Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জানালায়

জানালায় | শৈলেন সরকার

শৈলেন সরকার

 

মলি এল কাল সন্ধেবেলা। বিয়ের পর এই প্রথম। প্রায় বছর তিনেক পর। তুই তখন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে। দরজায়। বারান্দায় আলো না থাকায় তোকে দেখতে পাবে না কেউ। তুই জানতিস। আমি তখন দুপুরের ডাল গরম করছি। হলুদ বুদ্‌বুদ্‌গুলির জেগে ওঠা দেখছি। তুই কি তবে আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিলি? তুই কি জানতিস আগে থেকে?

পরশু সন্ধের পর যখন প্রণব ডাক্তারের ওখান থেকে ফিরছি, তখনই শুনলাম, মলি আসছে। ওর মা— মানে নীহারমাসি তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। মা-কে ডেকে যখন নীহারমাসিই কোথায় গিয়েছিলাম জানতে চাইল, অবাক হলাম খুব। তুইও হতিস। কতদিন পর নীহারমাসি ডেকে কথা বলল বল তো? মায়ের চোখ, প্রেসার আর প্রেসক্রিপশনের কথা বলার পর আমিই জানতে চাইলাম, ‘ঠান্ডার মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে?’ নীহারমাসি মেসোমশায়ের কথা বলল। ওদের জামাইয়ের কথা। বিশ্বাস কর, প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে আমাকে ওদের নাতির কথা শুনতে হল। দেখতে নাকি একেবারে ওর বাবার মতো। দুষ্টু নাকি খুব! আর ওর জামাইয়ের যা চাকরি, তাতে নাকি ছুটি পাওয়াই মুশকিল।

দূরে পুকুরের জলটা বেশ চিকচিক করছিল তখন। আলোর জন্যই। কিছুটা অবশ্য বাতাসের জন্যও। ছোট ছোট ঢেউ তৈরি হয়েই ভেঙে পড়ছিল। মা বলল, ‘তার মানে মিটে গেল সব?’

মা কি তোকে বলেছে কিছু, মানে, মলিকে নিয়ে? এমন মেয়েকে পেটে ধরলে কী করত বলেনি? এমন মেয়ে আর মেয়েজামাইয়ের মুখ দেখলে কী হয় বলেনি? আমাকে অবশ্য বলছিল কী সব।

দূরে একটা মাইক বাজছিল কোথাও। সম্ভবত কীর্তন জাতীয় কিছু হবে। বেশ দূরেই। হয়তো বা হাওয়ার জন্যই, কীর্তনের সেই ঝমঝম করা ধ্বনি হঠাৎ করেই জেগে উঠে পরমুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছিল একেবারে। আমি তখন কেন যে এমনি রেগে উঠলাম কে জানে? বলে উঠলাম, ‘থামবে তুমি?’

মলিদের বাড়িটা এখন কেমন পালটে গেছে দেখেছিস? একটিমাত্র বেলাতেই। কেমন ছিমছাম আর পরিষ্কার লাগছে না? যেন চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে কেউ ‘আহ্‌’ করল। তুই কতক্ষণ ছিলি, মানে দরজায়? সেই যখন মলির বর ট্যাক্সি থেকে নামল, আর পরপর দুবার হর্ন পড়ল, আর নীহারমাসিদের সবকটা ঘর আর বারান্দায় আলো জ্বলে উঠল, সেই তখন থেকেই?

ছেলে কোলে নিয়ে মলির বরই অবশ্য ট্যাক্সিওয়ালার টাকা মেটাচ্ছিল। মলির ‘বাবা’ বলে ডেকে ওঠা কানে এসেছিল আমার। উনুনের আগুন যদিও লাল হয়ে জ্বলছিল, আর চারপাশ থেকে হালকা নীল শিখাগুলি যদিও বাইরে ছড়িয়ে পড়তে চাইছিল, আমি তখন রুটির তাওয়া সামলাচ্ছি। তুই নিশ্চিত তখন পশ্চিমের জানালায়। বম্বে কাট ব্লাউজের হেম করছিস। মা কী করছিল রে তখন? আর বাবা? লোকটা জিজ্ঞেস করেনি কিছু? ট্যাক্সির হর্ন বা তোর ছুটে যাওয়া নিয়ে? হ্যাঁ রে বাবা, ছুটেই গেছিস তুই, না বললে কী হবে? আচ্ছা, মা কি তখন বিছানায়? ব্লাউজের কাজ করছিল? না কি গল্প করছিল এমনি? বিশ্বাস কর আমি নিজের কানে শুনেছি। এই সেদিনও। কাকে নাকি বলেছে। আমাদের কথাই। সত্যি! সম্ভব হলে নাকি একদিনেই…। মা আবার একদিন বিভার কথা তুলল। ওর দোষের কথা। ও নাকি বাপের বাড়ি ফিরে না এলেই ভালো করত। ওর নাকি ওখানে থাকা উচিত ছিল। আর কী বলল বল তো? নাহ্‌, বলব না। ভাববি ক্ষ্যাপাচ্ছি তোকে। ভাববি ইয়ারকিই মারছি। বলল, ‘তুই হলে নাকি কিছুতেই এত বড় ভুল করতিস না।’

এর মধ্যে রবিকাকু যেদিন এল, তুই তো বাড়ি ছিলি না। মা তোর গুণের কথা তুলল। তোর পরিশ্রমের কথা, সারাদিন মেশিন আর সেলাই নিয়ে পড়ে থাকার কথা। আর, আমার কথাও বলল অবশ্য। তোর পেছন পেছন যেভাবে থাকার কথা আমার, সেভাবেই। ওদের শরীরের কথাও উঠল। বাবার গলা, বুক আর প্রেশার। মায়ের চোখ, ইউরিন, দাঁত। রবিকাকা কেন এসেছিল কে জানে? হয়তো কোথাও কোনও কাজে এসে মনে পড়ে গেছে হঠাৎ। মা চা করতে বলল চিৎকার করে। আমার নাম ধরেই। রবিকাকু তবু, বিশ্বাস কর, চুপ করেই রইল একেবারে। আমাকে কেমন ‘ফুলু, ফুলু’ করে ক্ষ্যাপাত মনে পড়ে তোর? চুল ধরে টানত। ভেবেছিলাম, মনে পড়বে ঠিক, একসময় ডেকে উঠবেই ‘ফুলু’ বলে। সেই লোক বিশ্বাস কর, বসতেই চাইল না কিছুতেই। বলল, ‘একদম না বউদি।’ কোথায় নাকি কাকে দাঁড় করিয়ে  রেখে এসেছে। একদম টাইম নেই। আর একদিন নাকি সকাল সকাল এসে…। যেমন বলে সবাই। আমি অবশ্য জায়গা ছেড়ে উঠিনি আর। ব্লাউজগুলি মেঝের উপর ফেলে রেখে, যেমন থাকতিস তুই একেক সময়, আমিও তেমনি করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পুকুরের জল আর মাছেদের বুজকুড়ি কাটা দেখছি। হঠাৎ করেই ওদের তলিয়ে যাওয়া লক্ষ করছি। কী মনে হচ্ছিল বল তো তখন? মনে হচ্ছিল, আমাদের বাড়িতে কেউ যেন না আসে আর। কেউ না।

রবিকাকু চলে যাওয়ার পর মাকে ধমকালাম খুব। কেন তুমি চা খাওয়ার কথা বললে? কেন? লোকটা যখন দশ মিনিটও বসতে চাইছে না, তখন, কেন তুমি আমাদের কথা তুললে?

বাবা কাশছে। মা তোকে এতক্ষণ লক্ষ করেছে ঠিক। আমি জানি ব্লাউজের পিঠের ভাঁজে সুঁচ চালাতে গিয়েও একবার আড়চোখে দেখে নিয়েছ তোকে। বাবাকে হয়তো ফিসফিস করে বলেছেও কিছু। যেমন বলে আর কি…। যেমন করে বাড়ি বিক্রির কথা বলে। যেমন করে রাস্তাঘাটের কথা আর পাড়ার বাজে ছেলেদের কথা বলে। বিভার কথা বলে— যেমন করে শোনায় আমাদের। এর চেয়ে নাকি মরে যাওয়াও ভাল। বিভা নাকি নিজের মুখেই বলেছে মা-কে। ও নাকি আমাদের কথা তুলেছে। বলেছে, ‘বেঁচে গেছেন মাসিমা।’ জানিস না তুই? এর আগে বলিনি তোকে এসব কথা? না থাক, বিভাকে তোর জিজ্ঞেস করতে হবে না কিছু। বড়জোর অন্য কোনওভাবে অন্য কোনও কথা উঠলে শুনিয়ে দিবি। বলবি, আমাদের কথা যেন ও না ভাবে। ন্যাকা কোথাকার! বলবি, ওর সম্বন্ধে কম কিছু জানি না আমরা। হ্যাঁ, ওই যে গ্যামাক্সিন ফ্যাক্টরির ব্যাপারটা…। কোন এক পরেশবাবু…। তোরও তো না জানার কথা নয়, শুনিসনি? সত্যি? ঠিক আছে, তোকে বলতে হবে না। আমিই, হ্যাঁ, আমিই বলব। ওইটুকু একটা কোলের বাচ্চাকে ফাঁকা ঘরে রেখে কীভাবে…?

—কে?

শব্দ হল না একটা? কেউ ডাকছে বলে মনে হল না? তোর নাম ধরে ডাকল কেউ? না কি আমাকে? দরজায়ই তো? না কি জানালায়? না কি পেয়ারার ডালগুলিই। রাস্তা দিয়ে কেউ চলেই গেল হয়তো। তার মানে কেউই নয়। এমনিই। এখান থেকে অবশ্য কিছু বোঝা মুশকিল। মানে, কেউ যদি দাঁড়িয়েও থাকে…। দরজার বাইরেটা একেবারেই অন্ধকার। এমনকী রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলিরও যেন এখানে আলো দেওয়ার কথা নয়। দেখেছিস কোনও দিন? লক্ষ করেছিস? আমি দেখলাম। সেদিনই। ওই যেদিন নীহারমাসির সঙ্গে কথা বলে ফিরছি। মা-কে নিয়ে। নিজেদের বাড়িটাকেই এত ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল…। বিশ্বাস কর। আশপাশের প্রত্যেকটা ঘর, ঘরের দেওয়াল আর ছাদ একেবারে অন্যরকম। নিরুদের নারকেলগাছটার জন্যও হতে পারে অবশ্য। পোস্টের আলো গাছটাতেই যেন আটকে গেছে পুরোপুরি। আর পুকুরঘাটের ভেঙে পড়তে থাকা পাড়…? লক্ষ করেছিস কোনওদিন? পেয়ারাগাছটার গোড়া পর্যন্ত চলে এসেছে দেখলাম। বারান্দা পার হয়ে ঢালটা হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেছে যেন।

দরজার পর্দাটা কবেকার, মনে আছে তোর? মনে পড়ছে না? সেই যেবার সেজপিসি এল, সঙ্গে রুনা, রাউরকেল্লা থেকে। অনেক বছর পর অবশ্য। বলল, ওরা জায়গা কিনেছে ওখানে, আর ফিরবে না এদিকে। মনে করে দেখ, আমরা সিনেমায় গেলাম সবাই মিলে। সিনেমা হলে পুলকদা যেচে এসে কথা বলল। রুনাকে দেখে, ও কে— জানতে চাইল, মনে পড়ছে?

পর্দাটা রুনারই পছন্দ করা। হালকা সবুজের ওপর নীল। যেন ঝর্ণার জল গড়িয়ে পড়ছে। ওদের ওখানে নাকি ঝর্ণা আছে কোথায়। ও বলছিল। নদী আর পাহাড়। জলের নীচে রঙিন পাথর। আর কী কী কিনেছিল মনে আছে? আমাদের দুজনের জন্য দুটো শাড়ি, বাবার জন্য ধুতি আর পাঞ্জাবি, আর মায়ের জন্য? তাঁতের শাড়ি একজোড়া। আমার কিন্তু যাওয়ার ইচ্ছে ছিল খুব। একটা নদীর কথা বলেছিল মনে আছে? হেঁটে পার হওয়া যায়। যায় কখনও? তুই বিশ্বাস করিস? একটা নদী হেঁটে…, আর জলের স্বচ্ছতার কথা? মনে আছে? বলেছিল, পায়ের প্রত্যেকটি আঙুলই নাকি চোখে পড়ে তখন।

পর্দার সেই নকশা অবশ্য কবেই নষ্ট হয়ে গেছে। রুনার নাকি ছেলে হয়েছে একটা। বর ইঞ্জিনিয়ার। ওদের বিয়ের কার্ডের ডিজাইনটা মনে আছে তোর? মনে পড়ছে? আলগা করা একটা প্রজাপতি। রঙিন একেবারে। পাতলা। যেন সত্যিকারেরই। যেন স্পর্শ করামাত্র রং লেগে যাবে। যেন সেই ডানা আর শুঁড় আর সেই চোখ নষ্ট হয়ে যাবে একেবারে। প্রজাপতিটা তো ছিল অনেকদিন। ঘরেই। টেবিলের ওপর পেতে রাখা কাগজের নীচে অনেকদিন ছিল কিন্তু।

ভালো কথা, সেদিন তরুণদাকে দেখলাম। সম্ভবত স্কুলে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে ছেলেকে। কোথায় পড়ে কে জানে? নিশ্চয়ই ভালো কোনও স্কুলে। কী চমৎকার হয়েছে রে ছেলেটা! ফর্সা বা কালো— কোনওটাই নয় অবশ্য। ওর বাবার মতোই। ছেলেদের যে রকম হলে ভাল লাগে আর কি। আর শুধু রং-ই কেন? পুরো চেহারাটাই। ঝকঝকে চোখের। পায়ে জুতো। সাদা জামা আর নেভি-ব্লু প্যান্ট। বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে ছেলেটা বকবক করছিল খুব। এত ইচ্ছে করছিল কথা বলতে! ছেলেটার সঙ্গেই। এত ইচ্ছে করছিল আমার। ওর হাত, ওর গাল, ওর চুল ছুঁয়ে দিতে এত ইচ্ছে করছিল! তোর সঙ্গে যদি সত্যি সত্যি কিছু হত তো এতদিনে তোদের ছেলেও…। রাগ করছিস না তো? সত্যি বলছি, হয়তো তোর ছেলেই দাঁড়িয়ে থাকত। এই সেদিনের মতোই একটার পর একটা বাস ছেড়ে দিত, সেদিনের মতোই বকবক করত ঠিক। কোনদিন মনে করতে পারছিস? ওই যে গেল মাসে বিপুলদার বাড়ি থেকে দেরি করে ফেরার জন্য মেজাজ নিলি খুব। বললি, বিপুলদাকে দেখলেই নাকি গলে যাই আমি— মনে পড়ছে? সেদিন আসলে অনেকদিন পর তরুণদাকে দেখে একটা অদ্ভুত ভালো-লাগা এসে গিয়েছিল। যেন দশ বছর আগেকার সেই রোদ, রোদের সেই উত্তাপ। বাতাস আর ডালপালার সেই নড়ে ওঠা। তুই কিন্তু অন্য কিছুও ভাবতিস। মনে করে দ্যাখ, একদিন তরুণদার চুলে আঙুল ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন রেগে গেলি, মনে পড়ছে? তরুণদা তখন শুয়ে, শুয়ে মানে আধা শুয়ে, সেদিনও তুই সেই পশ্চিমের জানালায়। বাইরের পুকুরে সবুজ কচুরিপানা আর বেগুনি আর সাদা মেশানো সেই ফুল। তুই আমাকে সেদিন অহেতুক বাইরে পাঠালি।

একটা ভারি মেঘ চাঁদটাকে আড়াল করছে কেমন। বাইরে। মলিদের বাড়ির সবকটা জানালা দিয়েই আলো বেরিয়ে আসছে। একটা রিকশা থামল না? সম্ভবত মেসোমশায়। হ্যাঁ, মেসোমশায়ই। মলির মা কী একটা বলল যেন। কচি গলায় একটা ডাক শোনা গেল না? যেন ধমকে উঠল কেউ। আদর করেই। দরজায় দাঁড়িয়ে এসব অবশ্য স্পষ্ট দেখতে পাওয়ার কথা। তুই আর উঠিস না কিন্তু, বিপুলদা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে। ব্লাউজগুলি বুধবারই জমা করতে হবে। দুপুরের আগেই। কে কথা বলল রে? বল, জল গরম করছি।

বোম্বে-কাট ব্লাউজগুলির ডিজাইন লক্ষ করেছিস? এবারেরটা। হাতা আর পিঠের এমব্রয়ডারি। সবুজ, নীল আর লালের। কেমন ঢেউ খেলানো দেখেছিস? কোন একটা সিনেমায় কে যেন পরেছে। আগে হলে জানা থাকত তোর। বিপুলদার পয়সায় কম তো সিনেমা দেখিসনি। আমি? দেখেছি তো। তবে তোর মতো নয়। যা হিংসুটে তুই! কার কাছ থেকে কী শুনে এসে সেবার বাড়িতে যা কাণ্ড করলি! আমি যেন পালিয়েই গেছি। যেন আমার আর ফেরার কথা নয়। আসলে সঞ্জুদার এক বন্ধুর জন্যই। তুই কি তোর মাদ্রাজি সিল্কের জন্য ভয় পাচ্ছিলি, না কি আমার জন্যই? লোকটার কথা কে বলেছিল রে তোকে? একটা বিশ্বকর্মা পুজোর দিনই সম্ভবত। সারাটা দিন ঘুড়ি উড়ছিল খুব। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ। দিনভর ‘ভো কাট্টা’ বলে চিৎকার উঠছিল। মায়ের চোখ দেখাতে যাওয়ার কথা ছিল সেদিন। মা অবশ্য তখনও দিনে এক ডজন মাল তুলছে। একাই। বাবার রোগটা ধরা পড়েনি তখনও।

আমাদের বাড়িটা কিন্তু সেই একই রকম রয়ে গেল। সেই ল্যাম্পপোস্ট, সেই পুকুর, ছোট ছোট ঢেউ। সেই মেহেন্দির বেড়া, বারান্দা। আচ্ছা, আমাদের বারান্দায় একটা আলো থাকে না কেন রে? ছোট একটা বাল্‌ব। এই যেমন মলিদের বারান্দায় জ্বলে উঠল আজ। বাবা বলত, সামনের পুজোতেই দেওয়ালটা পাকা করে নেবে। মা সায় দিত। বলত, মেয়েরা বড় হচ্ছে। বলত, ছোট পার্টিশান রাখতে হবে একটা। ভাল হত কিন্তু। মানে, ছোট একটা পার্টিশান থাকলে। একটা অন্তত আড়াল থাকত। এই যে তুই ব্লাউজ-হাতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে— এটা আমার চোখে পড়ত না। তুই কি মলির কথা ভাবছিস? নীহারমাসি বলছিল, মলি এলে আমরাই নাকি আগে টের পাব। বলছিল, বর আর ছেলেকে নিয়ে ও নাকি আমাদের ঘরে ঠিক হাজির হবে। সবার আগে নাকি আমাদের সঙ্গেই দেখা করতে চাইবে।

—কে?

শব্দ হল না একটা? একটা কেন, দুটোই। পরপর। কেউ যেন দাঁড়িয়ে। যেন কীভাবে শুরু করবে ভেবে নিচ্ছে।

—মলি?

কী কাণ্ড দেখ দিদি! দুজনেই ঠকে গেলাম। মা-ও। অথচ ঠিক সাড়ে সাতটায় এই ইঞ্জেকশনের কথাটা তো প্রতিদিনের। ঠিক সাড়ে সাতটায় রঞ্জিতবাবুর আসার কথা। দুটো টোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ফাঁকে, আমাদেরই তো ‘রঞ্জিতবাবু…’ বলে দরজা খুলে দেওয়ার কথা। এরপর গরম জল, টাওয়েল। আর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বাবার ‘আর পারছি না রঞ্জিতবাবু’ বলে ওঠা।

ঘরের বেড়ার গায়ে আটকে রাখা কাগজগুলি আলাদা করে দেখেছিস কোনওদিন? সামনের বর্ষায় জল বেরোবে ঠিক। কবে যেন লাগানো হয়েছিল? তুই, আমি আর মা মিলে কবে যেন পুরনো খবরের কাগজগুলি জোগাড় করলাম? কেটে আলাদা করলাম। আঠা লাগিয়ে কবে যেন…? বাঁশের খুঁটি আর কাঠের ফ্রেমগুলি কেমন বেরিয়ে পড়েছে দেখেছিস? বাঁশের বেড়া চারপাশে প্রায় পুরোটাই চোখের সামনে চলে আসছে। সামনের বর্ষায় ভুগতে হবে ঠিক, দেখিস।

মা কি বলল রে কম্পাউন্ডার রঞ্জিতবাবুর কানে? কী জানতে চাইল? বাবার বেঁচে থাকা নিয়ে? না কি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে? বাইরে কেমন হাওয়া দিয়েছে না? কচুরিপানার ডাঁটগুলি কেমন নড়ছে দ্যাখ। অপুদের টিভি-র পর্দাটা চিকচিক করছে। গান হচ্ছে মনে হয় কোনও। একটা কথা, রঞ্জিতবাবুকে তুই চায়ের কথা বলিস কেন রে প্রতিদিনই? কেন বলিস? প্রতিদিন সেই একই জানতে চাওয়া, ‘চা খাবেন তো?’ আর প্রতিদিনই রঞ্জিতবাবুর সেই ‘না’ বা ‘সময় নেই’ বলা। তুই কি বেহায়া রে দিদি!

একটা পাখি ডেকে উঠল কোথায়? অন্ধকারেই। ট্যাঁ-ট্যাঁ-ট্যাঁ-ট্যাঁ—। শব্দ হল না একটানা? এখন অবশ্য চুপচাপ একেবারে। যেন স্বপ্নের মধ্যেই। বা, কিছু যেন মনে পড়ে যাওয়া। রান্নাঘরে গড়িয়ে গেল কিছু। মেঝেতে শব্দ করল কেউ। যেন ভয় দেখাতে চাইছে। কাকে? কাকে, কে ভয় দেখাতে চাইছে রে দিদি?

মা বলত, ‘এখন রাগ করলে হবে দিদি?’ বলত, ‘যা হওয়ার হয়েই গেছে, মেনেই নাও।’ তুই তখন হয়তো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। আমিও হয়তো বুজকুড়ি ওঠানো দেখছি মাছের। আচমকাই ঘাই মারা। নীহারমাসি তুলনা দিত খুব। আমার আর তোর। বলত, ‘তোমার মেয়েদের দেখেও কিছু শিখল না মলি।  এ রকম একটা ছেলের সঙ্গে…।’

তুই কি ভেবেছিলি বাঙ্গালোর থেকে নেমেই ছুটে আসবে? মলির বর সত্যিই কি ভাল কাজ করছে? তোর কী মনে হয় রে? একটু ভাল হয়েছে চেহারা? মলির? গলায় বা কানে দেখলি কিছু? শাড়িটা? ওরা জেগে আছে এখনও? দেখলাম। একটু আগেও মা যখন বাইরে গেল, গান বাজছিল একটা। কী মনে হয় রে, টেপ-ডেক? ওদের ঘরেই। মানে, নীহারমাসির। নিশ্চিত মলির বরেরই কেনা। হয়তো শ্বশুরবাড়ির জন্যই। পাচ্ছিস আওয়াজটা? ছিল একটু আগেও। হয়তো সাউন্ড কমিয়ে দিয়েছে।

তুই কি খাবি এখন? এই…, এই দিদি? পরে? পরে কেন? পরে কী হবে? তুই কি সত্যি-সত্যিই কারও কথা ভাবছিস? তুই কি ভাবছিস সত্যিই আসবে কেউ? মলি? ওর বর? তা হলে? না কি তরুণদা বা বিপুলদা? যেমন আসত। ডেকে নিয়ে গল্প করত। আমি হয়তো তখন ঘরে। মা হয়তো সেলাই করছে। আমিও। আর কান পেতে শুনছি। বিশ্বাস কর, তোদের সব কটা কথা শোনার চেষ্টা করছি। পরের দিকে অহেতুক রাগ করতিস তুই। তরুণদাকে আমি কোনও দিনই পাত্তা দিইনি। বিশ্বাস কর, তুই তো আমার দিদি। প্রথম দিন আমি একেবারেই চমকে উঠেছিলাম। কী ভয়…! বিশ্বাস কর তুই। জানি ভাববি বানিয়ে বলছি, সত্যি। বললাম, ‘আপনি না দিদিকে…?’

একটা পার্টিশান থাকলে সত্যিই ভাল হত। সত্যি। ওদের দুজনকে চোখের উপর দেখতে হত না সারাটা দিন ধরে। আমাদের মা আর বাবা। বাবা কি সত্যিই বাঁচবে আর? তোর কি মনে হয়? হাসপাতালের ডাক্তার বলল কিছু? আমাকে তো বলল, ‘তোমার দিদিকেই বরং…।’ আমার কিন্তু ভয় হয় খুব। সত্যি বলছি। কেন, কে জানে? তুই কি বাবার উপর রাগ করে আছিস খুব? আর মায়ের উপর? ওদের ওই অদ্ভুত কথাগুলি ভালো লাগে না তো তোর? আমারও লাগে না। তোকে আর আমাকে নিয়ে বলা বানিয়ে বানিয়ে বলা সব কথা। সেজপিসিকে চিঠি দিয়ে জানাবার কথা। ফটো পাঠাবার কথা। মনে পড়ে তোর? সেজপিসির একটা চিঠি পেয়ে মায়ের সে কি ব্যস্ততা! পুরনো ছবি খুঁজে না পেয়ে কী বকাঝকা! আর্ট স্টুডিওতে গিয়ে তোর হাসিমুখে বসা। পেছনে সিনারি। পাহাড় আর মেঘ। লোকটা বলেছিল, ‘কাশ্মির…।’ সেজপিসি অবশ্য খবর পাঠায়নি আর।

বিভা ফিরবে এক্ষুনি। ইটের রাস্তায় শব্দ হবে। হালকা। সতর্কতার। সম্ভবত লাস্ট ট্রেনের আগের কোনও ট্রেনই। চারটে মাত্র স্টেশন। এত দেরি হবে কেন? কাজ নাকি প্রচুর। অনেক অর্ডার। ওভারটাইম। তাই বলে এত রাত? অনেকেই নাকি দেখেছে। মাঝবয়সি একটা লোক। স্টেশন পর্যন্ত নাকি এগিয়ে দেবে। রোজ। ওর হাঁটার মধ্যে কেমন চনমনে ভাব দেখেছিস? যেন পাত্তাই দেবে না কাউকে। সত্যিই দেয় না কিন্তু। ওর দাদাকেও না। ওর বউদিকে নাকি সেদিন বলেছে আচ্ছা করে। কীভাবে বলে রে এসব কথা? কীভাবে বলে? ও নাকি যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ও নাকি সংসারে কম টাকা দেয় না। বাড়িতে ওরও নাকি ভাগ আছে। সত্যি? এই বাড়িটা তো আমাদেরই। আমার আর তোর। বাবা-মা না থাকলে তো আমরা দু’জনই…। আমি আর তুই। হয়তো অনেক বছর ধরেই। শুধু তুই আর…।

বাবা বাঁচবে না আর, আমি জানি। প্রণব ডাক্তার সেদিন বলল মা-কে। বলল, ‘যা হয়েছে তাতে…।’ প্রণব ডাক্তার অবশ্য হাসপাতাল কী বলল— জানতে চেয়েছিল।

ভারি মেঘের টুকরোটা এখন আর নেই। সাদা আর হালকা পালকের মতো কিছু এখনও লেগে। চাঁদের মাটিই ছুঁয়ে আছে যেন। পর্দাটা পছন্দ করে রুনা সেবার বলেছিল, ‘ঠিক ভালো লাগবে, দেখো।’

শব্দ হচ্ছে না একটা? এই দিদি, শুনছিস? এই দিদি? শব্দটা এদিকেই আসছে না? শুনতে পাচ্ছিস? ভারি পায়েরই। যেন লম্বা লম্বা পা ফেলেই কেউ…। দাঁড়িয়ে পড়ল না? কিরে শুনতে পাচ্ছিস? কেউ দাঁড়িয়ে পড়ল না বাইরে? কে? ডাকব? কিরে? নামব বিছানা ছেড়ে? না কি ডাকব মা-কে? বাবা? থাক। প্রণব ডাক্তারের কথা ঠিক হলে আর কয়েকটা দিন মাত্র। তুই বরং বলিস না কিছু। ছেড়ে দে। মলির কথা কী বললি? আসবে না? মা বলল? মানে, মা? মা বারণ করে দিয়ে এসেছে? কেন? বাবার জন্য? তোর বিশ্বাস হয় এসব? বিশ্বাস হয়? মা আসলে হিংসে করছে নীহারমাসিকে। তুই বুঝবি না এসব। নীহারমাসিকে সেদিনই সহ্য করতে পারছিল না মা। নীহারমাসির মুখ থেকে বর আর ছেলেকে নিয়ে মলির ফেরার কথা শুনে মা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মিটে গেল সব?’

আমরা বরং ভালোই থেকে যাই কী বলিস? না কি খারাপ হবি নতুন করে। খারাপ হবি? হতে পারবি? তাকিয়ে দেখেছিস আয়নার দিকে? এই দিদি, কিরে? দেখেছিস? দেখিসনি তো। আমিও দেখি না। অনেক দিন। এত ভয় করে! এত ভয় করে আমার! একেক সময় সত্যিই মনে হয়, একটা পার্টিশান যদি হত। যদি অন্তত আমরা নিজেদের না দেখতে পেতাম।

পাখিটা ডেকে উঠল ফের। ট্যাঁ-ট্যাঁ-ট্যাঁ-ট্যাঁ— । একটানা। মাঝেমধ্যেই কী যেন মনে পড়ে ওর কে জানে? বা কোনও স্বপ্নই। যেন ভয় দেখাবে কেউ। যেন কোনও পা থেমে যাবে এক্ষুনি। এক্ষুনি দরজার বাইরে ডেকে উঠবে। উঠব? দেখব একবার? দেখবি তুই? চাঁদের গায়ে এখন হালকা পালকের মতো মেঘ। যেন ছুঁয়ে আছে। নরম। পর্দাটা টেনে দে দিদি। টেনে দে। আমার এখন সত্যিই ভয় করছে।