মনোজ কুমার, আদিবাসী এবং আরাকু কফির গল্প

মনোজ কুমার, আদিবাসী এবং আরাকু কফির গল্প

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

সন দু হাজার এক। বিশাখাপত্তনম থেকে পনেরোশো মিটার দূরের আরাকু উপত্যকা। অনন্তগিরি, বোরা গুহালু, চাপারাই, কাটিকির আরাকু। পূর্বঘাটের কোলে শোয়া মোহময়ী আরাকু। সালের উল্লেখ করা কেন? কারণ, সেবছরই মনোজ কুমার আরাকু এলেন। নন্দী ফাউন্ডেশনের প্রধান। কেরলের অর্থনীতি পড়া মানুষ। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালে কাজ করা মানুষ। লড়াই করার মানুষ মনোজ। কোন লড়াই? সে গল্পে আসছি।

কফি। আদিবাসী। উপত্যকা। মনোজ দেখলেন আরাকুর উষ্ণ দিন এবং শীতল রাত্রি। দেখলেন মাটি, বৃষ্টির সহাবস্থান। দেখলেন রাজ্য সরকারের লিজ নেওয়া কফি বাগান। অনন্তগিরি লাগোয়া। মনোজ দেখলেন একটা বড় ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। আদিবাসী, উপত্যকার আদিবাসীদের মধ্যে কফি চাষের আগ্রহ তলানিতে। মনোজ দেখলেন কফি বাজার তৈরি করতে হলে এদিকটাই ধরতে হবে। বাধা এল। আদিবাসী? আবার ওদেরকে কেন? কফি থেকে পাঁচ ছয় বছর পর মূলধন পাওয়ার অপেক্ষায় ওরা আসবে? সেই ধৈর্য আছে ওদের? শিক্ষা আছে? অসহযোগিতা পাবেন। যাবেন না। তবু, মনোজ গেলেন। দেখলেন বিপরীত ছবিটা। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সেরকম অ্যাপ্রোচ কোথায়? আদিবাসীরা বিরক্ত। এই ফাঁকটা ধরলেন মনোজ। বোঝালেন। ফলাফল হাতেনাতে।

দু হাজার একে শুরু করে দুহাজার পাঁচে হাজার দুয়েক আদিবাসী কফিচাষী। আরও পাঁচ ছ বছর পর আরও বাড়ল। আদিবাসীদের কোঅপরেটিভ হল। সংক্ষেপে যার নাম SAMTFMACS। বোর্ডে তিরিশজন আদিবাসী। বাইরের কেউ নেই। আরাকুর সাতশ চল্লিশটি গ্রামের পঞ্চাশ হাজার একর জায়গায় লড়াই করা হাজার দশেক ফার্ম। পঁচিশ হাজার চাষী। এগ্রহের অন্যতম বৃহৎ জৈব চাষ সমবায় প্রকল্প। নিজের হাতে কফি চাষ, মাটি, আবহাওয়া, কম্পোস্টিং, কফি উৎপাদন ও বাজার সংক্রান্ত আদিবাসীদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আরাকু কফিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। বছরে একশো টন কফির উৎপাদন। মনোজের নেতৃত্বে আদিবাসীদের লক্ষ্য প্রত্যেক হার্ভেস্টের পর উন্নততর কফি বিন তৈরি।

সঙ্গী। মনোজের এই জয়যাত্রায় শুরুটা একা হলেও পরে পেয়েছেন অনেককেই। নিউজিল্যান্ডের ডেভিড হগ। ভারতপ্রেমী। কৃষিপ্রেমী। কোদাইকানালে সাধুর মতো জীবনযাপন করতেন। মনোজ হগকে আরাকুতে নিয়ে এলেন। হগের বায়োডায়নামিক্স কৃষি ম্যাজিক দেখাল। চাষীদের বোঝালেন হগ। আরাকুতে বিদেশি, অর্থাৎ আরাকুর মাটির পক্ষে সহনশীল নয় এমন বৃক্ষের উৎপাদন বন্ধ করে আদিবাসীদের লাগাতে বললেন নেটিভ ট্রি। দেশীয় গাছ। আম, জাম, গোলমরিচ। পাখিরা আসবে। মৌমাছি আসবে। বিষ্ঠা, পরাগরেণু কফি উৎপাদনে কখনও সার, কখনও অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। তাই হল। উৎপাদন বাড়ল হুহু করে। তেইশ মিলিয়ন গাছ লাগাল আদিবাসীরা। বৃক্ষরোপণের রেকর্ড স্থাপন। এবং কার্বন ক্রেডিট। আরাকু উপত্যকার চাষীদের থেকে ক্রেডিট কিনে নিল ইউরোপীয় সংস্থাগুলো। আর্থিক সঙ্গতি হল। চাষীরাও উৎসাহ পেল।

ব্যক্তিগত লাভ? দেশের অন্যান্য আদিবাসী প্রকল্পে কুড়ি শতাংশ লভ্যাংশও নিজেদের জোটে কিনা সন্দেহ। সেখানে আরাকু কফি অরিজিনালস, আরাকুর ব্র্যান্ড কফি থেকে আদিবাসিদের আয় আশি শতাংশ। আই রিপিট। আশি শতাংশ।

সিগনেচার। সিলেকশন। গ্র্যান্ড রিজার্ভ। মাইক্রোক্লাইমেট। চারধরনের ভ্যারাইটি আরাকু কফির। নিজস্ব অ্যারাবিকা কফি ছাড়াও আরাকু কফির তৈরি স্পেশালিটি কফি পৃথিবীর বহু কর্পোরেট এবং টেস্টারদের মতে সুস্বাদুতম। হায়দ্রাবাদের ছোট একটি রেস্তোরার পর বেঙ্গালুরুতে দেশের বৃহত্তম কফি শপ বানাচ্ছে আরাকু কফি। তারপর মুম্বইতেও।

ভালো আছেন আদিবাসীরা। তবে মনোজের লড়াই শেষ হয়নি। এবার তাঁর লক্ষ্য বিদর্ভ। রাসায়নিক চাষ, দারিদ্র, আত্মহত্যার দেশ বিদর্ভ। ওখনে জৈব চাষ ধরবেন। পারলে, একমাত্র মনোজ কুমারই পারবেন।

মনে পড়ছে কফি মিউজিয়াম। সঙ্গীতে, শোভায়, আবহে অন্যরকম। জমজমাট। নেপথ্যে গল্পটা। বলা রইল। প্রিয় পাঠক, আরাকু গেলে একবার ঘুরে আসুন। জেনে আসুন। চেখে আসুন…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...