Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পাশফেল বিতর্কে দু’ পয়সা

অপর্ণা ঘোষ

 

মিড ডে মিলের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কারও আপত্তি নেই। না, কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে, কোথায় চুরিচামারি হচ্ছে, সে সব বলছি না। মূল প্রোজেক্ট এবং তার ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়েই বলছি। আপত্তি নেই? নিশ্চয়ই?

তাহলে বিশ্বাস করুন, আপনাকে সরকারি স্কুল থেকে পাশফেল তুলে দেওয়ার বিরোধী হতেই হবে। নইলে খুব বিচ্ছিরি অশান্তি তৈরি হবে। ঠিক যেন… যেন… হাতের পাথর লাগানো আংটিটা খুলতে ভুলে গিয়ে আপনি কোনও বিজ্ঞান অধিবেশনে ভাষণ দিতে উঠে পড়েছেন!

কেন বলছি? আচ্ছা, একটু ভেঙে বলি।

মিড ডে মিল প্রকল্প কেন? বাচ্চাদের স্কুলে আনার জন্য। কোন বাচ্চা? আমার-আপনার নয়। এ সব সেই হাঘরে, গরিবগুর্বো বাচ্চা, যাদের পরিবারে বাচ্চার খুব অল্প বয়সেই পড়াশোনাটা একটা বিলাসিতা বলে বোধ হতে থাকে, যাদের দিয়ে আমাদের শাইনিং দেশের স্কুল ড্রপআউটের একটা নধর পার্সেন্টেজ তৈরি হয়, এবং যাদের সংখ্যাটা আমার-আপনার থেকে অনেক বেশি, সেসব বাচ্চা। এদের স্কুলে আনার জন্য খাবারের মতো একটা মৌলিক জৈবিক বিষয়ের লোভ দেখাতে হয়। এদের, এবং এদের পরিবারকে। এরা খায়, এবং পরিবারের একটা পেটের একবেলার খাওয়ার খরচ বাঁচায়। শুনে এবং সারাংশে কল্পনা করে যতই বীভৎস লাগুক কিছু করার নেই। এটাই আমাদের দেশ, আমিও জানি, আপনিও জানেন। ফলে এই প্রকল্পের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

এবার এখানেই প্রশ্নটা। খাবার দেওয়া হচ্ছে স্কুলে, কোনও লঙ্গরখানায় নয়। অতএব উদ্দেশ্য, তাদের স্কুলে আনা এবং পড়ানো, অন্নদানের পূণ্যার্জন নয়। যদি পাশফেল তুলে দেওয়া হয়, তবে তারা স্কুলে আসবে, কিন্তু পড়বে না। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন। কারণ তাদের আরও অনেক জরুরি কাজ আছে!

কেমন জরুরি কাজ? আমি যে মফস্বলের স্কুলটাতে পড়াই, সেখানকার মেয়েগুলো বিড়ি বাঁধে। আট-নয়-দশ থেকেই। পেটের দায়। যে দায়কে স্বীকার করে মিড ডে মিল। হল না জরুরি কাজ?

এবার আশা করি শিশুশ্রম নিয়ে আবার কেউ চোখ কপালে তুলছেন না!

ফলে, টাইম ইজ টু কল আ স্পেড আ স্পেড। অসাম্য, বৈষম্য শুধু নেইই, বিশ্রীভাবে দাঁত ভেঙচে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সবার জন্য এক নিয়ম জাতীয় কথাবার্তা শুনতে ভালো, কিন্তু আসলে তাতে ওই অসাম্যের গোড়াতেই সার-জল ঢালা হয়।

সিবিএসই স্কুলগুলিতে ইলেভেন অবধি পাশফেল নেই। চেষ্টা করা হচ্ছে সমস্ত স্কুলকে সেই লাইনে নিয়ে আসতে। কিন্তু এটাকে যদি আমি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলি? যেমনভাবে চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে হিন্দী ভাষাকে? যেমনভাবে ক’দিন আগে নীট (NEET) পরীক্ষায় সিবিএসই সিলেবাসের কোশ্চেন পেপার চাপানোর চেষ্টা হল? খুব ভুল বলব কি? মনে হচ্ছে না কিন্তু!

আর এটাকেই যদি কেউ কাউন্টার লজিক হিসেবে খাড়া করতে চান? যেমন, এই যে সিবিএসই-র স্কুলগুলোতে যে পাশফেল নেই, তাতে কই, অসুবিধা হচ্ছে না তো! ওই যে বললুম, এসব শুনতে ভালো কথাবার্তা! কারা পড়ে মশাই সিবিএসই-র স্কুলগুলোতে? তাদের কাছে ফেল করাটা আদপেই কি সমস্যা? সেই বাচ্চাদের কি বিড়ি বাঁধা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম থাকে? তাদের কি দুপুরে একপেট খাবার দেওয়ার গাজর ঝুলিয়ে স্কুলে আনতে হয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলে আরও কটা প্রশ্ন করতে পারি। যেমন, পাবে আমাদের সরকারি স্কুলগুলো সিবিএসই-র অনুমোদন? মানে, অনুমোদন পাওয়ার ক্রাইটেরিয়াগুলি জানা আছে তো? বা এই যে এখন আমাদের স্কুলগুলোতে এইট অবধি পাশফেল নেই, এবং তারপরে নাইনে গিয়ে সব হুড়মুড়িয়ে ফেল করছে শুধু এই অভ্যাসটা না থাকার ফলে, তার দায়টা ঠিক কার?

শেষ প্রশ্নটার উত্তরে অবশ্য আমরা আছি। শিক্ষকরা। সফট টার্গেট। পড়ার নির্মল আনন্দ দিতে পারছি না পড়ুয়াদের। দেব। সত্যি বলছি। শুধু আপনারা ওদের দারিদ্র নির্মূল করে দিন। এই ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করুন, যাতে আমার-আপনার বাচ্চার মতো ওদেরও পড়াশুনো ছাড়া আর কোনও কাজ না থাকে। আমরা নয় শৌচাগার গণনা থেকে ভোটের কাজ সমস্ত কিছু সামলেও বাচ্চাদের পড়াব। শুধু ওদের শান্তিতে পড়তে বসাটা নিশ্চিত করুন।

কেন বলছি? একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিই। আমাদের স্কুলে গড়ে ফাইভে দুশো জন ভর্তি হয়। কয়েক বছর ধরেই কমতে কমতে এ বছর সেটা ৮৫। গত কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা পাশফেল না থাকার পরিণতি।

পাশফেল তুলে দিলে আসলে মেরুকরণ বাড়বে প্রবলভাবে। একদিকে যাদের একটু পয়সা আছে, তারাই ছুটবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলিতে। যে প্রবণতা এখনই খুব জ্বলন্ত। আর যাদের সে সামর্থ্য নেই, তারা আস্তে আস্তে আরও খসে পড়বে শিক্ষাব্যবস্থার মানচিত্র থেকে। সেটা আগেও ছিল এবং চিরকালই হয়, কিন্তু এখনকার এই অপসারণের একটা মজা আছে। মিড ডে মিল এবং পাশফেল না থাকার সুবাদে সবাই এখন এইট পাশ। এরপর নাইনটা কোনওরকমে ঠেলেঠুলে পার করিয়ে দিলে মাধ্যমিকে ঢালাও গ্রেস দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়ার নির্দেশিকা আমাদের সবার কাছেই চলে আসে। ফলে যেটা হল বা হচ্ছে, রাষ্ট্রের কাঁধ থেকে নিরক্ষরতার বোঝাটা খাতায় কলমে সরিয়ে দেওয়া গেল অনেকাংশে, এবং এদের শিক্ষার মূলস্রোতে ঢুকতে দেওয়াও হল না। চমৎকার নিঃসন্দেহে। মাধ্যমিকের পর এদের জন্য খোলা থাকবে বিড়ি বাঁধা ইত্যাদির মুক্ত ভুবন। আর আমরা, শাইনিংরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাব উচ্চশিক্ষার ঝাঁ চকচকে দুনিয়ায়।

একটা কথা না বলে লেখাটা শেষ করে দেওয়া উচিত হবে না। মানে ধরুন দু’ পয়সা দেব বলেছি তো, কিন্তু পৌনে দুই হয়ে রয়েছে দেখছি এখনও। বিষয়টা হল, এই যে শিক্ষাকে একদিকে কর্পোরেটদের মৃগয়াক্ষেত্র বানিয়ে তোলা আর অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া মানুষকে আরও প্রান্তিক করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মুখোশের আড়ালে তার কল্যাণকর দায়িত্বটা বেমালুম ভুলে যাওয়া, এ কিন্তু আজকের ঘটনা নয়। যদি তা বলি, তাহলে সত্যের অপলাপ করা হবে। বরং ঘটনাটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি, এমনভাবে দেখা ভালো। যে প্রক্রিয়ার শুরু হয়েছিল সেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে (ঠিক করে বললে ১৯৭৬-এ সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের মধ্যে দিয়ে) শিক্ষাকে রাজ্যের এক্তিয়ার থেকে তুলে কেন্দ্র-রাজ্য যুগ্ম তালিকাভুক্ত করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে, রাজ্যে সরকারি স্কুল থেকে ইংরাজি তুলে দিয়ে গণহারে ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইভেট স্কুল জন্মানোর ছাড়পত্র করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। আর যে প্রক্রিয়ার লক্ষ্মণ দেখা যায় বছর বছর শিক্ষায় সরকারগুলির বাজেট বরাদ্দ কমে যাওয়ায়, প্রায় কোনও সরকারি সিবিএসই-আইসিএসই স্কুল না থাকায়। যাক, এ আরও দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। সময়সুযোগ হলে কখনও করা যেতে পারে। আপাতত দু’ পয়সা পূরণ!