Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সান্ধ্যসংলাপ : ফিরে দেখার জ্যামিতি

প্রিয়ক মিত্র

 

রবিবার সন্ধেবেলা সাগ্নিক মুখার্জী ‘প্ররোচিত’ ‘সাত তলা বাড়ি’-র ‘সান্ধ্যসংলাপ’ প্রযোজনাটি দেখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভব এসে ধাক্কা দিল। নাটকটি নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই আলাদা করে আমার। দর্শকাসনে বসে থেকে মনের ভেতর স্মিতহাসি নিয়ে একটা নাটক দেখা শেষ করার পর কেমন একটা জ্বোরো আলস্য আসে, কিছু বলার থেকে বিরত থাকতেই ইচ্ছে হয়। সব ভালোলাগার ওপর শব্দের মালিকানা খাটে না। আমি শুধু একটা ছোট্ট ভাবনাসূত্রের কথা ভাগ করে নিই, যা একান্তভাবেই এই নাটকের প্ররোচনায় জন্ম নিয়েছে।

নাটকের শেষে ‘প্ররোচনা’ শব্দটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নাটকটির ‘প্ররোচক’ সাগ্নিক মুখার্জী বললেন, এই নাটকটি অভিনয়ের জন্য শুধুই খানিক উস্কানি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এই উস্কানিটুকু সাগ্নিক স্বয়ং নিজেকেও দিয়েছেন, কারণ তিনি নিজে এই নাটকের একজন অভিনেতা। নাটকটিতে চারটি চরিত্র, চারজন অভিনেতা সেই চারটি চরিত্রকে প্রাণ দিয়েছেন। সাগ্নিক বাদ দিয়ে বাকিরা হলেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়, ঋদ্ধিবেশ ভট্টাচার্য, সর্বজিৎ ঘোষ। চারজনেই নাট্যশরীরে এতটাই মিশে ছিলেন, যে কোথাও কোনও অভিনয়ের চেষ্টা আলাদা করে চোখে পড়েনি। তবে মূল বক্তব্যের জায়গাটা অন্যত্র।

নাটকটির মঞ্চভাবনাতেই কোথাও নাটকটির সব না বলা বাণী লুকিয়ে। ষাটের দশকের মধ্যবিত্ত ঘরদুয়ার, মেসবাড়ির ঘরের কাঠামো, টাঙিয়ে রাখা অবিন্যস্ত জামাকাপড় এক অদ্ভুত ঝিমধরানো জীবনদর্শনের সাক্ষ‍্য বহন করত। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে যখন উনিশ শতকের বাবুবিলাসের রং হারিয়ে কলকারখানার ধুলো, আর্থসামাজিক অস্তিত্বের সংকট, মধ্যবিত্তের অলীক একান্ত স্বপ্ন বুকে নিয়ে ম্লান ছাপোষা বেঁচে থাকার লড়াই এসে জমা হচ্ছে, তখন বাংলা ছায়াছবি, বাংলা গান, আকাশবাণী এগুলো ছায়ার মতোই সঙ্গী হয়ে উঠেছিল নাগরিক যাপনের। এই সবকিছুই পরের প্রজন্মগুলোর কাছেও দৃশ্যমান বা শ্রাব্য থেকেছে, হারিয়ে গেছে শুধু যাপনটা। দেশভাগ পেরিয়ে আসা বাঙালি, কলোনিজীবনের বাঙালি, পণ্যসভ্যতার বাইরে বাঁচা কেরানি বাঙালিকে খুঁজতে হলে আমাদের ভরসা করার সবথেকে শক্তিশালী মাধ্যম বোধহয় সিনেমা, এবং সঙ্গীত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সুবোধ ঘোষের লেখায়, বা সমরেশ বসুর ‘বি.টি রোডের ধারে’-তে যে নাগরিক জীবনের প্রতিচ্ছবি পাই, তাকে কোথাও গিয়ে বারবার পূর্ণতা দিয়েছে ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’-এর ভাষ্য, অথবা ‘সুবর্ণরেখা’-য় সীতা, ঈশ্বর, হরপ্রসাদের কাছে ধরা দেয় কলকাতার যে নিষ্ঠুর কবিতা, অথবা ‘মহানগর’-এ আরতি-সুব্রতর টিকে থাকার লড়াইয়ের কলকাতার ছবি, বা ‘হারমোনিয়াম’-এর রঙবেরঙের কলকাতা। এসব ছবির পাশাপাশি রয়েছে সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষের সুর, গৌরীপ্রসন্ন, পুলক বা সলিল চৌধুরীর লিরিক। সেই কলকাতার যাপন, তার চলচ্চিত্রায়িত কাব্যময়তার বিনয়ী এবং শ্রদ্ধাবনত উদযাপন এই নাটকের প্রাণ। মঞ্চ, আলো কোথাও সেই ফেলে আসা দশকের কথা বলে যেন। আর তার সঙ্গেই চলে স্বর্ণযুগের বাংলা সিনেমার স্মৃতিকে কিছুক্ষণের জন্য দর্শকদের অভিজ্ঞতায় জ্যান্ত করে তোলার প্রয়াস।

শুধুই দেশভাগ দিয়ে ঋত্বিককে চিহ্নিত করা কাম্য নয়, তা ক্লিশে এবং শিল্পভাবনার পক্ষে ক্ষতিকর, তবু বলি, দেশভাগক্লিষ্ট যে বাঙালির কথা ঋত্বিক সারাজীবন তাঁর প্রতিটা ফ্রেমে ধরতে চেয়েছেন, সেই বাঙালির যন্ত্রণাবোধে প্রলেপ দিয়েছে সে যুগের সিনেমাই। উত্তমকুমার কীভাবে সেই সময়ের বাঙালির মননে গেঁথে গেছেন, সেই সংকটের সময় তার সব কমনীয়তা নিয়ে উত্তমকুমার কীভাবে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন তা ‘এফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গবেষণামূলক নিবন্ধে পড়েছিলাম। পরবর্তীর বলিউডে নায়কের নির্মাণ কীভাবে ঘটল তা নিয়ে আশিষ নন্দীরা চর্চা করেছেন। চলচ্চিত্রে নায়ক তৈরি হয় সময়ের ভিত্তিতে। সময়ের ইঁট কাঠ কংক্রিট তাকে তৈরি করে। এই নাটকে উত্তমকুমার অভিনীত যে কটি সিনেমার দৃশ্য অভিনীত হয়েছে, তার মধ্যে ‘নায়ক’-এর একটি দৃশ্য রয়েছে। যেখানে উত্তমকুমারের স্টারডম এক্সপ্লয়েট করা হয়েছে পুরোদমে। নায়ক সন্দর্ভটির রক্তমাংস কঙ্কাল পরিষ্কার হয়ে ওঠে এই সিনেমার চিত্রনাট্যে। প্রসঙ্গত, এই দৃশ্যে মুকুন্দ লাহিড়ীর ভূমিকায় শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি মনে থাকবে। এই দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গেই অভিনীত হয়েছে পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’-এর দৃশ্য। যে সিনেমায় সত্তর দশকের যৌবনের ‍রাগ জেদ ব্যর্থতাবোধ ধরা পড়েছিল অসামান্য ভঙ্গিমায়। রাজনৈতিক রাগের বাইরেও সে দশকের যৌবনের দিশাহীন যে রাগ ছিল তার ছবি আমরা পাব তপন সিনহার ‘আপনজন’-এ, বা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-তে। এই সিনেমায় ধৃতিমান চ্যাটার্জী প্রমুখ অভিনেতাদের মাঝে গনাদার মতন একটি নিখাদ ভালোমানুষ অসহায় চরিত্রে ছিলেন উত্তমকুমার। ‘নায়ক’-এর জৌলুস সেখানে নেই, ওই দশকে এমন অকৃতদার পরোপকারী জীবনে অসফল দাদারা পাড়ায় পাড়ায় থাকত, যারা মুখ বুজে গঞ্জনা সহ্য করত, ভালোবাসা পেত না তেমন। পাশাপাশি ‘নায়ক’ এবং ‘যদুবংশ’-এর এই দুটো দৃশ্য অভিনয়ে উত্তমকুমারের অভিনয়ের যে তারতম্যের বিজ্ঞান, তার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে ওঠে ওইসময়ের নায়ক ওইসময়ের প্রতিনিধি হয়ে ওঠা চরিত্রগুলির মধ্যে কীভাবে প্রবেশ করতেন‌ তার রূপরেখা। ‘মহাপুরুষ’-এর যে উচ্চমার্গের রসিকতা তাও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এই নাটকে ‘মহাপুরুষ’-এর দৃশ্যে রবি ঘোষ অভিনীত চরিত্রের অভিনয়ে ঋদ্ধিবেশ ভট্টাচার্যের সাবলীল অভিনয় হাসি ফোটায় দর্শকদের। এক ধাক্কায় মনে করিয়ে দেয় সেই অন্য গ্যালাক্সির বার্তা বয়ে আনা অভিনয়ের কথা। বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং আন্ডাররেটেড অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যেটুকু ঋণশোধ করা যায় তাও করা হয়েছে এই নাটকে। ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘শশীবাবুর সংসার’, ‘ওরা থাকে ওধারে’-র সারল্যও ভ্যানিশ করে গেছে মুকুলের দুষ্টু লোকের মতন।

এই নাটকটিতে দৃশ্যগুলির পুনর্নির্মাণ হয়নি, দৃশ্যগুলিকে ভালবাসাভরে উল্লেখ করা হয়েছে শুধু। সেটার মধ্যে দিয়ে যেন আসলে ফিরে দেখা, ছুঁয়ে যাওয়া ফেলে আসা দশকগুলোকে। সিনেমার উৎকর্ষের কথা থাক, সেইসময়ের সিনেমা দিনের শেষে সেইসময়ের মানুষের কথা বলত, যা এখনকার সিনেমা পারতপক্ষে বলে না। সেই সময়কে ফিরে স্পর্শ করার মাধ্যম হয়ে ওঠে এসব দৃশ্য সংলাপ। ‘সান্ধ্যসংলাপ’, কারণ সন্ধের মতোই বিষাদবিধুর সেই সময়ের স্মৃতি, পুরনো কলকাতার ভূগোলে জেগে থাকা বাড়ির ছাদগুলোর ব্যথাচুপ ঘন হয়ে থাকা, সেখানে আচমকা জ্বলে ওঠা কোনও ষাট পাওয়ারের বাল্ব, ক্লান্ত কাজফেরত মানুষের ঘরে ফেরা, শাঁখের আওয়াজ, সন্ধের স্নান এসব যেন দূরের ট্রানজিস্টারে ভেসে ওঠা ছায়ানট রাগের মতন। একজন প্রিয়জন বলেছিল, স্বর্ণযুগের বাংলা গান বা সিনেমা সময় বিশেষে অসহ্য, কারণ মানুষগুলো নেই, শুধু দৃশ্যগুলো বেঁচে আছে। তার বা তার মতন আরও অনেকের এই বেদনাকে এড়িয়ে যাবে কে? কোন জাদুকরই বা ঝিলমিলে মুছে দেবে এই ব্যথাদাগ?