অবশেষে ফাদার স্ট্যান স্বামীকে ভারত রাষ্ট্র হত্যা করল

শান্ত মিত্র

 

প্রাবন্ধিক, সমাজভাবুক, পেশায় করণিক

ভারত রাষ্ট্র সন্ত্রাস, অবরোধ, অস্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, মব লিঞ্চিং প্রভৃতি নানান অসাংবিধানিক, অমানবিক, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এবং দীর্ঘ ব্যবহারে আরও ধারালো করে তোলা হাতিয়ার বেপরোয়াভাবে ব্যবহার করে ৮৪ বছরের বৃদ্ধ স্ট্যান স্বামীকে আর বাঁচিয়ে রাখার সাহস পেল না, আইন-আদালত, ন্যায়াধীশ, “আইন রক্ষাকারী”-দের সক্রিয় সহযোগিতায় তাঁকে হত্যা করল। মানুষের, বিশেষত সেই সব খাড়া মেরুদণ্ডী মানুষদের জীবন নিয়ে কৌতুক করতে ভারত রাষ্ট্র অভ্যস্ত, যাঁরা জোর গলায় বলেন যে যা চলে আসছে, তা কেবল চলে আসছে বলেই মেনে নেওয়া যায় না, তার ন্যায্যতা বিচারের প্রয়োজন আছে, এইসব মানুষদের জন্য যে আদালত পারকিনসনস রোগের শিকার স্ট্যান স্বামীকে সুষ্ঠুভাবে তৃষ্ণার জল খাওয়া থেকে বঞ্চিত করার জন্য বলে, এটা স্ট্যান স্বামীর “ছল, বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক” বিষয়কে তিনি “সহানুভূতি” পাওয়ার জন্য ব্যবহার করছেন! ভারত রাষ্ট্রের ইতিহাস প্রতিবাদীদের তপ্ত রক্তে লাঞ্ছিত হওয়ার ইতিহাস— আন্দামানের সেলুলার জেলে পণ্ডিত রামরক্ষার জীবনদান থেকে ছত্তিশগড়ের আদিবাসী গ্রামে, সিংভূমের, মেদিনীপুরের আর বাঁকুড়ার চুয়াড়দের, সিধু-কানু-চাঁদ-ফুলো থেকে বিরশা মুন্ডা-র আত্মবলিদান— রাষ্ট্রের থেকে মসৃণভাবে পথ করে দেওয়ার জন্য পিচ্ছিল করে এসেছে এ তাবৎকালে। প্রয়াত কবি সত্যেন বন্দ্যোপাদ্যায় এক অমোঘ এবং প্রতিস্পর্ধী প্রশ্ন তুলেছিলেন সত্তরে, এটাই যদি নিয়ম হয়, তাহলে আমরা কেন সেই নিয়ম মানছি? স্ট্যান স্বামীদের মতন মানুষরা এই বেনিয়মকে সংহত চ্যালেঞ্জের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন গত তিন দশক বা তারও বেশি সময় ধরে।

ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে তিনি তুলে ধরেছিলেন আটটি অমোঘ প্রশ্ন, যার মধ্যে অন্তর্লীন ছিল রাষ্ট্র-পরিচালনায় কাদের রয়েছে হক, কার কতটা ভাগিদারিত্ব। সংবিধান রচনার অব্যবহিত পরেই বাবাসাহেব আম্বেদকার বুঝেছিলেন যে, যে আর্থিক অসাম্যের ওপর ভর করে ভারত রাষ্ট্র এই “পিছড়ে বর্গ”-কে মনুর সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করছে, তারা একদিন ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে স্বর্গলোক তোলপাড় করে দেবে। স্ট্যান স্বামীর মতো মানুষদের কানে সেই আহ্বান পৌঁছেছিল। তাই তাঁরা হয়ে উঠলেন ভারত রাষ্ট্রের কাছে “বিপজ্জনক”, যাঁরা রাষ্ট্রকে ন্যায়নীতির ভিত্তিতে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশের মানুষের কাছে রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করার অসম্ভব দ্বন্দ্বযুদ্ধের মহড়ার সূত্রপাত ঘটালেন।

স্ট্যান স্বামীর এক নিষ্পাপ প্রশ্ন ছিল, সরকার যে সংবিধানের নামে রাষ্ট্র চালানোর অঙ্গীকার করেছে, সেই সংবিধানের পঞ্চম তপশিলের ২৪৪(১) ধারা ভঙ্গ করছে কেন, যেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা রয়েছে যে “ট্রাইব অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল” বা টিএসি-র সদস্যদের কেবলমাত্র উপজাতি বা ট্রাইব-দের মধ্যে থেকেই আসতে হবে, যে কমিটি রাজ্যের রাজ্যপালকে আদিবাসী জনগণের উন্নয়ন, তাদের ভালোমন্দর ব্যাপারে একমাত্র পরামর্শদাতা হবে, কোনও কর্পোরেট সংস্থার সিইও-রা নয়! দেশের সংবিধান রাজ্যপালকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, গত ৭০ বছর ধরে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে কোনও রাজ্যপালই এই আদিবাসীদের সঙ্গে মুখোমুখি বসে তাদের সমস্যা সঙ্কট নিয়ে কোনও কাজের কাজ করেননি। ক্ষমতার যে ব্যবহার দেশের নাগরিকরা প্রত্যক্ষ করেছে, তা তো স্রেফ ক্ষমতার অপব্যবহার। এই টিএসি-র সভা বসা বিরলতম ঘটনার একটা, যদি কখনও বসে, তবে তা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে, এক দাম্ভিক পরিমণ্ডলে। এই সহজ প্রশ্নে সরল উত্তর আশা করা স্ট্যান স্বামীদের অন্যতম “দেশদ্রোহী” কাজ!

বিশ্বায়নের নিশানবাহী “উন্নয়ন”-এর জগন্নাথের রথের সারথি ভারত রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবৃন্দ যখন মধ্য ভারতে আদিবাসীদের আওতায় থাকা মাটির ওপরে অরণ্য ও মাটির নীচের খনিজ সম্পদে ভরপুর অঞ্চল থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে কর্পোরেটদের হাতে সেই মালিকানা তুলে দিতে উদ্যত হয়, তখন স্ট্যান স্বামীদের মতো “দেশদ্রোহী”-রা ভারতের সংবিধান উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রের এই নীতিবিগর্হিত অমানবিক কাজকে সংবিধান যে অনুমোদন দেয় না, সেই মর্মে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেন। ১৯৯৭ সালের সেই ঐতিহাসিক রায়, যা সমতা রায় নামে পরিচিত, সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের কর্পোরেট দ্বারা লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু রক্ষাকবচ যুক্ত করা হয়। কর্পোরেট-প্রিয় ভারত রাষ্ট্র সেই আইনি বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় প্রভৃতি অঞ্চলকে দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলির মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করে অচিরেই। অরণ্য অধ্যুষিত মধ্য ভারতের সমগ্র অঞ্চল, গড়চিরোলি, বস্তার, মহুয়াদাঁড় থেকে ঝাড়খন্ড রাজমহল আবার উলগুলানের ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে। এই ন্যায়সঙ্গত বিদ্রোহে ব্যতিব্যস্ত ভারত রাষ্ট্র একদিকে যেমন সালওয়া জুড়ুম, গ্রে-হাউন্ড সেনা, আধা-সামরিক বাহিনি সম্পূর্ণ শান্তির সময়ে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে, পাশাপাশি যাঁরা আদিবাসীদের তাঁদের সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাঁদেরকে “ষড়যন্ত্রী” বলে আখ্যা দিয়ে “দেশদ্রোহিতা”-র অভিযোগ এনে বিনাবিচারে বন্দি করে, অবহেলা, অত্যাচার করে তাঁদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার এক ঘৃণ্য এবং সভ্য সমাজে ধিক্কৃত পদ্ধতি গ্রহণ করে। অনেকের সঙ্গে স্ট্যান স্বামী সেই রাষ্ট্রীয় হত্যার বলি হলেন।

ভারতের ইতিহাসে, এক প্রদেশের মানুষ অন্য প্রদেশে এসে সেই প্রদেশের বঞ্চিত, প্রপীড়িত মানুষের আপনজন হয়ে ওঠার ঘটনা ঘটেছে অহরহ। বাংলার যতীন দাশ লাহোর জেলে রাজনৈতিক বন্দির স্বীকৃতির দাবিতে ৬৩ দিন অনশন করে সেখানের মানুষের মন জয় করলেন, জলপাইগুড়ির মানুষ শঙ্কর গুহনিয়োগী ভিলাই-এ মদ্য ব্যবসায়ী মাফিয়াদের গুলিতে প্রণ দিলেন, বেঁচে রইলেন দল্লি-রাজহারার রুক্ষ অঞ্চলের মানুষদের প্রাণরসের মাঝে, তেমনি ত্রিচি-র মানুষ, স্ট্যানিস্লাস লডুস্বামী রাঁচি ঝাড়খন্ডে এসে হয়ে উঠলেন স্ট্যান স্বামী, জেস্যুইট পাদ্রি বেছে নিলেন আদিবাসীদের তাঁর ঈশ্বর হিসেবে, গড়ে তুললেন আদিবাসীদের নিজস্ব মানবাধিকার সংস্থা, “জোহার”, দেশ-বিদেশ ঘুরেও ফিরে এসেও সেই রাঁচি শহরের ধারে নিজের মতো করে, আদিবাসী স্থপতির হাতে নির্মিত তাঁর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে, যেখান থেকে ভারত রাষ্ট্র তাঁকে ভুয়ো মামলা, ভুয়ো সাক্ষ্য, ভুয়ো যোগাযোগের “অভিযোগ”-এ সর্বমোট ৫ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র বানিয়ে বিচারব্যবস্থাকে এড়িয়ে বিনা-বিচারের বন্দি হিসেবে রেখে হত্যা করল। এ এক অদ্ভুত পরিহাস, তাঁকে স্বাস্থ্যের কারণে জামিন দেওয়া বিচারের মামলার দিন স্থির করল এই হত্যাকারী রাষ্ট্র তাঁকে সুস্থ থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মেরে ফেলার ঠিক পরের দিন। “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না”।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4858 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...