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্যকে যে-কোনও প্রকারে রক্ষা করা।
১৯৫৮-১৯৫৯ সময়ে খাম ও দক্ষিণ তিব্বতে তিব্বতিদের যে গেরিলা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সম্পর্কেও দলাই লামা একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমেরিকার তরফ থেকেও ইঙ্গিত এসেছিল— দলাই লামা চাইলে তারা এই গেরিলা আন্দোলনে সাহায্য করতে পারে। বস্তুত, প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা গোম্পো তাশিকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহে সিআইএ যে কিছুদিন সহায়তা করেছিল, সেই সংবাদও তাঁর কাছে পৌঁছেছিল। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও তিনি তাদের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁর নিজের কথায়, “Of course, as a student of Buddha and a deep admirer of Mahatma Gandhi’s nonviolence philosophy, I could not imagine myself making such a request.” তাছাড়া, হিংসাত্মক এই আন্দোলন যে চিনের সংগঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আদৌ ফলপ্রসূ হবে না, তাও তিনি ভালোভাবে বুঝেছিলেন।
যাইহোক, এই সতেরো-দফা চুক্তিই ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত চিন–তিব্বত সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি ছিল। দলাই লামার বিশ্বাস ছিল, সতেরো-দফা এই চুক্তিতে তিব্বতের স্বাধীনতা হরণ করা হলেও, চুক্তির শর্ত মেনে চিন তিব্বতিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং তাদের আধুনিকীকরণের অন্তত কিছুটা চেষ্টা করবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তিব্বতের দূরত্ব যে তাদের অগ্রগতির পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা, তা দলাই লামা বারবারই স্বীকার করেছেন।
কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমে যেদিকে এগোতে থাকে, তাতে চুক্তির অসারতা ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে। চুক্তির শর্ত মেনে নেওয়া মানে কার্যত চিনের তিব্বত আক্রমণকে বৈধতা দেওয়া। তবু ১৯৫১ থেকে ১৯৫৯— এই আট বছর ধরে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া দলাই লামা চিনের তাবড় তাবড় পোড়খাওয়া নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছেন, চুক্তির সীমার মধ্যেই থেকে তিব্বতের অবস্থার যতটুকু পরিবর্তন সম্ভব তা ঘটানোর চেষ্টায়। ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিন সরকার তাঁকে বেজিংয়ে জাতীয় পিপলস কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ট্রেনে বেজিং শহরে পৌঁছলে দলাই লামা ও পাঞ্চেন লামাকে অভ্যর্থনা জানাতে স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাই ও ভাইস চেয়ারম্যান চু তে। বেজিংয়ে পৌঁছনোর কয়েকদিন পর চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়; বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এনলাই, লিউ শাওচি-সহ চিনের অন্যান্য উচ্চপদস্থ নেতারা। মজার বিষয়, তখন মাও ছিলেন একষট্টি বছরের প্রাজ্ঞ নেতা, আর দলাই লামা ও পাঞ্চেন লামার বয়স যথাক্রমে উনিশ ও ষোলো।
এখানে যে কথাটি বলা অত্যন্ত প্রয়োজন, তা হল— এই বইয়ে কোথাও তিনি ব্যক্তি মাও সেতুং বা মার্কসবাদের দর্শনের প্রতি কোনও অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেননি। চেয়ারম্যান মাওয়ের সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সাক্ষাতের বিশদ বিবরণ তিনি নিজেই দিয়েছেন। মার্কসবাদের মহত্ব ও তার অন্তর্নিহিত ত্রুটি সম্পর্কে যে মূল্যায়ন তিনি করেছেন, তা উদ্ধৃত করা প্রয়োজন বোধ করি:
I was impressed by the sense of purpose and dedication displayed by many of these first-generation revolutionaries, as well as their obvious successes in their attempts to create a more egalitarian society. I learned much about Marxism-Leninism, and was particularly struck by the emphasis in Marxist economic theory on equal distribution of resources rather than pure profit-making. The idea of taking care of the less privileged people, of the working class, is wonderful. To oppose all exploitation, and to strive for a society without national boundaries — these are excellent ideals. As I was exposed to all these in my youth, these aspects of socialist thinking left a strong impression such that I sometimes describe myself as half-Buddhist and half-Marxist. However, as I have thought about it over the years, what is lacking in Marxism is compassion. Its greatest flaw is the total neglect of basic human values, and the deliberate promotion of hate through class struggle. Furthermore, as time went on, in case of Communist China, Marxism seemed to have given way to Leninism, with state control of the people by the Party as the primary objective.
এরই পাশাপাশি ১৯৬৬ সালের মে মাস থেকে ১৯৭৬ সালে মাও সেতুং-এর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চিনের ইতিহাসে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অধ্যায়টি চলেছিল, তার মর্মন্তুদ বর্ণনা দলাই লামা দিয়েছেন এই বইয়ে। এর সূচনা হয়েছিল রেডগার্ডদের হাতে লাসার যোখাং মন্দিরের ধ্বংসলীলা দিয়ে। মঠের অভ্যন্তরে সুপ্রাচীন ফ্রেসকো ও অমূল্য শিল্পকর্ম ধ্বংস করে ফেলা হয়। অসংখ্য প্রাচীন পুঁথি মন্দিরের প্রাঙ্গণে টেনে এনে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এসবই করা হয়েছিল “The Four Olds”— অর্থাৎ Old Ideology, Old Culture, Old Habits এবং Old Customs— নির্মূল করার উদ্দেশ্যে। সপ্তম শতাব্দীর অবলোকিতেশ্বরের এক অমূল্য মূর্তি, যা তিব্বতিদের কাছে বিশেষভাবে পবিত্র বলে মান্য ছিল, সেটিও ধ্বংস করা হয়।
ক্রমে এই ধ্বংসলীলা ছড়িয়ে পড়ে দলাই লামার গ্রীষ্মকালীন আবাস নোরবুলিঙ্কা-সহ তিব্বতের সর্বত্র। ১৪০৯ সালে তিব্বতের মহান দার্শনিক চোংখাপা প্রতিষ্ঠিত গান্দেন মঠ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। হাজার হাজার মানুষ নিহত হন। তিব্বতি আচার-অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। “শ্রেণিশত্রু” আখ্যাপ্রাপ্ত সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের বাধ্য করা হয় জনসমক্ষে নিজেদের “অপরাধ” স্বীকার করতে; প্রকাশ্যে তাদের লাঞ্ছনার ব্যবস্থা করা হয়।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পাঞ্চেন লামা। দলাই লামা গোপনে ভারতে চলে আসার পর দেশে আটকে থাকা তিব্বতিদের উপর অকথ্য অত্যাচার নেমে আসে। ১৯৬২ সালে পাঞ্চেন লামা এই অত্যাচারের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে চিনের শাসকদের উদ্দেশে একখানি পিটিশন প্রেরণ করেন। চিনা ভাষায় প্রায় সত্তর হাজার অক্ষরে লেখা সেই পিটিশনকে মাও সেতুং আখ্যা দিয়েছিলেন, “a poisoned arrow at the heart of the Party” বলে। ১৯৬৪ সালে চিন সরকার তাঁকে “an enemy of the Tibetan people” ঘোষণা করে। পাঞ্চেন লামাকে তথাকথিত “struggle sessions”-এ প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করা হয় এবং ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তাঁকে কারাবন্দি রাখা হয়।
কী ছিল এই “struggle session”? তিব্বতি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘থাবযিঙ্’। এই সময়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হত একখানা গাধার টুপি, তারপর তাকে মাথা নিচু করে দাঁড় করানো হত। সমবেত “সাধারণ” মানুষ তখন গালিগালাজ, থুতু ছিটোনো— এমন নানা উপায়ে তাকে হেনস্থা করত। তিব্বতে দলাই লামার পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদটি হল পাঞ্চেন লামার। চিন তৎকালীন দলাই লামার সঙ্গে পাঞ্চেন লামার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করার চেষ্টাও করেছিল। অথচ এই বইয়ে দলাই লামা খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, তিনি যখন তিব্বতের বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে তিব্বতের ইস্যুটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, তখন পাঞ্চেন লামাই তিব্বতের অভ্যন্তরের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, তিব্বতের গভীর সংকটের সময়ে দলাই লামার ভারতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। সেই প্রশ্নেরও উত্তর তিনি দিয়েছেন এই বইয়ে—
If any colleagues who fled with me into exile in 1959 ever had any doubt about the correctness of our course of action, then the Cultural Revolution utterly dispelled them. Had I stayed in Tibet, I wouldn’t have been able to do anything meaningful in the face of this insane and systematic onslaught.
মাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী চিয়াং চিং ও তাঁর “Gang of Four”— যারা এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রধান পুরোধা ছিলেন— তাঁরা পার্টির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে পিছু হটে যান। দেং জিয়াওপিং-এর নেতৃত্বে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পথ প্রশস্ত হলে অবস্থার অনেকটা উন্নতি ঘটে। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে তিব্বতের একদল বন্দিকে ঘটা করে মুক্তি দেওয়া হয়; পাঞ্চেন লামাও তখন মুক্তি পান।
১৯৭৯ সালে দেং জানান, তিব্বতের পূর্ণ স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়— “But except for independence, everything is negotiable. Everything can be discussed.”
তিনি ভারত ও তিব্বতের সীমান্ত শিথিল করারও সম্মতি দেন, যাতে ভারতে বসবাসকারী তিব্বতিদের সঙ্গে তাঁদের দেশে থাকা পরিবারপরিজনদের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থাকলেও, প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনও অর্জিত হলে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটানো সম্ভব— এমনটাই বিশ্বাস করেন দলাই লামা, এবং এ কারণেই তিনি তাঁর ‘মধ্যপন্থা’র নীতিকেই শ্রেয় বলে মনে করেন।
যদিও দেং তিব্বতের বিষয়ে তুলনামূলক উদার মনোভাব নেন, কিন্তু ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে চিন দলাই লামার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যতটা আগ্রহী, তিব্বতকে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার বিষয়ে ততটা নয়। তবে লক্ষণীয় পরিবর্তন যা ঘটে— ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত মনাস্ট্রিগুলি নতুন করে গড়ে তোলা হয়, এবং সর্বোপরি বেশ কিছু ধ্রুপদি তিব্বতি টেক্সট আধুনিক বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়।
কিন্তু নতুন করে যে বিষয়টি উদ্বেগের হয়ে ওঠে, তা হল— চিন তার পাঁচ দফা প্রস্তাবে তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থেকে চিনা সরকারি আধিকারিক ও ক্যাডারদের সংখ্যা কমিয়ে আনার কথা বললেও, বাস্তবে ‘উন্নয়ন’-এর নামে চিন থেকে হাজারে হাজারে মানুষ এসে তিব্বতের আদি ভূখণ্ডে বসবাস শুরু করতে থাকে। ফলে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের দাবির মূল উদ্দেশ্য— তিব্বতের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করা— তা ব্যর্থ হতে বসে। তিব্বত ক্রমে চিনেরই আরেকটি প্রদেশে পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়; তিব্বতের মানুষ তাঁদের জন্মভূমিতেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হয়ে বেঁচে থাকবেন— এই ছিল মূলত চিনের লক্ষ্য।
দলাই লামা লিখেছেন, এই পরিস্থিতিতে তিব্বতের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে নিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর কাছে আর কোনও পথ খোলা ছিল না। তিনি লিখেছেন, “I often describe the international community as our ‘Fourth Refuge’, in addition to the traditional Buddhist refuge of the Three Jewels— the Buddha, dharma, and the Sangha.”
১৯৮৮ সালের ১৫ জুন তিনি স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে যে ভাষণ দেন, তাতে স্পষ্টই বলেন— চিনের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার তিব্বতের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করতে পারে, কিন্তু শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, পর্যটন, বিজ্ঞান, খেলাধূলা ও অন্যান্য অরাজনৈতিক বিষয়ে তিব্বতকে পূর্ণ স্বাধিকার দেওয়া হোক। স্ট্রাসবুর্গ প্রস্তাবে তিব্বতের অনেকেই দলাই লামার উপর খুশি হতে পারেননি। এমনকি তাঁর সহোদর তাকছের রিনপোচে স্বয়ং এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের মতে, এই প্রস্তাবে দলাই লামা তিব্বতের স্বাধীনতার দাবির থেকে পিছু হটেছেন।
দলাই লামা তাঁর বইয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বিষয়টিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে সাবেক বহু প্রতিপক্ষ দেশ বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরস্পরের দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছাকাছি এসেছে। তাঁর মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিব্বতের পূর্ণ স্বাধীনতা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
মজার ব্যাপার হল, তিব্বতের অনেক মানুষ এমন মনে করলেও, এবং স্ট্রাসবুর্গ প্রস্তাবে কোথাও পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি না তোলা সত্ত্বেও, চিন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। তাদের মতে, এই প্রস্তাবে স্বাধীনতার প্রশ্নটি ‘পুরোপুরি পরিত্যাগ করা হয়নি’।
এরপর ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে জেনেভায় আলোচনায় বসতে প্রথমে সম্মতি জানালেও, পরে চিন সেখান থেকে সরে আসে। একই বছরের মার্চ মাসে লাসায় এক গণবিক্ষোভ হয়, যেখানে চিনা পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭৯ সালে দেং জিয়াওপিংয়ের হাত ধরে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
এরপরও বেশ কয়েকবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দলাই লামা দেং জিয়াওপিং ও সাধারণ সম্পাদক জিয়াং জেমিংকে নতুন করে বার্তা পাঠান আলোচনায় বসার জন্য।
এর মধ্যে চিন Tibet: Its Ownership and Human Rights Situation শীর্ষক একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। শ্বেতপত্রের একটি বড় অংশ জুড়ে তিব্বতের ইতিহাস এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তিব্বত চিরকালই চিনের অংশ ছিল। তিব্বতের যাবতীয় অসন্তোষকে দেখানো হয় সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত হিসেবে।
২০০৮ সালে চিনে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তিব্বতের ভেতরে ও বাইরে বহু মানুষ সোচ্চার হন। ওই বছরের অক্টোবর মাসে অষ্টম আলোচনাচক্রে দলাই লামার পক্ষ থেকে Memorandum on Genuine Autonomy for the Tibetan People পেশ করা হয়। বলাই বাহুল্য, চিন এই ‘Genuine Autonomy’-র বিষয়ে একমত হয়নি।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে এই বিবৃতির উপর একটি স্পষ্টীকরণ দেওয়া হয়। তিব্বত ইস্যুতে চিনের সঙ্গে এটাই ছিল শেষতম আনুষ্ঠানিক আলোচনা। এরপর আর কোনও বৈঠক বা আনুষ্ঠানিক সংলাপ হয়নি।
দলাই লামা লিখেছেন, চিনের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর তিনি আশা করেছিলেন, আলোচনা এবার হয়তো ইতিবাচক দিকে মোড় নেবে। জিনপিং বৌদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল; পারি শহরে ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে বসে তিনি চিনের জনগণের উপর বৌদ্ধধর্মের সুগভীর প্রভাবের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। জিনপিং-এর বাবা দলাই লামার বিশেষ পরিচিত ছিলেন। দেং জিয়াওপিং-এর ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নিজেকেও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আঁচ টের পেতে হয়েছিল। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্রবিক্ষোভের উপর রাষ্ট্রীয় দমননীতির তিনি বিরোধিতা করেছিলেন।
কিন্তু জিনপিং ক্ষমতায় আসার পরও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এই আলোচনা আমরা শুরু করেছিলাম পরবর্তী দলাই লামার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমান বিতর্কের প্রসঙ্গ দিয়ে। এই বিষয়ে যাবতীয় কৌতূহলের উত্তর আমরা এই বইয়ে পাই। ২০০১ সালে দলাই লামার বয়স যখন একষট্টি, তখনই তিনি আংশিক অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তিব্বতি নির্বাসিত সরকারের পরিচালনার ভার তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নির্বাহী পর্ষদের হাতে তখনই অর্পণ করেন। উদ্দেশ্য একটাই— তাঁর জীবদ্দশায় যদি তিব্বত সমস্যার সমাধান না-ও হয়, তবুও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব থাকবে। তারা এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এর মানে এই নয় যে তিনি নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসছেন। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল, তিব্বতের লড়াই ক্রমশ একজন মাত্র ব্যক্তির উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালের ১৯ মার্চ, পঁচাত্তর বছর বয়সে তিনি যাবতীয় ‘সেকুলার’ দায়িত্ব থেকে পূর্ণ অব্যাহতি নেন। তিব্বতের সমস্ত মানুষকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন— রাজা বা ধর্মীয় প্রধানের নেতৃত্বের দিন শেষ। গণতন্ত্রই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর শেষ কথা। ভবিষ্যতে দলাই লামার পদ থাকবে কি না, সেটা অধিকৃত তিব্বতে ও বহির্বিশ্বে বসবাসকারী তিব্বতিরাই ঠিক করবেন। কিন্তু ১৯৯৫ সালে তিব্বতি ঐতিহ্য অনুযায়ী খুঁজে পাওয়া মাত্র ছ-বছরের শিশু পাঞ্চেন লামাকে যেভাবে অমানবিকভাবে কারাগারে পাঠিয়ে, লটারির মাধ্যমে নিজেদের পছন্দসই প্রার্থীকে চিন পাঞ্চেন লামা ঘোষণা করে, তা পরবর্তী দলাই লামা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। চিনের নির্বাচিত পাঞ্চেন লামাকে যেমন তিব্বতিরা স্বীকার করে না, তেমনি একইভাবে দলাই লামার নির্বাচনও যদি চিনের ইচ্ছানুযায়ী হয়, তিব্বতিরা দেশ বা দেশের বাইরে কেউই তা মেনে নেবেন না। তাছাড়া, তাঁর মতে, ধর্মনিরপেক্ষ কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে চিনের এ-ধরনের হস্তক্ষেপ তার দ্বিচারিতারই প্রমাণ।
দলাই লামার মতে, তিব্বতের আধুনিকিকরণের ফলে সেখানে প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে— চিনের এই দাবিটি যদি সত্যি হত, তাহলে তিব্বত ও বহির্বিশ্বে এত বিক্ষোভ, এত অসন্তোষ চোখে পড়ত না। ২০০৯ সালে উত্তর-পূর্ব তিব্বতের কির্তি মঠের এক সন্ন্যাসী তিব্বতের স্বাধীনতার দাবিতে বাজারের মধ্যে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার পর ১৬০ জনেরও বেশি সন্ন্যাসী ও সাধারণ মানুষ একই প্রতিবাদের একই পথ বেছে নেন। শুধু তিব্বতে নয়, ভারত ও নেপালেও এমন ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিব্বতের খ্যাতনামা তরুণ গায়ক চেওয়াং নোরবু পোটালা প্রাসাদের সামনে আত্মাহুতি দেন। এক বৌদ্ধমতাবলম্বী হিসেবে দলাই লামা যদিও এই চূড়ান্ত পদক্ষেপ সমর্থন করেন না, তবু এই সমস্ত দুঃখজনক ঘটনা তাঁকে ব্যথিত করে— সে কথা তিনি বলেছেন।
বইয়ের পরিশেষে তিনি তিব্বতি ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অধিকৃত তিব্বতে শিক্ষার প্রাথমিক ভাষা হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে চিনা ভাষা। উদ্দেশ্য একটাই— এমন এক নতুন প্রজন্ম তৈরি করা, যাদের প্রথম ভাষা আর তিব্বতি থাকবে না। চিনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিপুল সংখ্যক অ-তিব্বতিকে সাবেক তিব্বতে স্থানান্তরিত করে জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের জায়গাটিও মুছে দিতে চায় তারা। সেই সঙ্গে তিব্বতি মঠগুলিতে সরকারি আধিকারিকদের বসানো হয়েছে নজরদারির উদ্দেশ্যে। এসবই তিব্বতের সুপ্রাচীন ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পক্ষে এক গভীর আতঙ্কের কারণ। শুধু তিব্বতের মানুষ বা তাদের সমাজ নয়— আজকের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই অধিগ্রহণের পরিবেশগত বিপদের কথাও তিনি ভেবে শঙ্কিত হয়েছেন।
আমরা যেটিকে তিব্বতি মালভূমি বলি, সেটিই এশিয়ার বৃহত্তম নদীগুলির উৎসস্থল। এই নদীগুলি শুধু তিব্বতের নয়, গোটা এশিয়ার প্রাণস্বরূপ। পূর্ব তিব্বতের খাম প্রদেশের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। ভূটানের সীমান্তের খুব কাছে নির্মিত হয়েছে একাধিক মেগা-ড্যাম। পরিবেশবিদরা বহুদিন ধরেই এই বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্কের কথা বলে আসছেন। সবাই জানেন, তিব্বতি মালভূমি লক্ষ লক্ষ টন তামা, লোহা, দস্তা, লিথিয়াম ও ইউরেনিয়ামের মতো বিরল খনিজের ভাণ্ডার। এর পরিবেশগত তাৎপর্য কতখানি, তা আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তবু এই বই তিনি কেবল নৈরাশ্যের সুরে শেষ করেননি। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি আশার কথা বলেছেন, করণীয় কাজের দিকনির্দেশ দিয়েছেন। সারা বিশ্বে তিব্বতি ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার যে উল্লেখযোগ্য প্রসার সাম্প্রতিককালে লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। একইভাবে তিনি গভীর আস্থা রেখেছেন তিব্বতের সাধারণ নাগরিকদের প্রতি। বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আজও সুগভীর। তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম এসেছিল চিন থেকেই— তাই তিব্বতের বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি চিনের সাধারণ মানুষের কোনও বিদ্বেষ নেই বলেই তিনি মনে করেন। তাঁর বিশ্বাস, আগামিদিনে চিনের সাধারণ মানুষ তিব্বতের পাশে থাকবেন।

