Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

উত্তরপ্রদেশ : সংকীর্ণ ভোট-রাজনীতির সূতিকাগার

উত্তরপ্রদেশ

সফিউল

 

 

এখনও পর্যন্ত যে ১৪ জন ব্যক্তি স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন তার মধ্যে ৮ জন উত্তরপ্রদেশ থেকে। বৃহৎ রাজ্যগুলির অন্যতম হিসাবে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে উত্তরপ্রদেশ বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক যুদ্ধের ময়দান। প্রধানমন্ত্রী তৈরি করায় উপরের উচ্চ পরিসংখ্যানই ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখা নরেন্দ্র মোদিকে উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে টেনে এনেছিল কিনা সঠিকভাবে বলা কঠিন। হয়তো সংস্কার কুসংস্কারে ভরপুর মানুষ নিজের সুরক্ষা সব দিক থেকে নিশ্ছিদ্র করতেই উত্তরপ্রদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্যনির্ণায়ক ভূমিকাটিকে স্বীকার করেছেন।

কিন্তু এতজন প্রধানমন্ত্রী উপহার দেওয়া উত্তরপ্রদেশের সামাজিক রাজনৈতিক উল্লম্ফনের বিশ্লেষণ করলে যথারীতি হতাশা ভিন্ন কিছু পাওয়া যায় না। ধর্ম জাতপাতের রাজনীতির জাঁতাকল থেকে দেশের মুক্তি আনতে এতগুলি প্রধানমন্ত্রী কিছু ভূমিকা রাখতে পেরেছেন কি? সামাজিক অস্পৃশ্যতা থেকে কোনও মুক্ত বাতাস এসেছে? শিক্ষা সংস্কৃতির দিক থেকে কোনও উৎকৃষ্ট অবদান এসেছে? একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে অন্যতম ঘন মুসলিম সন্নিবিষ্ট রাজ্যে সংখ্যালঘু নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে? সবগুলির উত্তর এক বৃহৎ শূন্য।

স্বাধীনতার পর কিছুদিন পর্যন্ত এই উত্তরপ্রদেশে কিছুটা বাম রাজনীতির প্রভাব ছিল, তারপর যেভাবে বাম রাজনীতি, শ্রমিক রাজনীতি বিনষ্ট হয়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়েই উত্তরপ্রদেশে ধর্ম ও জাতপাতভিত্তিক বিভেদমূলক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়েছে। ২০১১ সালের সেন্সাস থেকে দেখা যাচ্ছে এই রাজ্যে ৭৯.৭% হিন্দু এবং ১৯.২% মুসলিমের বসবাস, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ সহ অন্য ধর্মের মানুষের সংখ্যা ২%-এর কম। রাজনীতির উদ্দেশ্য যেখানে বৃহত্তর উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্রতাকে ত্যাগ করা, সেখানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতে সবসময় বিভাজনকে কাজে লাগানো হয়েছে ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধি করতে।

বর্তমান সময়ে জাতপাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে মূলত দুটি সংগঠনকে দেখা যায়, যাদের বাহ্যিক বক্তব্য কিছুটা মিললেও আভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য ও পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদিকে বামপন্থী সংগঠনগুলি পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ, ভোটের নিরিখে তো বটেইসমাজ সাংস্কৃতিক দিক থেকেও তাদের প্রভাব সমগ্র উত্তরপ্রদেশে হতাশাজনক। সেখানে “ভোটবাজ” বামদল বা “বিপ্লবী” বামদল সবার পরিণতিই কমবেশি একই রকম। অন্যদিকে সঙ্ঘী মতাদর্শ, উত্তরপ্রদেশের ১৯% ও সারা দেশের ১৪% মুসলিমের বিরুদ্ধে বাকি জাতপাতে বিভক্ত হিন্দু সমাজকে একমাত্রিক এক হিন্দু মতাদর্শের আদর্শে সংগঠিত করে যা বর্তমানে দেশের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়েছে। মুসলিম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে যে রাজনীতি সঙ্ঘ পরিবার করে চলেছে তার হাত ধরে বাকি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতির থেকেও তাদের লক্ষ্য বরাবর থেকেছে হয় রামদেবের মতোভণ্ড ব্যবসায়ী বা আদানি বা আম্বানিদের সেবা করা। তবে সংঘীদের চতুর রাজনীতি এমনকি মুসলিম জনগণেরও একাংশের ভোট দখল করে নিয়েছে।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সর্বভারতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে যে বহুমুখী লড়াই হয়, উত্তরপ্রদেশকে তার মধ্যে একটি মডেল হিসাবে ধরাই যেতে পারে। দিল্লির নিকটবর্তী রাজ্য ও গঙ্গা যমুনা সহ অনেকগুলি নদী এই রাজ্যকে অনেকগুলি উৎপাদন শিল্পের পীঠস্থান করে তুলেছে। যেখানে লড়াই একই সঙ্গে বৃহৎ পুঁজির ও ক্ষুদ্র পুঁজির অসম দ্বন্দ্বের। শ্রমিক সমস্যার সবথেকে সহজ সমাধান বাহুবলি পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া। তাই শিল্পাঞ্চলে মাফিয়া দৌরাত্ম্য অনেকটাই বেশি। শ্রমনিবিড় শ্রমিক সংগঠনের অনুপস্থিতিতে মাফিয়ারাই এই অঞ্চলের শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সরাসরি মধ্যপক্ষ। এরাই নির্বাচনের সময়েও প্রায় সব দলের তুরুপের তাস। ১৯৮৪ সালে যে কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশের প্রায় সবকটি আসন দখল করেছিল, ১৯৯৮ সালেই তা শূন্যে নেমে এসেছিল। এর মধ্যেই ভারতের ধর্ম ও জাতপাতের রাজনীতির যে ঘুমন্ত দৈত্য চাপা ছিল তা তীব্রভাবে জনজীবনে আত্মপ্রকাশ করে ফেলে। ১৯৮৫/৮৯ পর্যন্ত জনসঙ্ঘ বা বিজেপি সংসদে ৮৫ আসনের মধ্যে ১০-এর মধ্যে ও বিধানসভায় ৮০-র মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার গণ উন্মাদনা এবং তারও আগে মন্ডল কমিশন বিরোধী উন্মাদনা সৃষ্টি করে এক লাফে বিজেপিকে লোকসভায় ৮৫ আসনের মধ্যে ৫১টির দখল এনে দেয়। ১৯৮৯-এ ৪৩০ আসনের বিধানসভায় বিজেপির ৫৭ আসন ছিল, ১৯৯১-এ সেই আসন সংখ্যা ২২১-এ পৌঁছে দেয়। হিন্দু রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে হিন্দু বেকার যুবকদের স্বপ্নপূরণের বীজ বপন করেছিল ফ্যাসিস্টরা।

৯০-এর দশকের প্রাথমিক পর্যায়ে হিন্দু ভোটের ঘনীভবন খুব দ্রুত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অপ্রাপ্তির হতাশাও ডেকে আনে। বাবরি মসজিদের ধ্বংস অস্পৃশ্যতা দূরে ঠেলতে পারেনি, আর্থিকভাবে সক্ষম হয়েও দলিত যুবকের ঘোড়ায় চেপে বিয়ে করতে যাওয়াও অসম্ভব করে রেখেছে, এমনকি দলিত হয়ে গোঁফ রাখলেও সামজিক অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হয় এখনও। আর এই সব কিছুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠে এসেছিলেন মায়াবতী। ১৬% বর্ণহিন্দু (৮% ব্রাহ্মণ)-র রাজনীতির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায় ওবিসি ও দলিত পরিচিতিভিত্তিক সমাজবাদী ও বহুজন সমাজবাদী দল। ৯০-এর দশকের শুরুতে ১৯% মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার চাষবাস করে যে বিজেপির উত্থান হয় তাকে ৯০-এর দশকের শেষেই দলিত রাজনীতির মসিহা মায়াবতী যিনি আবার কিছুটা মুসলিম সমর্থন পেয়েছিলেন তাদের সঙ্গেই জোট বেঁধে টিকে থাকতে হয়। অন্যদিকে ৪৪% ওবিসির (৯% যাদব, ৭% লোধী, ২.৭% জাঠ, কুশাওয়া ৭%, কুর্মি ৭%, গুজ্জর ১.৫% ও অন্যান্য ১০%) ও ১৯% মুসলিমদের একটা বড় অংশের সমর্থন নিয়ে নতুন শতকে সমাজবাদী দল ক্ষমতায় টিকে থাকে প্রায় এক দশকের বেশি। এদের মধ্যে কুশাওয়া ও জাঠ বরাবর বিজেপির সঙ্গে থেকেছে। স্বাধীনতার পর থেকে যে এককাট্টা মুসলিম ভোট কংগ্রেস পেয়ে এসেছিল তাতে ফাটল ধরে যায়, এবং সেই ভোট সপা বা বাসপার দিকে যাওয়ার ফলে কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশ থেকে ধুয়ে মুছে যায়। ২০১৭ সালে ৪০৩ বিধানসভায় বিজেপি জোটের ৩১০+ আসনের জয় দীর্ঘদিনের জাতপাতের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের উত্থান ঘটিয়েছে। সব ধর্ম ও জাতি থেকে নির্ণায়ক সংখ্যক ভোট একমাত্র কংগ্রেসই ভারতে পেয়েছে, ২০১৪ সালে সেই একই পরিস্থিতি বিজেপির জন্যও ছিল। এমনকি মুসলিমদের একটা অংশের ভোট তারা পেয়েছিল। ২০১৪ সালে ৮০টির মধ্যে ৭৩টি আসন দখল করে বিজেপি যে উথালপাথালের সূচনা করে, তার শেষ প্রদর্শনী হিসাবে ২০১৭-এর বিধানসভা নির্বাচনকে উল্লেখ করা যেতে পারে। ৮% ব্রাহ্মণ ও ৮% ঠাকুর সম্প্রদায়ের ভোটের সিংহভাগ বিজেপির কুক্ষিগত, তার সঙ্গে তিনটি কৌশলের সাহায্যে ওবিসি গোষ্ঠীর ভোটও তারা পেয়েছে। এক, ‘বনবাসী’দের (এসটি, ওবিসিদের এই নামটি বিজেপির দেওয়া) জন্য রাজ্য, যথা ঝাড়খন্ড-ছত্তিসগড়, উপহার দিয়ে। দুই, তাদের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের লড়াই লাগিয়ে দিয়ে, এবং তাদের সাহায্যে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংগঠিত করে। তিন, হিন্দু মূল ধারারই তার অন্তর্গত এই আহ্বান তাদের কাছে রেখে।

এতগুলি প্রধানমন্ত্রী উপহার দেওয়া উত্তরপ্রদেশ-এর দারিদ্র জাতীয় গড়ের বেশি। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা গোটা দেশের মধ্যে উত্তরপ্রদেশে সবথেকে বেশি। অন্যদিকে প্রতি হাজার পুরুষের নিরিখে নারীর অনুপাতের দিকে নজর রাখলে দেখা যায়, নগণ্য খ্রিস্টান (৯৫০) উপস্থিতিকে উপেক্ষা করলে মুসলিমদের নারী-পুরুষের অনুপাত (৯৩৫) সব থেকে ভালো, অন্যদিকে শিখদের নারী-পুরুষের অনুপাত (৮৮৫) বাদ দিলে সার্বিক হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীর অনুপাত সব থেকে খারাপ (৯০৭)। নারী পুরুষের অনুপাত আসলে একটি সমাজের সার্বিক বিকাশ ও লিঙ্গসাম্যের উপর আলো ফেলে। উত্তরপ্রদেশে সেই চিত্রও হতাশাজনক। আবার শিক্ষায় নারীর অবস্থান ভয়াবহভাবে করুণ। কেবল ৫৯% হিন্দু নারী সাক্ষর, তার পাশে মুসলিম নারীর অবস্থা আরও করুণ, মাত্র ৫১% মুসলিম নারীসাক্ষর। সামাজিক অগ্রগতি ও প্রগতির প্রাথমিক দায়িত্ব প্রধানত সংখ্যাগুরুদের উপর বর্তায়। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে আরও একটি লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। তালাক নিয়ে মুসলিম নারীর জন্য বিজেপির দরদ, মায়াবতী, মমতারা যখন রাজনীতিতে নির্ণায়ক হতে চান ঠিক তখনই প্রিয়াঙ্কা গান্ধির কংগ্রেস রাজনীতিতে পদার্পণ নতুন কোনও আলো নিয়ে আসবে কি?

পরিচিতি সত্তার রাজনীতির পীঠস্থানে অনেক অনেক পরিচিতি খেলা করে। ব্রাহ্মণ, ঠাকুর পরিচিতির আত্মগর্ব সেখানে অন্যদের মাথা নিচু করে হাঁটার ও গলার আওয়াজ নিচে রাখার দাবি করে। এরই বিপরীতে সেখানে আছে প্রতিস্পর্ধারও রাজনীতি। যে আবেগের বশেএকজন শ্রমজীবী মানুষের কাছে তার শ্রমিক-পরিচয়ের থেকে তার চামার-পরিচয় মূল্যবান হয়ে ওঠে। এরকম আবেগ নিয়ে চলা একজন শ্রমিক স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে চামার মাত্রেই মায়াবতীজির ভোটার। এখন বুঝতে পারি, এরকম হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। একজন তথাকথিত নিচু জাতের মানুষ হয়ে তিনি সিংহাসনে বসেন এবং ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় আমলারা তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন, যা উত্তরপ্রদেশ-এ বিপ্লব বৈকি। বর্ণহিন্দুরা ওই রাজ্যে এখনও যেরকম জাঁকজমক করে পৈতে পরেন, টিকি রাখেন, ঢাক-ঢোল-ঘোড়া নিয়ে বিবাহ করেন, হিন্দু বৌ-রা পতিভক্তির প্রতীকস্বরূপ করওয়া চৌথের অনুষ্ঠান করেন, তাতে মায়াবতীর এই জাঁক চামারদের আত্মসম্মানে শান্তিজল ছেটাতে বাধ্য। বলাই বাহুল্য উত্তরপ্রদেশ-এর জমিদার শ্রেণির (ওই রাজ্যে তারা আগে বর্ণহিন্দু, পরে জমিদার বা কলকারখানার মালিক) ভোট তাই কখনওই মায়াবতীর দিকে যায় না, কংগ্রেস অথবা বিজেপির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে। তা সত্ত্বেও ভারতের বদ্ধ জলাশয়ের রাজনীতি আবার নতুন নতুন হতাশার জন্ম দেয় ও নতুন দিশার সন্ধান করতে বাধ্য করে।

ভারতের মুসলিমদের মধ্যে থাকা এক আতঙ্ক দীর্ঘদিন তাদের কংগ্রেসের পক্ষে থাকতে বাধ্য করেছে, বলা ভালো যে কোনও দেশেই সংখ্যালঘুদের পক্ষে প্রাথমিকভাবে র‍্যাডিক্যাল বৈপ্লবিক রাজনীতি বা দলের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস জোটে না, তাই ছাপোষা মানুষরা প্রাথমিকভাবে একটু কম বিপজ্জনক রাজনৈতিক শক্তির কাছে প্রায় শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেয়। ভারতে কংগ্রেস দীর্ঘদিন মুসলিমদের এই শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় দিয়েছে কিন্তু আতঙ্কের কারণ নির্মূল করার চেষ্টা বিন্দুমাত্র করেনি, বরং সময়ে সময়ে কংগ্রেস মুসলিমদের বিপদের মাঝসমুদ্রে ফেলে দিয়ে উদ্ধারকারীর ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এভাবেই মুসলিমরা একসময়ে সংগঠিতভাবে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে পরিণত হয়েছিল। যদিও আর এক গুরুত্বপূর্ণ কারণও ছিল। দেশভাগের মধ্য দিয়ে উচ্চবিত্ত, সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের অধিকাংশই ঐ পারে পারি দিয়েছিলেন, যার ফলে মুসলিম সমাজের যারা নেতা তারা প্রায় আর কেউই ভারতে থাকেননি। মুসলিম সমাজে নেতার অভাব ভীষণ বাস্তব হয়ে উঠেছে ভারতে, মুসলিম সমাজের নেতা সুতরাং কংগ্রেসেরই হিন্দুরা। মাঝারি মাপের নেতা হিসেবে সৈয়দ ও আশরাফি মুসলিমরা, যাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ হিসাবে দেখা যেতে পারে। আঞ্চলিক দলগুলির উত্থান সম্ভবই ছিল না যদি সংখ্যালঘুরা তার চিরচারিত কংগ্রেস প্রেম থেকে সরে না আসতেন, বাবরি কাণ্ডের পর। বাবরি কাণ্ড ভারতের রাজনীতির এক সুস্পষ্ট বিভাজিকার সীমানা। লালু-মুলায়ম-জ্যোতিবাবুদের বিজেপি-বিরোধী ভূমিকা মুসলিম মন জয় করেছিল নিঃসন্দেহে। যাই হোক, কিন্তু সেই জোটবদ্ধ ভোট আর থাকেনি ২০০৭ সালে এবং তা নিশ্চয়ই এক অর্থে অগ্রগতি। সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের ভোট জোটবদ্ধ থাকে অসহায় অবস্থা থেকে, আর অসহায় অবস্থাকে সহজে কাজে লাগায় সংখ্যালঘু মৌলবাদ। তাদের সেই জোট স্বাধীন জোট নয়, মৌলবাদের পতাকার অধীনে জোট। সুতরাং তাদের রুটিরুজির দাবিগুলি আর সামনে আসে না। রুটিরুজির প্রশ্ন সামনে না আসলেও পরিচিতি সত্তার রাজনীতিতে মুসলিম সমাজ থেকে কোনও নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কাল্ট ফিগার উঠে আসেনি।

উত্তরপ্রদেশ-এর বিস্তৃত অঞ্চলে বিরাট বিরাট ক্ষেত, গঙ্গার পাশের এই অঞ্চলে আপাতভাবে অনেক স্বচ্ছলতাও আছে স্থানবিশেষে। গ্রামে স্বচ্ছলতার প্রকাশ, অথচ কি ভীষণ পিছিয়ে পড়া। শিক্ষা-সংস্কৃতির লেশমাত্র নেই। মেয়েরা সারাদিন ক্ষেতে খামারে কাজ করেন আর যেহেতু সেখানে পরপুরুষের উপস্থিতি তাই সর্বক্ষণ হাঁটু পর্যন্ত ঘোমটা! দেখেন কী করে, মনে এই প্রশ্ন আসে, সিন্থেটিক শাড়ি এই গ্রাম্য হিন্দু মহিলাদের ভরসা, এনারা বোরখা পরেন না, তবু বোরখা যতটা আলোচনায় স্থান পায়, প্রায় “হাঁটু” পর্যন্ত ঘোমটা নিয়ে তুলনায় আলোচনা হয় না। পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের পর্দা প্রথা সংখ্যালঘু মেয়েদের মধ্যেই তখনও (আজকাল বৃদ্ধি পেয়েছে লজ্জাজনকভাবে, বিশেষত শিক্ষিতাদের মধ্যে!) বিরল ছিল, সংখ্যাগুরুদের তো প্রশ্নই নেই। ভাবতে অবাক লাগে, যে রাজ্য থেকে বছরের পর বছর প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসেছেন, সেখানে এই অন্ধকার! বোঝা যায় সমাজে আলোর বিস্তারের জন্য সামাজিক উথালপাথাল প্রয়োজন, যার কিছুটা হলেও আমরা পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি। এই রাজ্যে মুসলিমরা জোট বেঁধেছিল চাষি হিসেবে, মোল্লাদের প্রজা হিসেবে নয়। সেই ঘোমটা সংস্কৃতি সংখ্যাগুরু সমাজে এইভাবে থাকলে সংখ্যালঘু মেয়েদের অবস্থা কী করুণ হবে, বোঝা দুষ্কর নয়। যেখানে হিন্দু মেয়েরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত সেখানে মুসলিম মেয়েরা ভয়ে তাদের রীতি রেওয়াজের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, এটা আশা করাই বাহুল্য। ভাই-এর অর্ধেক সম্পত্তির বৈষম্যমূলক অধিকার আইনিভাবে মুসলিম মেয়েদের থাকলেও বাস্তবে সেটাই যখন জোটে না তখন ভাইবোনের সমান অধিকারের দাবি কিভাবে মুসলিম রমণীরা তুলবে? যাই হোক, মুসলিম সমাজ ২০০৭ সালে এসে মায়াবতীর থেকে সরতে শুরু করলেন, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২০১২ সালে। সংখ্যালঘু ভোট সমাজবাদী পার্টিতে আবার কেন্দ্রীভূত হল। কিন্তু সেদিন থেকেই বোঝা যায় কীভাবে বিজেপি মুসলিম মহিলাদের মন জয় করছে। তিন তালাক নিয়ে তারা সরব হচ্ছে, উত্তরাধিকার আইন নিয়ে সরব হচ্ছে, আর মুসলিম মেয়েরা, শিক্ষিতা অশিক্ষিতা সকলেই মনে মনে তাদের তারিফ করছেন। অথচ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি এক্কেবারে নীরব, বলা ভাল মুসলিম মৌলবাদের পক্ষেই সরব। মুসলিম সমাজকে নিরেট সমাজ হিসেবে দেখার শাস্তি তারা পেলেন হাতেনাতে, ২০১৪ সালে। কংগ্রেস সমাজবাদী পার্টি জোট করেছিল বলে বর্ণহিন্দুরা বিজেপির দিকে চলে গেছিল, এই একপাক্ষিক বিশ্লেষণ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সামিল। শুধু এই জন্য বিজেপির ওই বিরাট ভোট শতাংশ সম্ভব ছিল না, একমাত্র উত্তর হল মুসলিম ভোটের একাংশ তারা পেয়েছিল। মুসলিম শিক্ষিত সমাজের একাংশ ও মেয়েদের ভোট। স্বামীরা জানতেই পারেনি!

আজ ২০১৯ সাল, পশ্চিমবঙ্গের এক ঘটনার উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করব। বারাসাত অঞ্চলের ঘটনা। এক মেয়ের স্বামী মারা গেছে, মেয়েটি গর্ভবতী। এবার তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে প্রাপ্য দিতে রাজি নয়, তাদের বক্তব্য হল শাশুড়িই সব পাবে। কারণ মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে দাদা-দাদীর সম্পত্তিতে বাবার মাধ্যমেই অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়, মায়ের মাধ্যমে নয়, তাই বাবার অনুপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে তার উত্তরপুরুষের কাছে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নাকচ করে। সেই জটিল পরিস্থিতিতে সালিশি করতে গেলে যে কেউ যারপরনাই হেনস্থার শিকার হতে বাধ্য। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিতে যদি সেই স্ত্রী লড়াই করে, স্ত্রী-র মা-বাবা-আত্মীয়স্বজন দৃঢ়ভাবে মেয়ের পাশে দাঁড়ান তবে তাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না। কিন্তু আমি জানি পশ্চিমবঙ্গেও মেয়েটির বাড়ির লোক মেয়েটিকেই ‘সহ্য’ করতে বলবে। আর আমি নিশ্চিত যে এই ঘটনা উত্তরপ্রদেশ-এ রোজ ঘটে, আর সেখানে সালিশি করতে গেলে হেনস্থা হতে হবে না, গুলি খেতে হবে। খাপ পঞ্চায়েতের বর্বর রাজত্ব সেখানে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতারা চাইছেন সেখানেও তা হোক, আর উত্তরপ্রদেশ-এ যে এখনও তা বলবৎ তার কারণ এটা নয় বাঙালিদের পাঁচটা পা আছে, তার কারণ জাতীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারা তা প্রশ্রয় দিয়েছেন। বিজ্ঞানের এই উন্নতির যুগে, ওই এলাহাবাদ শহরেই নামজাদা গবেষণা সংস্থা থাকা সত্ত্বেও এই অন্ধকার টিকে থাকার একমাত্র কারণ হল রাজনীতি। যে রাজনীতি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলের সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় দিলেও সামাজিক কাঠামোতে হাত দেওয়ার অধিকার কাউকে দেয় না এবং কোনও প্রতিস্পর্ধা সেই রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জও জানায় না।

২০১৯ সালে যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভোট আসতে চলেছে, মায়াবতী-অখিলেশ জোট, হিন্দু মেয়েদের এই মধ্যযুগ থেকে বার করে আনার জন্য কিছুই বলেনি। কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের জোট যে হল না তা শুধু বর্ণহিন্দুদের বোকা বানাবার জন্য, এই দাবিও অর্ধসত্য। নিশ্চয়ই আগামী বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে বিরোধীদের মধ্যে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব। মুসলিম ভোট যাতে কংগ্রেসের ঘরে না যায় তা নিশ্চিত করা। আর কংগ্রেসের নব্য মুখ প্রিয়াঙ্কার মতো আধুনিকাও নিশ্চয়ই আমেঠিতে ঘোমটা পরেই ভোট চাইবেন। ফলে বিজেপির চোরা স্রোত থেমেও, থামছে না। বিজেপিকে সমূলে বিনাশ করার পবিত্র দায়িত্ব কেউ পালন করছেন না। আঞ্চলিক দলগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য ১৯% সংখ্যালঘু ভোট, এবং তা যেন একজোট হয়ে পড়ে। তাই ব্রিগেডে ১৯ তারিখ আমরা দেখলাম ২০১৯ সালের জন্য ১৯ জন হবু প্রধানমন্ত্রীকে। আগেই বলেছি জোটবদ্ধ মুসলিম ভোট তারা চায় মোল্লাদের ছায়ায়, যার ফলে যোগী আদিত্য ওরফে অজয় সিং বিস্ত-এর মতো এক দাঙ্গাকারী খুনিও হাজতে থাকার বদলে গেরুয়া পড়ে তখ্‌তে বসেন।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গেও সংখ্যালঘু ভোটকে জোটবদ্ধভাবে কুক্ষিগত রাখতে মমতা রাজ্যের মোল্লাদের তোল্লা দিয়ে যাচ্ছেন আবার মুসলিমদেরও আতঙ্কিত রাখার খেলাটা পর্দার আড়ালে খেলে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম সমাজ মূলত দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আঞ্চলিক দলে মুসলিম ভোট ভাগ হলেও সেখানেও উর্দুভাষী আশরাফি মুসলিমদের প্রতিপত্তিই বেশি। উত্তরপ্রদেশ-এও লিঞ্চ হওয়ার সম্ভাবনা সবার থাকলেও দলিত মুসলিমরাই আক্রমণের স্বীকার। আগামী ভারতবর্ষ কোন পথে চলবে তার নির্ণায়ক অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশ-এ ভোটের ফলাফল কেমন হয় তার উপর নির্ভর করবে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি দলিত পরিচিতি সত্তার মতো মুসলিমদের পরিচিতি সত্তাকেও ধারণ করে মুসলিম নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করবে, সে সম্ভাবনা এখনই দেখা যাচ্ছে না। সংখ্যালঘুদের ভোট নিয়েআঞ্চলিক দল ও কংগ্রেসের মধ্যে টানাটানিতে পশ্চিমবঙ্গও উত্তরপ্রদেশ হয়ে উঠবে, নাকি মৌলিক কোনও রাজনীতির পত্তন ঘটে বিজেপির শক্তির বিনাশ ঘটবে সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু এটুকু বলাই যায় উত্তরপ্রদেশ-এর রাজনীতিতে জোট বা বৃহত্তর জোট আপাতভাবে বিজেপিকে রুখতে হচ্ছে মনে হলেও তার বাস্তব ভিত্তি শুধু নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই। যে লড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে আবার কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও। সেখানে বিরুদ্ধে জোট বা মহাজোট হোক বা না হোক,সবটাতেই একটা প্রতিযোগিতামূলক বন্ধুত্বের ছোঁয়া থাকবে। যে বন্ধুত্ব লোকসভার দিকে নজর রেখে আর প্রতিযোগিতা রাজ্যে রাজ্যে ভবিষ্যতের কথা ভেবে।