Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং ঘৃণ্য রাজনীতি

জিনাত মহল

 

আমার প্রাণের শহর জিয়াগঞ্জ। চাকরি সূত্রে এক যুগ থেকে এই শহরে বসবাস করছি। গঙ্গার দুই তীরে গড়ে ওঠা দুটি প্রাচীন জনপদ জিয়াগঞ্জ ও আজিমগঞ্জ। এই দুটি যমজ শহর নিয়ে গড়ে উঠেছে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভা। সত্তর শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত হলেও এই শহরের ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার গঠন আলাদা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও শিখ জৈন খ্রিস্টান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি বসবাস করেন। এই কারণে স্থানীয় মানুষ তাদের প্রিয় শহরকে ভালোবেসে “ভারতের ক্ষুদ্র সংস্করণ” বলে থাকেন।

গত ৮ই অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন সকালে এই শহরে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পাল, তার স্ত্রী বিউটি পাল যিনি অন্তঃসত্তা ছিলেন এবং তাদের ছয় বছরের শিশুপুত্র আর্য পাল আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হলেন। বন্ধুপ্রকাশবাবুর বাড়ি থেকে আর্তচিৎকার শুনে পাড়া-প্রতিবেশীরা বেরিয়ে এসে এক অচেনা যুবককে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখলেন। বাড়ির মধ্যে তিন জায়গায় তিনটি লাশ পড়ে ছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করা হয়েছে। ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন নেই। দেখে আন্দাজ করা যায় খুব পরিচিত কেউ অতর্কিতে আক্রমণ করেছে। হত্যার বীভৎসতায় এলাকাবাসী ভীত সন্ত্রস্ত ও স্তব্ধ হয়ে পড়ল।

প্রতিবেশীরা জানালেন বন্ধুপ্রকাশবাবুর আদি বাড়ি সাগরদিঘি থানার অন্তর্ভুক্ত বাড়ালা গ্রামে। চাকরি করতেন বাড়ালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কয়েক বছর হল জিয়াগঞ্জে নতুন বাড়ি করে থাকছেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব বেশি সখ্যতা বা শত্রুতা কোনওটাই ছিল না। নিজের কাজ এবং পরিচিত গন্ডি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।

আমরা নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ শহরের ছাত্র-শিক্ষক সমাজ ও সাধারণ মানুষ মিলে একটি নির্দলীয় মিছিল করি এবং গণস্বাক্ষর সম্বলিত একটি পিটিশন প্রশাসনের হাতে তুলে দিই। প্রশাসনের তরফ থেকেও সঠিক তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হয়।

কিন্তু ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসামাত্র বিজেপি আইটি সেলও সক্রিয় হয়ে উঠল তিনটে লাশ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে। চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল সকল বিজেপি নেতা ট্যুইটে হিন্দু বীরের হত্যার প্রতিকার চাইলেন। শুধুমাত্র গেরুয়া আইটি সেল নয়, বিক্রি হয়ে যাওয়া মিডিয়াও এমনভাবে খবর প্রকাশ করতে শুরু করল যেন মনে হয়  মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে হিন্দুরা মারাত্মকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। তারা এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নানান ভিত্তিহীন যুক্তিহীন মনগড়া গল্প ছড়িয়ে দিল। যেমন—

বন্ধুপ্রকাশ পাল স্বয়ংসেবক ছিলেন। মুসলিমরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফলে ইসলামি মৌলবাদী শক্তির হাতে তিনি খুন হয়েছেন।

মুর্শিদাবাদে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জিয়াগঞ্জের মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনায় জৈন ও শিখদের সংখ্যা অনেক বেশি।

বন্ধুপ্রকাশবাবুর মা ও তার আত্মীয়রা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন তিনি কোনও রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সুতরাং স্বয়ংসেবক হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবরা বলছেন চায়ের দোকানের রাজনীতির আলোচনাতেও তিনি কখনও যোগ দিতেন না।

ওনার ফেসবুকের দেয়ালে ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায় ওনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগাযোগ ছিল না।

বন্ধুপ্রকাশের নিকট প্রতিবেশী মনোজ সরকার, বিজেপির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সদস্য। তিনিও জানিয়েছেন বন্ধুপ্রকাশের সঙ্গে বিজেপির কোনও সম্পর্ক ছিল না। বিজেপির রাজ্য স্তরের নেতা বিদ্যুৎ রায় চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন বন্ধুপ্রকাশবাবু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদস্য ছিলেন না। কিন্তু এখনও ক্রমাগত বিজেপি আইটি সেল সেই মিথ্যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় প্রোপাগান্ডাটি হল— বন্ধুপ্রকাশ মৃৎশিল্পী ছিলেন। দুর্গা প্রতিমা বানানোর শাস্তি হিসাবে তাকে খুন করা হয়েছে।

বন্ধুপ্রকাশবাবু একজন শিক্ষক ছিলেন। না পেশাগতভাবে, না শখে— প্রতিমা তো দূরের কথা মাটির পুতুলও কোনওদিন বানাননি। তাছাড়া জিয়াগঞ্জ শহরে একাধিক দুর্গাপূজা হয়। বিভিন্ন প্রতিমা শিল্পী মূর্তি গড়েন। কেউ কোনওদিন আক্রমণের সম্মুখীন হননি।

তৃতীয় গল্পটি অবৈধ মসজিদ নির্মাণের। বন্ধুপ্রকাশবাবু নাকি অবৈধ মসজিদ নির্মাণে বাধা দিয়েছিলেন তাই খুন।

ওনার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা মসজিদ আছে বটে। কিন্তু তা বহু পুরনো এবং সেখানে কোনও বৈধ বা অবৈধ নির্মাণকার্য চলছে না। ওনার মসজিদ কমিটির সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ বা হাসি-মশকরা কোনওটাই হয়নি। এলাকার মুসলিমরাও হত্যাকাণ্ডের ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আছে।

গেরুয়া আইটি সেল শুধু গালগল্প দিয়েই থেমে থাকেনি। ছাত্র-শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ডাকা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্রতিবাদ মিছিলের ভিডিও আরএসএসের মিছিল বলে প্রচার করেছে।

বিজেপির অপপ্রচারের প্রতিবাদ করতে করতে আমরা যখন ক্লান্ত তখনই আমাদের রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি এই হত্যাকাণ্ডকে ‘ছোট ঘটনা’ ও ‘বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব’ বলে আরও একবার রাজনৈতিক রং লাগালেন। তিনটে লাশ ওনার কাছে ‘ছোট ঘটনা’!

জিয়াগঞ্জবাসী মিডিয়া মিথ্যাচার ও নেতাদের লাশ নিয়ে রাজনীতি দেখে হতভম্ব বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। এমনকি স্থানীয় বিজেপি নেতারাও লজ্জিত। আমরা বিভেদের অপচেষ্টা ব্যর্থ করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। আমাদের ছাত্ররা মসজিদ পাহারা দিয়েছে যা কোনও খবরে দেখানো হয়নি। জিয়াগঞ্জের নাগরিক সমাজ আরও একবার পথে নেমেছে সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে। মিথ্যা খবর পরিবেশন করায় মিডিয়াকে বয়কট করেছে। ধর্ম ও দলের পার্থক্য ভুলে জিয়াগঞ্জবাসী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুটো লড়াই লড়ছে— মিথ্যে প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে ও আসল খুনিকে খুঁজে বের করা।

ইতিমধ্যে পুলিশি তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে সৎ ভাইদের সঙ্গে বিবাদ এবং আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিবাদ খুনের মোটিভ হতে পারে এমন আশঙ্কা করা হয়েছিল। পুলিশ উৎপল বেহেরা নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে যে বন্ধুপ্রকাশবাবু ও তার পরিবারের খুনের দায় স্বীকার করেছে। বন্ধুপ্রকাশবাবু পেশায় শিক্ষক হলেও বিভিন্ন চিটফান্ড মিউচুয়াল ফান্ড ও এসআইপির এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। উৎপল বেহেরা বাড়ালায় ওনার প্রতিবেশী ছিলেন। উৎপল, বন্ধুপ্রকাশবাবুর কাছে একটি পলিসি করেন। পলিসির টাকা দিলেও তার কোনও রশিদ তাকে দেওয়া হয়নি। রশিদ চাইলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছিলেন বন্ধুপ্রকাশ। সেই রাগ ও ক্ষোভের কারণে উৎপল বন্ধুপ্রকাশবাবু ও তার পরিবারকে হত্যা করেছে।

যদিও উৎপল বেহেরা নামটা প্রোপাগান্ডাপ্রেমীদের ঠিক পছন্দ হয়নি। এখনও বিষ উগরে দিচ্ছেন। উৎপল বেহেরা হিন্দু এবং বিজেপি কর্মী কিন্তু তার ব্যক্তিগত অপরাধের দায় হিন্দুসমাজকে ভোগ করতে হবে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে খুনির নাম ‘উৎপলে’র পরিবর্তে ‘ওসমান’ হলে?

জানি না কী হত। তবে এই মুহূর্তে জিয়াগঞ্জবাসী হিসেবে গর্বিত— মিথ্যা অপপ্রচার ও রাজনৈতিক চাপের মুখে দাঁড়িয়েও আমরা সত্যের পক্ষ নিয়েছি। দলমত ধর্ম নির্বিশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। জিয়াগঞ্জের মানুষের বার্তা দেশের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ুক; মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিথ্যার গতি রুখে দিক।