Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মারি, তালা-চাবি আর মন

কৌশিক দত্ত 

 



লেখক স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ, কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার।

 

 

 

মানুষ যদিও বেঁচে থাকাটা টের পায় তার মনে এবং সূক্ষ্ম বিচারে কেউ বলতে পারেন যে আসলে মনটাই বাঁচে শরীরকে আশ্রয় করে, তবু চোখে তো পড়ে আধারটাই… আধারটুকুই। চর্মচক্ষে শরীরের বেড়ে ওঠা আর ক্ষয়ে যাওয়া দেখা যায়। মনের আকার-আকৃতি কে কবে দেখেছে? মানুষের অস্তিত্বের ব্যবহারিক সংজ্ঞা তাই মূলত শরীরকে অবলম্বন করে নির্মিত। যখন আমরা মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বলি, খুব সচেতন না হলে সাধারণত শরীরের কথাই বলি। চিকিৎসক (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ব্যতীত), জনস্বাস্থ্য আধিকারিক, জনদরদী স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী বা রাজনৈতিক কর্মী… সকলেই ভাবিত থাকেন মূলত মানুষের শরীর নিয়ে। শরীর বাঁচাতে গিয়ে মন অবহেলিত হয় প্রায়শই। মহামারির সময় তো কথাই নেই। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আর সবকিছু চাপা পড়ে যায়, বিশেষত মানবিক গুণাবলী। মন হল গিয়ে “মানবিক” আর শরীর “জৈবিক”। মহামারি হল জৈবিক অস্তিত্বের সঙ্কট এবং যেন-তেন প্রকারে সেটুকুকে রক্ষা করার লড়াই।

কোভিড-১৯ অতিমারির লগ্নেও মানুষের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল তেমনই, কিন্তু মন তো নিজের কষ্ট আর অস্তিত্ব জানান দেবেই। সোশাল মিডিয়ার প্রসারের দৌলতে অন্যের মনের খবর আজকাল আমরা তাড়াতাড়ি পাই। দেখে ভালো লাগছে, এই মহামারির সময়ে সোশাল মিডিয়ায় এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও মানুষের মনের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। এসব কথা এবার বেশ তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। পাশাপাশি শুরু হয়েছে করোনাতঙ্কে আত্মহত্যার ঘটনাও, যা দুশ্চিন্তার কারণ। বেশ কিছু ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে শরীরের পাশাপাশি মনেরও যত্ন না করলে শরীরটাও বাঁচবে না।

মহামারির লগ্নে মানসিক স্বাস্থ্য বা তার সমস্যাকে বুঝতে চাইলে শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষ বা স্নায়ুবিজ্ঞানের উপর নির্ভর করলে চলবে না, অবলম্বন করতে হবে Bio-psycho-social মডেলটিকে। সমাজের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিকে বুঝতে হবে। অবশ্যই প্রত্যেকের নিজস্ব মানসিক ও শারীরিক গঠন সেই মানুষটির মানসিক স্থিতি বা অস্থিতির উপর প্রভাব ফেলবে। সামগ্রিকভাবে এই সবরকম বিষয়ের আলোচনা একটি প্রবন্ধে সম্ভব নয়। আপাতত এই মহামারি ও লকডাউন সংক্রান্ত সেইসব বিষয়ের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকব, যা একসঙ্গে অনেক মানুষকে প্রভাবিত করবে।

এই মুহূর্তে মানুষের মানসিক চাপ এবং মনোরোগ বেড়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা একাধিক সমস্যার সহাবস্থানের ফলে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে কোনটা বা কোনগুলো কাকে/ কাদের কতটা তীব্রভাবে আক্রমণ করবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করবে ব্যক্তির আর্থসামাজিক অবস্থানের উপর। “আর্থসামাজিক” শব্দবন্ধটা আমরা যখন উচ্চারণ করি, তখন সাধারণত অর্থনৈতিক দিকটির উপরেই বেশি গুরুত্ব দিই, কিন্তু মনের উপর মহামারির প্রভাব প্রসঙ্গে আলোচনায় আর্থিক ও সামাজিক দুই দিককেই গুরুত্ব দিতে হবে। কিছু বিষয় কমবেশি সবাইকেই বিব্রত করবে, আবার কিছু সমস্যার বাস্তব প্রভাব হবে নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক অবস্থানের মানুষের উপরেই সবচেয়ে প্রকট।

আলোচনার সুবিধার্থে এক, দুই করে বিভিন্ন ধরণের সমস্যার কথা বলা যাক।

১) ছোঁয়াচে রোগের মহামারি। নিজে মরে যাবার ভয়। প্রিয়জনকে হারাবার ভয়। নিজে রোগের বাহক হয়ে প্রিয়জনের শরীরে জীবাণু চালান করে তাঁদের মৃত্যুর কারণ হতে পারি, এই আশঙ্কা এবং আগাম অপরাধবোধ। এই ভয় সব ধরনের মানুষকেই গ্রাস করেছে বা করছে। দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সাহসী মানুষেরাও মরতে ভয় পান। কেউকেউ ভয়টা প্রকাশ করতে পারেন। অনেকের ঘাড়ে আবার সাহসী মুখোশ এঁটে থাকার দায়। সাহস হয়ত এঁদের সামাজিক সম্মানের বা ‘ফ্যান ফলোয়িং’-এর অন্যতম ভিত্তি। মৃত্যুভয় স্পষ্ট হয়ে গেলে সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর সম্মান হারানোর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন তাঁরা। এর ফলে নিজের আতঙ্ক অন্যের কাছে প্রকাশ করে হাল্কা হতে পারেন না এঁরা এবং অন্তর্লীন চাপে আর তাপে সেদ্ধ হতে থাকেন প্রেশার কুকারের ভাতের মতো।

নিজের জীবন-মৃত্যু নিয়ে যাঁরা বাস্তবেই কম ভাবেন, তাঁরাও প্রিয়জনকে হারাবার ভয়ে কাতর হন। খুব বেশি মানুষকে ভালোবাসতে শিখিনি আমরা অনেকেই। তবু সন্তান, স্ত্রী/স্বামী, বাবা-মা, কোলেপিঠে মানুষ করা মাসি-পিসি-দিদা বা কোলে বড় হওয়া ভাইঝি-বোনপো, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের হারাতে আমরা ভয় পাই। এই ভয় একজিস্টেন্সিয়াল। আমাদের অস্তিত্ব ছিঁড়ে যাবার ভয়। এই ভয় নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু নেই, একে লুকোনওর প্রয়োজন নেই। বরং এর মোড়ক খুলে পাশের মানুষের ভয়ের সঙ্গে নিজের ভয়কে মিলিয়ে নিতে পারলে এর ধার আর ভার খানিক কমতে পারে। পরস্পরকে সান্ত্বনা দেবার সুযোগটুকু তৈরি হয়।

২) অনিশ্চয়তা মানুষের পক্ষে রোমহর্ষক। শুধু মানুষের জন্যই নয়, যেকোনও প্রাণীর জন্য একথা সত্য। যেকোনও একটি ঘটনা নিয়মিত ব্যবধানে প্রত্যাশিতভাবে ঘটতে থাকলে আমরা ক্রমশ তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি, তার সঙ্গে জড়িত রোমাঞ্চ কমে যায়, তা সেই রোমাঞ্চ আতঙ্কের হোক বা পুলকের। যদি ঘটনাক্রম সম্বন্ধে নির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করা না যায়, তার নির্দিষ্ট ক্রম ও সময়সীমা না থাকে, তবে আমাদের ভেতরে উদ্বেগ (anxiety) নামক আবেগ (emotion)টি জাগরুক হয়ে ওঠে। এরকম হওয়া প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি। এমন পরিস্থিতিতে যে প্রজাতির মানসিক শান্তি ক্ষণিকের জন্যও ব্যহত হয় না, উদ্বর্তনের পরীক্ষায় সেই প্রজাতির পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। আসলে বিপদ যে আসে এরকম অনিশ্চিতভাবেই, অনিয়মিত নড়াচড়া বা সহসা অস্বাভাবিকতার রূপ ধরেই। তাকে চিহ্নিত করতে না পারলে, স্নায়ু টানটান হয়ে না উঠলে মৃত্যু ধেয়ে আসতে পারে।

একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। ধরা যাক জঙ্গলের মধ্যে সবুজ দূর্বাঘাসের কার্পেট বিছানো এক মাঠে এক মনোরম সকালবেলায় প্রাতরাশ সারছে একদল হরিণ। হাওয়ায় দুলছে ঘাস, আশেপাশের গাছপালা, ঝোপঝাড়। এইসব দোলনই হচ্ছে ছন্দোবদ্ধভাবে, হাওয়ার তালে তালে। হঠাৎ উত্তর-পূর্ব কোণের একটা ঝোপ বেখাপ্পাভাবে দুলে উঠল। একটু পরে পাশেরটা। ছন্দপতন। প্রথম যে হরিণটির চোখে পড়বে এই অনিয়মিত অপ্রত্যাশিত নড়াচড়া, সে সচকিত হবে। উৎকর্ণ হবে। তারপর হয় ডেকে উঠবে, নাহয় ছুট লাগাবে। তার পিছন পিছন দৌড়বে হরিণের দল, ঝোপের আড়ালে লুকোনো বাঘের থাবা এড়িয়ে আরেকটা দিনের দিকে। এভাবেই বাঁচে প্রাণীকুল। “অনিশ্চয়তা = ভয়” এই সমীকরণকে প্রাথমিকভাবে সত্য ধরে নিয়েই বাঁচে। তাতে দু-চারবার ভুলও হয়। সেই ভুলকে “erring on the safer side” বলা যায়। বিবর্তন এই জাতীয় ভুলকে বরদাস্ত করে, কারণ ঠিক বিপরীত ভুলের জন্য মাশুল দিতে হয় অনেক বেশি। এই কারণেই কোনও অজানা, নতুন জিনিসকে প্রাণীরা প্রথমে ভয় পায়। কিছু সময়ের মধ্যে সেই নতুন বস্তু বা প্রাণী কোনও ক্ষতি না করলে ক্রমশ কৌতূহলী হয় সেই অচেনার বিষয়ে, কিন্তু তাকে নিরীক্ষণ করে অতি সাবধানে।

অতএব নতুনত্বকে সমীহ করা এবং অনিশ্চয়তাজনিত অ্যাংজাইটি অনুভব করা বেঁচে থাকার আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আতঙ্কে পরিণত হলে উপকারের বদলে অপকার করতে পারে। একদম সামনে বাঘ দেখলে আতঙ্কিত হরিণের পা অসাড় হয়ে যেতে পারে, সে হারাতে পারে পালানোর বা লড়াই করার ক্ষমতা। এই মুহূর্তে এক অদৃষ্টপূর্ব অতিমারির সম্মুখীন হয়ে একদল মানুষ যখন বিপদকে সঠিক মাত্রায় সমীহ করে নিজেদের পরিমিত উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে প্রাণপণে লড়তে চেষ্টা করছেন, অন্য অনেকেই তখন আতঙ্কের আতিশয্যে অভিভূত হয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়, হতাশ, অবসন্ন হয়ে লড়াই করার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলছেন। অবশ্য এর বাইরে আছেন আরেকদল মানুষ, যাঁরা সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে চাইছেন না। এঁদের মধ্যে কারও কারও বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত সমস্যাটিকে লঘু করতে পারার সঙ্গে। আবার কেউকেউ বাস্তবে এতটাই ভয় পাচ্ছেন যে ভয়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করে নিজেদের প্রবোধ দিতে চাইছেন, মনস্তত্বের ভাষায় একে “denial” বলা চলে। অবশ্যই যে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের দ্বারা সমস্যার গভীরতা মাপতে চাইছেন এবং নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কারণে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ থেকে বিপর্যয়ের স্পষ্ট সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রমাণ হাতে আসার আগে বিপদের সম্ভাবনা আগাম মেনে নিতে রাজি নন, তাঁদের এই হিসেবের মধ্যে রাখছি না।

৩) এবার ভাবুন, পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে লড়াই করা বা দৌড়নো বারণ? ধরুন হরিণটি বাঁধা আছে গাছের গুঁড়িতে আর এগিয়ে আসছে বাঘ। আর্তনাদ বা ছটফট করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না হরিণ বেচারার। এই মুহূর্তে এই অতিমারি ও লকডাউনের ফলে অনেকের বাস্তব পরিস্থিতি হয়েছে এরকমই। সাধারণত কোনও বিপদের মোকাবিলা করার এবং বিপদ থেকে প্রিয়জনদের আড়াল করার যে পদ্ধতি আমরা শিখেছি, তা হল এগিয়ে গিয়ে বিপদকে রুখে দেওয়া, প্রয়োজনে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অচল। নির্দিষ্ট কিছু পেশার মানুষকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এগিয়ে যেতে হবে বিপদের মোকাবিলায় শুধুমাত্র তাঁদের জন্য বরাদ্দ কাজটুকু করতে এবং সেই এগোনোর মধ্যেও প্রয়োজনাতিরিক্ত জীবনের ঝুঁকি নেওয়া বারণ, হিরোইজম ব্রাত্য এবং যথোপযুক্ত বর্ম পরা আর সাবধানতা অবলম্বন করা বাধ্যতামূলক। বাকিদের হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া বারণ। এগোলে সুবিধের চেয়ে অসুবিধে বেশি হবে। তাঁদের বীরত্বের কারণেই তাঁদের প্রিয়জনের মৃত্যু হতে পারে। হাত গুটিয়ে গৃহবন্দি হয়ে বসে থাকাই তাঁদের জন্য বরাদ্দ ভূমিকা এই নাটকে। চোখের সামনে শহরকে মৃত্যুদূতের কবলে যেতে দেখলেও তেড়ে যাবার উপায় নেই, মাথায় চেপে বসা বোলারকে থামানোর জন্য স্টেপ আউট করে ছক্কা হাঁকানোর জো নেই। হাত-পা বাঁধা হরিণের মতো অনুভূতি হতেই পারে। বস্তুত বীরত্ব আর পৌরুষের ধারণা এই মহামারিতে এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা অস্বস্তিদায়ক… শুধু পুরুষের পক্ষেই নয়, পৌরুষের ছত্রছায়ায় নিশ্চিন্ত থাকতে অভ্যস্ত আবালবৃদ্ধবনিতার পক্ষে।

৪) লকডাউন এই হাত-পা বাঁধা অবস্থাটাকে আরও সমস্যাজনক করে তুলেছে। এই অতিমারি এবং লকডাউনের কারণে যেসব অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তা মানুষকে গ্রাস করছে, তা শুধুমাত্র রোগকেন্দ্রিক নয়, প্রবলভাবে অর্থনৈতিকও বটে। খাদ্যের অনিশ্চয়তা, জীবিকার অনিশ্চয়তা। কবে এই রোগের প্রকোপ স্তিমিত হয়ে আসবে, কবে লকডাউন উঠবে, সেসব কথা কেউ জানে না। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চলতে থাকলে খাবার-দাবার ঠিকমতো পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সচ্ছল মধ্যবিত্তরাও চিন্তিত। লকডাউনের আভাস পেয়েই বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন অগণিত মানুষ। সাধ্যমতো বাজার করেছেন অনেকেই। এক-দেড় মাসের রসদ জমা করেছেন অনেকে। এমন করার পিছনে যে মনোভাব কাজ করে, তার মধ্যে মিশে আছে আতঙ্ক আর আত্মকেন্দ্রিকতা। খাবার পাওয়া যাবে কিনা/কী খেয়ে বাঁচব?— এই আতঙ্ক। খেয়াল করুন, এই আতঙ্ক কিন্তু গোষ্ঠীর জন্য নয়, নিজের জন্য। “আমরা” নয়, “আমি” কী খাব, এই ভাবনা এসেছে। বলতেই পারেন যে শুধু নিজের কথা ভাবেননি, পরিবারের কথা ভাবছিলেন। অতএব “আমরা”। পরিবার আসলে খুব ছোট “আমরা”। বর্তমান সামাজিক কাঠামোয় পরিবার হল “আমি”র একটা সম্প্রসারিত সংস্করণ মাত্র। অবশ্য এটুকু প্রসারিত হতে পারা মন্দ নয়, বিশেষত যেখানে পরিবারের মধ্যেও স্বার্থের হানাহানি ক্রমশ বাড়ছে।

না, কাউকে আচমকা মহৎ হতে বলা হচ্ছে না। কারও নিন্দা করাও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। শুধু নিজেদের মনের ভেতরটাকে চেনা দরকার, কারণ মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির পথে সেটা প্রথম ধাপ। এটুকু বোঝা দরকার যে একটি অচেনা ভাইরাসের মুখোমুখি হয়েও আমরা মোটেই মানবপ্রজাতি হিসেবে বা নিদেনপক্ষে দেশবাসী, রাজ্যবাসী বা নগরবাসী হিসেবে একজোট হতে পারিনি। খাদ্যের জোগান কম পড়তে পারে ভাবামাত্র আমরা প্রতিযোগিতার মানসিকতায় চলে গেছি। অন্যদের হারিয়ে দিয়ে নিজের আর নিজের পরিবারের জন্য প্রচুর খাবার জমিয়ে ফেলতে হবে। কিনে ফেলতে হবে অজস্র মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ওষুধ। জমাতে হবে এসব। তাতে যদি এসব জিনিসের কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি হয়, দাম বেড়ে যায় আর কেউ খুব প্রয়োজনেও কিনতে না পারে? তাহলে কী হবে? সেসব আমরা ভাবিনি। না, আমরা সজ্ঞানে কারও মৃত্যুকামনা করিনি (বেশিরভাগ মানুষের কথা বলছি), কিন্তু নিজের চিন্তায় এত মশগুল ছিলাম যে অন্য কারও কথা ভাবারই সুযোগ পাইনি।

নিজেকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতে থাকলে কখনওই নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। চাহিদা আর নিরাপত্তাহীনতার বোধ হাত ধরাধরি করে বাড়তে থাকে। একইসঙ্গে ক্রমশ অসম্পৃক্ত হয়ে যেতে হয় বাকি পৃথিবী থেকে। একাই বাঁচতে হবে, একাই লড়তে হবে, একাই বিপন্ন হতে হবে, একাই মরে যেতে হবে… এমন মনে হতে থাকে। যে মানসিকতার দরুন তিনজনের পরিবারের জন্য এক কুইন্টাল চাল একবারে কিনে জমাতে ইচ্ছে করে এই দুঃসময়ে, সেই মানসিকতাই মানুষকে অন্তরে জনবিচ্ছিন্ন, বিপন্ন ও প্রবল উদ্বিগ্ন করে তোলে। এহেন বিপন্নতা মৃত্যুরও কারণ হতে পারে… আত্মহত্যাই হোক বা হৃদরোগ বা স্ট্রোককে ত্বরান্বিত করাই হোক।

নিঃস্বার্থ হতে বলা হচ্ছে না। জীবজগতে নিঃস্বার্থ কেউ না। সম্পূর্ণ স্বার্থবোধহীন হওয়া প্রকৃতিবিরুদ্ধ। নিজের স্বার্থেই জীবেরা মিলেমিশে বেঁচে থাকে। নিজেদের স্বার্থেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছিল। প্রযুক্তির খুব বেশি উন্নতি হবার ফলে যন্ত্রপাতির সাহায্যে আজকাল একাই অনেককিছু করে ফেলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে একাই বেঁচে থাকা যায়, তাই সমাজ বা সমষ্টিকে ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে অনেকেরই। ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে আমাদের গোষ্ঠীচেতনা। সেই চেতনাকে এই অবকাশে জাগিয়ে তুললে মন্দ হয় না। “আমি” বোধকে অবলম্বন করেই বাঁচবে প্রত্যেক ব্যক্তি, শুধু সেই ‘আমি’র সামান্য প্রসারণ জরুরি। আমাদের অনেকের আমিত্বের সঙ্গে এখনও জড়িয়ে আছে পরিবার। খাদ্যের অনটন হবে ভাবলে পরিবারের পেটের কথা ভাবি। তাই পরিবারও আমাদের কথা ভাবে, আমাদের আশ্রয় দেয়। যদি আমার আমি-কে আরেকটু বড় করে নিজের পাড়া, নিজের শহর, নিজের রাজ্য, নিজের দেশ, নিজের প্রজাতি, নিজের পৃথিবীকে নিজের সত্তার সঙ্গে কিছুটা যুক্ত করতে পারি, তাহলে সত্তার অংশ হওয়া সেইসব সমষ্টির জন্য যেমন আমি ভাবব, তেমনি আমার জন্যেও তারা ভাববে। তখন আর আমার খাবার, ওষুধ জোগাড় করার সম্পূর্ণ দায় আমার একার ওপর থাকবে না। সমষ্টির ঘাড়ে নিজের দুশ্চিন্তার বোঝা খানিকটা চাপাতে পারলে মনও ভারমুক্ত হবে। ব্যষ্টির পক্ষে যে বিপদ খুব বড়, সমষ্টির পক্ষে তা তত ভয়াবহ নয়। এভাবে দেখতে পারলে পালানোর বদলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা পাওয়া যায় অনেক সহজেই।

জীবিকা নিয়েও বিপুল চিন্তা। সরকারি কর্মচারীরা হয়ত এই ব্যাপারটুকুতে নিশ্চিন্ত, কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মীরা প্রায় সকলেই কমবেশি উদ্বিগ্ন… চাকরি থাকবে কিনা, মাইনে কমে যাবে কিনা, দোকান বা ব্যবসার কী দশা হবে? এরকম হাজার চিন্তা, যা অতি গুরুতর, কারণ জীবিকার নিশ্চয়তার উপরেই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের বেঁচে থাকা। এই উদ্বেগ অত্যন্ত ন্যায্য এবং একে অগ্রাহ্য করতে বলার কোনও উপায় নেই।

এবার খাদ্য, জীবিকা ইত্যাদির প্রশ্নে দরিদ্র, গৃহহীন, কর্মহীন বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের কথা ভাবুন। দুইমাস কেন, চার-পাঁচদিনের খাবার একবারে কিনে ফেলার ক্ষমতাও বহু মানুষের থাকে না। অনেকের কাছেই এই মুহূর্তে আগামীকালের খাদ্যের নিশ্চয়তা নেই। লকডাউনের ফলে যে হাত-পা বাঁধা পরিস্থিতি, তাও সবচেয়ে মারাত্মক এঁদের ক্ষেত্রেই। মনে করুন আপনার শিশু সন্তান অভুক্ত এবং অসুস্থ। আপনার হাতে পয়সা নেই। আপনি কিছু কাজ জানেন… ছুতোরের বা কামারের। অথবা প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করতে পারেন। অন্য সময় হলে কারও বাগানে আগাছা সাফ করে বা ইটের পাঁজা বয়ে দিয়ে কিছু রোজগার করে আনতেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্যও। এখন তার উপায় নেই, কারণ চারিদিকে সব বন্ধ। আপনার দক্ষতা বা শক্তি থাকা সত্ত্বেও কিছু করার উপায় নেই, হাত-পা বাঁধা। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, ততদিন আর শরীরে শক্তি থাকবে কিনা, সন্তান সেই সুদিন দেখতে পাবে কিনা, কিছুই জানেন না। এই মানুষের উদ্বেগ আর অসহায়তার কথা ভাবুন।

ভাবুন সেই শ্রমজীবী মানুষের কথা, যিনি কখনও নিজের আত্মসম্মান বিক্রি করেননি, পরিশ্রমের দ্বারা নিজের পেটের ভাত জোগাড় করেছেন। ভিনরাজ্যে কর্মরত সেই শ্রমিকের কাছে আজ কোনও সঞ্চয় অবশিষ্ট নেই, বাড়িওয়ালা উৎখাত করেছে। কোনও দয়ালু ধনাঢ্য ব্যক্তির অনুকম্পার ভাত তাঁকে খেতে হচ্ছে জনসমক্ষে রাস্তায় বসে আর সেই ছবি ক্যামেরাবন্দি করছে কেউ। তিনি খেতে-খেতে কাঁদছেন অথচ অপমানের ভাতটুকু ফেলে উঠে যেতেও পারছেন না, কারণ বাঁচতে হবে আর তার জন্য হাঁটতে হবে আরও দেড়শো মাইল নিজের গ্রামের দিকে। আমরা শহুরে ভদ্রলোক। অনাহার জানি না, কিন্তু মানসম্মানের ব্যাপারটা তো বুঝি। এই মানুষটির যন্ত্রণা বুঝব না?

জীবিকার অনিশ্চয়তাও এঁদেরই সবচেয়ে বেশি। রাস্তার মোড়ে পরোটার দোকানটা কি আর চালু করা যাবে? দিল্লির যে ছোট গ্যারেজ বা কারখানায় কাজ করে পেট চলছিল, সেটা কি আবার খুলবে? বুলন্দসহর থেকে আবার ফিরে যাওয়া যাবে দিল্লি অব্দি? মুম্বাইয়ের স্বর্ণকার কি আবার কাজে ফেরাবেন মুর্শিদাবাদের শ্রমিকটিকে? ফেরালে সে কবে? মাইনে ঠিক থাকবে? যোধপুর পার্কের বাড়িতে কি আবার কাজে নেবে ক্যানিং-এর মহিলাটিকে? ততদিন বাঁচার উপায়ই বা কী?

এইসব মানুষের এইসব দুশ্চিন্তার গভীরতা মাপার ক্ষমতা আমাদের নেই। মাপতে পারলে বুঝতাম অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কের সামান্যই আমরা দেখেছি৷ সমষ্টির কথা ভাবতে পারার এও এক সুবিধে, নিজের বোঝাটাকে হাল্কা মনে হয়। রাষ্ট্র ও সমাজ নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে এঁদের পাশে না দাঁড়ালে, করোনার দিনগুলোতে এঁদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকার করে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে না নিলে এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে কোনও আলো ফুটবে না। কয়েকটি রাজ্য সরকার নিজেদের দায়িত্ব স্বীকার করে অন্তত অনাহারে মৃত্যুটুকু রুখে দেবার অঙ্গীকার করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার অন্তত মৌখিকভাবে দায় এড়ানোর কথা বলেননি। সমাজের অংশ হিসেবে আমরাও যদি এঁদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি, তাহলে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষেও তা ভালো হবে।

৫) সময়ের ভার। এও এক বড় ভার। অবসরের পর অনেকেই একে সামলাতে হিমসিম খান। এখন শুধু বৃদ্ধেরা নন, অল্পবয়সিরাও হাতে পেয়ে গেছেন হঠাৎ অনেকটা সময়, অথচ যেসব কাজে তাঁরা অভ্যস্ত, তার অনেকগুলোই করার উপায় নেই। যাঁরা কর্মমুখর জীবনযাপন করেন, অনেক চলাফেরা করেন, তাঁদের যদি হঠাৎ সব কাজ বন্ধ করে বসে যেতে হয় দীর্ঘদিনের জন্য, তাহলে চরম অস্থিরতা অনুভূত হতে পারে মানসিক এবং শারীরিকভাবে। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকাও কঠিন মনে হতে পারে। এমনটা হওয়ার স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, যার জটিলতা এড়িয়ে যেতে চাইছি।

প্রশ্ন হল, উপায় কী? মনকে শান্ত, সংহত করে ফেলতে পেরেছেন যাঁরা, তাঁদের এরকম হবে না। যোগ, ধ্যান, মনোসংযোগের বিবিধ প্রাচীন ও নতুন প্রণালী অবলম্বন করে এই পথে এগোনো যায়। এসব পদ্ধতির সঙ্গে ধর্ম ব্যাপারটা নানাভাবে জড়িত বলে এগুলো নিয়ে অনেকের অস্বস্তি থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এই অভ্যাসগুলোর সঙ্গে ধর্ম বা ভগবানের কোনও যোগ নেই। এসব অভ্যাস মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার পদ্ধতি মাত্র। ধর্মীয় সাধনার একটা ধাপ হিসেবে এগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। আপনি ধর্মহীনভাবেও ব্যবহার করতে পারেন, ঠিক যেমন বিদ্যুতের সাহায্যে আলোও জ্বালানো যায়, আবার পাখাও চালানো যায়।

তবে এই মুহূর্তে এইসব পদ্ধতি অবলম্বন করার পরামর্শ দেব না। এসব পথে ফল পেতে গেলে অভ্যাসের প্রয়োজন, যা সময়সাপেক্ষ। এরকম সময়ে মাথায় একরাশ চিন্তা আর শরীরে ছটফটানি নিয়ে ছবিতে দেখা মেয়েটির মতো ধ্যানাসনে বসে ‘মেডিটেশন’ অভ্যাস করতে চেষ্টা করলে হয়ত আরও বেশি অস্থির লাগতে পারে। চেষ্টা করে দেখতেই পারেন, কিন্তু উল্টো ফল হচ্ছে দেখলে পদ্ধতি বদলাতে হবে। অন্যভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। যে কাজটি আগে করতে ভালোবাসতেন অথচ বহুদিন সুযোগ পাননি, সেই কাজটি আবার করার চেষ্টা করুন। বই পড়া, ছবি আঁকা, গান গাওয়া বা শোনা, নাচের অভ্যাস… যা ইচ্ছে। নিয়মিত কিছুটা হাল্কা বা মাঝারি শরীরচর্চা করলে শরীরের অস্থিরতা কমবে এবং মনও শান্ত হবার সুযোগ পাবে। টিভি দেখতে পারেন। খবর অবশ্যই দেখবেন, কিন্তু সারাদিন মহামারির খবর দেখতে থাকলে মন ভারাক্রান্ত হতে পারে, আতঙ্ক বাড়তে পারে। অন্যরকম অনুষ্ঠানও দেখুন।

বাড়ির কাজে হাত লাগানোর এই হল সেরা সময়। গৃহকর্মের দায়িত্ব এমনিতে যাঁদের ঘাড়ে (সাধারণত মহিলারা), তাঁদের উপর কিন্তু চাপ বেড়েছে এই সময়ে, কারণ সব কাজ তাঁদেরই করতে হবে। গৃহকর্ম সহায়িকাদের পক্ষে এখন কাজে আসা সম্ভব নয় এবং তাঁদেরও অধিকার আছে নিজেদের বাড়িতে নিরাপদ থাকার। তাঁরা ইচ্ছে করে ছুটি নেননি, বাধ্য হয়ে নিয়েছেন। তাঁদের কাজের নিশ্চয়তাটুকু দেওয়া আমাদের দায়িত্ব এবং সম্ভব হলে এই সময়ের মাইনেটাও। পাশাপাশি এটাও বুঝতে হবে যে বাড়ির মহিলাদের উপর চাপ বেড়েছে। তাঁরা হয়ত সময়ের ভারের বদলে কাজের ভারে নুয়ে পড়ছেন। পুরুষদের এমনিতেই উচিত গৃহকর্মে নিয়মিত অংশ নেওয়া। সেটা দয়া নয়, দায়িত্ব। অনেকে তবু সেই কাজ এড়িয়ে যান, ব্যস্ততার কারণে অথবা ব্যস্ততার অজুহাতে। এখন সেই ব্যস্ততা যাঁদের নেই, তাঁরা ঘরের কাজে হাত লাগান। এতে সুফল ফলবে অনেকরকম। আপনার সময়ের ভার লাঘব হবে। স্ত্রী বা মায়ের কাজের চাপ কমবে এবং তাঁরা সন্তুষ্ট হবেন। পাশাপাশি আপনি নতুন কাজ শিখতে পারবেন, আগে শিখে থাকলে ঝালিয়ে নিতে পারবেন এবং এসব আপনিও পারেন দেখে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। কদিন খুব মন দিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করলে বুঝতে পারবেন এর গুরুত্ব আর জটিলতা। তখন গৃহকর্মকে ছোট করে দেখার প্রবণতাও চলে যাবে। সেও একরকম মনোরোগের উপশম।

এর পাশাপাশি নিজের অঞ্চলের অসুস্থ, বৃদ্ধ, একাকী বা দুস্থ মানুষদের সাহায্য করার উদ্যোগ নিতে পারেন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার সব নিয়ম মেনেই এটা করা সম্ভব। এতে অন্যেরও উপকার হবে, আপনার মনেরও।

৬) টিভি, খবরের কাগজ, সামাজিক মাধ্যম থেকে এই যে প্রচুর কথা জেনে ফেলছেন ভাইরাস, মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি সম্বন্ধে, যার অনেককিছুই বেশ ভয় দেখানো গোছের, তাতে আপনার আতঙ্ক বা অবসাদ বাড়তে পারে। এই ব্যাপারে সচেতন আর সাবধানী হতে হবে। খারাপ খবরের পাশাপাশি ভালো খবরগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। নির্দিষ্টভাবে নজর দিতে হবে নিজের কর্তব্যের উপর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ সাহেবকে উপদেশ দিয়েছিলেন সমুদ্রের ঢেউ দেখে ভয় না পেয়ে শুধু খেয়াল রাখতে যেন নিজের ডিঙিতে কোনও ছিদ্র না থাকে। সাগরের তুফান আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। তাকে এড়াতে চাই অবশ্যই, কিন্তু হঠাৎ যদি সে এসেই পড়ে তবে তার মেজাজের কথা ভেবে লাভ নেই। নিজের ডিঙিটার যাবতীয় ফুটোফাটা আগাম মেরামত করে রাখাই আমাদের হাতে, ওটুকুই আমাদের কাজ। করোনা মহামারি রুখতে আর বিপদ থেকে দেশকে বাঁচাতে আমাদের ঠিক কী কী করতে বলা হচ্ছে, সেটুকু মন দিয়ে শুনে, বুঝে, অযথা ভয় না পেয়ে নিজের কাজটুকু করে যাওয়াই সময়ের দাবি। এতে মনের অভিমুখ থাকবে পজিটিভ বা শুভ। তার দ্বারাই প্রতিহত হবে অবসাদ।

৭) “সোশাল ডিস্ট্যান্সিং” আর “লকডাউন”-এর ফলে মানুষের একাকিত্ব বেড়েছে হঠাৎ। এমনিতে আজকাল মানুষ মানুষের মুখের দিকে চেয়ে সামনাসামনি কথা বলে কম, মোবাইল টেপে বেশি। সামনের মানুষটিকে অবহেলা করে দূরের মানুষের সঙ্গে চ্যাটে ব্যস্ত থাকে। তবু যে মানুষের সান্নিধ্য এতখানি প্রয়োজনীয় ছিল, তা হয়ত আমরা বুঝতেই পারতাম না হঠাৎ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়লে। ঘরে বসে যে ছটফটানি, তার একটা অংশ আড্ডার অভাবের ফলেও। বহু মানুষের মুখ দেখতে না পাওয়ারও একটা প্রতিক্রিয়া আছে, যা আমরা এমনিতে খেয়াল করি না। আসলে সমাজবদ্ধতা আমাদের ভেতরে ঢুকে গেছে। যাঁরা বয়স্ক এবং মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটে তেমন সড়গড় নন, তাঁদের অনেকেরই জীবনের জানালা ছিল কোনও চায়ের দোকান, পার্ক বা কারও বৈঠকখানার প্রাত্যহিক আড্ডা। সেসব আপাতত বন্ধ। এঁদের অনেকে হয়ত হারিয়েছেন জীবনসঙ্গীকে আর পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গেও গড়ে ওঠেনি তেমন সংযোগ। এঁদের একাকিত্বের ভার এই মুহূর্তে মারাত্মক। বাড়িতে যদি অন্য কেউ থাকেন, তবে এই সময়ে এঁদের আরও বেশি সাহচর্য দিন। পাড়ার যুবক-যুবতীরা উদ্যোগ নিয়ে পাড়ার দাদু-দিদা, জেঠু-জেঠিমাদের খোঁজখবর নিন, তাঁদের সঙ্গে গল্প করুন টেলিফোনে।

পাশাপাশি নিজেদের বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতদের সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলুন ফোন বা ইন্টারনেটের সাহায্যে। বহুদিন কথা হয়নি যে পুরনো বন্ধুর সঙ্গে, তার ফোনের দরজায় কড়া নাড়ুন… মনের দরজাতেও। বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার বদলে বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধেই গড়ে তুলুন প্রতিরোধ। আমরা ভাগ্যবান যে এমন সময়ে বাস করি, যখন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার এতরকম উপায় আছে। শুধু মনের দরজাটুকু খোলা রাখা চাই।

যাঁরা নিজেদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন এই সময়ে, তাঁদের মানসিক চাপ অন্য মাত্রার। অনেকে অন্যত্র কাজ করেন এবং সেখানেই আটকে পড়েছেন। কেউ হয়ত কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন, ফিরতে পারেননি। নিজে এক জায়গায় আর পরিবার অন্যত্র এক মহাবিপদের মুখোমুখি। অসহায়তার অনুভূতি তীব্র হতে বাধ্য। বেঙ্গালুরু, মুম্বাই, ইউরোপ, আমেরিকায় কর্মরত এমন অনেকের সঙ্গেই আমরা পরিচিত। তাঁদের কষ্টের কথা আমরা নিয়মিত শুনতেও পাচ্ছি। যাঁদের মুখের কথা আমাদের কানে তেমনভাবে পৌঁছয় না, সেরকম অগণিত দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিকও একই মনোকষ্টের কবলে। উপরন্তু তাঁদের আছে নিদারুণ আর্থিক অনটন আর অনিশ্চয়তা। এটুকু খেয়াল রাখলেই সহজে বোঝা যাবে কেন এঁরা লকডাউনের মধ্যেও তিনশো কিলোমিটার হাঁটছেন বা আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসে ভিড় জমাচ্ছেন। শারীরিকভাবে দূরে থেকেও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এইসব মানুষের দিকে আমরা বাড়িয়ে দিতে পারি শুশ্রূষু হাত। সেই হাতের ছোঁয়ায় শান্তি পাবে তাঁদের এবং আমাদের নিজেদের মন।

“সোশাল ডিস্টান্সিং” কথাটাকে যেন ভুল না বুঝি আমরা। সামাজিক দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা আমরা চাই না। শারীরিক দূরত্ব, মানসিক সাহচর্য আর সামাজিক মেলবন্ধন… এই তিনের সমন্বয়েই আমরা পেরোতে পারব এই তুফানি দরিয়া। এই মেলবন্ধন বজায় রাখতে পারলে তা ভবিষ্যতের সমাজকেও করে তুলবে সুন্দরতর।

৮) দূরত্বজনিত সমস্যার পাশাপাশি আছে নৈকট্যজনিত সমস্যাও। সকলের পরিবার বা বাড়ির পরিবেশ যে একইরকম ভালো, তা তো নয়। অনেক পরিবার স্রেফ অভ্যাসে টিকে ছিল। কাজের চাপে বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটত বলে পরস্পরের সঙ্গে দেখা হত কম। সেই সময়টুকু কোনওমতে সহ্য করে নেওয়া যেত। এখন লকডাউনের দৌলতে গৃহবন্দি সেসব মানুষকে থাকতে হবে পরস্পরের কাছাকাছি সারাদিন, সারা সপ্তাহ, সারা মাস। অপছন্দ যদি তীব্র হয়, তবে অসহনীয় হতে পারে এই সহাবস্থান। এর ফলে সম্ভবত কোনওমতে টিকে থাকা কিছু পরিবার দ্রুত এগিয়ে যাবে ভাঙনের দিকে। সবক্ষেত্রে তা আটকানো যাবে না, সর্বদা ভাঙন রুখে দেওয়া মঙ্গলজনকও নয়। তবু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত এই চ্যালেঞ্জটাকে কাজে লাগিয়েই সম্পর্ক মেরামত করা যেতে পারে। আমরা যদি এই সময়ে পরস্পরকে অনেকটা সময় দিই, সাহচর্য দিই, জানার চেষ্টা করি অন্যের এতদিন না বলা কথাগুলো, বুঝতে চেষ্টা করি পাশের মানুষটাকে, তবে হয়ত নতুন করে আবিষ্কার করতে পারব নিজেকে, তাকে এবং সম্পর্ককে। করোনার দিনরাত্রি পেরিয়ে হয়ত বেরিয়ে আসবে আরও মজবুত আর সুখী কিছু পরিবার।

৯) যাঁদের আগে থেকে ডিপ্রেশন বা অন্য কোনও মনোরোগের চিকিৎসা চলছে, তাঁদের কথা আলাদাভাবে বলা দরকার। অবসাদ যাঁদের আগে থেকেই গ্রাস করেছে, তাঁদের অনেকের মননের ধরনের মধ্যে একটা বিশেষ দিক হল জীবনের খারাপ দিকগুলোর দ্বারাই বিশেষভাবে প্রভাবিত হওয়া, সেই খারাপের গুরুত্বকে বহুগুণ বাড়িয়ে প্রলয়ঙ্কর পর্যায়ে ভেবে ফেলা আর ভালোগুলোকে খেয়াল না করা। এর ফলে তাঁরা সহজে হতাশ হন, আঘাত পান, মুষড়ে পড়েন। বর্তমানে মহামারি আর লকডাউনের পরিস্থিতি সত্যিই অনেকের অবসাদ বাড়িয়ে দিতে পারে। কারও ক্ষেত্রে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে পারে। আত্মহত্যার ভয়ও আছে। কোনও সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যাঁদের নিয়মিত কাউন্সেলিং বা থেরাপি (যেমন কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি) চলছিল, তাঁদের পক্ষে এই সময়ে তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যাঁরা ওষুধ খান, তাঁরা অন্তত ওষুধগুলো বাদ দেবেন না এই সময়ে। ফোন, স্কাইপে, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেল বা মেসেঞ্জারে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। কথা বলুন। অবসাদ আর উদ্বেগ বাড়লে সেই কথাও সঙ্গে সঙ্গে কাউকে জানান। অসুবিধে বুঝলে যোগাযোগ করুন নিজের চিকিৎসক বা থেরাপিস্টের সঙ্গে। “ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম” এবং “ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটি”র পশ্চিমবঙ্গ চ্যাপ্টার একাধিক হেল্পলাইন চালু করেছেন। সেইসব ফোন নম্বর সহজলভ্য। সেখানে ফোন করুন। বিভিন্ন অঞ্চলে যদি সামাজিক সহায়তার জন্য কোনও ব্যবস্থা চালু হয়, তবে সেখানেও যোগাযোগ করতে পারেন।

পাশাপাশি নানারকম কাজে ব্যস্ত থাকুন। যথাসম্ভব চেষ্টা করুন ভালোর দিকে নজর দিতে, যদিও অবসাদগ্রস্ত মানুষের পক্ষে তা খুবই কঠিন। তবু লড়তে হবে। মানসিকভাবে একা রাখবেন না নিজেকে, সংযুক্ত থাকুন মানুষের সঙ্গে। মানুষের হাতই আমাদের টেনে তুলতে পারে।

দীর্ঘ হয়ে গেল প্রবন্ধ, তবু না বলা থেকে গেল বেশ কিছু কথা। সে থাক। থামতেও তো হয়। নিজের বিশ্বাসের কথা বলে শেষ করি। লড়াইটা কঠিন নিঃসন্দেহে, কিন্তু লড়াইটা আমরা জিতব। জিতবই।