ত্রিপুরার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা— নতুন মোড়কে পুরনো গল্প

তানিয়া লস্কর

 

 

প্রাবন্ধিক, পেশায় আইনজীবী

 

 

 

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ একটি বিশেষ প্রভাব সবসময়ই ছিল। তবে বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদ নিজের নিয়মে যখন আবার রূপ পরিবর্তন করে নতুন-উদারীকরণ রূপে ঝাঁকিয়ে বসছে, তখন ধর্ম এবং জাতের নামে মেরুকরণের রাজনীতিও দেশে দেশে আবার চাগাড় দিয়ে উঠছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং অবশ্যই ভারত এবং বাংলাদেশেও একই অবস্থা। তবে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে হিন্দু-ডানপন্থীদের ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে এই মেরুকরণ ভয়ঙ্কর রূপে সামনে আসছে। অর্থনৈতিক অবস্থা যত খারাপের দিকে যাচ্ছে, মেরুকরণ তত বাড়ছে। অরুণাচল এবং মেঘালয়ের মতো রাজ্য যেখানে এই কয়েকবছর পর্যন্ত হিন্দু ডানপন্থী সংগঠনগুলোর কোনও চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না, সেসব জায়গায় আজকাল আরএসএস, ভিএইচপি-র মতো সংগঠনগুলোর মাল্টিস্টোরেড অফিস খুলেছে। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বাড়ছে। ত্রিপুরাতে অক্টোবর মাসের শেষের থেকে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে সেটাও এই চিত্রেরই একটি অংশ।

বাংলাদেশে দুর্গাপূজোর দিনগুলোতে হওয়া ধর্মীয় অশান্তিকে ভিত্তি করে ২১ তারিখ থেকে ত্রিপুরার নানা স্থানে প্রায় ২৮টি মসজিদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। ভাঙা মসজিদগুলোর ফটোসহ পোস্ট সামাজিক মাধ্যম এবং মক্তব মিডিয়া ইত্যাদি নানা নিউজ পোর্টালে প্রকাশ হওয়ার পরেও সরকার তথা প্রশাসন সেগুলো সমানে অস্বীকার করে যাচ্ছে। এমনকি কর্পোরেট মদতপুষ্ট মিডিয়া হাউসগুলোও প্রায় নীরব। ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বললেও ভুল হবে না। বাড়তি এটুকু যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো দলগুলো ‘অই মোহাম্মদ তেরা বাপ কা নাম, জয় শ্রী রাম জয় শ্রী রাম’, ‘ত্রিপুরা মে মোল্লাগিরি নাহি চলেগা, নাহি চলেগা’ ইত্যাদি নানা উসকানিমূলক স্লোগানসহ মিছিল করে যাচ্ছে এবং প্রশাসন তাতে কোনও ধরনের বাধা দিচ্ছে না। এই লেখা সম্পূর্ণ করা পর্যন্ত গ্রাউন্ড থেকে পাওয়া খবর মতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। সুতরাং চোখ কান খোলা রেখে এর কারণ সমূহ বিশ্লেষণ করা অতি প্রয়োজন।

২০১৪ সালে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপি সরকার হাজারো মিথ্যে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দিয়েছে। তারপর সেগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে বর্তমানে তাদের জনতার রোষের কবলে পড়তে হচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিকসহ নানা স্তরের সাধারণ জনতাকে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। সরকারপক্ষ তাদেরকে নিরস্ত্র করতে পুলিশি উৎপীড়নসহ নানারকম দমনমূলক পদক্ষেপ নিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারের হাতে একটি মোক্ষম অস্ত্র বাকি থাকে— সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। এটি সবসময়ই পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণির ক্ষেত্রে একটি ‘রেড হেয়ারিং’ হিসেবে কাজ করে। এর ফলে বাকি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যা থেকে সবার চোখ সরিয়ে দেওয়া যায়। এবং সংখ্যালঘুদেরকেও মানসিক চাপে রাখা যায়। তারা তখন নিজেদের সমস্যা নিয়ে লড়াইয়ে নামতে সাহস করে না। ফলে এক ঢিলে দুটি পাখি মারা যায়।

তাছাড়া ত্রিপুরায় ২০২৩ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলছে। তার আগে বর্তমানে নভেম্বর মাসে শহরগুলোতে মিউনিসিপালিটি নির্বাচন। জনসংখ্যার নিরিখে ৬০ শতাংশ হিসেবে নির্বাচনী রাজনীতিতে বাঙালিরা ত্রিপুরায় একটি নির্ণায়ক জনগোষ্ঠী। সেখানে তেইশের নির্বাচনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আবেগের প্রতিনিধিত্ব করে এমন নতুন দলের প্রবেশ ঘটছে। সেটা নিয়েও সরকারপক্ষ কিছুটা চাপে আছে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে মরিয়া হয়েই ডানপন্থীদের সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়িতে চাগাড় দিতে হচ্ছে।

এই খুনি রাজনীতিকে প্রতিহত করতে হলে বাঙালি এবং তিপ্রা জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বাঙালি অভিজাত শ্রেণি যারা প্রগতিশীল চিন্তায় বিশ্বাস করে তাদেরকে নিজেদের জতি বা আরও স্পষ্ট করে বললে কাস্ট-হেজিমনি ছেড়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের মতো তিপ্রা সহ বাকি উপজাতিদের মধ্যে জন্ম নেওয়া বাঙালি ভীতিকে দূর করার জন্য মাঠে নামতে হবে। মনে রাখা উচিত যে ত্রিপুরাতে এনআরসি করার দাবি নিয়ে একটি রিট আবেদন ইতিমধ্যেই উচ্চতম ন্যায়ালয়ে বিচারাধীন আছে। এই অবস্থায় ডানপন্থী রাজনীতির পাতা ফাঁদে পা দিলে আখেরে এর খেসারত বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমান দুই পক্ষকেই  দিতে হতে পারে। অসমের সাম্প্রতিক এনআরসি পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করলে একথা খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। অতএব ঠান্ডা মাথায় বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে শাসক ও সুযোগসন্ধানী আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর পাতা ফাঁদ এড়িয়ে চলাই এই মুহূর্তে ত্রিপুরার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4873 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...