Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুগগাকুড়ুনি

শুভ্র মৈত্র

 

মা গুলেনকে আগেই বলে রেখেছে, ‘এবারে কিন্তু বাত্তা বেচবি না। বেড়াটা বাঁধতে হবে।’ আসলে ঐ যে বন্যায় ঘর ডুবে গেছিল ওদের, তারপর থেকেই বেড়াটা আর বাঁধা হয়নি। নদীর ঘাটে ওদের ঘরগুলোর আর কিছু থাক না থাক বেড়া আছে। গুলেন জানে, বেড়াটা দিলেই মা আবার মনের সুখে পুঁই, লাউ পুঁতবে, আর লক্ষ্মী, মানে মায়ের বিড়ালটাও বুঝে নেবে নিজের এলাকা।

এসব কথা এইদিনগুলিতেই শুরু হয়। মানে এই দশমীর পরদিন। সারা পুজো সেরে আসলে যে রাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা। কাল ভাসানের পর অনেক রাত পর্যন্ত হইহল্লা চলেছে ঘাটে। একেকটা দুর্গা আসছে আর জলে ভাসানো পর্যন্ত কী চীৎকার। গুলেন, অখিল, গোপীরা তো সারারাত জলেই ছিল। মিনতি, ইসমাতারাদের উপর কড়া হুকুম ছিল, ঘর থেকে বেরোবি না! ও যায়ওনি। ঘর থেকেই তো দেখা যায় সব। বেটাছেলে, মেয়েছেলেদের নাচ, পুলিসের হাঁইচাঁই, দুর্গাকে টেনে জলে নিয়ে যাওয়া। আর তারপরেই গুলেন অখিলদের জলে দাপাদাপি। দুর্গার শরীর থেকে বাঁশ-বাত্তা ছুটাতে হয়। কাঠের খাঁচাটা বের করে আনতে হয়। তারপর জলের মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে আসতে হয় ঘাটে। ভারী কম আছে! একলা পারা যায়!

খড় বের করা হাতের টুকরো, একরাতের মধ্যেই উঠে গেছে রং, সিংহের লেজ, গণেশের শুঁড়, ময়ূরের গলার ভাঙা অংশ— সব পরপর সুতো দিয়ে বাঁধা। বালির উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা কালো মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে। ওটা নিশ্চয়ই ঠাকুরের চুল। ঠিক যেন একটা রেলগাড়ি। গুলেন দূর থেকে দ্যাখে। বালির উপর দিয়ে চলেছে। ওর বোন মিনতি, আরও কিছু সঙ্গী নিয়ে এই রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলছে। কেউ কেউ হাতে নিয়েছে কুড়িয়ে পাওয়া টিনের তলোয়ার, চক্র। ভাসানের পরদিন সকালে ওদের এই খেলা চলে, কুড়নোর খেলা। কে কী পেল দেখাতে হবে।

হঠাৎ কী মনে হল, ঠেক ছেড়ে উঠে এল গুলেন। এসেই ধাঁই ধাঁই করে চড় কষাল মিনতির পিঠে। ‘উফফ মা গো’, কঁকিয়ে ওঠে মিনতি। কারণ বোঝার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে গুলেন, “বলেছি না, দুর্গার মুখ তুলবি না! পাপ লেগে যাবে। ভাসিয়ে দে বলছি।” এবারে মিনতি বুঝল ওর মার খাওয়ার কারণ। সত্যিই ভেবেছিল খেলা হয়ে গেলে দুর্গার মুখটা ঘরে নিয়ে যাবে। মা বলেছিল দুর্গার মুখ ঘরে না আনতে। মনে ছিল না। সকালে ঘাটে এসে মিনতি কুড়িয়ে নিয়েছিল দুর্গার মুখটা। কেউ নেয়নি। অবশ্য দুর্গা কিনা ও নিজেও জানে না। লক্ষ্মী, সরস্বতী— যে কোনও কারওই হতে পারে। চুল ছাড়া সব তো একইরকম। ঘরে নিয়ে গিয়ে সাজাবে ভেবেছিল। তা দাদার চোখ পড়ে গেল। বাড়িতে নিয়ে গেলে মাও রাখতে দিত না।

…মনসুরও আছে ওদের সাথে, ওর বোন ইসমাতারাকে নিয়ে। গঙ্গা ভাঙনে বাড়ি ঘর কেটে যাওয়ার পর এই নদীর ধারেই ঘর বেঁধেছে ওদের বাপ আলতাফ। এই নদীর ধারে মুসলমান নেই কেউ। ওরাই প্রথম। তবুও তেমন হুজ্জুতি হয়নি। আসলে তখনও হিন্দু পার্টির এত রবরবা হয়নি। কেউ বলেনি পরিবেশ খারাপ হয়ে যাবে। গুলেনের বাপ তখনও বেঁচে, ওই হাতে ধরে নিয়ে এসেছিল আলতাফচাচাকে। লেবারের কাজে গিয়ে আলাপ। পঞ্চানন্দপুরে গঙ্গার ধারে ঘর ছিল, সেবার নদী খুব পাড় কেটেছে, ওদের বাড়িঘর সব চলে গেছে। এখানকার মানুষ কেউ আপত্তি করেনি। করবে কি, নদীর পাড় কি কারও বাপের?…

ওদিকে, মিনতি সুফল বিউটিদের দল, বড়দের দলে যাদের জায়গা নেই— ওরা ইতিউতি খুঁজে পাচ্ছে চুল, জড়ির কাপড়, সিংহের কেশর, গণেশের ইঁদুর, আলতা মাখা পায়ের আঙুল। মনসুরও আছে ওদের সাথে, ওর বোন ইসমাতারাকে নিয়ে। গঙ্গা ভাঙনে বাড়ি ঘর কেটে যাওয়ার পর এই নদীর ধারেই ঘর বেঁধেছে ওদের বাপ আলতাফ। এই নদীর ধারে মুসলমান নেই কেউ। ওরাই প্রথম। তবুও তেমন হুজ্জুতি হয়নি। আসলে তখনও হিন্দু পার্টির এত রবরবা হয়নি। কেউ বলেনি পরিবেশ খারাপ হয়ে যাবে। গুলেনের বাপ তখনও বেঁচে, ওই হাতে ধরে নিয়ে এসেছিল আলতাফচাচাকে। লেবারের কাজে গিয়ে আলাপ। পঞ্চানন্দপুরে গঙ্গার ধারে ঘর ছিল, সেবার নদী খুব পাড় কেটেছে, ওদের বাড়িঘর সব চলে গেছে।

এখানকার মানুষ কেউ আপত্তি করেনি। করবে কি, নদীর পাড় কি কারও বাপের? কোনওরকমে ঠাঁই নেওয়া মানুষগুলির পেটের চিন্তার বাইরে অন্য ভাবনার ফুরসৎ কই? গুলেন তখনও ছোট। মানে ঐ বিকালবেলা টাউনের রাস্তায় ফুচকা বিক্রি শুরু করেনি। তখনই আলতাফচাচা এসেছিল। সবকিছু মনে নেই, তবে আলতাফচাচার একটা কথা মনে আছে, “নদী ছাড়া বাঁচব কি করে? পানি লিয়্যেই তো থাকি। ভাসাবে, কাটবে, ফের সোহাগও করবে।” তখন বোঝেনি, এখন বোঝে। ফি বর্ষায় যখন জল উঠে ওদের ভাসিয়ে দেয়, তখন কত গাল পারে নদীকে, কিন্তু এখন তো নদীই এনে দিচ্ছে দুর্গা, সরস্বতী, পয়সা।

আলতাফচাচার মতো ওরাও এখানে সব জুড়ে বসা মানুষ। বাপ বলত না কিছু, কিন্তু মায়ের কাছে শুনেছে গুলেন, পালাপালির বছরে ওপার থেকে আসার আগের সময়টার কথা। বাপ ওখানে জমিতে কাজ করত, টাইমে নদীতে মাছ ধরত। মাটির দাওয়ায় বসত সবাই। এসব শুনেছে গুলেন।

আর এখন শোনে অন্য কথা।  কয়েকদিন ধরেই কানে আসছে উঠে যেতে হবে। নদীর পাড় ফাঁকা করে দিতে হবে। কী সব কাগজ নাকি নেই ওদের। বাবা বলত ওদেশে একটা তুলসীতলা ছিল। মা এখনও তুলসীগাছ লাগায়। জলে ডুবে মরে যায়, আবার লাগায়। তার জন্য বেড়া দেয়। এবারেও বলেছে, ‘বাত্তা লাগবে’।  আসলে ওদের কোনও জমিই নেই, বেড়া দিয়ে সেটাই ভুলে থাকতে চায় মা।

“শুন্‌, পালের সাথে কিন্তু আগে থেকে কথা বলে লিতে হবে। আগেরবার খুব ঠকিয়েছিল।” অখিলের কথায় সায় দেয় সবাই। পাল মানে ওই যারা প্রতিমা বানায়। ওদেরই কাজে লাগে এসব। দুর্গার মুখ দিয়েই চলে কালী, তারপর জগদ্ধাত্রী, আরও কত কী! কার্তিকের মুখও কাজে লেগে যায়। আসলে সব কিছুই কাজে লেগে যায়, চুল, টিপ, অলঙ্কার— সব। তার চেয়েও বেশি, বাঁশের বাত্তা, খড়ের বাঁধন। নিত্যর গলা শোনা গেল, “তেমন হলে অন্য পালের কাছে যাব।” নদীর ধারে কাঠ বাঁশের জঙ্গলে বসে চলে ওদের শলা। কে বলবে সারারাত প্রায় জলে দাঁড়িয়ে কেটেছে সবার। ক্লান্তির ছাপ নেই। আসলে এ সময়েই তো দুটো পয়সা আসে। অবশ্য ওরা জানে, নিজেরা যাই ভাবুক না কেন, শেষ কথাটা গুলেনই বলবে। জলে সবচেয়ে বেশিক্ষণ নিজে থাকে, সবচেয়ে বেশি দুর্গা টানে, ভাগেও ওর মালই বেশি। পালের সাথে দরদাম করতে ওকেই মুখিয়া করে সবাই। একবার উঠে গিয়ে বোনকে শাসন করে আবার এসে বসেছে। চুপ করেই আছে। অখিলের দেওয়া বিড়িটা দুই টান মেরে ফেলে দিয়েছে আগেই।

সবার কথা শুনছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কার ভাগে কতটা, কতটা বাড়ির জন্য এসব নিয়ে জল্পনা চলে। অখিলের নুলো ভাইটার জন্য সত্যিকারের ময়ূরের পালক লাগবে। ও বলে রেখেছে। আর ওর সব আবদারের জন্য অখিলের শুধু নয়, গুলেন-গোপী সবারই দুর্বলতা আছে। গোপীর ঘরের জানালার জন্য কাঠ নিয়ে যাবে, আগেই বলেছে। সেগুলো আলাদা করে, বাকি সব বিক্রি। পাল নিয়ে নেবে সব। এই বাঁশ, কাঠের উপরেই আবার চাপবে খড়, মাটি। রং মেখে হবে কালী, সরস্বতী।

“গুলেনদাদা, মিনতি ফের দুর্গা লিয়্যাছে,” ইসমাতারা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে গুলেনকে রিপোর্ট দিল। ও জানে, মিনতিকে শাস্তি দেবার এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। কিন্তু মিনতিরাও বরাবর এটা আন্দাজ করে, তাই পিছন পিছন উঠে আসে। “দাদা, দ্যাখ তো এটা কি দুর্গা? এটা তো লক্ষ্মী। ওই ছুঁড়ি তখন থেকে সান্তাচ্ছে!” গুলেন গুম মেরে থাকে। কিছু বলে না। মনে হয় ঝড় উঠবে এক্ষুনি। চুপ করে থাকে মিনতি। হাতে ধরা এখনও গলে না যাওয়া মুখটা, রংটা উঠে গেছে শুধু। সাইজ দেখে বোঝা যাচ্ছে দুর্গা নয়। লক্ষ্মী-সরস্বতীই হবে। মিনতি কী করবে বুঝতে পারছে না। দাদার চুপ করে থাকাতেই আরও বেশি ভয় পেয়েছে। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বালি খুঁটছে।

অখিল এগিয়ে এল, “লক্ষ্মী লিয়্যা কী করবি তুই?” মিনতি চুপ। “কি রে বল? লক্ষ্মী লিয়্যা কী করবি?” কোনওরকমে মিনতির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, “বসাব ঘরে… মা কহ্যাছিল… লক্ষ্মী থাকলে কেহ তাড়ায় দিতে পারে না।”