সিনেমা কি শুধু তাৎক্ষণিকতারই উদযাপন?

সত্যব্রত ঘোষ

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

 

 

কলকাতায় এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হয়ে গেল আমেরিকার অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচারস আয়োজিত বার্ষিক অস্কার পুরষ্কারে বিবেচ্য হবার জন্য ভারতীয় ছবির মনোনয়নের আসর। প্রথমবার, ২০১৯ সালে জুরিদের রায়ে জোয়া আখতার পরিচালিত ‘গালি বয়’ অস্কারে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া-র তত্ত্বাবধানে এবার ১৪টি ছবির (অস্কার ভারতের মনোনয়নের জন্য পাঠানো অন্য ছবিগুলি: ব্রিজ (অহমিয়া)), লায়লা ঔর সাত গীত (গোজরি), চেলো শো (গুজরাটি), শেরশাহ, শেরনি, কাগজ ও তুফান (হিন্দি), নায়াট্টু (মালয়ালাম), আট্টা ভেল জালি, গোদাবরী, কারখানিসাঞ্চি ওয়ারি (মারাঠি)।) মধ্যে পি এস বিনোদকুমার পরিচালিত তামিল ছবি ‘কুঝাংগাল’-কে একই শিলমোহর দেওয়া হল।

মারাঠি, গুজরাটি, প্রমুখ ভাষার ১৪টি ছবির মধ্যে মনোনয়নের জন্য ছিল হিন্দি ছবি ‘সর্দার উধম’-ও। একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে গত ১৬ অক্টোবর ছবিটির মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই যে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না দর্শকরা তাঁদের পরিচিতজনদেরও ছবিটি দেখতে অনুরোধ করে চলেছেন। ‘ওয়ার্ড অফ মাউথ’ এই প্রক্রিয়ায় ছবির দর্শকসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে বিরূপ সমালোচনায় লেখা ও বলা হয়: ছবিটির দৈর্ঘ্য যথেষ্ট বেশি। সেই একই কথা আবার কলকাতায় মনোনয়নের আসরে জুরিদের মুখেও শোনা গেল।

একথা ঠিক, দেশেতে এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অনধিক ১৫০ মিনিটের সময়টিকে কমবেশি প্রায় অধিকাংশ চিত্রনির্মাতারা নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এবং এটাও ঠিক, ‘সর্দার উধম’-এ অন্তত দুটি অংশ বেশ কিছুটা প্রলম্বিত। তবে এই দুটি অংশই ছবির জন্য জরুরি ছিল, যেখানে চিত্রনির্মাতা সুজিত সরকার তাঁর মূল চরিত্রকে সামনে রেখে নিজের শিল্পগত অবস্থানটি তুলে ধরেছেন।

একটি দৃশ্য লন্ডনের পার্কের সেই Free Speech Platform-এ, যেখানে উধম সিং এক ব্রিটিশ গৃহহীন মানুষকে বোঝাচ্ছেন যুদ্ধে কোনও দেশই আসলে জেতে না। বন্ধু ও নেতা ভগৎ সিংয়ের থেকে পাওয়া মিলেমিশে থাকবার শিক্ষাটিকেই মনে রেখে হতাশাক্লিষ্ট নেশাচ্ছন্ন উধম সিং শপথ নিতে বলছেন এক নিঃসহায় প্রৌঢ়কে। অন্য দৃশ্যটি ছবির শেষে আসে। জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলিতে আহত কিশোরকে হাসপাতালে আনবার পরে সারা রাতের পরিশ্রমে বিধ্বস্ত চিকিৎসক পরীক্ষা করছেন। তারপরে তরুণ উধম সিংকে জানাচ্ছেন কিশোরটি মৃত। উধম সিং-এর আবেগে কেউ যে সাড়া দেবে না, তা বোঝাতে চিত্রনির্মাতা একটিতে রেখেছেন নিরুত্তাপ নির্বান্ধব এক বিদেশি ভিক্ষুককে। অন্যটিতে রয়েছে গুলির আঘাতে যন্ত্রণাদগ্ধ এবং রক্তপাতে অকালমৃত অনাথ আশ্রমে তাঁর সঙ্গে থাকা এক ছোট্ট বন্ধু।

এমন এক লড়াইয়ে উধম সিং সামিল যা এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর পাশে কেউ নেই। তার মানে উধম সিং কি শুধুই তাঁর ব্যক্তিগত লড়াই লড়ছেন? দেশপ্রেম দেখানোয় যে সোচ্চার উপায়টি ভারতীয় চলচ্চিত্রে সুপ্রচলিত, এখানে তা পরিহার করে চিত্রনির্মাতা নতুন এক ভাষ্য রচনা করছেন। শাজি করণ সহ অন্য জুরিদের মনে হয়েছে সেই ভাষ্য থেকে নাকি ‘ভুল’ বার্তা পৌঁছাবে পাশ্চাত্য দেশগুলির কাছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বছরের বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এর অনেকগুলিতে যে পুরস্কারগুলি দেওয়া হয়, চিত্রনির্মাতাদের জন্য তা শুধু গৌরবজনকই নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সোপানও বটে। কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই চিত্রনির্মাতাদের নিজস্ব উদ্যোগে পাঠানো ছবিগুলির মধ্যে থেকে উৎসবের নিজস্ব কমিটি কয়েকটি ছবি প্রদর্শন এবং পুরস্কারপ্রাপ্তির যোগ্য কিনা তা বেছে নেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিত্রনির্মাতারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্যে প্রচারের অঙ্গ হিসেবে নিজেরাই উৎসবগুলিতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের ছবি প্রদর্শনের আয়োজনও করেন। কিন্তু অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচারস আয়োজিত বার্ষিক অস্কার পুরষ্কারের ক্ষেত্রে নিয়মটি আলাদা। এখানে দেশগুলির সরকারের উদ্যোগে চিত্রনির্মাতাদের শীর্ষ সংগঠন দ্বারা গঠিত একটি কমিটি ছবি মনোনয়নের দায়িত্ব নেয়। নির্বাচিত ছবিটিকে এরপর অস্কার পুরস্কার কমিটির বিবেচনার জন্য আমেরিকায় প্রদর্শনের জন্য পাঠানো হয়। এই মনোনয়নকে তাই এক অর্থে সরকারি মনোনয়নই বলা যেতে পারে।

সেরা বিদেশি ছবির পুরস্কার অর্জনের জন্য এযাবৎ যে পঞ্চাশাধিক ভারতীয় ছবি পাঠানো হয়েছে তার অধিকাংশই হিন্দি ভাষায় নির্মিত। যার মধ্যে তিনটি ছবি প্রতিযোগিতার শেষ পর্ব অবধি পৌঁছাতে পেরেছে (মাদার ইন্ডিয়া— ১৯৫৭, সালাম বোম্বে— ১৯৮৮ এবং লগান— ২০০১)। এছাড়া তিনটি মালয়লাম, তিনটি মারাঠি, দুটি বাংলা, দুটি তামিল (এবারটা মিলিয়ে), একটি করে তেলেগু, গুজরাটি, কোঙ্কনি এবং অসমিয়া ছবি বিভিন্ন বছরে আমেরিকায় পাঠিয়েছে ভারত সরকার। বাকি তেরোটি ছবির তুলনায় ‘কুঝাংগাল’-কে যোগ্যতর মনে করে ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া গঠিত কমিটি এবার ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে কেন মনোনীত করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তবে ছবিটি নিয়ে তামিল চলচ্চিত্র সমালোচকদের উচ্ছ্বাস কম নয় (“তামিল সিনেমায় এত বিস্তৃত গ্রাম্য জীবন এমন অনাড়ম্বরে আর্ট হাউস সিনেমার শৈলীতে আগে দেখা যায়নি।”)।

‘সর্দার উধম’-কে বাদ দিয়ে একজন পরিচালকের প্রথম প্রয়াসকেই এমন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির দ্বারা স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে ভ্রূকুঞ্চন স্বাভাবিক। জুরি সদস্যদের প্রশ্ন করা হয় ‘সর্দার উধম’-কে অস্কার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে কেন মনোনয়ন দেওয়া হল না, তখন তাঁদের একজনের উত্তর এখন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই চিত্র এবং সঙ্গীত পরিচালক বলেন, “সর্দার উধম’ অসাধারণ ছবি, এর সিনেম্যাটোগ্রাফি বিশ্বমানের। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিসংবাদী নায়ককে দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই ছবিতে ব্রিটিশদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা দেখানো হয়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে ঘৃণা ধরে রাখা ঠিক নয়।” অন্য সদস্যরা অবশ্য ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের এই বক্তব্যকে ‘তাঁর ব্যক্তিগত মতামত’ বলে নস্যাৎ করে মিলিতভাবে জানিয়েছেন ফেডারেশনের গাইডলাইন মেনে নিরপেক্ষভাবে একটি ছবিকে নির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু একটি ভারতীয় ছবিতে, যার বিষয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যালীলা এবং পরবর্তী ঘটনাক্রম, তাতে ব্রিটিশদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব ফুটিয়ে তোলা কি আদৌ সম্ভব?

‘সর্দার উধম’ ছবিতে আমরা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে অস্বস্তিতে পড়তে দেখি। তাঁর অধস্তন হোম সেক্রেটারি সরাসরি চার্চিলের থেকে জানতে চান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমরা ব্রিটিশরা কি ভারত ছেড়ে দেব? কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে চার্চিল উত্তর দেন, “ব্যাপারটাকে এইভাবে বলা যেতে পারে যে, ওখানে কৌশলগত উপস্থিতি বজায় রাখবার জন্যে আমাদের নতুন কোনও উপায় পুনরাবিষ্কার করতে হবে।” চার্চিলের এই সংলাপটি শুনে ইন্দ্রদীপ দাসগুপ্তের মন্তব্যকে শুধুমাত্র ‘ব্যক্তিগত’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? ঔপনিবেশিকতার শোষণযন্ত্রকে আমরা যতই দুষি না কেন, ভারতে ব্রিটেনের ‘কৌশলগত উপস্থিতির উপায়’ উইন্সটন চার্চিল এবং তাঁর উত্তরসূরি ক্লিমেন্ট অ্যাটলি নিশ্চয়ই আবিষ্কার করেছিলেন, যা আজ বিশ্বায়নের যুগেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

ছবিটিতে একবার নয় বারবার উধম সিং বলছেন ভারতে সাম্রাজ্যবাদের যে evil ব্রিটিশরা তৈরি করেছে, তিনি তারই প্রতিবাদ করছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যালীলার নায়ক রেজিনাল্ড ও’ডায়ার প্রসঙ্গে পাঞ্জাবের অবসরপ্রাপ্ত গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার ছবিতে বলছেন, “He died a broken man. কিন্তু কর্তব্যপালনে এতটুকুও বিচ্যুত হয়নি সে। রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে সোচ্চার পাঞ্জাব তথা ভারতবাসীদের ভয় পাওয়ানোর জন্যে জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো একটি ঘটনার প্রয়োজন ছিল।”

শুধুমাত্র ও’ডায়ারদের মারতে উধম সিং যে লন্ডনে যাননি, তা ছবিতে প্রতিষ্ঠিত। ছবির পরতে পরতে আমরা দেখি জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যালীলার বিরুদ্ধে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে লন্ডনে এসে উধম সিং দেখছেন সেখানকার সংগঠনের নেতৃস্থানীয়রা সম্পূর্ণ হতোদ্যম। সংগঠন থেকে তাঁকে বলা হল “lie low for sometime.” বিদ্রোহ প্রতীকী (symbolic) হয়, এবং এখানেই আতঙ্কবাদের সঙ্গে বিদ্রোহের মূল ফারাক। ভগৎ সিং যে কথা HSRA-র সদস্যদের বলতেন, তা অনুসরণ করে উধম সিং আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি-র সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে বোঝাতে চান দুই পক্ষের ক্ষেত্রে শত্রু কিন্তু এক। কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তৎপরতায় ব্যর্থ হন সেই প্রয়াসে। মাইকেল ও’ডায়ারের সান্নিধ্যে আসবার পরে অন্তত দুবার তাঁকে মারতে প্ররোচিত হলেও মারেন না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হেফাজতে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে উধম সিং শুধু জানতে চান একটাই কথা: মানুষ এতটা শয়তান হয় কীভাবে যে এত নৃশংস কাণ্ড ঘটানোর এতগুলি বছর পরেও তার মধ্যে অনুশোচনার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই?

আমাদের ইতিহাসের পাতাগুলিতে উধম সিংয়ের উল্লেখ নামমাত্রই। সংবাদপত্র এবং পুলিশ নথিতে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তাতে ব্যক্তি উধম সিংকে চেনার সুযোগ অল্পই। জালিয়ানওয়ালাবাগ এবং অমৃতসরের সংলগ্ন এলাকায় উধম সিংকে নিয়ে যে লোকগাথার জন্ম, তা অবশ্য শুনে চলেছে সেখানকার তিনটি প্রজন্ম। এই উপাদানগুলি থেকে তো রূপকথাই তৈরি হয়। অথচ সুজিত সরকার সেই উপাদনগুলি থেকেই বুনেছেন রক্তমাংসের এমন এক মানুষের শোক, প্রেম, ক্রোধ এবং ঋজু ব্যক্তিত্বের ভাষ্য, যা কালের গণ্ডি পেরিয়ে সরাসরি আঘাত করে ‘অচ্ছে দিন’-এর ভারতের উথলে ওঠা দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবোধের মর্মস্থলে। বিদেশে অত বড় মঞ্চে ‘সর্দার উধম’ প্রদর্শনের পর ভারতের সাংস্কৃতিক কর্তৃপক্ষকে সম্ভবত অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত। তাই ছবিটিকে যে সরকারিভাবে আন্তর্জাতিক ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হয়নি, ভালোই হয়েছে। কারণ শুধু চলচ্চিত্রে কেন, শয়নে, জাগরণে, চিন্তনে বর্তমানের ভারতের বৈষম্যপীড়িত বাস্তবতাকেই রূপকথা বলে মেনে নিয়ে এখন আমরা তাৎক্ষণিকতার উদযাপনেই অভ্যস্ত হচ্ছি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. প্রবন্ধের শেষ কয়েকটা লাইনে সত্যব্রত খুব সঠিক ভাবেই ব্যাঙ্গ টি ছুঁড়ে মেরেছেন। সিনেমাটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিলো, আমার ইনার স্পেসটা’র প্রতিবিম্ব যেনো আমার চোখের সামনে তুলে ধরেছে। দরকার আছে বইকি, যে নিয়তির নিষ্পেষণে আমরা হতোদ্যম, হতোৎসাহিত আমরা নপুংসকে পরিণত হচ্ছি ক্রমাগত, তাকে আজ না হয় কাল গুলি করে মারার দরকার আছে!
    সত্যব্রত খুব ভালো বিশ্লেষণ করেন, এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।

আপনার মতামত...