Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে…

রাজদীপ্ত রায়

 

ইতিহাস বলে যে, একটি ‘টোটালিটারিয়ান’ সরকার যখন উগ্র উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কোনও একতরফা সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই উদ্দেশ্যে আইন বা বিধি প্রণয়ন করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেসব বিধিনিষেধ মেধাবিরলতার অনন্য নজির হয়ে ওঠে। বিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরে ফ্যাসিবাদ, নাৎসি শাসন অথবা রাশিয়ার গ্যুল্যাগ ইত্যাদি দেখে ফেলার পর এ-হেন দুরাচারী নির্বুদ্ধিতার ঢাকপেটানো উদাহরণ একনায়কতন্ত্রের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। কিন্তু একুশ শতাব্দীর খান কুড়ি বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার তথাকথিত পরাকাষ্ঠা বলে পরিচিত ভারতবর্ষে যখন সরকারি আদেশনামা জারি করে উচ্চশিক্ষার গবেষণাক্ষেত্রে কার্যত বেড়ি পরানোর তোড়জোড় চলে, তখন সেই সিদ্ধান্তকে শুধুই মেধাবিরল ঢপকীর্তন ভাবাটা বোধহয় উচিত হবে না। বরং, বলা চলে এক অদ্ভুত সভ্যতা-পরিপন্থী, কুযুক্তিদিশায় ধাবমান ভাবাদর্শের পিঠে সওয়ার হয়ে ভারতের বর্তমান শাসকদল উচ্চশিক্ষায় সর্বতোভাবে একটি মেধাবিরল পরিস্থিতি তৈরি করতে এবং তাকেই সরকারি মান্যতা ও স্বীকৃতি দিতে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে উঠেছে ইদানীং। সম্ভবত আরও বেশি-বেশি করে— নির্দ্বিধায় বলা যায়, গত পঞ্চাশ বছরের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে সবচাইতে বেশি হঠকারীভাবে।

ভারতবর্ষের সরকারি অর্থানুকূল্যে চলা উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলিতে গবেষণা করতে গেলে বিষয় নির্বাচনের সময় ‘জাতীয় অগ্রাধিকার’-এর কথা মাথায় রাখতে হবে, এই মর্মে আদেশনামা জারি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। কেরলে একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ বোর্ড থেকে জনৈকা অধ্যাপকের পদত্যাগ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলা যাদবপুরের সর্বজনশ্রদ্ধেয় এমেরিটাস অধ্যাপক শ্রী সুকান্ত চৌধুরী মহাশয়ের প্রতিবাদী পিটিশন, স্বাক্ষর-সংগ্রহ অভিযান, দেশজোড়া প্রতিবাদী কর্মসূচি আর দেশের আসন্ন সতেরোতম লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে আপাতভাবে সরকার পিছু হঠলেও, এ-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ সামান্যই যে, নির্বাচন পেরোলেই গবেষণা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ বেশ আঁটসাঁটভাবেই গেড়ে বসতে চলেছে দেশের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে। সুকান্তবাবু তাঁর পিটিশনে খোলসা করে ক্ষতির দিকগুলো দেখিয়েওছেন। সে নিয়ে সদর্থক চর্চা সমাজ-মাধ্যমে অব্যাহত। ওঁর প্রতিবাদবার্তায় একটা ছোট্ট কিন্তু জোরালো ইঙ্গিত ছিল ‘জাতীয় স্বার্থ’ বা ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ নামক শব্দবন্ধটিকে ঘিরে। সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে বরং এই আপাতনির্বোধ কিন্তু আদতে বিষাক্ত অভিসন্ধিমূলক গবেষণাবিধিটির মূল চরিত্র ও উদ্দেশ্য বুঝতে কিছুটা সুবিধে হতে পারে।

‘দিন আনি দিন খাই’ করে জীবন কাটানো নিতান্ত ছাপোষা ভারতবাসীও এই সার সত্য জানে যে, এই মুহূর্তে দিল্লির মসনদে বসে থাকা দলটি, আর যা-ই হোক, ঘিলুহীন পপ্যুলিজমের রাস্তায় হাঁটে না। হাঁটেনি কোনওদিন। তাদের শাসনক্ষমতায় থাকার ইতিহাস বা বিরোধী হিসেবে আচরণ ও আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি স্মরণে রাখলে সে বাস্তব অনুধাবন করতে বিশেষ বেগ পাওয়ার কথাও নয়। সুনির্দিষ্ট হিন্দুত্ববাদকে (আশীষ নন্দী মশাইয়ের করা ‘হিন্দুইজ্‌ম’ এবং ‘হিন্দুত্ব’-র পার্থক্য স্মর্তব্য) রাজনৈতিক হাতিয়ার করার সঙ্গে-সঙ্গেই এই ক্ষমতাসীন দলের প্রথম প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছে ভারতীয় ইতিহাসের বহুত্ববাদী প্রাণসত্তাটি। সোজা করে বললে, আজকের গবেষণাবিধি নির্মাণ বা গবেষণাক্ষেত্রকে নষ্ট করবার ফিকিরের মূল উদ্দেশ্য ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক চরিত্রটিকেই সমূলে বিনষ্ট করা। যাতে, ইতিহাসজ্ঞানহীন এবং একরৈখিক ধ্যানধারণাপুষ্ট এমন একটি ‘হোমোজিনাইজেশন’কে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, যা কিনা অতি সহজ বাইনারি তৈরি করে। সমসত্ত্বতার ধারণাটিকে মান্যতা দিয়ে সমস্ত বিরুদ্ধ মতের টুঁটি চেপে ধরতে পারে অচিরেই। আর সেই টুঁটি চেপে ধরার নানা প্রচেষ্টার মধ্যে নবতম সংযোজন উচ্চশিক্ষা গবেষণায় “ন্যাশনাল প্রায়োরিটি” বা জাতীয় অগ্রাধিকার নামক একটি ইতিহাস-পরিপন্থী বিপত্তির আমদানি।

প্রভূত প্রতিশ্রুতির ঢক্কানিনাদ সাঙ্গ করে, এবং সবক’টি প্রতিশ্রুতিই ভাঙা হবে এমন প্রতীতি অচিরেই তৈরি করে, শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার উচ্চশিক্ষায় ‘বিশেষ’ নজর দিয়েছে ২০১৪-র মাঝামাঝি থেকেই। ক্ষমতাসীন দলের উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শকে সাধারণ্যে মান্য করে তোলার পথে যদি কোনও একটি শক্তি প্রথম থেকেই অন্তরায় হয়ে থাকে, সেটি ভারত নামক জনপদের অন্তঃস্তলে থাকা সুগভীর বহুত্বের বোধ। কিন্তু এই বোধ বা ‘প্ল্যুরালিস্টিক’ দেশ-চৈতন্য বিমূর্ত হলেও আধিদৈবিক নয়। এর সত্যবহ এবং পরম্পরা-আশ্রয়ী নিহিত রূপটি ধরা আছে দেশ-কাল-জনভারে প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় ইতিহাসের নিশ্চিত গ্রন্থিতে, ‘জিন’-এ। অর্থাৎ, ভারতীয় প্রেক্ষিতে সবরকম উগ্রতার বিরুদ্ধে গিয়ে সকলের আবাসযোগ্য একটি দেশ-পরিসরের কল্পনা জল-হাওয়া-পুষ্টি পায় ভারতীয় ইতিহাসের বহুরৈখিক চলনের অপরূপ আখ্যান থেকেই। শুধু আজ নয়। যুগ-যুগ ধরে। দেশীয় ইতিহাসের এই মূল সুরটিকে মান্যতা দিয়ে একটি ‘ইনক্ল্যুসিভ’ ভারতবর্ষের প্রথম প্রণেতা ও তাত্ত্বিক নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহরু। বিজেপি, বিশেষ করে মোদিবাবুর বিজেপি, প্রথম থেকেই বহুত্বের এই ইতিহাসনির্ভর নির্মিত আইকনটিকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। সচেতনভাবে। ২০১৪ থেকেই নেহরুর জনমূর্তিকে প্রতিস্থাপিত করবার জন্য বর্তমান সরকার ও শাসকদল ইতিহাস ফুঁড়ে হাজির করে শ্রী বল্লভভাই পটেলকে। তাঁকে সামনে রেখে দেশ নামক এক একশিলীভূত অচলায়তনের মডেলকে ‘প্রায়োরিটাইজ’ করার সার্বিক চেষ্টা চালায়। এবং খুব সুচতুরভাবেই সে চেষ্টার প্রথম প্রকাশস্থল হয়ে ওঠে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্র। দেশের সমস্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বল্লভভাইয়ের জন্মদিন পালন ও আলোচনাসভা সংগঠিত করার ডাক দেওয়া হয়। সবটাই হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। জনমানসে ‘আয়রন ম্যান’ নামক একটি সর্বৈব ঔপনিবেশিক, জাতিসত্তাভিত্তিক ও দেশগঠনের এক ‘ইউরোসেন্ট্রিক’ ধারণাকে সামনে রেখে। অথচ বল্লভভাইয়ের জীবন, কাজ বা ভূমিকা নিয়ে কোনও সত্যিকারের গবেষণাপ্রয়াসকে মান্যতা দেওয়া হল না জাতীয় স্তরে। কেননা, গবেষণা দাবি করে যুক্তির বৈভব ও স্বকীয়তা। এই দুইয়ে ভর করে আলোচনা করলে দেখা যাবে, ইতিহাসের ছাত্রমাত্রেই জানেন, নেহরুর ভারতবোধ যে বহুত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে, বিরোধাভাসকে প্রশ্রয় দেয়, বল্লভভাইয়ের ভারতবোধে তার কোনও জায়গা ছিল না। নেহরুকে লেখা তাঁর চিঠিপত্রে ভারতের জাতিভিত্তিক বহুত্বের প্রতি মমত্ব নয়, বরং বিরক্তিই প্রকাশ পেয়েছে বেশি। বিশদে না-গিয়েও বলা যায়, বিজেপি সরকারের নেহরুর প্রতিস্থাপক হিসেবে বল্লভভাইকে জাতীয় আইকন হিসেবে তুলে ধরা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একটি সুপরিকল্পিত সমসত্ত্বীকরণের সন্দর্ভ নির্মাণ। যার একদিকে হয়তো প্রচুর অর্থ অপচয় করে মূর্তি নির্মাণ করার অস্মিতা আছে, কিন্তু একইসঙ্গে অন্যদিকে সুদূরপ্রসারী একটি ভাবাদর্শের বেসাতি আছে সুনিশ্চিত, যা অনেক বেশি ক্ষতিকর এবং ভয়ঙ্কর।

এই দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটাই বিনা বাধায় চরিতার্থ হয়, যদি ভারতবর্ষের সার্বিক জ্ঞানচর্চাক্ষেত্রটিকেই বেঁধে ফেলা যায় নিয়মের সুশৃঙ্খল বেড়াজালে। যার একটি প্রধান সূত্র এই গবেষণাক্ষেত্রে জাতীয় অগ্রাধিকার নির্বাচন।

যে দু’টি শব্দ এই গবেষণাবিধির ভার বহন করছে, ভারতীয় ইতিহাস বা আচরিত সমাজ পরিসর সে দু’টি শব্দকে কোনওদিনই একরৈখিক ছাঁচে ফেলে ভাবতে চায়নি। ইতিহাস, যা কিনা এই সরকারের অন্যতম শত্রু এবং আক্রমণের লক্ষ্য, শেখায় যে ভারতীয় প্রেক্ষিতে ‘জাতি’ কখনওই সমসত্ত্ব কোনও ধারণার বাহক নয়। এখানে নেশন বলতে আমরা এমন কোনও প্রাগিতিহাস পাই না যা ‘ভারতীয়’ বলে নির্ণীত একটি নির্দিষ্ট জাতির হদিশ দিতে পারে। উল্টোদিকে, বহুজাতির সমন্বয়ে এবং সহাবস্থানে ঋদ্ধ, দীর্ঘকালীন অভ্যেস-সংস্কার-আচার-বিশ্বাস সম্বলিত একটি বিস্তৃত ভারতীয় ভূখণ্ড, যেখানে বিবিধতা থাকা সত্ত্বেও একটি স্বাদেশিক পরিচয়, বহুরৈখিক ভারতীয়ত্ব স্বীকৃতি পায়, তাকেই যুগ-যুগ ধরে ভারতভূখণ্ডের ইতিহাস বহমান ও সজীব জাতীয় চেতন বলে মান্যতা দিয়ে এসেছে। ধর্ম, বর্ণ, সংস্কার, শ্রেণি, খাদ্যাভ্যাস, রুচি, পরিধেয় বা আচরণের সমস্ত বিবিধতাকে ধারণ করে, ‘ইনক্ল্যুড’ করে, যে দেশসত্তার নির্মাণ, তা যে ক্ষমতাসীন দলের কাঙ্ক্ষিত ভারতীয়ত্ব নয়, সে-কথা বলাই বাহুল্য। কাজেই, গবেষণাক্ষেত্রের বিধিপত্রে উচ্চারিত ‘ন্যাশনাল’কে রাষ্ট্রীয় ‘প্যানপ্টিকন’এর আওতায় না-আনলে উদ্দিষ্ট সমসত্ত্বীকরণের ভাবধারার সমূহ বিপদ হবেই হবে। ‘এক্সক্ল্যুসিভ’ জাতীয়তার মানদণ্ড হাতে নিয়ে, ইতিহাসকে দুমড়ে, মুচড়ে, ভ্রান্তপাঠে অণ্বিত করে, জাতীয় ইতিহাস সংসদের মাথা থেকে উদার চিন্তার কাণ্ডারীদের হঠিয়ে যে যজ্ঞ আয়োজন হয়েছে গত পাঁচ বছর ধরে, ধীরে ধীরে, কিন্তু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সে রাজসূয় বিফলে যায়, যদি অ্যাকাডেমিক পাঠদানের কেন্দ্রগুলিকে বশে রাখা না-যায়।

আর ২০১৪ থেকে এযাবৎকাল পর্যন্ত একটি সত্য তো সকলের কাছেই পরিষ্কার যে, ক্ষমতাসীন দলের সরকারি নীতির অন্যতম বড় সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি হয়, হয়ে চলেছে, দেশের সমস্ত বড় বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তর থেকে। লাগাতারভাবেই। সুতরাং, জ্ঞানচর্চার অঙ্গনগুলিতে, যা কিনা গবেষণার মূল সুর, অর্থাৎ বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতা, বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানের ধারাগুলিতে, যদি একটি সংক্ষিপ্ত বন্ধনীর মধ্যে নিয়ে আসা যায়, নির্দিষ্ট সংজ্ঞারূপের সীমায় চিহ্নিত করা যায়, তা হলে বিরোধিতার জায়মান সম্ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায় বইকি।

কিন্তু এই ‘নেশন’ বা ‘জাতি’ এবং সেই সংক্রান্ত ‘জাতীয়’ বলে চালিয়ে দেওয়া ধারণাকে ঐতিহ্যপরিপন্থীভাবে একরৈখিক করা যদি একটি দিক হয়, তবে এর অন্যদিকে আছে দ্বিতীয় ভারবাহী শব্দটি। ‘প্রায়োরিটি’ বা ‘ইন্টারেস্ট’ বা অগ্রাধিকার। এবং অগ্রাধিকারের সঙ্গে জড়িত অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নগুলি। ভারতবর্ষে গবেষণা করতে গেলে ভারতবর্ষটা কি বা কেন, সে বিষয়ে আনুপূর্বিক না-হলেও একটা সার্বিক ধারণা থাকা জরুরি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পূর্বনির্ধারিত সরকারি, বা সরাসরি বললে রাষ্ট্রীয় ধারণার সঙ্গে গবেষকের ধারণার কোনও মিল থাকতেই হবে। যে ভারতবর্ষে কোনও এক মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী বিরুদ্ধমতের ছাত্রগোষ্ঠীকে অসুরের উপাসক বলে গাল পাড়েন, দুর্গাকে সর্বভারতীয় ঐশী শক্তি এবং আরাধ্য বলে মনে করেন, খবরই রাখেন না যে ভারতবর্ষের কোনও বিস্মৃত প্রান্তে সত্যি-সত্যিই অসুর বলে একটি জনজাতি থাকে, বা তাদের দলপতিকে বিনাশের মাধ্যমে যে তথাকথিত শুভশক্তির জয়গান গাওয়া হয়ে থাকে তা যে আদতে বর্ণাশ্রম ও শ্রেণিবিভক্ত ভারতীয় সমাজে উঁচুশ্রেণির আধিপত্যের জয়গাথা রচনার প্রয়াস, সেখানে ‘ন্যাশনাল প্রায়োরিটি’ বা গবেষণায় বিষয়ের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা কখনওই সহজ কাজ নয়। এটা মানতে হবে যে, ভূগোলের মতো ভারতবর্ষের রীতি-নীতি-ইতিহাস-সংস্কৃতি-আচার সবই বড্ড বিচিত্র। এখানে আমার মতে যা জাতীয় স্বার্থ, অন্যের মতে তা জাতীয় স্বার্থ না-ও হতে পারে। নিদেনপক্ষে, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ হিসেবে তো গণ্য হতেই পারে।

গবেষণার কোনও দলীয় রাজনীতি থাকে না। থাকা কাম্যও নয়। কিন্তু বৃহত্তর অর্থে গবেষণা, বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানে, তো একটি সর্বৈব রাজনৈতিক জ্ঞানচর্চা। একজন গবেষক যখন কোনও বিষয় নির্বাচন করেন, তখন তিনি সপ্রশ্ন ও তার্কিক একটি অবস্থান নেন জেনেবুঝেই। দেশ বা রাষ্ট্র যেভাবে ভাবছে, বা সাধারণত যেভাবে ভাবে, তার ওপরে প্রশ্ন তুলে, তার্কিক পরিসর তৈরি করে অনুসন্ধান ও পাঠনির্ভর কোনও যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোটাই তার কাজ। সে সিদ্ধান্তের গ্রহণযোগ্যতা থাকতেও পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিসরে এই প্রশ্ন/পরিপ্রশ্নের নিরন্তর চর্চা জারি রাখাটাই গবেষণার উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় মতামত বা ধ্যানধারণাকে অমোঘ ভেবে নেওয়ার এখানে কোনও জায়গাই নেই। থাকার কথাও নয়। বরং, রাষ্ট্র তার চলার পথের ভুলভ্রান্তি বা ধূসর ভাবনাক্ষেত্রগুলির হদিশ পায় এই বিবিধ সিদ্ধান্তনির্ভর নানান গবেষণার সৃষ্টিক্ষেত্র থেকে। রাষ্ট্রের কাজের অগ্রাধিকার নির্মাণ হয় এই তর্কবহুল গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে। আমাদের দেশেও এযাবৎকাল তা-ই হত। সভ্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটাই দস্তুর।

কিন্তু, এই অদ্ভুত নির্দেশিকা জারি করে, রাষ্ট্র বা সরকার, যা কিনা আমাদের দেশে দীর্ঘকাল থেকেই সমার্থক চেহারা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বসে আছে, গবেষণায় বিষয় নির্বাচনের অগ্রাধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়ার নাম করে সাম্প্রতিককালে হয়ে উঠতে চাইছে গণতন্ত্রের বিরোধী। ‘ক্রিপ্টো-ফ্যাসিবাদী’। একনায়কতন্ত্রী। বিষয় নির্বাচনের অধিকারকে নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে বেঁধে ফেলা আসলে গবেষণার মূল আত্মায় আঘাত। নির্বাচনের অধিকারে যদি কোনও অগ্রাধিকার থাকেই, তবে তা হওয়া উচিত গবেষকের নীতি ও বিবেক অনুযায়ী তৈরি হওয়া অগ্রাধিকার। কিন্তু সেখানেই যে রজ্জুতে সর্পভ্রম। কেন না, তা হলে অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্ন করাই যায় যে, দূর লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাতক্ষম কোনও উচ্চশক্তির মিসাইল না কি অন্ন, রুটি-রুজি আর চাকরির সুনিশ্চিত বন্দোবস্ত, কোনটা আমাদের দেশে এ-মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন? মহাকাশগবেষণা জরুরি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে কর্মসঙ্কোচন, অনাহার বা জাতীয় সম্পত্তির সিংহভাগ সবেধন নীলমণি কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে, আর বাকি দেশবাসী নিরন্ন উপবাসী, এই নিয়ে কারণ অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ আর প্রণিধানযোগ্য গবেষণাও যে ভীষণভাবে জরুরি, সে কথা ভুলি কী করে। আশঙ্কা হয় যে, যে সরকারের উদ্দেশ্যমূলক এবং ভ্রান্ত ‘দেশীয় অগ্রাধিকার’ নীতির ফলে সামরিক বলে বলীয়ান হওয়াটাই দেশীয় উন্নতির মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়, আর কৃষকের, সাধারণের বা গড়পড়তা ভারতীয় নাগরিকের বেঁচেবর্তে থাকার প্রয়োজনীয় বরাদ্দগুলিকে নিপুণভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ‘অগ্রাধিকার-সারণীর পেছনের দিকে, সেখানে গবেষণার বিষয়ের অগ্রাধিকার নির্বাচন হবে কোন জাদুকাঠির নিরিখে!

রাষ্ট্রীয় স্তরে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার এই মারাত্মক প্রবণতা গণতান্ত্রিক কাঠামোকে অস্বীকার করে। রাষ্ট্র থেকে জনগণে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের যে সাংবিধানিক শপথ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে স্বীকৃত এই সিদ্ধান্ত তাকেই অচল করতে চায়। গবেষণার বিষয় নির্বাচনে অপ্রাসঙ্গিক উপাদান হিসেবে ‘ন্যাশনাল প্রায়োরিটি/ইন্টারেস্ট’ নামক ‘প্যানপ্টিক্যাল গেইজ’, বা উগ্র জাতীয় চোখ নিয়ে আসার খেয়ালখুশি বাস্তবে গবেষণার উদ্দেশ্য এবং বিধেয়কেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে। উপদ্রুত করে তোলে জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন করে?

এর উত্তরে সুনির্দিষ্ট এক-দু’টো সাম্প্রতিক প্রবণতা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যায়। সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বা ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে সবচাইতে বড় গবেষণা অঞ্চল দু’টি। একটি সমাজবিজ্ঞানে। অন্যটি বিজ্ঞানে। (সুবিধের জন্য সাহিত্য বা ভাষাতত্ত্বকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে সমাজবিজ্ঞানের আওতায় রেখে আলোচনা করা যেতে পারে। আর কমার্স বা বাণিজ্যক্ষেত্র বিষয়েও একই যুক্তি প্রযোজ্য। অর্থাৎ সেই ক্ষেত্রটিকেও সমাজবিজ্ঞানের বিস্তৃত ধারার অঙ্গ বলে ভাবা যায়। অন্তত এই আলোচনার সীমিত বিষয়ভিত্তিক পরিসরে।) সাম্প্রতিক সরকার যে দলটি চালায়, তাদের ঘোষিত অর্থনৈতিক নীতিতে উদারীকরণের বিরুদ্ধে কোনও ডাক নেই। থাকার কথাও ছিল না। উলটে, তাদের সার্বিক বেসরকারিকরণের চেষ্টা এবং রাষ্ট্রীয় দায়ভার ছেঁটে ফেলে কর্পোরেট পুঁজির আওতায় আরও বেশি-বেশি করে দেশকে ঠেলে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রটিকে যদি ধীরে-ধীরে প্রশ্নহীন, এবং শেষপর্যন্ত নির্বীজ করে দেওয়া যায়, তা হলে এই ঢালাও বেসরকারীকরণে কোনও বাধা আর স্বাভাবিকভাবেই থাকে না। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এই নীতিতে খুব সহজেই সত্যিকারের মেধাবীর কাছে মর্যাদা ও আকর্ষণ হারাবে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হলে তাকে যেতে হবে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির দরজায়। আর, অবনমন এবং ক্রমাগত বরাদ্দ সঙ্কোচনের প্রভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ধুঁকতে থাকবে দেশময়। এই পরোক্ষে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করবার চিকণ রাজনীতিতে দেশের সর্বস্তর থেকে উঠে আসা মেধার বিকাশ, প্রতিপালন আর গবেষণার প্রাসঙ্গিক পরিসরে চলতে থাকা ব্যবস্থার প্রতি ক্রমান্বয়ে উঠতে থাকা প্রশ্ন এবং তর্কের সহজাত ব্যবস্থাটাকেই একটু-একটু করে হিমঘরে পাঠানো যায়। পাশাপাশি, একধরনের জ্ঞান ও মেধামুক্ত অঞ্চল তৈরি করে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বাহ্যিক বাগাড়ম্বর আর চাকচিক্যকে আরও বেশি আকর্ষক করে তোলা যায় উচ্চ বা মধ্যবিত্তের কাছে। ঠিক যে উপায়ে প্রথমে বিএসএনএল-কে ক্রমান্বয়ে হতশ্রী করে অন্যান্য বহুজাতিক টেলি-কোম্পানিগুলিকে আরও বেশি লোভনীয় করে তোলা হয়েছে। এবং তারপর জনমানসে একটা অকর্মণ্য সংস্থা হিসেবে একটু-একটু করে তার পরিচিতি গড়ে উঠতে দিয়ে, শেষে বেতন এবং সুযোগসুবিধে আটকে কয়েক লাখ কর্মচারীর জীবন অনিশ্চিত করে দেওয়া হচ্ছে। সংস্থাটাকেই তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থে, অথচ সমাজে ততটা হেলদোল মোটেও হচ্ছে না। কারণ, বেহিসেবি জনগণ কর্পোরেট ফোন কোম্পানির মায়া কুহকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। একই সূত্রে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বিষয় নির্বাচনের মানদণ্ড স্থির করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজার নিয়ন্ত্রিত আপাত-উদারতার ঠাঁট যে আরও নিশ্চিত করা যায়, সন্দেহ নেই। শ্রেণিসচেতন মেধাবিরলতার সার্বিক স্থিতাবস্থা সুদৃঢ় করা যায় দেশ জুড়ে।

অন্যদিকে, বিজ্ঞানের গবেষণাতেও শুধুমাত্র রাষ্ট্রনির্ণীত উপযোগিতা ক্ষেত্রকেই পরিপুষ্ট করা যায় এই ‘জাতীয় অগ্রাধিকার’এর অছিলায়। নিশ্চিতভাবেই। দেশীয় সমাজের প্রাত্যহিক দুর্দৈবে থাকা শতকরা সত্তরভাগ মানুষের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি বা অসামান্য স্বাধীন চিন্তায় আলোকিত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের চাইতেও জাতীয় (পড়ুন সরকারি, এবং সেই কারণেই রাষ্ট্রীয়) অগ্রাধিকারে তখন যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বৃহস্পতির চাঁদে মহাকাশযান পাঠানো, সে আর আশ্চর্য কী!

লক্ষ করলে দেখা যাবে, গত পাঁচ বছরে ভারতে যত স্বাধীন চিন্তক হয় নিহত বা আক্রান্ত হয়েছেন, ততটা আর কখনওই আগে হননি। এই সেদিনও, জ্যঁ দ্রেজের মতো তৃণমূলস্তরে কাজ করা অর্থনীতিবিদকে থানায় আটকে রেখে হেনস্তা করেছে পাশের রাজ্যের পুলিশ। কার বা কাদের প্ররোচনায়, সহজেই অনুমেয়। কালবুর্গি, পানেসার বা লঙ্কেশ ইত্যাদি সরকারি নীতির সমালোচক এবং উদারচিন্তকদের হত্যার উল্লেখ এ-ক্ষেত্রে করা যেতেই পারে। মোদ্দা কথা হল, রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা চলবে না। বকলমে, রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি যে সরকার, বা সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত সংখ্যাগুরু দল, তার কোনও সিদ্ধান্তকে গবেষণার নামে তার্কিক পরিসরে টেনে নিয়ে যাওয়া চলবে না। ইতিহাস বলে উগ্র, একমেরুকরণের ফ্যাসিবাদী চলনে বিশ্বাসী রাষ্ট্রশক্তি বা দল সর্বদা তার বিপরীত মেরুতে অবস্থিত উদার ও যৌক্তিক চিন্তার মেধাচর্চার অভ্যেসে অশনিসংকেত দেখে। ভারতবর্ষের দীর্ঘ জ্ঞানচর্চার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে লালিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এতদিন গবেষণাক্ষেত্রে সেই ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বহুত্বচর্চার ধারা বহমান রেখেছে। রাখতে পেরেছে। বিষয় নির্বাচনের ঔদার্যে এবং যৌক্তিক প্রশ্ন ও অনুসন্ধান করবার উদার পরম্পরায় জারি থেকেছে সদর্থক গবেষণা ‘প্র‍্যাক্সিস’। অর্থাৎ, উদার বিবিধতার সন্দর্ভকে পঙ্গু করে, হত্যা করে, মুছে দিয়ে যে নির্বিবাদী ‘টেইলর মেইড ইন্টেলেকচ্যুয়াল’ সত্তা গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সরকার, যেখানে বিরোধীকে অবলীলায় দেশের শত্রু বলে দেগে দেওয়া যায়, ইতিহাসকে করা যায় বিকৃত বা ‘পোস্ট-ট্রুথ’-আকীর্ণ, সেখানে গবেষণা বা জানার চেষ্টাটুকুকে আপাদমস্তক সামরিক সাঁজোয়া দিয়ে মুড়ে ফেলে তাঁবেদার তৈরি করা হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। তর্কপ্রিয় ভারতীয় বিড়ম্বনা বাড়ায় বই কমায় না। সুতরাং, গণতান্ত্রিক বোধকে ভূলুন্ঠিত করে চুপিসাড়ে একটি টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলবার সরকারি প্রয়াস উচ্চশিক্ষার গবেষণায় ভূত দেখবেই দেখবে। আর, আজকের দুনিয়ায় এ-কথা কে না জানে যে, স্বাধীন গবেষণার নামে এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, আর যত বেশি জানে, তত কম মানে!