Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিলকিস বানোকে নিয়ে কোনও নৈর্ব্যক্তিক প্রবন্ধ লেখা কেন সম্ভব নয়

শতাব্দী দাশ

 

বিলকিস বানোকে নিয়ে একটি তথ্যবহুল নৈর্ব্যক্তিক প্রবন্ধ লিখে ফেলা সম্ভব কি? বিলকিস বানো, এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কালে ধর্ষিত মেয়েদের মধ্যে প্রথম, যিনি ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনলেন৷ ঘুণ ধরা বিচারব্যবস্থার বুকের উপর বসে ন্যায়বিচার উপড়ে আনলেনও বলা চলে। প্রমিথিউসের আগুন ছিনিয়ে আনার মতোই আশ্চর্য এই ঘটনা।  তাঁর গল্প অসহায়তার, প্রতিরোধের, আবার শেষ পর্যন্ত জয়েরও। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সব মেয়েদের সঙ্গে যেন বিলকিসের চেনা-শোনা হয়। বিলকিসের স্পর্ধার গল্প জেনে বড় হলে ঝঞ্ঝায় মাথা না নোওয়ানোর জেদটি রপ্ত হতে পারে।

২৩শে এপ্রিল, ২০১৯-এর খর দুপুরে আমরা জানতে পারলাম, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে, গুজরাট সরকার যেন সত্ত্বর ৫০ লক্ষ ক্ষতিপূরণ দেয় বিলকিস বানোকে। যেন পালিয়ে বেড়ানো মেয়েটি সরকারি উদ্যোগে ঘর পান, চাকরি পান। মনে পড়ল, এরকমই আরেক খর দুপুরে, দু’বছর আগে, ২০১৭ সালের ৪ঠা মে, মুম্বাই হাই কোর্টের রায় বেরিয়েছিল। বিলকিস বানোর সঙ্গে এপ্রিল-মে-র গনগনে আঁচের গভীর কোনও সম্পর্ক আছে নিশ্চয়।

২০০৮ সালে মুম্বাই স্পেশাল কোর্ট বিলকিস বানো কেসে যে এগারো জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল, ২০১৭ সালে মুম্বাই হাইকোর্ট তাদের শাস্তি তো অব্যাহত রেখেছিলই, উপরন্তু যে দুই ডাক্তার ও পাঁচ পুলিশকর্মীকে স্পেশাল কোর্ট অব্যাহতি দিয়েছিল কর্তব্যে ইচ্ছাকৃত গাফিলতির অপরাধ থেকে, তাদেরও হাইকোর্ট অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করেছিল৷ শাস্তি হয়েছিল তাদেরও। প্রাপ্তির ঘড়া সামান্যই অপূর্ণ ছিল। বিলকিসের উকিল ভদ্রলোক সাংবাদিক সম্মেলনে একটাই কথা বলছিলেন দু’বছর আগে, “এখনও ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে না পারাটা কাঁটার মতো বিঁধছে।”

সেই ক্ষতিপূরণও এল অবশেষে৷ উল্লেখ্য, এর আগে রাজ্য সরকার পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিলেন বিলকিসকে। বিলকিস ও তার পরিবার তা গ্রহণ করেননি। তর্কের খাতিরে যদি মুহূর্তের জন্য ধরেও নিই যে, দাঙ্গা বাধানোয় সরকারি মদত ছিল না, তবুও এ’কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দাঙ্গা প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক৷ উনিশ-কুড়ির এক বধূকে সুরক্ষা না দিতে পারার দায় সরকার ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা ধরিয়ে দিয়ে৷ বিলকিস তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

বিলকিস বানোকে নিয়ে একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রবন্ধ লিখে ফেলা কেন সহজ নয়? কারণ সাংবাদিক-লেখিকা রাণা আয়ুব স্মৃতিচারণ করেন:

২০০২ সালের মে মাসের দুপুরে আমরা মুম্বাই থেকে কিছু ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবক গুজরাটে চলেছিলাম। লক্ষ্য ছিল আক্রান্ত মহিলা ও শিশুদের সাহায্য করা… বাসে করে গেছিলাম কম্বল, জামাকাপড় আর সামান্য যা কিছু জোগাড় করা গেছিল, তা নিয়ে। প্রত্যেক রিলিফ ক্যাম্পে নিজেদের গল্প শোনাচ্ছিলেন, দগদগে ঘা দেখাচ্ছিলেন কেঁদে-কেটে একসা হওয়া মহিলারা। বাচ্চারা মায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছিল, বায়না করছিল। কিন্তু মায়েরা শুনিয়েই চলেছিল তাদের ভয় আর ক্ষতের কাহিনী। তরুণীর শরীরে যে ঘা, তা ঘিরে মাছি ভনভন করছিল। সে সময়েও ক্যাম্পে ক্যাম্পে ফিসফিস করে তারা এক মেয়ের গল্প আওড়াত৷ দাহোড়ের সেই মেয়ে, যে গণধর্ষিত হয়েছে, যার পরিবারকে কেটে ফেলা হয়েছে, যার শিশুকে আছড়ে মারা হয়েছে, অথচ যে কিনা পুলিশে গেছে, যে কোর্টে দৌড়চ্ছে৷ সেই সাহসী মেয়েটিই বিলকিস বানো।

*****

গল্পটা এতদিনে সবারই জানা৷ ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০০২।

গোধরায় সবরমতী এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগ ও ঊনপঞ্চাশ করসেবকের মৃত্যু৷ তারপর তো লেগে গেল বা লাগানো হল হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা৷ হিন্দু করসেবকদের মৃত্যুর বদলা নিতে নির্বিচারে মুসলমান হত্যা চলতে লাগল। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই যে যার বিচার-বুদ্ধি মতো নিরাপদ স্থানে পালাতে শুরু করলেন৷ দাহোড় জেলার রন্ধিকপুর গ্রাম থেকে বিলকিসের পরিবারও পালাচ্ছিল গোধরা কাণ্ডের ঠিক চারদিন পর। ১৭ জন, একটি ট্রাকে৷

মার্চের ৩ তারিখ। ছাপ্পারওয়াড় গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক মাঠে৷ একটা কাঁচা সড়ক নেমে গেছিল পান্নিভেলা গ্রামের দিকে। দূরে পাহাড়। হঠাৎ দূর থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশজনের হল্লা শোনা গেল৷ ওদের হাতে ছিল কাস্তে, তলোয়ার,লাঠি। স্থানীয় ভাষায় হুঙ্কার: ‘আ রাহিয়া মুসলমানো, এমানে মারো, কাটো’। ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছিল বড়জোর। আট জন নিকেশ হয়ে গেছিল৷ ছজন আজও নিরুদ্দেশ। বিলকিসের মায়ের সামনে তাঁকে ও তাঁর সামনে তাঁর মাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল৷ বিলকিসের তিন বছরের মেয়ে, সালেহা৷ তাকে কোল থেকে ছিনিয়ে আছাড় মারা হয়েছিল। মুহূর্তেই মারা গেছিল সে। বিলকিস বানো, উনিশ-কুড়ি বছর, পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তাও তখন। তাঁর উপর এক এক করে চড়াও হয়েছিল বারো-তেরো জন। বিলকিসের ধর্ষিতা মায়ের গলার নলি কেটে নেওয়া হয়েছিল৷ তাঁর তুতো বোন, যে ঠিক দুদিন আগে সন্তানের জন্ম দিয়েছিল, তাঁকেও গণধর্ষণ করা হয়েছিল৷ তিনি বাঁচেননি, তাঁকে কেটে ফেলা হয়েছিল৷

গর্ভবতী বিলকিসের উপর যখন এক এক করে চড়াও হচ্ছিল সংখ্যাগুরু পৌরুষের ওজন, তখন তিনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন। ভাগ্যিস৷ তাঁকে মৃত ভেবে মাঠেই ফেলে রেখে গেছিল তারা৷ তিন ঘণ্টা পরে তাঁর হুঁশ ফেরে৷ তিনি আবিষ্কার করেন নিজের নিসুতো, রক্তাক্ত শরীর। আবিষ্কার করেন চারপাশে ইতস্তত ছড়ানো প্রিয়জনের শব। নিজেকে কোনওমতে একটি পেটিকোটে ঢেকে কাছের পাহাড়ি, আদিবাসী গ্রামে পৌঁছন৷ জামাকাপড়, আশ্রয়, শুশ্রূষা পান৷

তার পর শুরু হয় তাঁর লড়াই৷ যে লড়াই সতের বছর ধরে চলেছে এর পর৷ বিলকিসের ঘটনা ২০০২ সালের মার্চে গুজরাটে ঘটে যাওয়া অসংখ্য খুন-ধর্ষণের ঘটনার একটি৷ তফাত হল, হাজার হাজার মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারেননি। কী এক অসম্ভব জেদে বিলকিস পেরেছিলেন৷ গ্রামের অনালোকিত, গোমুখ্যু, গরীব, সাধারণ বিলকিস। বিলকিসকে নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক প্রবন্ধ লেখা তাই বড় বালাই।

কোথা থেকে যেন সাহস জুটিয়ে তিনি থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করে এসেছিলেন। এক হোমগার্ডের সাহায্যে বিলকিস এফআইআর করতে গিয়েছিলেন হেড কনস্টেবল সোমাভাই গোরির কাছে। কী করেছিল সেই হেড-কনস্টেবল? পরবর্তীকালে জানা যায়, সে বিলকিসকে ঠকিয়েছিল। সিবিআই-এর মতে “He suppressed material facts and wrote a distorted and truncated version.” নতুন কিছু নয়। রায়ট চলাকালীন এরকম অনেক কেসই ‘ডিসমিস’ করেছে বা করার চেষ্টা করেছে গুজরাট পুলিস, ‘প্রমাণের অভাব’-এর অজুহাতে। তারপর পাবলিক হসপিটাল হয়ে বিলকিস পৌঁছলেন গোধরা রিলিফ ক্যাম্পে৷ সেই পাবলিক হাসপাতালের ডাক্তারদের বিরুদ্ধেও আছে ভুল রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ৷ প্রসঙ্গত, সিবিআই-এর মতে, সে’সময় গুজরাতে এমনকি পোস্টমর্টেমও করা হত অভিযুক্তদের বাঁচানোর মতো করেই। মৃতদের মাথা-মুখগুলো থেঁতলে দেওয়া হত, যাতে মৃতকে সনাক্ত না করা যায়।

পুলিশ বলেছিল, বিলকিসের বয়ানে অসঙ্গতি। ম্যাজিস্ট্রেট এক বছর পর কেসের ফাইল বন্ধ করেছিলেন। তাতেও দমেননি তিনি। সমাজকর্মীদের ধরে কড়া নেড়েছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দরজায়৷ পিটিশন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে৷ সুপ্রিম কোর্ট সাড়া দিয়েছিল৷ মানবাধিকার কমিশনের কাছে রিপোর্টও তলব করেছিল। ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই-কে নির্দেশ দেয়, মামলাটির তদন্ত করতে হবে। বিলকিসের অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে সিবিআই।

প্রতিরোধ যত দানা বাঁধছিল, ততই বিলকিস পাচ্ছিলেন প্রাণনাশের হুমকি। বারবার বাড়ি বদল করতে হয়েছে তাঁকে৷ তবে তাঁর বর য়াকুব রসুলের সঙ্গে তাঁর পুনর্মিলনও হয়েছে৷ জন্ম নিয়েছে আরেকটি কন্যাও।

এমতাবস্থায় প্রাণভয়ে গুজরাট থেকে মামলাটি সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানান বিলকিস। ২০০৪ সালে মুম্বাই আদালতে আসে বিলকিসের কেস। চার বছরের মাথায় স্পেশাল কোর্ট কুড়ি জনের মধ্যে তেরো জনকে দোষী ঘোষণা করে৷ এগার জন পায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

২০০৪ সালের এক প্রেস কনফারেন্সে বিলকিস সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন তৎকালীন রাজ্য সরকারকে, অর্থাৎ প্রকারান্তরে নরেন্দ্র মোদিকে।

ওঁর কী দায়িত্ব ছিল না আমাদের রক্ষা করা? সরকারের দায়িত্ব ছিল না? কিংবা ঘটনা ঘটার পর দোষীদের ধরা বা ক্ষতিপূরণ দেওয়া কি ওঁর দায় নয়? আমি একা তো নই৷ ধর্ষণকে তো অনেক মেয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল দাঙ্গার সময়।

সেই নরেন্দ্র মোদি যখন নিজেকে ‘মা-বোনের ইজ্জতের চৌকিদার’ বলেন, তখন অলক্ষ্যে ঘৃণায় বিলকিস বানোদের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে না কি? বিলকিস বানো জিতেছেন৷ কিন্তু যে সব অতি-পুরুষেরা বিধর্মী নারীতে জোর করে প্রবিষ্ট হওয়াকেই হিন্দুধর্মের জয় বলে বক্তৃতায়-স্লোগানে ঘোষণা করে লোক তাতিয়েছিল, তারা অনেকেই আজ সদর্পে টুইটার হ্যান্ডেলে ‘চৌকিদার’ শিরোপা লাগিয়েছে নামের আগে। এই কারণেও বিলকিস বানোকে নিয়ে আজও নৈর্ব্যক্তিক প্রবন্ধ লিখে ওঠা যায় না।

সিবিআই এরপর বোম্বে হাইকোর্টে আপিল করে, তিনজন যাবজ্জীবনপ্রাপ্তর চাই আরও বড় সাজা৷ সাতজন ‘অপরাধে সাহায্যকারী’, যার মধ্যে আছে ভুল রিপোর্ট দেওয়া দুই ডাক্তার ও অসহযোগিতা করা পাঁচ পুলিশকর্মী, তারাই বা বেকসুর খালাস পায় কী করে? নয় বছর পর, ২০১৭ সালের মে-তে বোম্বে হাই কোর্ট ঘোষণা করে, ওই সাতজনও শাস্তি পাবে। যদিও মৃত্যুদণ্ড পাবে না পূর্বোক্ত তিনজনের কেউই৷

*****

বিলকিস সাহস দেখানোর পর অন্য কিছু কেসে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া গেছে৷ ২০০৪ সালে বেস্ট বেকারি মামলাও শুরু হয়েছিল। ভাদোদরার বেস্ট বেকারিতে দাঙ্গার সময় আগুন লাগিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল চোদ্দ জনকে। সর্দারপুরার অগ্নিকাণ্ডের জেরে সতেরো জনকে ধরা হয়েছিল। আবার ২০১৮ সালে বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গি ধরা পড়েন নারোদা পাটিয়া কাণ্ডের জন্য, যেখানে মারা পড়েছিল সাতানব্বই জন। ও হ্যাঁ, বেস্ট বেকারির মামলার ক্ষেত্রে বিচারকরা গুজরাটের রাজ্য-সরকারকে ‘আধুনিক নিরো’ বলেছিলেন। আর সামগ্রিক দাঙ্গা বিষয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণের বক্তব্য ছিল:

There was governmental and administrative support for the communal riots in Gujarat.

নির্ভয়া কেসে ফাঁসির আদেশ এবং বিলকিস বানোর কেসে ২০১৭ সালের রায় (যেখানে ফাঁসি নাকচ হয়, কিন্তু দোষী ডাক্তার ও পুলিশরাও সাজা পান) বেরিয়েছিল সামান্য সময়ের ব্যবধানে। জ্যোতির ঘটনাটি ঘটেছিল রাজধানী শহরে। তাঁর মৃত্যু তাই অভূতপূর্ব আলোড়ন ফেলেছিল। গণদাবির চাপে জ্যোতির অপরাধীদের ফাঁসি দিতেই হত রাষ্ট্রকে৷ অন্যদিকে বিলকিসের ছিল একার লড়াই। তিনি ধর্ষিত হয়েছিলেন দেশের প্রত্যন্ত কোণে, দাঙ্গাবিধ্বস্ত সময়ে, আরও হাজার মেয়ের মতাই। তিনি পাশে পেয়েছিলেন শুধু কিছু সজ্জন উকিল ও সমাজকর্মীকে। তবে অপরাধীদের যে ফাঁসি হয়নি, তা নিয়ে বড় একটা আক্ষেপ বিলকিসের দেখা যায়নি৷ সাংবাদিক সম্মেলনে ২০১৭ সালে বিলকিস বলেছিলেন, “মুঝে বদলা নহি, ন্যায় চাহিয়ে।” সেই সম্মেলনে য়াকুব রসুল, বিলকিসের বর, বলেছিলেন, দাঙ্গায় সর্বহারা হওয়ার কথা, বিলকিসকে হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়ার কথা, গরুবিক্রেতা হিসেবে নিজের পারিবারিক পেশা রাতারাতি হারানোর কথা।

ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়ে ধর্মের ও পিতৃতন্ত্রের সেই চোখ বদলায় না, যে চোখ নারীকে ভোগ্য হিসেবে দেখে; বিধর্মী নারীকে ‘নষ্ট’ করে বিধর্মকে ‘বেইজ্জত’ করা যায় বলে ভাবে; ভাবে, বিপক্ষের নারীকে ‘নষ্ট’ করলেই ‘বেইজ্জত’ করা যাবে বিপক্ষকে। ইতিহাস সাক্ষী, এমন ঘটনা মানুষের দেশ, ধর্ম, জাতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে বারবার ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি ধর্ষিত হয়েছিল দুই থেকে চার লাখ মেয়ে৷ ইমামরা নাকি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিল, হিন্দু বাঙালি মেয়েরা ‘গণিমতের মাল’, যুদ্ধের বলি হোক তারা। জার্মানি দখল করার সময় লাল ফৌজ কী করেছিল জার্মান মেয়েদের প্রতি? সোভিয়েতের মহত্তর আদর্শ পৌরুষের আস্ফালনে কিছুমাত্র তফাত ঘটিয়েছিল, এমনটা শোনা যায়নি দুর্ভাগ্যবশত।

নানাস্তরে ‘অ্যাবিউস’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘গ্যাসলাইটিং’ পরিভাষাটি ব্যবহার করি আমরা। আপনার মাথা ফোলা কেন? কেউ ঠুকে দিয়েছে? না তো! মাথা ঘুরে নিজেই নিজের মাথা ঠুকে ফেলেছিলেন দেওয়ালে, মনে নেই? এই মিথ্যে জোর দিয়ে দশবার বললে আপনি, যিনি স্বয়ং ভিক্টিম, তিনিও তা বিশ্বাস করতে শুরু করবেন। নিজের বোধ, বুদ্ধি, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা সবই ধোঁয়াটে হয়ে যাবে।

বৃহত্তর ক্ষেত্রে, আদালতের শুনানিরও আছে এক নিজস্ব, স্বীকৃত গ্যাসলাইটিং প্রক্রিয়া। বিলকিসের ক্ষেত্রে, প্রতিটি নির্যাতিত মেয়ের ক্ষেত্রে, সেই প্রক্রিয়া চলে, ‘আইনি যুদ্ধ’-র নামে। এক্ষেত্রে চলেছিল সতেরো বছর। ধর্ষিতা মেয়েটি শুনেছেন, তিনি ধর্ষিতাই নন। তাঁর মৃত মেয়েটাও ওখানে ছিল না। ছিলেন না আত্মীয়রাও, যাঁদের চোখের সামনে এফোঁড়-ওফোঁড় হতে দেখেছেন। ধর্ষণের পর গর্ভবতীর পেটের ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়নি কেন? তাহলে নিশ্চয় ধর্ষণ হয়নি। এই আইনানুগ গ্যাসলাইটিং-এর সামনে অটল থাকতে পারেন বিলকিস। সেই বিলকিসকে নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক প্রবন্ধ লেখা যায় নাকি?

বিলকিস পেরেছেন মানে চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও পারা যায়। বিলকিস প্রমাণ করেছেন, হাল ছেড়ে দেওয়াটা একটা বিলাসিতা, যা সবার সাজে না। বিলকিস ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিলেন, ২০০২ সালের পর থেকে এই প্রথমবার। বিলকিস চান তাঁদের মেয়ে আইনজীবী হোক, যাতে তাঁর মতো আরও অনেক নির্যাতিত বিচার পান। বিলকিস বানোকে নিয়ে একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রবন্ধ লিখে ফেলা তাই একেবারেই অসম্ভব।