Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মেঘালয়ে খনি দুর্ঘটনা ও সরকারের ভূমিকা

রায়া দেবনাথ

 

২০১০ সাল, ৫ আগস্ট, চিলির কপিয়াপোতে স্যান হোসে সোনা-তামা খনিতে ধ্বস নেমে মাটির ২৫০০ ফুট গভীরে আটকে পড়েন ৩৩ জন খনি শ্রমিক। এই খনিটিতে আগে থেকেই ধ্বসের সম্ভাবনার কথা জানা থাকলেও, তাতে পাত্তা দেয়নি খনি মালিক স্যান ইস্টার্ন মাইনিং কোম্পানি। ওই ৩৩ জন কোনও রকমে রেসকিউ চেম্বারে গিয়ে আবিষ্কার করেন তাদের সুরক্ষার জন্য মালিক পক্ষ যে ওষুধের বাক্স দিয়েছিল তা খালি, রেডিওটি বিকল, ভেন্টিলেশন শ্যাফট মইবিহীন এবং সঙ্গের খাবার প্রতিশ্রুতির তুলনায় অনেক কম। মালিক কোম্পানিটি শ্রমিকদের উদ্ধারকাজে অংশ নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু এগিয়ে আসে চিলির সরকার। শুরু হয় উদ্ধারকাজ। চিলির সরকার নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণের সঙ্গেই সাহায্যের খোলা আবেদন পাঠান বিশ্বের কাছে। ১৭ দিনের মাথায় ড্রিলিং মেশিনের সঙ্গে উঠে আসে একটি নোট। বেঁচে আছেন ওই ৩৩ জন। নব উদ্যমে আরও জোরদার ভাবে শুরু হয় রেসকিউ অপারেশন। খাবার আর পোশাক পাঠানো হয় ভূগর্ভে বন্দি শ্রমিকদের কাছে। তিনটি পৃথক ড্রিলিং রিগ দল,  চিলি সরকারের তৎকালীন প্রত্যেক মন্ত্রী, নাসার প্রতিনিধিরা এবং গোটা পৃথিবীর ডজন খানেক সংস্থা এই রেসকিউ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। আটক শ্রমিকদের সহকর্মীরাও তাদের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অবশেষে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর, ৬৯ দিন পর, বিশেষ শক্তিশালী ক্যাপসুলে করে একে একে মাটির উপরে তুলে আনা হয় ৩৩ জনের প্রত্যেককে। জীবিত অবস্থায়। উদ্ধারকাজ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয়ে গেছিলেন সাংবাদিকরা। কাগজ কলম আর ক্যামেরা নিয়ে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল খবর। বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, প্রতিবেশী দেশের সরকার এগিয়ে এসেছিলেন উদ্ধারকাজ এবং উদ্ধার পরবর্তী শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য অর্থসাহায্য নিয়ে। ১৩ অক্টোবর, ২০১০, টেলিভিশন পর্দার মাধ্যমে অন্তত ১ কোটি মানুষ সাক্ষী ছিলেন ৩৩ জন সহমানুষের ৬৯ দিন পর আবার খোলা আকাশ দেখতে পাওয়ার মুহূর্তের। এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে, দ্য ৩৩ নামে, পরে একটি সিনেমাও তৈরি হয়।

২০১৮ সাল, ১৩ ডিসেম্বর। মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তিয়া পাহাড় জেলায় কসনে কয়লার একটি অবৈধ র‍্যাটহোল খনিতে কয়লা কাটতে নামেন ২০ জন শ্রমিক। স্থানীয়দের বয়ান অনুযায়ী, শ্রমিকদেরই কেউ একজন কয়লা কাটতে গিয়ে ফাটিয়ে ফেলেন গুহার দেওয়াল। ফলস্বরূপ খনির গা ঘেঁষে বয়ে চলা লাইতেন নদী থেকে হুড় হুড় করে জল ঢুকতে শুরু করে দেয় খনির ভিতর। বিপদ বুঝে খনির ভিতর থেকে কোনও রকমে বেরিয়ে আসেন ৫ জন। আটকে পড়েন বাকি ১৫। মাটির ৩৭০ ফুট গভীরে, ৭০ ফুট জলের তলায়! এবং এই প্রথম নয়! ২০১২ সালে দক্ষিণ গারোতে একটি র‍্যাটহোল খনি দুর্ঘটনায় ১৫ জন শ্রমিক ‘’নিখোঁজ’’ হয়ে যান। ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ থেকে ৯ জানুয়ারি, ২০১৯— এই সময়কালের মধ্যে ওই খনি থেকে এখনও অবধি ‘প্রাপ্তি’ পচনশীল মৃতদেহের গন্ধ, তিনটি ভাঙা হেলমেট আর ১৫ জন মানুষের লাশ হয়ে যাওয়ার দৃঢ় সম্ভাবনা। অন্যদিকে এই ক’দিনে খুলে গেছে একটা প্যান্ডোরার বাক্স। যতদিন গড়াচ্ছে সেখান থেকে রোজ বেরিয়ে আসছে নির্মম কিছু সত্যি ও আরও হাজারো প্রশ্ন।

হ্যাঁ, অবৈধ, বেআইনি। যে খাদানটিতে ১৩ ডিসেম্বর আটকে পড়েছিলেন ওই ১৫ জন, পার্শ্ববর্তী অন্যান্য বহু খাদানের মতো সেটিও আদতে অবৈধ। মেঘালয়ে মোট সঞ্চিত কয়লার পরিমাণ আনুমানিক ৬৪০ মিলিয়ন টন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কয়লা উত্তোলনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক ও অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে বিশেষত জয়ন্তী পাহাড় জেলার নদীগুলো ভীষণভাবে দূষিত হয়ে উঠছিল। নদীর জলে অ্যাসিডের মাত্রা উত্তরোত্তর বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ২০১৪ সালে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল, মেঘালয়ের (পূর্ব জয়ন্তীর সঙ্গে পশ্চিম খাসি ও দক্ষিণ গারোর এই ধরনের সমস্ত খনি) র‍্যাটহোল মাইনগুলিকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে। তবে শুধু পরিবেশ দূষণই নয়, এনজিটি আলাদাভাবে আরও দু’টি বিষয় নির্দেশ করে। ১) এই খনিগুলিতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ভয়াবহ অভাব, ২) এই খনিগুলি আদতে সার্বিকভাবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষদের আর্থসামাজিক জীবনমান খুব উন্নত করতে পারছে এমনটা নয়। খনিগুলি অবৈধ ঘোষিত হলেও খনি মালিক এবং মেঘালয় সরকারের মিলিত পিটিশনের ভিত্তিতে যে কয়লা এই মুহূর্তে উত্তোলিত হয়ে আছে তার সরবরাহের অনুমতি মেলে সুপ্রিম কোর্ট এবং এনজিটি উভয়েরই কাছ থেকে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯ এই অনুমতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে।

 

এই র‍্যাট হোল মাইনিং আসলে কী?

যথার্থ অর্থেই ইঁদুরের গর্তের মতো এই খনিগুলি। মাটির সঙ্গে প্রথমে খাড়া, তারপর আড়াআড়িভাবে সরু গর্ত খুঁড়ে ভূগর্ভের অভ্যন্তরে কয়লার স্তর অবধি পৌঁছানো হয়। এই গর্তগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এতই সরু হয় যে একসঙ্গে দু’জন তার মধ্যে পাশাপাশি নামতেও পারেন না। এক এক করে নেমে গোটা দিন ধরে হাঁটু মুড়ে ঘাড় বেঁকিয়ে ভাঙাচোরা হেলমেটের টিমটিমে আলোয় কয়লা ভেঙে যাওয়া। সন্দেহাতীতভাবে অত্যন্ত বিপজ্জনক, স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এবং নিরাপত্তাহীন। প্রসঙ্গত, মেঘালয় ব্যতীত ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে এই ধরনের খনি দেখতে পাওয়া যায় না।

২০১৪ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরেও কিন্তু বন্ধ হয়নি এই খনিগুলো থেকে বেআইনিভাবে কয়লা উত্তোলন। নিষিদ্ধ হওয়ার পর কিছুদিন খানিক ধরপাকড় চলেছিল বটে, কিন্তু সেই সময় ওই অঞ্চলগুলোতে বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল অপরাধের মাত্রা। যদিও তথ্য বলছে খনি মালিকদের পকেট ভারী হওয়া ছাড়া এই খনিগুলির মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে মেঘালয়ের ওই অঞ্চলগুলির মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনও রকম উন্নতি না হলেও এটাও বাস্তব যে আশপাশের এলাকার বেশ কিছু পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওই খনিগুলোতে কয়লা উত্তোলনের কাজই করে এসেছেন। এ ব্যতীত অন্য কোনও কাজই তাঁরা জানতেন না, বা অবস্থার ফেরে শিখে উঠতে পারেননি। ফলে বছরের পর বছর ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একই কাজ করে এসেছেন পেট চালাতে। হঠাৎ করেই ২০১৪ সালে খনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের বাস্তবিক অর্থেই অকুল পাথারে পড়তে হয়। বিকল্প পেশার সন্ধান না দিয়ে খনি বন্ধ নিয়ে সাময়িক বিতর্কও শুরু হয়। শুধু স্থানীয়রা নন, এই খনিগুলোতে কাজ করতেন বিহার, আসাম থেকে আসা বহু পরিযায়ী শ্রমিকও। তারাও সাময়িকভাবে দিশাহীন হয়ে পড়েন। তবে এই দশা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কারণ নিষিদ্ধ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ফের প্রশাসনের নাকের ডগাতেই রমরম করে ফের নিষিদ্ধ খনিগুলোতে খনন কাজ শুরু হয়ে যায়।

গোটা দেশের মতো মেঘালয়ের যে কোনও কয়লাখনিও ১৯৫২ সালের খনি অ্যাক্ট এবং ১৯৫৭ সালের খনি ও খনিজদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অ্যাক্ট-এর মধ্যেই পড়ে। যদিও মেঘালয়ের খনি মালিকরা দীর্ধদিন ধরে সিক্সথ শিডিউল এরিয়ার দোহাই দিয়ে এই খনিগুলোর উপর ইউনিক প্রপার্টি রাইট ক্লজের দাবি জানিয়ে এসেছে। এই ক্লজ অনুযায়ী ব্যক্তিগত মালিকানার ক্ষেত্রে এই খনিগুলি খনিমালিকদের একেবারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সমতুল্য। ফলত কোনও রকম সরকারি নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই এই খনিজাত সম্পদের উপর সীমাহীন একচ্ছত্র অধিকার খনি মালিকেরই। এই দাবির সারবত্তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও খনিমালিকরা এই সম্পত্তির মর্জিমাফিক ব্যবহারে কোনও ‘কার্পণ্যই’ করেননি। কোনও দিন! নিষিদ্ধ হওয়ার আগেও এখানে শ্রম আইন মানার কোনও উদাহরণ দেখা যায়নি। অবৈধ ঘোষণার পর বেআইনি উত্তোলনের ক্ষেত্রে শ্রম আইন মানার কোনও প্রশ্নই বোধহয় আর আসে না। ২০১৪ সাল থেকে খাতায় কলমে নিষিদ্ধ হওয়ার পরে এই খনিগুলি থেকে বেআইনিভাবে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খনিমালিকরা আয় করেছেন তা আদতে “কালো টাকা”। শুধু তাইই নয়, প্রশাসনিক উচ্চস্তরে বহু হর্তাকর্তার সঙ্গে এই খনিমালিকের “বন্ধুত্বের” জেরে খনি সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে দিনের পর দিন বেড়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণহীন দাপট। দাপট এতটাই যে এই মালিকদের ভয়ে ১৩ই ডিসেম্বরের দুর্ঘটনার পরেও এই নিয়ে খুব একটা মুখ খুলতে সাহস পাননি স্থানীয় বাসিন্দারা। এই খনিমালিকরা ২০১৪ সালের পর থেকে যথেচ্ছ হারে ধ্বংস করেছে প্রাকৃতিক সম্পদ, বিষিয়ে তুলেছে পরিবেশ। যত দিন গেছে, শ্র্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের উদাসীনতা পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।

শিলংয়ের বুদ্ধভানু সরস্বতী কলেজের গবেষক কৃষ্ণ চৌহানের একটি গবেষণা পত্র অনুযায়ী, বহু ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা এমনকি সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের সঙ্গেও এই খনিগুলোর যোগাযোগ একটি ওপেন সিক্রেট।

 

পেট বড় বালাই

খনি অবৈধ। নিরাপত্তার চরম অভাব। খনির অভ্যন্তর চরম অস্বাস্থ্যকর। এত সব কিছু জানার পরেও কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন এই খনিগুলোতে কাজ করে গেছেন, যাচ্ছেন শ্রমিকরা? সোজা উত্তর পেটের দায়ে, পরিবারের জন্য তুলনামূলক স্বচ্ছলতার সন্ধানে। অবৈধ ঘোষণার এই খনিগুলোতে কাজের পারিশ্রমিক চড়চড় করে বেড়েছে। যে পারিশ্রমিকের টানে এখানে আরও বেশি ভিড় জমিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। স্থানীয় অনেকেই ফের অবৈধ খাদানে কাজে ফিরেছেন কারণ, ওই যে, অন্য কোনও বিকল্প কাজের সন্ধানই তাদের জানা নেই। তাছাড়া, একদিন খনিতে কাজ করলে মেলে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। মাস গেলে অন্তত ২০-২৫ হাজার টাকার স্থায়ী ইনকাম। দিন আনি দিন খাই পরিবার অগ্রাহ্য করবে কীসের ভরসায়? এ অঞ্চলে একেবারে শিশুশ্রমিক তেমন দেখা না গেলেও, ১৫-১৬ বছরের কিশোর শ্রমিকদের সংখ্যা কম নয় কিন্তু। তারাও বাড়ির বড়দের পথ অনুসরণ করে খনিতে কয়লা কাটতে শিখে যাচ্ছে। দ্রুত! বাড়ির বড়রাই হাতে ধরে তাদের এই অবৈধ খাদানে নিয়ে আসছেন।

অতএব প্রাণ হাতে করে লজঝড়ে হেলমেট, প্রাগৈতিহাসিক লিফট সম্বল করে নিচে নামা। পরিণতি কতটা ভয়ানক হতে পারে তার একটা ছোট্ট উদাহরণ গত ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা। এবং তারপর? চিলিতে যেভাবে ৩৩ জনকে বাঁচাতে গোটা দেশ, তার সরকার, মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছিল— এখানেও তো তাই হওয়া উচিত ছিল, তাই না?

 

কিন্তু বাস্তবে কী হল?

১৩ তারিখ বিকেলেই ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে এই দুর্ঘটনার খবর পৌঁছায়। উদ্ধারকারী একটি দলও পাঠানো হয়। কিন্তু তারা জানায় এ তাদের কম্ম নয়।

পরেরদিন মধ্যরাতে গুয়াহাটি থেকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের একটি দল এসে পৌঁছায়, এবং পরের দিন সন্ধে অবধি “ঘটনা পর্যবেক্ষণ’’ করেই তাঁরা কাটিয়ে দেন।

রাতের বেলা দলটি জানায় খনির ভেতর ৭০ ফুট জল, খনিকে জলমুক্ত করতে হবে। দলটি মাত্র ২৫ অশ্বশক্তি যুক্ত দু’টি পাম্প পায়। আসে শব্দ শুনে বস্তুর অবস্থান নির্ণয়ের যন্তর। অন্যদিকে ডুবুরিরা জানান অত গভীরে জলের মধ্যে কাজ করতে তারা যথাযথ প্রশিক্ষিত নন। এবং উভয়ের দ্বারাই উদ্ধারকাজ এক ফোঁটাও এগোয় না।

ঘটনার তিনদিন পরে, ১৬ ডিসেম্বর, খনি সুরক্ষা দফতরের ডিরেক্টর ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারকে, কোল ইন্ডিয়াকে চিঠি লিখে দ্রুত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প চাইতে বলেন। এবং তারপরেই শুরু হয় টানা ১০ দিন ব্যাপী অদ্ভুত এক অধ্যায়। এই ১০ দিনে কী কী হয়েছে? আরও বিশেষজ্ঞ এসেছেন। তাঁরাও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাম্পের কথা বলেছেন। কিন্তু কোল ইন্ডিয়াকে চিঠি লিখে পাম্প চাওয়া হয়নি। খনিমধ্যস্থ জলের অ্যাসিডিক লেভেল মেপে বোঝা গেছে তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে খনিতে জল ঢুকছে। কিন্তু কোল ইন্ডিয়াকে চিঠি লেখা হয়নি।

ইতিমধ্যে, পূর্ব জয়ন্তী পাহাড়ের ডেপুটি কমিশনার মেঘালয়ের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারকে চিঠি পাঠিয়েছেন। বার বার করে ১০০ অশ্বক্ষমতার পাম্পের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেছেন, কিন্তু ওই যে এর মধ্যে চলে এসেছে ক্রিসমাস। অতএব জল সরিয়ে খনি থেকে খান ১৫ শ্রমিক উদ্ধারের মতো ‘নগণ্য’ কাজে মনোনিবেশের থেকে সরকারি পদাধিকারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার থেকে অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বড়দিনের ছুটি করানোর মতো ‘কাজে’।

২৪ ডিসেম্বর এনডিআরএফ ওই ছোট পাম্পদুটোও বন্ধ করে দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এনডিআরএফ কর্তা জানান “সবাই এখন বড়দিনের ছুটি কাটাচ্ছে, আমরাও তাই এগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প এলে আবার কাজ শুরু করব।’’

ওই দিনই একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী রাজ্য সরকার নাকি তখনও পাম্পগুলো পাঠানোর আগে তা “পরীক্ষানিরীক্ষা” করে দেখছে। শুধু কি এইটুকু? অবশ্যই নয়। এই গোটা উদ্ধারকাজের সরকারিভাবে মূল দায়িত্বে থাকা, additional চিফ সেক্রেটারি পিডব্লিউ ইনগটিও এই সময় বড়দিনের ছুটিতে ছিলেন। অবশেষে টেকনিক্যাল সাহায্য চেয়ে কোল ইন্ডিয়ার কাছে চিঠিটি পৌঁছায় ২৬ ডিসেম্বর। এবং এই সময় মুখ্যমন্ত্রী তো কোন ছাড় মেঘালয়ের কোনও মন্ত্রীই একবারের জন্যও দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার প্রয়োজনটুকু বোধ করেননি।

২৯ নভেম্বর অর্থাৎ ঘটনার ১৬ দিন পর নৌবাহিনীর একটি দল এবং ওড়িশার ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের অন্য একটি দল ওই খনির কাছে পৌঁছায়। ওই দিনই ভুবনেশ্বর থেকে দু’টি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প আসে। দু’দিনের মাথায় কোল ইন্ডিয়া থেকে পাঠায় আরও দু’টি পাম্প। কির্লোস্কার ব্রাদারদের তৈরি এই ধরনের পাম্প ব্যবহার করা হয়েছিল থাইল্যান্ডে ভূগর্ভে আটকে পড়া কিশোর ফুটবলারদের উদ্ধারকাজে।

রাজ্য সরকারের উদ্ধারকাজে এই চরম গাফিলতির সময় কেন্দ্র সরকার কী করছিল? কেন? অপেক্ষা করছিল! একটা চিঠির, একটা অনুরোধের। আপৎকালীন ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেন কেন্দ্র সরকার কোনও উদ্যোগ নিল না? কারণ সেই সময় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাশের রাজ্য অসমে বগিবিল ব্রিজ উদ্বোধনে গিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন, কেন্দ্রের প্রধান বিরোধী দলনেতা কেন প্রধানমন্ত্রী সেলফি তুললেন, কেন দুর্ঘটনাস্থলে গেলেন না এই সব নিয়ে ভাবতে এতই ব্যস্ত রইলেন যে নিজেও সেখানে যাওয়ার সময় পেলেন না। ভুলে গেলেন মেঘালয় বিধানসভায় তাঁর দলেরও ২০ জন বিধায়ক আছেন।

এবং এই ১৬ দিন ঐ ৭০ ফুট জলের নিচেই কোনও রকম উদ্ধারের চেষ্টা না করেই ফেলে রাখা হয় ১৫ জন শ্রমিককে। হয়ত ততদিনে তারা সবাই মরেই গেছেন, হয়ত কোনও রকমে বেঁচে ছিলেন কেউ কেউ, কিন্তু ওই ১০ দিন তাদের লাশের খোঁজটুকুও কেউ করেনি।

এই মুহূর্তে যন্ত্রপাতির অভাব নেই। কিন্তু, শ্রমিকদের বেঁচে থাকার আশাও আর নেই। কারণ, ওই গর্তের মধ্যে জলের নিচে কোনও রকম খাদ্যের সরবারহ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও মানুষ বাঁচে না।

এইভাবে অবৈধ খাদানে ভয়ানক পরিস্থিতিতে কীভাবে এখনও খনন কাজ চলছে সেই নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন তুলছিলেন সমাজকর্মী অ্যাগনেস খারশিং। ২০১৮-র ৮ নভেম্বর এই নিয়ে খোঁজ খবর করতে গিয়ে জনা তিরিশ লোকের হাতে মার খান তিনি ও তাঁর সঙ্গী অমিতা সাংমা। তাঁরা এই ঘটনার সিবিআই তদন্ত দাবি করেন। এই সময় মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কোনার্ড সাংমা একটি আগ্রহোদ্দীপক দাবি করেন— ‘‘As per the information available with the Government, no mining has been done ever since the NGT has put a ban in 2014.”

যদিও, ১৩ ডিসেম্বরের ঘটনার জেরে মুখ্যমন্ত্রী নিজের অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে জানান— “We are aware of the illegal activities going on and this again is something that is not correct at all and appropriate action will be taken at appropriate time against the people who are involved in the illegal mining as this is not acceptable.”

 

এবং মিডিয়া

থাইল্যান্ডে ১৩ কিশোরের উদ্ধারকাজের সময় গোটা পৃথিবীর মত ভারতীয় মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবং ঠিক করেছিল।

২০০৬ সালে হরিয়ানার ৫ বছরের শিশু প্রিন্সকে উদ্ধারের সময় মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং ঠিক করেছিল।

কিন্তু কী হল মেঘালয়ের ক্ষেত্রে? দীপিকার বিয়ে, প্রিয়াঙ্কার হানিমুন, আম্বানির মেয়ের বিয়েতে অমিতাভের পরিবেশনের মতো “ভীষণ’’ জরুরি খবর পরিবেশনের মধ্যে ১৫টা জলজ্যান্ত মানুষের বাঁচামরার লড়াই ঠাঁই পায়নি।

আসলে উত্তরপূর্ব। এখানে বছর বছর বন্যায় মানুষ ভেসে যায়, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা রক্তাক্ত হয়, রাস্তা, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক পরিষেবার জন্য মাথা ঠুকে মরে, দিল্লিতে রাজা রানি বদল হয়, তাদের দলের বদল হয়, বদলায় না উত্তরপূর্বের মানুষের অবস্থা। “মূল’ ’ভূখণ্ডে পরিচিতি পেতে গেলে ছ’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মেরি কমের রুপোলি পর্দার মুখ হয়ে নামতে হয় উত্তরভারতের প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে। টুরিস্ট ডেস্টিনেশন, বিহু, চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি… এইতো উত্তরপূর্ব নিয়ে আমাদের ছেঁড়া ফাটা সার্বিক জেনারেল নলেজ। এমনকি যে আঁতেল বাঙালি চুটকিতে রাহুল থেকে মায়াবতী, অখিলেশ থেকে টিএন সেশন, চন্দ্রবাবু নাইডু থেকে বিজয়ন ইত্যাদিদের নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করতে পারবে, মেঘালয়ের রাজনীতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে-ই আবার গুগল ঘাঁটবে।

একটু ‘অন্যরকম’ দেখতে ‘ওদের’ তো, তাই এই আমরা ‘মূল’ ভূখণ্ডের বাসিন্দারা চিরকালই ওদের অপর করে রাখলাম। আর সম্ভবত তারই খেসারত দিল ১৫টা জ্যান্ত মানুষ।

আইন নিয়ম নিষেধাজ্ঞাকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে কিভাবে অবৈধ খনিতে এই ভাবে এখনও খনন কাজ চলে সেই প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, যেভাবে ১৫টা মানুষের উদ্ধারকাজে ঘুমিয়ে রইল প্রশাসন, ঘুমিয়ে রইল মিডিয়া, ঘুমিয়ে রইল রাষ্ট্র, তা ভাবনার অতীত ঘৃণ্য। তিলতিল করে শেষ হয়ে গেল মানুষগুলোর বাঁচার সম্ভবানা। অবহেলায় যেভাবে ফেলে রাখা হল তাদের, তা বোধহয় অমানবিকতার নয়া নিদর্শন তৈরি করল।

বছরের দ্বিতীয় দিনই রাজ্য সরকারের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছে শীর্ষ আদালত। আর জানিয়েছে, যদি লাশই থাকে, বের করে আনা হয় যেন তাই। হ্যাঁ, আপাতত লাশ খোঁজার পালা চলছে। যে বৃদ্ধ বাবা যুবক ছেলেকে খুঁজতে বারবার খনিতে নামার আবেদন করেছিলেন, জানি না এখন তিনি কী করছেন। মেঘালয় সরকার প্রতি লাশ পিছু লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছে। জানি না উঠবে কিনা সেই লাশ, জানি না কবে উঠবে সেই লাশ, জানি না সেই লাখ টাকা পাওয়ার পরে কেমন করে চলবে তাদের পরিবার। খনিগুলোর খনন বন্ধ হয়েই যাওয়া উচিত। জানি না এই ঘটনার পরে আশপাশের ৯০টা অবৈধ খনির উপর নজরদারি তীব্র হলে কী হবে পরিযায়ী আর স্থানীয় শ্রমিক আর তাদের পরিবারের? কোনও সরকার তাদের নতুন কাজ দেবে কি? শেখাবে নতুন কাজ? একমাসের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের আকাশপাতাল পার্থক্যের পর কেন আঙুল উঠল না তার দিকে? সর্বোপরি এতটা অবহেলা কেন? দরিদ্র এবং উত্তরপূর্ব বলে? নাকি আরও গভীর কোনও আঁতাত আরও গভীর কোনও ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবে বলে?

আসলে এই একটা প্রশ্নেরও উত্তর আমার জানা নেই। হয়ত জানতেও পারব না কোনও দিন। শুধু মনে মনে চাইব ওই ১৩ তারিখেই যেন মরে গিয়ে থাকে ঐ ১৫ জন। এই এতদিন ধরে দমবন্ধ পরিবেশে নড়াচড়ার একটুও সুযোগ না পেয়ে না খেতে পেয়ে তিল তিল করে মরার থেকে ওই সেইদিনই একেবারে মরে যাওয়া ভালো। জানি আমার ভাবনায় বাস্তব বদলাবে না, কিন্তু আমরা তো স্বার্থপর আদতে সবাই, ওই ভয়ানক জিনিস ভাবতে গিয়ে আতঙ্কিত হতে চাই না। তার চেয়ে ওদের লহমায় মৃত্যুর বাস্তব অথবা কল্পনাটুকু থাক। কতটা যন্ত্রণা হয়েছিল, সে তো আর কেউ জানবে না, আর লাশেরা কথা বলে না।

ও হ্যাঁ, দিন দুয়েক আগে একটি র‍্যাট হোল মাইন দুর্ঘটনায় দু’জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। এবং ৯ জানুয়ারি ২০১৯ অবধি ১৫ জন শ্রমিকের তিনটে ভাঙা হেলমেট উদ্ধার হয়েছে শুধু…