Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্রীড়নক

ক্রীড়নক | অপরাজিতা ভট্টাচার্য

অপরাজিতা ভট্টাচার্য

 

কাফেটারিয়াটা জলধির অফিসের ফ্লোরে নয়। দু ফ্লোর ওপরে। লিফটে চড়লেই মাথা ঘুরছে। হাই টেম্পারেচার, মাথা যন্ত্রণা ছেড়ে গিয়ে রেখে গেছে দুর্বলতা। হাত পায়ে যেন জোর নেই। মাথা ঝিমঝিম করছে। বাড়ি থেকে খাবার আনলেও একটু চা না হলেই নয়। জলধি সচরাচর কাফেটারিয়াতে যায় না। কিন্তু আজ একটু চা লাগবেই। এক সপ্তাহ পর জয়েন করেই দুপুরবেলা বাড়ি ফেরা যাবে না। এইচআরের কাজ হলে যা হয়। সারাদিন বিভিন্ন লোকেদের সঙ্গে কথা বলে যেতে হয়। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে বেশি।

কাফেটারিয়াতে বসে পিৎজা খাচ্ছে সফটওয়্যারের শৈলী। পিৎজা কামড়ালেও শৈলীর চোখ পাশের টেবিলে। জলধি পাশে বসলেও খেয়াল করে না শৈলী। মন দিয়ে পাশের টেবিলের কথাবার্তা শুনছে। জনা পাঁচেক ছেলে বসে আছে সেই টেবিলে। একজনই বলে চলেছে। আর বাকি চারজন শুনছে মন দিয়ে। যে ছেলেটি কথা বলছে, জলধি তাকে কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। বাকি চারজনকে সে চেনে। জলধিদের অফিসেরই।

যে ছেলেটি কথা বলছে সে ছাড়া বাকি সবাই বার্গার খাচ্ছে। ছেলেটি খাচ্ছে রুটি আর আলুর তরকারি।

‘কিরে শৈলী? হাঁ করে গিলছিস মনে হচ্ছে ছেলেটার কথাগুলো? প্রেমে পড়লি নাকি?’ শৈলীর হাতে টোকা মেরে জিজ্ঞেস করে জলধি।

‘যা তা। আমার একটা হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড আছে ডিয়ার। ছেলেটা কী বলছে তাই শুনছি। ইংলিশ অ্যাকসেন্টটা শোন একবার। এদিকে গায়ের রংটা কালো।’

শৈলীর কথায় জলধি কান পাতে পাশের টেবিলের আলোচনায়। চা খেতে খেতে জলধিও বেশ অবাক হয়। ছেলেটির ইংরাজি উচ্চারণ কলকাতার লোকজনের মত নয়। জলধি খুব নামকরা না হলেও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই পড়েছে। জড়তাহীন শুদ্ধ ইংলিশ বলতে পারার কারণে এইচআরের চাকরিটাও পেয়েছে। কিন্তু ছেলেটির উচ্চারণ ইংলিশ মুভির মত। অথচ কালো চুল, কালো গায়ের রং।

পরের দিন চা খেতে এসে ছেলেটিকে আবার দেখতে পেল জলধি। আজ একা বসে ভিডিও কল করছে, কাউকে দেখাচ্ছে কাফেটারিয়াটা। এদিকে শৈলীও আসেনি। ভিডিও কলে বাংলা, ইংলিশ দুই ভাষাতেই কথা বলছে ছেলেটি। বাংলা বলছে স্পষ্ট। কিন্তু ইংলিশ উচ্চারণ ভারতীয়দের মত নয়। যে ফ্যাক্টরগুলো ছেলেদের আকর্ষণীয় করে তার সবকটাই ছেলেটির আছে। গায়ের রঙ হাল্কা কালো, খুব লম্বা। হিপনটিক চোখ, খাড়া নাক, লম্বা গলা আর চওড়া কাঁধ। সঙ্গে অমন উচ্চারণের ইংলিশ। জলধি বেশ আকৃষ্ট হচ্ছে। নামটা জানতে ইচ্ছে করছে। কোন অফিসে কাজ করে সেটাও জানে না জলধি। তবে ওদের অফিসে নয়।

‘হে নিনাদ, হ্যাড ইওর লাঞ্চ?’ একটি ছেলে এসে বসল।

জলধি জানল কৌতূহলের ছেলেটির নাম নিনাদ।

নাম জানা হলে কথা বলার ইচ্ছে প্রবল হল। কিন্তু মেয়ে হয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলায় আটকে গেল জলধি। দুপুরবেলায় চা খাওয়ার অভ্যাস জলধির নেই। দুর্বলতার জন্য আসছে দুদিন হল। কিন্তু কাফেটারিয়ায় এবার থেকে আসতেই হবে নিয়মিত। নিনাদকে দেখা যাবে। জানা যাবে অল্পবিস্তর।

নিনাদ লাঞ্চে রোজ রুটি আর আলুর তরকারি খায়। কাফেটারিয়ার  মালিকের বাড়ি থেকে নিনাদের জন্য রুটি তরকারি আসে। ওদের কথা থেকে জানতে পেরেছে জলধি। নিনাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। জলধি কাফেটারিয়ায় আসত না বলে নিনাদকে চিনত না।

মাস খানেক পর এক রবিবার বিকেলে স্কুলের বন্ধুর জন্মদিনে জলধি ও আরও কয়েকজন আউট্রাম ঘাটে যায়। কেক কাটার আয়োজন চলছে। জলধি সামান্য অন্যমনস্ক হয়েই দেখতে পায় নিনাদকে, চোখে ক্যামেরা, গঙ্গার ছবি তুলছে। জিন্স আর পাঞ্জাবিতে নিনাদ যেন ভাস্কর্য। চোখ ফিরিয়ে নেয় জলধি।

আর ঠিক তখনই ‘আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?’ নিনাদের প্রশ্ন।

জলধি ঠিক এমনটাই তো চাইছিল। চাইছিল নিনাদ কথা বলুক। কাফেটারিয়ার কথা বলে জলধি। কথা এগোতেই কেক কাটার জন্য জলধিকে বন্ধুরা ডাকে। নিনাদ চলে যায়।

কাফেটারিয়ায় বা অফিস ছুটির পর জলধি আর নিনাদের কথা ঢিমে তালে এগোতে থাকে। নিনাদের জীবনবৃত্তান্তে আশ্চর্য হয় জলধি।

নিনাদকে জানতে জানতে কালবৈশাখী, শ্রাবণ পেরিয়ে হিম পড়ে কলকাতায়। নিনাদ ততদিনে জলধিকে জল ডাকে। হেমন্ত হিমের মতই শীতল, বিষাদ জীবন নিনাদের। আকৃষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে কাতরও হয়ে পড়ে জলধি। নিনাদকে আগলে রাখতে হবে। এই কাতরতাই কি ভালোবাসা?

কলকাতাতে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিনাদের। নিনাদ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই নিনাদের বাবা রোজগারহীন হয়ে পড়েন। চাকরি চলে যাবার পর তিনি যে রোজগারের চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু কাজ জোটেনি তেমন। নিনাদের বাবার বড়দা অর্থাৎ নিনাদের আপন জেঠু ছিলেন নিঃসন্তান। থাকতেন ক্যালিফোর্নিয়াতে। জেঠিমার ইচ্ছেতেই ওঁরা নিনাদকে দত্তক নেন। বছর দুয়েকের নিনাদকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যালিফোর্নিয়াতে। নিনাদের মা বাবা প্রাথমিকভাবে রাজি না হলেও অনটনের কারণে ম্রিয়মাণ ছিলেন। ছেলে পরিবারের বাইরে তো যাচ্ছে না, উপরন্তু যে সুযোগসুবিধায়, প্রাচুর্যে ছেলে বড় হবে তা নিনাদের বাবা মায়ের কাছে অকল্পনীয়।

‘আমি আমার জেঠু জেঠিমাকেই মা বাবা বলি। আর আমার মা বাবাকে কাকা কাকি। আমার সাত বছরের জন্মদিনের সকালে বাবা মানে আমার জেঠু আমাকে জানান ব্যাপারটা। আই মিন কারা আমার বায়োলজিক্যাল বাবা মা। আমি কেন ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকি। আমি সেদিন প্রায় কোন কথাই বলতে পারিনি সারাদিন। কেক কাটতেও ইচ্ছে করছিল না। মা যাকে ডাকি সে আমার মা নয়, জেঠিমা। যাকে কেমন দেখতে জানিও না, ফটো দেখিয়ে কাকিমা বলতে শেখানো হয়েছে সে আমার মা। সাত বছরের একটা বাচ্চা বড় হয়ে গেল অনেকটা জল।’

‘জল। শুনছ তুমি? না বইছ স্বভাবে?’

নিনাদের এরকম ডাকে বিবশ জলধি নিনাদের চওড়া কাঁধে মাথা দেয়।

‘এত্ত কেয়ারিং আমার মা তোমাকে কী বলব জল! স্কুলে আর খেলতে যাওয়ার সময়টুকু ছাড়া সব সময় আমার সঙ্গে কথা বলত আমার মা। ওদেশের বাচ্চারা এমনভাবে বড় হয় না। তবুও আমি ইন্ডিয়াতে আসতে চাইতাম। আমার বায়োলজিক্যাল বাবা মার কাছে। হয়ত আমার জন্যই ওরা ইন্ডিয়াতে আসতে চাইত না। যদি আমি না ফিরি।’

গঙ্গার ঘাটের বেঞ্চে বসে থাকতে ভালোবাসে নিনাদ। জলধিকে নিয়ে সেখানেই আসে। অন্য কোথাও যায় না। এখানে বসেই একটা পুরনো বাংলা গান একটু গেয়েছিল। এই গানটা কলকাতায় এসে নিজের বাবার কাছে শুনেছে।

এক যে আছে কন্যা তার শ্যামলা শ্যামলা বরণ,
দেখতে সে নয় মন্দ আহা পুতুল পুতুল গড়ন।

জলধি নিজেকে দেখতে পায় গানে। যেন মনে হয় নিনাদই লিখেছে গানটা তার জন্য। বিদেশে বড় হয়েছে নিনাদ। জলধিকে ভালোবাসে কিনা জানতে চাইতেই পারে জলধি। কিন্তু নিনাদ নিখাদ বন্ধুর মত কথা বলে। যে ভালোবাসায় বাসা বাঁধা যায় তেমনটি কি বাসে নিনাদ?

জলধির খুব জানতে ইচ্ছে করে। অথচ নিনাদের নিজের কথা বলা বেশি প্রয়োজন। কষ্টের নুড়ি পাথর জমে আছে তার বুকে, গড়িয়ে নামা প্রয়োজন। নামতে শুরু করলে হাল্কা হবে নিনাদ। সেই চাঁইতে কতরকমের না-পারারা যে জমে আছে! জলধি তাই নিজের প্রশ্নটা করে না। নিনাদকে বলে যেতে দেয়। চাপ চাপ অভিমান জমে থাকলেও খাঁ খাঁ করে নিনাদের বুক। সেই বুকটুকু কি জলধিকে আগলাতে দেবে নিনাদ?

স্কুল, কলেজের বন্ধু এবং অফিসের বন্ধু শৈলীর থেকে জলধি তাদের প্রেমসম্পর্কিত যা যা শুনেছে সেগুলো মোটের ওপর এক। কিন্তু তার সঙ্গে নিনাদের কথোপকথন মেলে না। নিনাদ এ দেশের মানুষ নয়। তার বড় হওয়াটাও অন্যরকম। জেঠু জেঠিমাকে মা বাবা বলে, জন্মদাতা বাবা মাকে কাকা কাকি। তাই বোধহয় মিলিয়ে লাভ নেই। ক্যালিফোর্নিয়াতে বড় হয়েও কী ভীষণ আড়ষ্ট নিনাদ। জলধিকে এতদিনে সে জড়িয়ে ধরবে এমনটাই আশা ছিল জলধির। কিন্তু সে শুধু তাকে জল বলে ডাকে।

‘জলের অপর নাম জীবন। আমি শুনেছি ছোটবেলায়।’ নিনাদের ছোট্ট ছোট্ট কথাতে টালমাটাল হয়ে যায় জলধি। নিনাদ যে কেন বোঝে না।

‘ওক গাছের পাতা যখন হলুদ হত, মাকে মনে পড়ত বেশি। স্কুলে যেতাম যে রাস্তা দিয়ে সেখানে ছিল ওক, পাইন গাছ। পাইন কোন কুড়িয়ে নিয়ে ভেবেছি মা আইসক্রিম পাঠিয়েছে। হলুদ পাতাগুলোও যেন মা পাঠিয়েছে ইন্ডিয়া থেকে। মা জানে হলুদ আমার প্রিয় রং। আই মিন কাকি।

‘রুটি তরকারি নিয়ে গেছি স্কুলে। বন্ধুরা হাসাহাসি করেছে। কিন্তু আই লাভ টু হ্যাভ রুটি আলুর তরকারি। বরফ পড়ার সময় মাকে মনে পড়ত খুব। মা যদি দেখতে পেত এমন বরফ। মা হয়ত আমাকে অনেক কিছুই অ্যালাউ করত যা জেঠিমা করেনি। আসলে জেঠিমা ভয় পেত। যদি আমার কিছু হয়ে যায়।’

গঙ্গার পারে প্রতি রবিবার ওরা আসে সূর্য ডোবার আগে। সূর্য ডোবে, কথায় কথায় জেগে ওঠে নিনাদ। জলধি মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে।

‘যাবে আমার বাড়ি?’ এক রবিবার নিনাদের আহ্বানে জলধি গেল ওদের বাড়ি।

একটা ভগ্নপ্রায় বিস্তৃত এজমালি বাড়ির সংস্কার চলছে। নিনাদদের পৈতৃক বাড়ি। ওর জন্মদাতা বাবা মা এই বাড়িতেই থাকতেন। বাড়িটার সর্বত্র নিনাদের বাবা মায়ের স্মৃতিস্পর্শ। একমাত্র ওয়ারিশ নিনাদ সংস্কার করাচ্ছে। নিনাদের একার পক্ষে এই বাড়ি সংস্কারের কাজ বেশ ঝক্কির, তবু করাচ্ছে।

‘আমি ঠিক করেই রেখেছিলাম ইন্ডিয়া আসব। বাবা মায়ের কাছে থাকব, ফিরব না। কিন্তু আমি আসার পর পরই ওঁরা মারা গেলেন। আমি নতুন করে অনাথ হয়ে গেলাম জল।’

জলধি এর আগে প্রেমের ব্যাপারে এতটা মনোযোগী হয়নি। ভালোলাগা বা ক্রাশ যে তার আগে ছিল না তা নয়। কিন্তু যে মানুষ নিজের কথা বলে কাঁদায়, যাকে সর্বক্ষণ ভাবতে ভালো লাগে, যার জন্য অপেক্ষা থাকে সে মানুষ নিনাদ। অথচ নিনাদকে তো বলে উঠতেই পারছে না। নিনাদ যদি হেসে উড়িয়ে দেয়।

বাড়ির চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাতে থাকে নিনাদ। ঈশান কোণের তুলসি মঞ্চটা মার্বেলে বাঁধানো হচ্ছে।

‘আমার মা এখানে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাত। দেশে আসার পর মা বাবাকে খুব অল্প সময়ই পেয়েছি। দুজনেই তো সেরিব্রাল স্ট্রোকে মারা গেলেন। সময় পাইনি একটুও জানো। দুজনেই অল্প কিছুদিনের মধ্যে চলে গেলেন। যেটুকু সময় ছিলাম মাকে বাবাকে শুধু দেখেই যেতাম। অফিস ছাড়া কোথাও যেতাম না। মাকে সবচেয়ে ভালো লাগত এই প্রদীপ জ্বালানোর সময়। চোখ বুজলেই দেখতে পাই। প্রদীপ জ্বালাবে তুমি জল?’

জলধির মুখ থেকে শব্দ সরেনি। নিনাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল, পারেনি। এসব ক্ষেত্রে জারিজুরি খাটে না, বাহাদুরির উত্তর দেওয়া যায় না। অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করে জলধি।

নিনাদ আবার জানতে চায়, ‘কী হল জল? সে ইয়েস অর নো।’

জলধি অনেক প্রেম এবং প্রোপোজ উপাখ্যান শুনেছে। কিন্তু এমনতর অভিনব। নিনাদ যে তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। নিনাদের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দেবার ইচ্ছে ছিল না জলধির। কিন্তু উত্তর না দিলে আবার জিজ্ঞেস করবে নিনাদ।

‘তাহলে তো সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানোর তোড়জোড় শুরু করতে হবে নিনাদ।’ জলধির উত্তরে সেদিন নিনাদ প্রথম তাকে তুলসিমঞ্চের সামনে জড়িয়ে ধরে। সন্ধের অন্ধকারে কপালে চুমু দেয়।

মাত্র তিন মাসের মধ্যে জলধি আর নিনাদের বিয়ে হল। নিনাদের সংস্কার করা বাড়ির ইন্টিরিয়র সাজাল জলধি। বাড়ির অন্দরসজ্জা, বিয়ের কার্ড সব জলধির পছন্দ। দ্রুততায় এগোতে লাগল সময়, ভেসে যেতে লাগল জল ও জলধি। প্রেম বা বিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা ছিল না জলধির। কিন্তু স্বামী হিসেবে একজন ভালো বন্ধুর আশা তো ছিলই। নিনাদ শুধু প্রেমিক হিসেবেই নয় মানুষ হিসেবেও শ্রদ্ধেয়। জলধির প্রতিটি অনুভবকে সে সম্মান করে। জলধির নিজস্ব পরিসরে ঢোকে না।

‘আমরা কিন্তু কলকাতাতেই থাকব এবং এই বাড়িতেই থাকব। আই মিন এটাই তোমার শ্বশুরবাড়ি। তুমি যেমন খুশি সাজাও এই বাড়িটা। আমরা কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়া যাব না।’ কথা প্রসঙ্গে বেশ কয়েকবার নিনাদ কথাকটা বলেছে।

নিনাদের জেঠু জেঠিমা বিয়ের কিছুদিন আগে এসেছিলেন। নিনাদরা মানালিতে হনিমুনে গেলে তাঁরাও ক্যালিফোর্নিয়া ফিরে যান। জলধির খুব ইচ্ছে ছিল সে দেশে যাওয়ার। নিনাদ যতই বলুক ক্যালিফোর্নিয়াতে তো অবশ্যই আরেকটা শ্বশুরবাড়ি আছে জলধির। কিন্তু এক জীবনে সব আশা পূরণ হয় না। নিনাদে ডুবে গেছে জলধি। ক্যালিফোর্নিয়া না যাওয়া হলে না হবে। নিনাদের জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা এই ক্যালিফোর্নিয়ার জীবন, যা নিনাদ ভুলে থাকতে চায়। জলধি কখনওই সেখানে যাওয়ার আবদার করবে না।

দুজনের অফিস একই বিল্ডিঙে। ফলে যাতায়াতও কমবেশি একসঙ্গেই হয়। অফিস, বাড়ি, বেড়ানো সব জায়গাতেই জলধিকে চোখে হারায় নিনাদ।

‘আমার বাবা মার কথা জানার পর ক্যালিফোর্নিয়াতে একটা কথা আমাকে খুব ভাবাত। আমি কত আরামে থাকি আর কলকাতায় আমার বাবা মা কত কষ্টে থাকে। আমি বড় হয়ে কলকাতায় গিয়ে চাকরি করব। ওঁদের খুব যত্নে রাখব, আরামে রাখব। আমি এলাম, তুমিও এলে, কিন্তু ওঁরা কিছুই পেলেন না।’ জলধিকে বুকে টেনে বলেছিল নিনাদ। নুড়িপাথর বুকে নিয়েই যেমন মানালি শহরে বিপাশা নদীর নাচ, প্রবাহ, জলধিকে ঘিরে নিনাদেরও তেমন।

হনিমুনে আরও একটু ব্যক্তিগত উষ্ণতার কথা বললে জলধির বেশি ভালো লাগত। কিন্তু নিনাদের জীবনের এই ক্ষতমুখটি বোজার নয়। আদরের সময় জলধি বন্ধুতার থেকে বন্যতা খোঁজে বেশি। হনিমুনে যেমনটা হয়। কলকাতায় কটামাত্র দিন নিনাদ নিজের মাকে পেয়েছিল। নিনাদের চুলে বিলি কেটে দিতেন মা। নিনাদ জলধির চুলে বিলি কেটে দিতে ভোলে না। নিনাদের স্পর্শ অভিভাবকের। জলধি বুঝতে পারে।

কলকাতায় ফিরে চাকরি, সংসারে জড়িয়ে জলধি বুঝতে পারে সন্তান আসছে। বসন্তের বিয়েতে শ্রাবণেই হুড়মুড়িয়ে তার আসার ইঙ্গিত। জলধির ইচ্ছে ছিল নিনাদ, সংসার, শপিং, বেড়ানো ইত্যাদি… সন্তান আসুক বছর দুই পর। এমন তো নয় যে সে সন্তান চায় না, তবে দ্বিধা ছিল। কিন্তু নিনাদ নিশ্চিত যারপরনাই খুশি হবে।

মাথাঘোরা, বমিভাব, খাবারে অনীহা ইত্যাদিতে নিনাদ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ‘কী হয়েছে তোমার জল? কেন কিছু খাচ্ছ না? ডক্টরের কাছে যাই চলো এখুনি।’

‘যাব কিন্তু গায়ানকোলজিস্টের কাছে যেতে হবে আমাদের…’ জলধির ঔজ্জ্বল্যে নিনাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ হয়ে যায়। জলধি ভাবে নিনাদও কি তবে চায়নি এত তাড়াতাড়ি সন্তান আসুক! কিন্তু সে নিনাদকে যেভাবে চেনে তাতে…

আর ঠিক তখনই নিনাদ বলে ‘গাড়ি বুক করি। গাড়িতে অফিস যাবে তুমি, নয়ত আর অফিস যাবেই না। বাড়িতেই থাকবে।’

‘আমরা কিন্তু এখনও বাড়িতে। ডক্টরের কাছে যাইইনি। ডক্টর কী বলেন আগে দেখি। তারপর না হয় গাড়ি কেনা যাবে।’

‘আমি চাইলে অনেক আগেই গাড়ি কিনতে পারতাম। ইচ্ছে করেই কিনিনি। সাধারণ মানুষের মত বাসে অটোতে অফিস গেছি। কিন্তু এবার আমি গাড়ি কিনবই।’

তুমুল বৃষ্টির রাত। নিনাদকে জাপটে শুতে যায় জলধি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নিনাদ।

‘বি কেয়ারফুল জল…’ জলধির চুলে দূর থেকে বিলি কাটতে কাটতে বলে নিনাদ।

‘শুনলে না ডক্টর কি বলল। আমি একদম ঠিক আছি। সামনে অনেক খরচ। গাড়ি কেনার কোনও দরকার নেই এখন। যেমন অফিস যাচ্ছিলাম তেমনই যাব। সব্বাই তো যাচ্ছে। কে বাড়িতে বসে থাকে। তাছাড়া তুমি এসবের কী জানো? একটু কাছে এসো না প্লিজ।’

নিনাদকে রাজি করিয়ে জলধি অফিস যেতে থাকে। কিন্তু নিনাদ ভয় পায়, ভীষণ ভয়। জলধি বাথরুমে গেলে দরজা লক করতে দেবে না। নিনাদের সারাক্ষণ দুর্ভাবনা, জলধি যদি পড়ে যায়, যদি মিসক্যারেজ হয়ে যায়।

মাস ছয়েকের দাম্পত্যে জলধি এবার সামান্য হলেও গুমরোতে থাকে। নিনাদের অহেতুক আতঙ্কে জলধি যেন হাতপা বাঁধা হয়ে যাচ্ছে। নিনাদের শৈশবের জন্যই নিনাদ এই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগে। জলধি বোঝেও, তবু মাঝেমধ্যে মন খারাপ হয়। নিনাদকে ছাড়া জলধির বাপের বাড়িতেও যাওয়া চলবে না। প্রেগন্যান্সি সংক্রান্ত কথাবার্তা ছাড়া আর কোনও কথা নয়। জলধির কী কী করা উচিত আর কী কী নয় সেগুলোই বলতে থাকে নিনাদ। প্রেগন্যান্সি সংক্রান্ত বইও কিনে এনেছে।

“ভাঙা ঘরে দ্বার দিয়েছি— ঝড় উঠেছে, ঘরের মাঝে কাঁথা পেতেছি— শীত লেগেছে, তুই দুধের বাছা, আমার কোলে, বুকের কাছে ঘুম যা।” জলধির পেটে হাত বোলাতে বোলাতে নিনাদ সুর করে বলতে থাকে।

জলধি অবাক হয়। ‘কোথায় শুনলে তুমি এই লাইনগুলো?’

‘এই লাইনগুলোই শুধু নয় জল, ক্ষীরের পুতুল সবটা জানি। জেঠিমা বই পড়ে শোনাত।’

জলধির কোনও সমস্যাই তেমন নেই। নর্মাল প্রেগন্যান্সি। কিন্তু নিনাদের কড়াকড়িতে আট মাসের মাথাতেই জলধি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হল। জলধি অফিসে গেলে নিনাদ শান্তিতে অফিস করতে পারে না। অবশ্য জলধি বাড়িতে বসার পরেও যে নিনাদ শান্তিতে অফিস করছিল তা নয়। কিছুক্ষণ পরপর ফোন করে করে জলধির খবর নেওয়া। জলধি বাড়িতে বরং বোরই হচ্ছে। জলধির বাবা মা চাকরি করেন। তাঁদের পক্ষে এসে একটানা থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া জলধির শারীরিক পরিস্থিতিও তেমন নয়। নিনাদ রীতিমত বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। যে পরিমাণ খাবারদাবার কিনে এনে জলধিকে খেতে বলছে জলধি তা খেয়ে উঠতে পারছে না। শ্বশুরবাড়ির কোন ঝুটঝামেলা জলধির নেই। অথচ প্রথমবার মা হবার অনুভূতিটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে না নিনাদের জ্বালায়। রাতে শুয়ে কথা বলাও চলবে না।

‘ঘুম দরকার জল, ঘুমোও’ বলবে নিনাদ। নিনাদ অফিসে থাকাকালীন কথা বলতে ইচ্ছে করলে যদি ফোন করে তবে মনের কথাটা বলা হয়েই উঠবে না। কোয়েশ্চেনেয়ার দিয়ে দেবে নিনাদ। ঘুমিয়েছ, জল খেয়েছ, ফল খেয়েছ এইসব হাবিজাবি কথা। জলধি তাই ফোন করে না।

জলধিকে ন মাসের সাধ খাওয়াতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এলেন নিনাদের জেঠু জেঠিমা। সামান্য স্বস্তি পেল জলধি। নিনাদ তুলনায় স্বাভাবিক হল।

এলাহি সাধ অনুষ্ঠানের পর যথাসময় ফুটফুটে একটা মেয়ের মা হল জলধি। নিনাদ মেয়ের নাম দিল জাহ্নবী। জলধির মনোগত ইচ্ছে জাহ্নবীকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় যায়। নিনাদের ঐ দেশের সিটিজেনশিপ আছে, মেয়েরও হবে। কিন্তু নিনাদকে সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয় না। নিনাদ জানলে আর রক্ষে নেই। জাহ্নবীর অন্নপ্রাশনের পরপরই ফিরে গেলেন নিনাদের জেঠু জেঠিমা।

জেঠু জেঠিমা চলে যাবার পরেই নিনাদ বলে যে সে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবে। জাহ্নবীর জন্য হসপিটাল থেকেই ন্যানি নিয়ে এসেছে জলধি। জাহ্নবী তার কাছে ভালই থাকে। মাঝবয়সি মহিলাটি জলধির বাড়িতেই থাকে। জাহ্নবীকে যত্নেই রাখে। সে ভরসাতেই জলধি নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। নিনাদের একেবারেই পছন্দ ছিল না । কিন্তু জলধি জানে এরপর সে আর ভালো চাকরি পাবে না। জাহ্নবী হবার জন্য লম্বা গ্যাপ হয়ে গেছে। জলধি বাড়িতে থাকবে না বলেই নিনাদ ওয়ার্ক ফ্রম হোম করতে চাইছে। জলধি বোঝে বলেই বিরক্ত হয়।

‘নিনাদ এ কেমন কথা! তুমি বাড়িতে থেকে কাজ কেন করবে? কী দরকার? আমি ঠিক ম্যানেজ করে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসব। এখন মেয়ে সলিড খাবার খেতে শিখবে। ন্যানি ভালো করেই খাওয়াবে। তুমি বাড়ি থাকবে কী জন্য?’

‘আমি মেয়ের থেকে দূরে গিয়ে কাজ করতে পারব না। তাছাড়া আমার কাছে যখন ওয়ার্ক ফ্রম হোমের অপশান আছে তখন কেন নেব না?’

‘এটাতেই আমার আপত্তি নিনাদ। তোমার চারপাশে দেখো তো কেউ এমন করছে কিনা।’ জলধি যারপরনাই অবাক হয় নিনাদের সিদ্ধান্তে। কিন্তু এও জানে নিনাদকে তার সিদ্ধান্তের বাইরে আনা অসম্ভব।

‘কাকে তুমি ন্যানি বলছ জল? কিচ্ছু জানেন না। দেখছি তো… শি ইজ আ বেবি… তাকে বসানোর চেষ্টা এখনই… ফ্লোরে ছেড়ে দিচ্ছে … হাত মোছাচ্ছে না… খাওয়ানোর সময় নিজের নোংরা আঁচল দিয়ে মেয়ের মুখ মুছে দিচ্ছে। ওকে ট্রেন আপ করতে হবে জল… তুমি পারবে না… তুমি ওর ওপর ডিপেন্ড করছ বেশি। আমি শেখাব ন্যানিকে সব।’

‘সেটাই তো বলছি। তুমি বাড়িতে থাকলে এসবই করবে সারাদিন। ন্যানির পেছনে লেগে থাকবে। তাহলে কাজ কখন করবে নিনাদ?’ জলধি আপ্রাণ নিনাদের বাড়ি থাকার ব্যাপারটা ঠেকাতে চেষ্টা করে। খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু নিনাদের স্বরে উষ্মা প্রবল। নিনাদের যে শীতল ধারাস্রোত, যে ব্যথা জলধিকে জারিত করেছিল আজ তা নেই। এই কথাস্রোতের তাত বেশি। জলধির সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। সে নিজে মা হিসেবে অতিরিক্ত উদাসীন নাকি বাবা হিসেবে নিনাদ অতীব কেয়ারিং!

প্রতিদিন বাড়ি ফিরে নিনাদ আর ন্যানির দু তরফা আলাদা আলাদা দোষারোপ শুনতে শুনতে হতোদ্যম হয়ে পড়ছে জলধি। তবে ন্যানির কথার প্রতিটি যুক্তিই সঠিক।

‘দাদাবাবু যা করতেছেন তাতে তোমার মেয়ে কিসুই শিখবে না গো। বাচ্চারে তো ছাড়তি হবে নাকি। ছেড়ে দিয়ে চোখে চোখে রাখতি হবে। আমরা হলাম মায়ের জাত। তার ওপর এই বাচ্চা রাখার কাজ করছি কতদিন। এক এক বাড়িতে কতবছর কাজ করেছি। আমার কাছে বাচ্চা রেখে মা বাবা দুজনেই চাকরিতে গেছে। দাদাবাবু ঘরে থেকে ঝামেলি। বোঝেন কি উনি সব? বাচ্চাটারে মোটে উঠতে দেবেনি বিছনা ছেড়ে। মাটিতে বসাতে দেবেনি।’

‘তুমি অন্য ন্যানি রাখো জল। ট্রেনড হওয়া চাই। শি নোজ নাথিং।’ বেডরুমে ঢুকতেই নিনাদের অভিযোগ।

জলধির মনে হতে থাকে নিনাদের জেঠু জেঠিমার কথা। তাঁরা বাড়িতে থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকত বা বলা ভালো জাহ্নবী ভালো থাকত। সারাদিন নিনাদ মেয়েকে নিয়ে বসে থাকছে। মেয়েকে নড়াচড়া করতে দিচ্ছে না, খাট থেকে নামতে দিচ্ছে না।

‘আজ তিনদিনে পড়ল মেয়ে হাগেনি। আর হাগবেও না। নড়াচড়া নেই, হামা টানা নেই, খিদে পাবে কী করে? খাচ্ছেও না, হাগছেও না। আমি কোনও বাচ্চারে তোমাদের ঐ পটিতে বসিয়ে হাগাই না। যেখানে যাবে পটি ঘাড়ে করে নিয়ে যাবে নাকি? আমার দুপায়ের মাঝে মেয়েরে বসাতে যেতেই দাদাবাবু কি একটা বলে তেড়ে এল। মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটার পেট ফাঁপছে দেখো গে।’

বেড রুমে উঁকি দিয়ে জলধি দেখল মেয়ে উঠে বসতে চাইছে। নিনাদ তাকে শুইয়ে রাখতে চাইছে। গান গাইবার মত করে লাইন কটা বলছে আর জাহ্নবীর মাথায় হাত বুলোচ্ছে।

“ভাঙা ঘরে দ্বার দিয়েছি— ঝড় উঠেছে, ঘরের মাঝে কাঁথা পেতেছি— শীত লেগেছে, তুই দুধের বাছা, আমার কোলে, বুকের কাছে ঘুম যা।”

নিনাদের কলিগের সঙ্গে আজ কথা হয়েছে জলধির। নিনাদ কোনও কাজই করছে না। নিনাদের চাকরিটা আর থাকবে না। নিনাদকে নাকি সে ইঙ্গিত দেওয়াও হয়েছে। অথচ নিনাদের কোনও হেলদোল নেই। সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়ে পড়ে আছে।

পিডিয়াট্রিশিয়ানের সঙ্গে একবার কথা বলবে ভাবে জলধি। মেয়ে বা নিনাদ কাউকেই নিয়ে যাবে না। নিনাদ গেলে সমস্যাটা বলাই যাবে না। নিনাদের চাকরি চলে গেলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। শুধু যে টাকাপয়সায় টানাটানি হবে তা তো নয়, ন্যানির সঙ্গে সারাদিন খুঁটিনাটি লেগেই থাকবে। মহিলাটি কাজ ছেড়ে দেবে। জলধিও শান্তিতে নিজের চাকরিটা চালিয়ে যেতে পারবে না। অথচ জাহ্নবীর যে তিনদিন পটি হচ্ছে না, খাচ্ছে না এসব মাথায় নেই নিনাদের।

পিডিয়াট্রিশিয়ানের পরামর্শ মত জলধি নিনাদকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। জাহ্নবী যে দেখতে দেখতে ন মাসে পা দিল, তাকে যে সারাদিন শুইয়ে রাখা চলবে না, কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে জাহ্নবীকে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না ইত্যাদি যথাবিধি বোঝায় জলধি। নিনাদ চেঁচামেচি, ঝগড়ার মানুষ নয়। সে নিজের জায়গা থেকে নড়ে না। জলধির কথাগুলো শুনতে শুনতে মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।

‘কী বলে যাচ্ছি তাহলে নিনাদ… কেন কোলে রাখছ ওকে… ফ্লোরে ছেড়ে দাও, বসুক, পড়ে যাক, হামা টানুক… যা খুশি করুক… ওরও কিন্তু স্পেস দরকার নিনাদ।’

“ভাঙা ঘরে দ্বার দিয়েছি— ঝড় উঠেছে, ঘরের মাঝে কাঁথা পেতেছি— শীত লেগেছে, তুই দুধের বাছা, আমার কোলে, বুকের কাছে ঘুম যা।” নিজের সুরে গেয়ে যায় নিনাদ।

‘নিনাদ এখন ওর ঘুম পায়নি। ঘুমের সময়ও নয়। ঘুম পেলে, ও নিজেই ঘুমোবে। নড়াচড়া না করলে, না খেললে কী করে ঘুম পাবে ওর? প্লিজ তুমি ওকে একটু ছেড়ে দাও। এসো না আমরা একটু গল্প করি।’

এভাবে হবে না। আমার পক্ষে তোমাকে বোঝানো অসম্ভব নিনাদ। তোমার চাকরিটা আর নেই নিনাদ। তুমি এর গুরুত্বটা বুঝতেই পারছ না। তিন মাসের মাইনে দিয়ে বসিয়ে দেবে তোমাকে। কে তোমাকে বোঝাতে পারবে! আমি কেন পারছি না! নিনাদের গুনগুন গান ভেদ করতে পারে না জলধির উদ্বেগ। এমন অদ্ভুত সমস্যার কথা বাবা মাকে বলতেও ইচ্ছে করে না জলধির। নিনাদকে বড় ভালোবাসেন জলধির বাবা মা। হয়ত বিশ্বাসই করবেন না। কিন্তু জানাতেই হবে জলধিকে। একার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। নিনাদ অসম্ভব জেদি।

জাহ্নবীর বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক করে তুলতে হলে নিনাদের থেকে সাময়িকভাবে ওকে আলাদা করতেই হবে। নিনাদ কারও কাছেই জাহ্নবীকে ছাড়তে চায় না। নিনাদের শৈশব হয়ত এর প্রধান কারণ। বাবা মাকে ছেড়ে এবং জেঠিমার অতিরিক্ত কেয়ারিঙে নিনাদের ভেতরে নিশ্চয়ই এক ভয় কাজ করে, যা সে অতিক্রম করতে পারে না। এই ভয় কাটাতে প্রফেশানাল হেল্প চাই, কাউন্সেলিং চাই। জলধির পক্ষে নিনাদকে বুঝিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

নিনাদের জেঠু জেঠিমাকে বিষয়টি জানায় জলধি। তাঁদের আসতে অনুরোধ করে। নিনাদ বিন্দুবিসর্গও জানতে পারে না। মেয়ের মত বাড়িও তার প্রাণ। নিনাদ কিছুতেই জলধির বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকবে না। যেদিন ভোর সকালে তাঁরা এসে পৌঁছবেন, তার আগের মাঝরাতে যখন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে নিনাদ, জাহ্নবীকে নিয়ে বাপের বাড়ি রওয়ানা হয় জলধি।