মণীশ মিত্র
নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা। কসবা অর্ঘ্য নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার
বন্ধু অভীক ভট্টাচার্যের অনুরোধে ‘গত পঞ্চাশ বছরে বাংলা নাটকের ক্রমজায়মান উত্তরাধিকার’ বিষয়ে কিছু লিখতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেছি। এত দীর্ঘ সময়ের স্মৃতিচারণ বা এত দীর্ঘ একটা সময় ধরে নাট্যচর্চার মূল ধারার প্রবহমানতায় যেভাবে স্রোতগুলো পালটে যেতে দেখেছি, যেভাবে অহঙ্কার বোধ করেছি এই চর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকার গরিমায়… আবার হতাশ হয়েছি নানা সময়ে নানা বিষয়ে… তা গুছিয়ে লেখা সত্যি আমার মতো সাঁতার না-জানা মানুষের ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পেরোনোর মতোই দুরূহ। আবার অনেক কথা বিস্তারে বলতেও ইচ্ছা করছে। অভীক এই লেখার জন্য অনুরোধ না-করলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না, এত কথা জমে আছে যা ছাপার অক্ষরে রেখে যেতে মন চায়। বেশ খানিকটা এগিয়ে আবার থমকে যেতে হল, কারণ কাজটা বেশ সময়সাপেক্ষ। শেষপর্যন্ত স্থির হল, গোটা বিষয়টি নিয়ে সবিস্তার লেখার আগে, তার একটা ভূমিকা করা যাক। আমার প্রতি অসীম স্নেহ থেকে অভীক সেই ভূমিকাটুকুই ছাপতে রাজি হলেন। অতএব এই লেখা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধের পূর্বাভাস হিসেবে গণ্য করলে বাধিত হব।
কিন্তু, শুরুটা কীভাবে করি!
বাংলা নাটক! সেটা কী? বাংলায় চর্চিত নাটক? বাংলা ভাষায় অভিনীত নাটক? নাকি, সেই নাট্যচর্চা যার প্রবহমানতায় লগ্ন হয়ে আছে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো বাংলার জীবন, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সঙ্গীত? এ কি সেই নাটক, যার গঠনের মূলে বাংলার লোকনাট্য? যার নান্দনিক বৈশিষ্ট্য বাংলার লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান থেকে আহরিত? কোনটা ঠিক বাংলা নাটক? কম্পিউটারে যেভাবে প্রোগ্রামিং করা হয় সেভাবে যদি কোনও বাংলা নাটকের পাত্রপাত্রীরা কেবল মরাঠি ভাষায় কথা বলেন, তা হলে কি সেটা মরাঠি নাটক হবে? রবি ঠাকুরের নিজের মাটিতে কি স্বতন্ত্র কোনও নাট্যচর্চার উদ্ভব হওয়ার কথা ছিল? যদি তা-ই হয়, তবে তা হল না কেন? পোস্ট কলোনিয়াল হ্যাংওভার থেকে সঠিকভাবে মুক্ত হতে পারল কি বাংলায় চর্চিত নাটক? বাংলা নাটকের প্রসঙ্গ এলে এমনই নানাবিধ প্রশ্ন মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। এই গদ্যের স্বাভাবিক ছন্দে যদি সে প্রসঙ্গ আসে, তবে এ বিষয়ে আমার মনোভাব আরও স্পষ্ট করে বলব। কিন্তু বন্ধু অভীকের আদেশে যখন এই প্রবন্ধ লিখতে সম্মত হয়েছি তখন ‘বাংলা নাটক’ শব্দবন্ধের যে সাধারণ তাৎপর্য তা ধরে নিয়েই আপাতত এগোতে হবে।
বাংলায় যে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল তা অবশ্যই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে কলকাতার অর্থবান বাবুদের বাড়ির চাতালে একধরনের শখের থিয়েটার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পরবর্তীকালে গিরিশ ঘোষ মহাশয়দের উদ্যোগে এই শহরে সাধারণ রঙ্গালয় তৈরি হয়, এবং তারও পরে আইপিটিএ-এর হাতে তৈরি হয় বাংলার গ্রুপ থিয়েটার। বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘নবান্ন’ নাটককে একটা যুগ বদলের চিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তৈরি হয় বহুরূপী নাট্য দল। সাধারণ রঙ্গালয়ের কাজও সমান্তরালে চলতে থাকে। এসব আমাদের শোনা কথা বা বই পড়ে জানা। নাটকের তো এটাই বৈশিষ্ট্য যে, সে কেবল বর্তমানে জীবিত। তার কোনও অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের প্রজন্ম হাজার চেষ্টা করলেও নবান্ন নাটকের সেই বিশেষ অভিনয় আর দেখতে পাবে না। লোকমুখে শুনে একটা আবছা ধারণা করতে পারবে মাত্র। আর যদি নাটকটার একটি ভিডিও রেকর্ডিং করা থাকে, তা হলেও এক ধরনের ধারণা হবে। কিন্তু নাটক দেখার প্রত্যক্ষ অভিঘাত কখনওই ঘটবে না, কারণ নাটকটি রেকর্ড করা মাত্র সেটা একটি ফিল্মে পরিণত হবে, অথচ প্রকৃতপক্ষে নাটক জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে জ্যান্ত মানুষের জৈবিক স্পন্দন, শরীর ব্যেপে আত্মা ব্যেপে অনুরণিত হওয়ার মতন একটি শিল্প।
তবুও যা জেনেছি বই পড়ে বা অগ্রজদের মুখে শুনে, আর আমার ব্যক্তিগত নাটক দেখার চর্চা— যে চর্চা আকাদেমি এবং শ্যামবাজার পাড়ার বাণিজ্যিক থিয়েটার উভয় জায়গা থেকেই শুরু হয়েছিল। তখন শহরে নাট্যচর্চার দুটি প্রধান স্রোত। একটি আকাদেমি-কেন্দ্রিক নাট্যচর্চা যেখানে গ্রুপ থিয়েটারের নাটক হয়, বিভিন্ন দল যেন একটা প্রগতিশীল চিন্তা থেকে একটা প্রতিবাদের ভাষা অনুসন্ধানে খুব একটা বাণিজ্যিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য না-দিয়ে থিয়েটার করেন; আর শ্যামবাজার পাড়ায় স্টার, রঙ্গনা, বিশ্বরূপা, সারকারিনা বা মানিকতলায় কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে একেবারে বাণিজ্যিকভাবে একটি নাটকের চর্চা চলে। সেই বাণিজ্যিক থিয়েটার বা বোর্ডের থিয়েটার বলা হত যাকে, সেখানে একধরনের গ্ল্যামার চর্চার চল ছিল। নামীদামি সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়োগ করা হত অভিনয়ে। তাঁদের গ্ল্যামারকে পুঁজি করা হত, যদিও সেখানে সব কালজয়ী প্রযোজনা হয়েছে। মানুষ টিকিট কেটে ভিড় করে নাটক দেখেছেন।
কিন্তু সেই সময়টাতে গ্রুপ থিয়েটার নামক যে চর্চা সেখানে কিন্তু এত বাণিজ্যিক মিশন থাকত না বলেই আমার বোধ হয়। বা থাকলেও আমি তা বুঝতে পারিনি, ছোট ছিলাম বলে। সাংঘাতিক সব ভাল কাজ হচ্ছে মঞ্চে, কিন্তু কখনওই যে হল সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে তা নয়। আর ঘটা করে বিজ্ঞাপনে হাউসফুল লেখা বা প্রধান অভিনেতার নাম উল্লেখ করে টিকিট বিক্রির চেষ্টা করার কুৎসিত প্রবণতা একেবারেই ছিল না। সেদিন এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রবীরদা, অর্থাৎ প্রবীর গুহ মজা করে বলছিলেন, মধ্যমগ্রামে যে নাট্য উৎসব হয় সেখানে নাকি দর্শক টিকিট কাটতে এসে বলেন চারটে সৌমিত্র দিন বা দুটো দেবশঙ্কর।
আমি এই লেখাটিতে যে নাট্য প্রযোজনার নাম উল্লেখ করব তা কখনওই সেই সময় অভিনীত নাটকগুলোর পূর্ণ তালিকা হতে পারে না, কারণ স্মৃতির দোষে কোনও উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার কথা বলতে ভুলেও যেতে পারি। কেবল স্রোতটাকে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করব। রঙ্গনায় নাটক করতেন গণেশ মুখোপাধ্যায় মহাশয়, বিশ্বরূপায় ‘ভালো খারাপ মেয়ে’ অভিনীত হচ্ছে। অভিনয় করছেন অপর্ণা সেন এবং পরিচালনা করছেন রমাপ্রসাদ বণিক। আবার কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে ‘পান্নাবাই’ বা ‘ইন্দ্রাণী’-র মতো নাটক। প্রতি বৃহস্পতি শনি ও রবিবার নিয়ম করে এই নাটকগুলি অভিনীত হত। বিশ্বরূপায় ‘নীলকণ্ঠ’ বা ‘দর্পণে শরৎশশী’-র মতো নাটক নিয়মিত হাউসফুল হচ্ছে। অভিনয় করছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আর গ্রুপ থিয়েটার চর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল আকাদেমি। আমাদের তখন আকাদেমিতে যাতায়াত শুরু হচ্ছে নাটক দেখতে। তখনও লেডি রানু মুখার্জী জীবিত। একজন নার্সের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই হলে আসতেন তিনি। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র তখন বহুরূপী-র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। তবুও বহুরূপী তখনও ধারাবাহিকভাবে সম্পূর্ণ শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে নাটকের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কুমার রায় নাট্য পরিচালনার কাজ করছেন। বহুরূপী-র যে নাটকটি প্রথম দেখেছিলাম, তা হল ‘মিস্টার কাকাতুয়া’। এবং তারপর ‘পিরিতি পরমনিধি’, ‘কিনুকাহারের থেটার’, ‘গ্যালিলিও’, ‘নিন্দাপঙ্কে’ এবং আরও অনেক। শাঁওলি মিত্র তখন পঞ্চম বৈদিক দল তৈরি করে নিয়মিত ‘নাথবতী অনাথবৎ’ অভিনয় করছেন। সে নাটক আমি পাঁচবার দেখেছি। সে ছিল আমার প্রথম মহাভারতের পাঠ। জুরির দলকে সঙ্গে নিয়ে কথকতার স্টাইলে দ্রৌপদীর দৃষ্টিকোণ থেকে মহাভারতের গল্পটি বলতেন শাঁওলীদি। সে এক অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা। একদিন শিশির মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত কবিপক্ষের অনুষ্ঠানে ওঁকে ‘রক্তকরবী’-র পাঠ-অভিনয় করতে শুনলাম। এত গভীর ছিল সেই পাঠ-অভিনয় শোনার অভিজ্ঞতা যে, তৎক্ষণাৎ বইটি কিনে কেবল পড়ে ফেলা নয়— তার একটি প্রযোজনাও করে ফেললাম আমরা। ওই বয়সে তো নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে একটা দুর্বার প্রত্যয় থাকে। অনেক পরে সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায় রচিত এবং অভিনীত ‘বিতত বিতংস’ নামে একটি নাটক শাঁওলীদি পরিচালনা করেন এবং অভিনয়ও করেন নিজে। আমি নিজে কতবার যে নাটকটা দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। প্রথমবার নাটক দেখার পর যে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম সেটুকু বলতেই হবে। আকাদেমিতে দেখেছিলাম ‘বিতত বিতংস’। আর তারপর আমার পিয়ারলেস ইন হোটেলে কিছু অতিথির সঙ্গে নৈশভোজের কথা ছিল। নাটক দেখে আমি কীভাবে হোটেলে পৌঁছেছিলাম মনে নেই, এবং দীর্ঘক্ষণ লাউঞ্জে অপেক্ষা করার সময়ও কার্যত সম্বিৎ ছিল না। দেরি হচ্ছে দেখে অতিথিরা ঘর থেকে নেমে এসে আমায় লাউঞ্জে আবিষ্কার করেন। আজও আমি স্মরণ করতে পারি না কীভাবে আমি হোটেলে গিয়েছিলাম, আর সেখানে বসে থেকে আমি কী ভাবছিলাম। এতই গভীর ছিল ওই নাটকের আবেশ। এখনও কানে বাজে, শেষ দৃশ্যে দিদি মঞ্চের একদম সামনে এসে বলছেন…
“পালাও, তিস্তা পালাও। যতক্ষণ না দিকচক্রবাল রেখা পিঠে দেওয়াল হয়ে ঠেকছে ততক্ষণ পালাও, নিরাপত্তা খোঁজো, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। একজন মানুষ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সত্য জেনে ফেলেছেন এবং তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে চাইছেন কিন্তু সমাজের সর্বস্তর থেকে ক্ষমতাসীন মানুষেরা তাকে আক্রমণ করছে আর তার মধ্যে দাড়িয়ে তিনি মেরুদণ্ড খাড়া করে বলছেন মানুষকে যে মনে রাখতেই হয় অনেক বছরের বিবর্তনের ফলে সে তার পিঠের সোজা শিরদাঁড়াটা পেয়েছে। কারণ সে মানুষ।”
নিজের অস্তিত্ব নিজের কর্মকাণ্ড, নিজের ‘মানুষ’ হয়ে বেঁচে থাকার লড়াই ভাবনার এমন গভীরে সব কিছু ওলট-পালট করে দিত যে, প্রায় বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম।
নান্দীকার তখন নিয়মিত অভিনয় করছে আকাদেমিতে। সচেতনভাবে আমার প্রথম দিকে নাটক দেখার অভিজ্ঞতায় নান্দীকারের ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ ছিল একটা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সেই প্রথম মঞ্চে দেখলাম রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, গৌতম হালদার এবং দেবশঙ্কর হালদারকে একসঙ্গে দাপিয়ে অভিনয় করতে। তারপর ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’, ‘এক থেকে বারো’, ‘ফুটবল’, ‘শানু রায়চৌধুরী’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সব প্রযোজনা দেখার সুযোগ ঘটল আমাদের। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন প্রয়াত। কেয়া চক্রবর্তী অবশ্য তার আগে মারা গেছেন। আমরা যে নান্দীকারকে দেখেছি তা হল রুদ্রদা-স্বাতীদি-গৌতম হালদার-দেবশঙ্কর হালদারের নান্দীকার।
ওদিকে অশোক মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে থিয়েটার ওয়ার্কশপ কাজ করছে, কিন্তু বিভাস চক্রবর্তী থিয়েটার ওয়ার্কশপে আর নেই। থিয়েটার ওয়ার্কশপের ‘বেলা অবেলার গল্প’, ‘বেড়া’-র মতো নাটক আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। অভিনেত্রী মায়া ঘোষকে থিয়েটার ওয়ার্কশপের প্রযোজনায় মঞ্চে প্রথম দেখলাম। কী সাংঘাতিক সে অভিনয়।
তার পর বিভাস চক্রবর্তীর সেই বিখ্যাত নাটক ‘মাধব মালঞ্চি কইন্যা’ দেখলাম। পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়মনসিংহ গীতিকার আধারে নির্মিত এই নাটক আমাকে সেভাবে প্রভাবিত করেনি। দুটি কারণ থাকতে পারে। এক, ‘মাধব মালঞ্চি কইন্যা’ দেখার আগেই আমি বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালিত গিরিশ ঘোষ রচিত পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি প্রযোজিত ‘বলিদান’ নাটকটা দেখে ফেলেছি। আর দ্বিতীয় কারণ হয়তো, পুরো নাটকের গঠন-বিন্যাস-সুর-স্বরে কোথাও যেন লোকসংস্কৃতির নিজস্ব মেঠো স্পন্দনটা খুঁজে পাইনি। পরিচালক হয়তো সেটা করতেও চাননি, কিন্তু মোটের উপরে নাটকটা আমায় সেভাবে টানেনি।
কিন্তু ‘বলিদান’ দেখে চমকে গিয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির প্রযোজনা পরিচালনা করছেন বিভাস চক্রবর্তী, আর অভিনয় করছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নাটকের দলের প্রথিতযশা সব শিল্পীরা। সে এক কাণ্ড ঘটত বটে। রবীন্দ্রসদনের শেষ দেওয়াল অবধি অভিনয় হত। আমি শিখেছিলাম, মঞ্চে এতজন ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতিতে অভ্যস্ত অভিনেতাকে এক সুরে গেঁথে ফেলা সম্ভব। কেতকী দত্ত অভিনয় করতেন, অভিনয় করতেন চিত্রা সেন। এক-একটি নাম উচ্চারণ করছি, আর কত কত স্মৃতি ভেসে আসছে মাথায়।
আকাদেমিতে তখন সুন্দরম মনোজ মিত্রের পরিচালনায় নিয়মিত নাটক করছে। দেখলাম ‘সাজানো বাগান’, যা পরে তপন সিংহ মহাশয় ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ নামে ছায়াছবিতে নিয়ে এলেন। মনোজদার ওই রিয়ালিস্টিক ন্যাচারালিস্টিক অভিনয় দেখে এক স্বতন্ত্র অভিনয়ের শিক্ষা তৈরি হয়েছিল। সুন্দরমের-এর পরের যে নাটকটি আমাকে সাংঘাতিক প্রভাবিত করেছিল তা হল ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’। চিত্রাদির, অর্থাৎ চিত্রা সেনের অভিনয় দেখে আমি ওঁর ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম।
ক্রমে জানতে পারলাম আমাদের শহরে হিন্দি ভাষায় খুব শক্তিশালী থিয়েটারের চর্চা চলছে। উষাদি, উষা গাঙ্গুলি তখন কলামন্দির বেসমেন্টে ‘হোলি’ নাটকটা করতেন নিয়মিত। ‘হোলি’ দেখার পর আমার নাটক সম্পর্কে সমস্ত ধ্যান-ধারণা আমূল বদলে গেল। সম্পূর্ণ নিরাভরণ মঞ্চে কেবলমাত্র একদল তরুণ অভিনেতার পারফরম্যান্স ও এনার্জি সেলিব্রেশনে একটা এত শক্তিশালী নাটক করে যে ফেলা যায়, সে সম্পর্কে আমার চোখ খুলল। আমি বুঝলাম, এই দলটির অভিনেতাদের একটি স্বতন্ত্র প্রস্তুতি আছে। শরীরমন দিয়ে সম্ভবত এঁরা খুব গভীরতর স্তর অবধি একটা চর্চা নিয়মিত করেন। আবিষ্ট হলাম, আকৃষ্ট হলাম।
অভীক উত্তরাধিকারের কথা বলতে বলেছেন, তাই আমি যদি আমার ব্যক্তিগত উত্তরাধিকারের গল্প বলতে চাই, অবশ্যই ঊষাদি এবং রঙ্গকর্মী-র কাজ আমার নিজস্ব নাট্যভাষা নির্মাণের অনুসন্ধানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আমার জীবনের প্রথম দিকের কাজ, ‘সঙ্কট’ নাটকের একটা সরলরৈখিক প্রভাব অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। ঊষাদির যে নাটকগুলো এরপর দেখেছিলাম তা হল ‘লোককথা’, ‘মহাভোজ’, ‘কোর্ট মার্শাল’, ‘অন্তর যাত্রা’ এবং অবশ্যই ‘রুদালি’। ‘রুদালি’ নাটকের গঠন ও অভিনয়প্রণালী, আমার মনে হয়েছিল, তৎকালীন যে নাটক চলছে আমার শহরে তার থেকে অন্তত পঞ্চাশ বছর এগিয়ে। ঊষাদি ‘মুক্তি’ নামে একটা নাটক করেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবীর গল্প, আর অভিনয় করেছিলেন কেতকী দত্ত। কেতকী দত্তর সেই শেষ বয়সের অভিনয় দেখে অনেকে মঞ্চে উঠে তাঁকে প্রণাম করতেন।
এই নাটকের গঠন রঙ্গকর্মীর অন্যান্য প্রযোজনার থেকে পৃথক ছিল। ঊষাদি একবার বলেছিলেন যে মঞ্চে যখন কেতকী দত্তর মতন অভিনেত্রী, তখন আর যা-ই করব তা বাহুল্য হয়ে উঠবে। সদত হসন মান্টোর গল্প নিয়ে অনেক নাটক করেছিলেন তিনি। মাঠে-ঘাটে করার জন্য একটি নাটক নির্মাণ করেছিলেন— ‘মাইয়ত’। আমি অনেকবার এই নাটকটি দেখেছি নানাস্থানে। এই যে সম্মিলিত গ্রুপওয়ার্ক, এই যে প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যে পারফরম্যান্স বডিগুলো তৈরি হয়েছে অভিনেতাদের তার বহমানতায় এক আশ্চর্য হোমোজিনিটি আমায় নাড়িয়ে দিয়ে যেত। বার্টল্ট ব্রেখ্ট-এর নাটক ‘মাদার কারেজ’-এর হিন্দি রূপায়ণ ‘হিম্মৎ মাই’ প্রযোজনা করেছিলেন ঊষাদি। সেও ভারতীয় নাটকের ইতিহাসে এক উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা।
একদিন রিহার্সাল থেকে পালিয়ে আকাদেমিতে ‘দায়বদ্ধ’ দেখতে গেলাম। সায়কের নাটক, মেঘনাদ ভট্টাচার্য পরিচালনা করেছেন। এর আগে কোন নাটকে এত রিয়েলিস্টিক ডিটেইলিং আমি দেখিনি। তবে নাটকটা যে আমায় মুগ্ধ করেছিল তার কারণ নাটকের বিষয় আর আবেগঘন অভিনয়। আমি সায়ক-এর বেশ কয়েকটা নাটক দেখেছি। ‘জ্ঞানবৃক্ষের ফল’, ‘বেওকুফ’, ‘যদিও স্বপ্ন’, ‘দিলদার’ ইত্যাদি। মেঘনাদদার থেকে অনেক কিছু শিখেছি আমি। সে সব কথা বিস্তারে বলতে হবে কখনও।
আমাদের সীমাদি, সীমা মুখোপাধ্যায় ওঁর দল রংরূপকে নিয়ে তখন গুরুত্বপূর্ণ সব প্রযোজনা উপহার দিচ্ছেন বাংলা থিয়েটারকে। ‘ভাঙ্গা বনেদ’, ‘আবর্ত’ আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
পাঠক নিশ্চয়ই ভাবতে শুরু করেছেন যে, একটা যুগ পেরিয়ে গেলাম অর্থাৎ অশোক মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তীদের সময় পেরিয়ে মেঘনাথ ভট্টাচার্য, সীমা মুখোপাধ্যায়ের থিয়েটারের কথা বলতে শুরু করেছি, কই অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নাটকের কথা তো বললাম না? চেতনা-র উল্লেখ কোথায়? ‘মারীচ সংবাদ’ বা ‘জগন্নাথ’! আসলে এই প্রবন্ধের ভাবনাই তো উদগত হয়েছে ‘মারীচ সংবাদ’-এর ৪৯ বছর ও চেতনা নাট্যগোষ্ঠীর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। তাই সে কথা তো আলাদা করে বলতেই হবে। কিন্তু, সে কথা বলব প্রসঙ্গান্তরে। পরে কখনও। শুধু ‘মারীচ সংবাদ’-ই নয়, আসবে আরও অনেক প্রসঙ্গ।
পরিশেষে আবারও বলি, বাংলা নাটকের ক্রমজায়মান উত্তরাধিকার, যার একটি সামান্য অংশ আমি এবং আমার দলও, এক সুবিস্তৃত অভিযাত্রা। এ লেখা কেবল তার মুখপাত মাত্র— কিংবা, বলা যেতে পারে এক মস্ত বড় আলোচনার বীজ। আশা করি, সে আলোচনা নিয়ে আবারও চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের সঙ্গে আমার দেখা হবে।