“জোটবাঁধা মানুষ কখনও হারে না…”

"জোটবাঁধা মানুষ কখনও হারে না"

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

El pueblo unido jamás será vencido…
(The people united will never be defeated)

১৯৭৩ সালে বানানো চিলি দেশের এক গানের দল Quilapayun-এর এই গানে এখন চিলির রাজপথ মুখরিত৷ কখনও বা শোনা যাচ্ছে বিশ্বজোড়া মেহনতি মানুষের গান ‘ইন্টারন্যাশনাল’। মানুষের দাবি ছিল, পদত্যাগ করতে হবে দেশের প্রেসিডেন্টকে। শেষ পর্যন্ত পুরো মন্ত্রিসভাই বরখাস্ত করলেন চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনিয়েরা। জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে বদল আনবেন দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয়। এবং সে জন্যই ঢেলে সাজাবেন মন্ত্রিসভা।

মূল্যবৃদ্ধি ও ক্রমাগত বেড়ে চলা আর্থিক বৈষম্যের প্রতিবাদে বিগত এক দশক ধরেই প্র‍তিবাদ জানাচ্ছিলেন চিলির সাধারণ মানুষ। শেষ কয়েক সপ্তাহে তীব্রতর হতে হতে সেই বিক্ষোভ বিপুল আকার ধারণ করে ২৮শে অক্টোবর। সান্তিয়াগো-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে সে দিন রাস্তায় নেমেছিলেন কয়েক লক্ষ মানুষ। অন্তত দশ লক্ষ মানুষের সমাবেশে অচল হয় রাজধানী। পিনিয়েরার পুলিশ শান্তিপূর্ণ সেই মিছিলেও লাঠি-গুলি-কাঁদানে গ্যাস চালায় নির্বিশেষে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী কয়েকশো মানুষ গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সরকারিভাবে কোনও আহত বা মৃতের সংখ্যা জানানো হয়নি। গত সপ্তাহে বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশের লাঠি-গুলি চলায় নিহত হয়েছিলেন অন্তত ১৭ জন। প্রাক্তন স্বৈরাচারী শাসক অগাস্তো পিনোশের জমানা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে গত তিন দশকে এত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর দেখেনি চিলি।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি)-র হিসেব অনুযায়ী পৃথিবীর ৩০টি ধনী রাষ্ট্রের মধ্যে চিলিতেই আর্থিক বৈষম্যের হার সব থেকে বেশি। গত কয়েক বছরে এই বৈষম্য আরও বেড়েছে। গত বছরে পিনিয়েরা দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে (এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি) নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও পরিষেবার খরচ ক্রমাগত বাড়ে। শেষে মেট্রোর ভাড়া এক লাফে ৩০ পেসো বেড়ে যাওয়ায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ।

১৯৭৩ সালে চিলির ডিক্টেটর অগাস্তো পিনোশের নির্দেশে দমন করা হয়েছিল সেই দেশের শ্রমিক বিদ্রোহ। মার্ক্সিস্ট সালভাদর আলেন্দের সরকারের পতন ঘটিয়ে শুরু হয় মার্কিন মদতপুষ্ট মিলিটারি শাসন৷ সতেরো বছরের মিলিটারি শাসনের পর গণতন্ত্র এলেও ডিক্টেটরের সংবিধান ছিল প্রায় অপরিবর্তিত৷ চিলির মসনদে এখন ছিলেন সেবাস্তিয়ান পিনিয়েরা, যিনি মার্কিন দেশের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলেন। সাধারণ মানুষের মতে ধনীরা ধনীতর হয়েছে, দারিদ্র্য আর অভাবে ছটফট করেছে গরীবের দল। নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্তর।

গত ১৩ অক্টোবর দেশের সাবওয়ের ভাড়া ৩০ পেসো বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভে নামে প্রথমে ছাত্ররা, যুবসম্প্রদায়, তারপর আপামর মানুষ৷  শুরু হয় ধড়পাকড়, মারধর, পয়েন্ট জিরো রেঞ্জ থেকে গুলি চালানো এবং শেষপর্যন্ত সরকার কর্তৃক যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা৷  এই সময় কীভাবে যেন ভাইরাল হয়ে গেল এক ভিডিও। মেরে আধমরা করে দেওয়া মানুষদের উলঙ্গ করে দৌড় করাচ্ছে পুলিশ! আগুনে ঘি পড়ল। সান্তিয়াগোর রাস্তায় নামল মানুষের ঢল। গুলি, লাঠি, জলকামান, আহতদের চিকিৎসা আটকানোর ষড়যন্ত্র, সবকিছুর পরেও ভয় পেল না চিলি। বরং নরম হল শাসকের সুর!

শিক্ষক বলছেন, তিনি চান স্বচ্ছ সরকার, চান আর্থিক বৈষম্যের অবসান, চান মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম, চান আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। ক্যামেরাশিল্পী বলছেন, সরকার আর কর্পোরেটকে দেশ লুঠতে আর দেবেন না। বলছেন, দেশ এগোল, তবু শ্রম-আইন আর শিক্ষা-আইনের বদল হল কই?  মেক-আপ আর্টিস্ট মেয়েটি বলছে, বারো ঘণ্টার বদলে চাই আট ঘণ্টার ডিউটি। ছাত্র বলছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধি চলবে না, চলবে না পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধিও। ফিল্মমেকার বলছেন, মানুষকে ক্রীতদাস বা ক্রিমিনালের চোখে দ্যাখে যে সরকার, তার পতন হোক৷ ট্রান্স মানুষটি বলছেন, চাই তাঁর কমিউনিটির অধিকার৷ এভাবেই এক সাতরঙা প্রতিরোধের সাক্ষী হয়ে থাকল রাজধানীর রাজপথ৷ আর থাকল ৭৩ সালের সেই গানের রেশ। El pueblo unido jamás será vencido…

The people united will never be defeated.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...