Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হাইলাকান্দি দাঙ্গা— দেওয়াল লিখন পড়তে শিখুন

তানিয়া লস্কর

 

‘শান্তির দ্বীপ’। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে এই নামেই সুপরিচিত বরাক। অথচ দুঃখের বিষয় বরাকের এই আত্মসম্মানকে নষ্ট করার জন্য কয়েক বছর থেকে ‘কু-চক্রীদের ছা’-রা উঠেপড়ে লেগেছেন। এরই আরেকটি প্রয়াস হিসেবে গত ১০ মে বরাকের দক্ষিণপ্রান্তের জেলা হাইলাকান্দিকে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের মাধ্যমে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনার বিবরণ মতে ৭ মে হাইলাকান্দি শহরের মোটামুটিভাবে জনবহুল এলাকার একটি মসজিদে তারাবিহ নামাজ চলাকালীন কিছু দুষ্কৃতিরা নামাজীদের মোটরবাইকের সিট ফালাফালা করে কেটে দেয়। সেই ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে ১০ তারিখ জুম্মাবারে রাস্তায় নামাজ পড়ার জন্য কিছু লোক সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনমত তৈরি করে। তারা যখন সেখানে নামাজ পড়ছিলেন তখন তাদের উপর পাথর ছোঁড়া হয়। তাতে নামাজীরাও পথে বেরিয়ে আসেন। এরপর ভাঙচুর শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে প্রথমে স্থানীয় উগ্র-সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ করা লোকদের প্রতিষ্ঠানসমূহ  ভাঙচুর করা হয়। এতে আপাত নিষ্ক্রিয় পুলিশ হঠাৎ করে অত্যধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে। যার ফলে জনতাও আরও তৎপর হয়ে। এবং শেষমেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে গুলি চালাতে হয়। তখনই পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যু ঘটে এবং আরও ৩ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় শিলচর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। লাঠিচার্জ-এর ফলে আঘাতপ্রাপ্ত হয় আরও অনেকেই। স্থানীয় সংবাদপ্ত্রগুলির রিপোর্ট মতে গুলি করার আদেশটি কর্তৃত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকের দেওয়া নয়। বরং কর্তব্যরত অফিসারেরা নিজেদের দায়িত্বে গুলি চালিয়েছেন।

ঘটনার পর্যালোচনা করলে যে প্রশ্নগুলি উঠে আসছে সেগুলি হল—

  1. দু-তিনদিন ধরে সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের দ্বারা ক্রমাগত প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও সেদিন নামাজের সময় পুলিশ প্রহরার ব্যাবস্থা করা হয়নি কেন?
  2. যে এলাকায় সিট কভার কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটে তার আশেপাশের দোকানগুলোর সিসিটিভি পরীক্ষার যে দাবি সাধারণ জনতার মধ্য থেকে উঠেছিল, সেটাকে প্রশাসনের তরফ থেকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কেন?
  3. স্থানীয়দের মতে আগের দিন শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান করে উভয় সম্প্রদায়ের কিছু লোক সম্মিলিতভাবে আশেপাশের এলাকায় পোস্টারিং করেন। প্রশাসন এভাবে উভয় সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক লোকদেরকে নিয়ে শান্তি-সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি কেন?
  4. টিয়ার গ্যাস, ওয়াটার ক্যানন এসব ব্যবহার না করে সোজাসুজি গুলি ছোঁড়াটা ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত?
  5. গুলি চালনায় আহত ৩ জন এবং লাঠিচার্জ-এর ফলে আঘাতপ্রাপ্ত ৬ জন লোকই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কী করে হয়?

এসব প্রশাসনিক গাফিলতি নাকি উপরমহলের নির্দেশ, কিছুই স্পষ্ট নয়। তবে একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল যবে থেকে বরাকে বিদেশি সন্দেহে নতুন করে ধরপাকড় শুরু হয়েছে এবং মানুষ ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন তখন থেকেই একটি মহল ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক ঐক্য নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে। অন্তত গত একমাসের ঘটনাক্রমেরই ইঙ্গিত বহন করে। গত ২৭ তারিখে কাছাড় জেলার শিলচরে বিগ বাজারের সামনে একজন পাঞ্জাবি পরা ছেলেকে কিছু লোক মারধর করে। এর কিছুদিন আগে শবে বরাতের দিন উচ্চমাধ্যমিকে পড়া একটি ছেলেকে টিউশন থেকে ফেরার পথে মারধর করে একটি বিশেষ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত তার থেকে সামান্য বেশি বয়সের কিছু ছেলে। এতসবের পরও প্রশাসন উপযুক্ত সক্রিয়তা কেন দেখাতে পারছে না সে এক আশ্চর্য ধাঁধা। কিন্তু এসবের মাঝে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে সাধারণ মানুষ এসব উস্কানিগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে প্রত্যাখ্যান করছেন। সেজন্যই কেবলমাত্র হাইলাকান্দি শহরের একটি বিশেষ এলাকা ছাড়া দাঙ্গা আর কোথাও ছড়ায়নি। এবং কার্ফুর সময়ও হিন্দু-মুসলমান একে অপরের পাশে থেকেছেন। দাঙ্গার এলাকা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রাজে এলাকায় এক হিন্দু ভদ্রমহিলা নন্দিতা যখন প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছিলেন তাকে নিজের অটোরিকশা করে হাসপাতালে পৌঁছে দেন মুসলিম প্রতিবেশী মকবুল। ছেলে জন্ম হলে আপ্লুত পরিবারের লোক নাম দিয়েছেন ‘শান্তি’। এছাড়াও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে আছে এমন আরও অনেক বৃত্তান্ত। শুনেছি যে ভারতীয় সংস্কৃতির তথাকথিত রক্ষক এবং ভূমিপুত্রদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া অতিদায়িত্বশীল গোষ্ঠীর যোগসাজশে এই ঘটনাটি ঘটেছে। খুবই সম্ভব। কারণ দুই সম্প্রদায়ের লোক মিলেমিশে থাকলে এদের রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে যেতে পারে। অতএব ১৫ জুন এনআরসির যে এএক্সক্লুশন লিস্ট বেরুবে তার আগে এবং বিশেষ করে জুলাইতে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পূর্বে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণটা অতি আবশ্যক। এসব বিষয় মাথায় রেখেই কি দাঙ্গার পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল? সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে এবার থেকে আরেকটু সচেতন হতে হবে। নাহলে কাশ্মির সহ আফস্পার আরোপিত বাকি রাজ্যগুলির মতো পরিস্থিতি ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হবে।