বাংলা নাটক: এক ক্রমজায়মান উত্তরাধিকার (WIP) — ষষ্ঠ বর্ষ, চতুর্থ যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

তা হলে, কোনও গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই শুরু করা যাক? চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সেপ্টেম্বর সংখ্যার বিষয়, বাংলা নাটক। বিষয়টি সুবিস্তৃত, কারণ বাংলা নাটক বলতে ঠিক কী বুঝব, তা নিয়েই নানা সমস্যা। বাংলা নাটক মানে কি বাংলা ভাষায় লেখা নাটক? বাংলা ভাষায় অভিনীত নাটক? বাংলার দর্শকদের সামনে অভিনীত নাটক? মঞ্চের নাটক? মঞ্চের বাইরের নাটক? বাংলার লোকউৎসব-সঙ্গীত-নৃত্য-পার্বণ-ব্রতকথা-কথকতার অনন্ত উৎস থেকে উঠে আসা নাটক? কলকাতা শহরের পেশাদার দলের নাটক? গ্রুপ থিয়েটারের নাটক? নাকি, এর সবগুলিই? বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নগুলির, বা এদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরও অসংখ্য উপপ্রশ্নের অধিকাংশের উত্তর আমাদের জানা নেই, কোনও কোনও প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ মীমাংসাও সম্ভবত এখনও হয়নি। অতএব, করজোড়ে জানাই, আমরা সেইসব জটিলতার মধ্যে যাচ্ছি না। বাংলা নাটক বলতে শতকরা সাড়ে নিরানব্বইজন বাঙালি যা বোঝেন, আমরা ঠিক সেই অর্থেই বিষয়টিকে গ্রহণ করতে ও বুঝতে চেয়েছি।

কিন্তু, তার পরেও কথা বাকি থাকে। বাংলা নাটক বলতে কি এখানে আমরা নাটকের লিখিত রূপ নিয়ে কথা বলব, নাকি তার মঞ্চাভিনীত রূপটিকে নিয়ে? তাত্ত্বিকদের একটা বড় অংশ মনে করেন, যে কোনও নাটকই আসলে একটি পারফরম্যান্স— একটি বা অনেকগুলি শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়ার একটি পারম্পর্যময় ও অর্থপূর্ণ সমষ্টি— যার সাফল্য বা ব্যর্থতা শেষপর্যন্ত তার মঞ্চায়িত রূপটিরই ওপর নির্ভর করে। এই যুক্তিক্রম অনুসরণ করলে, রচনা হিসেবে নাটকের কোনও পৃথক মূল্য না-থাকারই কথা— যতক্ষণ তা অভিনীত না-হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই অভিনয় দর্শকের সঙ্গে সরাসরি কমিউনিকেট করতে না-পারছে, ততক্ষণ তা নিছক একটি লিপিবদ্ধ রচনা, বড়জোর নাট্যাভিনয়ের একটি লিখিত সূত্র— কিন্তু, নাটক কোনওমতেই নয়। এর বিপরীত যুক্তিও অবশ্যই আছে, যা বলে, কোনও নাটককে আমরা কেবল টেক্সট হিসেবেও পড়তে পারি স্বচ্ছন্দে— তার অভিনয় হল কি না-হল, তা তেমন বড় কথা নয়। প্রশ্ন হল, বাংলা নাটকের উত্তরাধিকার আলোচনা করতে বসে আমরা এর মধ্যে কোন সূত্রটি গ্রহণ করব? সর্বোপরি, এমন নাটকও তো হতে পারে, যেখানে প্রায় কোনও স্ক্রিপ্টই নেই— শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপন ও তার অন্তর্নিহিত টানাপড়েনের ডায়ালেকটিক্‌স থেকে সরাসরি উৎসারিত হয়ে আসছে যে নাটক, তাকে কীভাবে দেখব?

তার পরের কথা, বাংলা নাটকের উত্তরাধিকার নিয়ে কথা বলতে বসে আমরা কি কোনও নির্দিষ্ট কালখণ্ডের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব? সত্যি বলতে কী, এই সংখ্যার বিষয়সূচির খসড়া নির্মাণ করতে বসে এই প্রশ্নটিই আমাদের সবচেয়ে বিব্রত করেছে। প্রথমে ভাবা গিয়েছিল, আলোচনা হবে কেবলমাত্র আধুনিক নাটক নিয়ে। কিন্তু, কাকে বলব আধুনিক নাটক, তা নিয়ে বিস্তর গোল বাধল। আধুনিকতা বলতে কেবল একটি কালিক ধারণাকেই গ্রহণ করব, নাকি তা নাটকের রূপগত, বিষয়গত, প্রকরণগত, নাকি বার্তা-প্রতিপাদ্য-মেজাজ ও সর্বোপরি রাজনৈতিক অবস্থানগত ধারণা— এমন নানা প্রশ্ন উঠে এল। কিন্তু আমাদের স্থানাভাব, অতএব প্রতিস্পর্ধী সবক’টি প্রশ্নকেই জায়গা করে দেওয়ার সুযোগ কম। অতএব, কাজ চালানোর মতো একটি সমাধানসূত্রে পৌঁছনোর জন্য আমরা শেষাবধি ঠিক করলাম, আমরা কথা বলব মূলত গত পাঁচ-সাত দশকে বাংলা নাটকের কয়েকটি বাঁক নিয়ে, যা আমাদের নাটক দেখার অভিজ্ঞতার সীমাকে প্রতিমুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করেছে, পালটে দিয়েছে, ভেঙে নতুন করে গড়েছে।

কিন্তু, সেখানেও সমস্যা। গত পাঁচ-সাত দশকের বাংলা নাটক মানে একের পর এক রথী-মহারথীদের মিছিল। সেখানে যেমন আছেন নাট্যকার, নাট্যপরিচালক বা নির্দেশক এবং নটনটীরা; তেমনই আছেন মঞ্চ-আলো-ধ্বনি-পোশাক নিয়ে মঞ্চের পেছনে কাজ করে চলা একঝাঁক মানুষ। বাংলা নাটক মানে তো কেবল শম্ভু মিত্র নন, বাংলা নাটক মানে খালেদ চৌধুরীও। এত বড় একটা জনসমষ্টি— যেখানে সকলের এবং প্রত্যেকের প্রবল সম্মিলিত উদ্যোগে বাংলা নাটক নামক এই বিশাল কর্মকাণ্ডটা এতদিন ধরে চলে আসছে— পেশাদার মঞ্চে, প্রসেনিয়ামের বাইরে, কখনও পুরোদস্তুর রিয়ালিস্টিক অভিনয়ে ও মঞ্চসজ্জায়, কখনও বা সাঙ্কেতিক ও প্রতীকী নির্মাণে, বিষয়ভাবনায় কখনও প্রবল নাগরিকতার কখনও বা লৌকিক নাট্যভাবনার হাত ধরে এই যে বিপুল এক ক্রমজায়মান উত্তরাধিকার— এর পুরোটা ধরা যাবে কী উপায়ে! কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলা হবে!

এইসব ভাবনার মধ্যে দিয়ে, খানিক অজ্ঞাতসারেই, আমাদের সামনে বিষয়টা দানা বেঁধে উঠছিল। দানা বেঁধে উঠছিল, খানিকটা যেন বা একটা নাটকের মতো করেই— সেখানে একের পর এক নানা বিপরীতমুখী ভাবনা তৈরি হচ্ছিল, তাদের মধ্যে লড়াই বাধছিল, প্রতিপ্রশ্নগুলিকে জায়গা করে দিতে গিয়ে অজান্তেই আমরা একটা ডায়ালেকটিক্সের মধ্যে দিয়ে চলেছিলাম। মাসাধিককালের সেই চর্চার পরে দেখা গেল আমাদের হাতে কয়েকটি লেখা এসে পৌঁছেছে, বিষয়ের দিক থেকে যথেষ্ট গুরুতর হলেও সামগ্রিকতায় যেগুলির অসম্পূর্ণতা পর্বতপ্রমাণ, বলার চেয়ে না-বলা কথাই সেখানে বেশি, গত কয়েক দশকের বাংলা নাটকের নির্ণায়ক প্রস্থানবিন্দুগুলির অধিকাংশই সেখানে লজ্জাজনকভাবে অনুল্লেখিত। কিন্তু, এত অসম্পূর্ণতার মধ্যেও, দেখা গেল, সব মিলিয়ে একটি অবয়ব যেন বা প্রকাশিত হয়ে উঠছে— হয়তো বা ঈষৎ কুয়াশাময়, তবুও অর্থপূর্ণ। সেই লেখাগুলিই, সযত্নে, আমরা পাঠকের জন্য সাজিয়ে দিলাম।

নাট্যসমালোচকরা বলেন, নাটকের কোনও অভিনয়ই সম্পূর্ণ নয়— ক্রমজায়মানতাই তার স্বরূপ। প্রতি অভিনয়েই তার রূপ পালটাতে থাকে। সেই অর্থে যে কোনও নাটকেরই একটি অভিনয় তার আগের অভিনয়ের চেয়ে আলাদা। এই যুক্তিক্রম অনুসারে, আমাদের এই সংখ্যার রচনাগুলিকেও একটি পুর্ণাঙ্গ সঙ্কলন হিসেবে গ্রহণ না-করে পাঠক যদি এগুলিকে একটি বৃহত্তর নির্মাণপ্রয়াসের অভিমুখে ধাবমান কয়েকটি ওয়ার্কিং ফাইল হিসেবে গ্রহণ করেন, বাধিত হব। শীর্ষলেখের ‘WIP’ অক্ষরগুচ্ছ সেই যাত্রারই সূচক— এই সংখ্যাটি অসম্পূর্ণ— এর কাজ চলেছে— ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস।

বাংলা নাটক দীর্ঘজীবী হোক…

প্রণাম ও ইতি।

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
অভীক ভট্টাচার্য

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...