যে জলে পালক ডোবে…

যে জলে পালক ডোবে… -- সৌমিত দেব

সৌমিত দেব

 

এপিটাফ

মৃত্যুচেতনা এক বিস্ময়কর ভোজবাজি। এ সবই আসলে মাস্তুলের ওপর থেকে ডাঙা দেখার চেষ্টা। সমুদ্র উলটে যায় অবশ্য মাঝেমধ্যে৷ মাথার ওপর জল, পায়ের নিচে মেঘ, কালো, কুচ্ছিত আঁশটে মেঘ। এখানে মাছেরা মৃত। এখানে সময় স্থির। এখানে যা কিছু কহতব্য, সব বেঁচে থাকার মতো নিদারুণ একঘেঁয়ে। ধুশ, খিদে পাচ্ছে আবার। এভাবে চলে?

মাটির স্বাদগন্ধ কেমন হবে তা নির্ভর করছে ধর্মের ওপর। মাটির ধর্ম। যদিও মাটির ছুঁৎমার্গ বিশেষ নেই। সব শরীরকে সে গাছ করতে পারে নিমেষেই। আমার বুকের ভেতর একটা অন্ধকার জঙ্গল আছে। মাঝেমধ্যে সেখান থেকে করাতের শব্দ পাই। ওখানেই রাখা হবে আমায়। কথা বলে রেখেছি।

মৃত মানুষের পোশাক কম দামে কেনা-বেচা করে জীবিতরা। সেই পোশাক পরে তারা যুদ্ধে নেমে পড়ে, রোজকার যুদ্ধ, ঢালতলোয়ার নেই। এই যেমন আমি ভীষণ যুদ্ধ করছি টানা কতকাল একটা দুশো ফুট বাই সাত ফুট ঘরে। অন্ধকার। তবু, বন্ধুরা কথা দিয়েছে মরে গেলে আমার পোষাক মৃত সৈনিকের বর্ম বলে বিক্রি করে দেবে। পাওনা বলতে এইটুকুই।

মৃত্যুচেতনা এক বিস্ময়কর ভোজবাজি। শ্বাসরুদ্ধকর সকালে মাঝেমধ্যে খবরের কাগজ খুলে আন্দাজ পাই জল কত দূর এল। নাকবরবার এলেই দে ডুব! সাঁতার জানি না, ফলে ভদ্রতার ভয় নেই। ভাসতে ভাসতে শেষে যখন আবর্জনার স্তুপে এসে থামবে ঢেউয়ের বজ্জাতি, তখন লোকে যাই বলুক, আমি মোহনা ভেবে নিশ্চিন্তে দেখব ওই তো ভালোবাসা, ওই তো, আয়, আয়….

***

 

প্রেমপর্ব

…আয় আয় আয়….

মানুষ আসতে শুরু করলেই অপরাধপ্রবণতা বাড়ে। কখনও সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলে এড়িয়ে যাওয়ার মত সাবলীলতায় তাই, আমাদের যুদ্ধ চলছে। জলের মত, এলাকা বিশেষে পরিষ্কার।

যদি প্রেম বলি তবে—

সময় তিন ধরনের।

এক যাদের হিসেব আছে।
তিন যাদের হিসেব নেই।

বাকি ওই টুকরো টুকরো ছড়িয়ে ছটিয়ে থাকা
আদর, বেড়াতে যাওয়া, অপেক্ষা, ঝগড়া, ইত্যাদি।

এক আর তিনের মাঝে পড়ে
দুই হওয়ার খুব চেষ্টা করছে।

বিয়েবাড়ির বাইরে কয়েকটা মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে। ছিন্নভিন্ন, ময়লা পোশাক। গেট থেকে একটু সরে এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে যেখান থেকে তাদের দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু যাতায়াতের অসুবিধে হয় না। চোখাচুখি হয়ে গেলে হাতের ইশারায় দেখায় একটু খেতে চাইছে। যাকে পায়, তাকেই বলে। নিমন্ত্রিত, বাড়ির কর্তা, সব মুড়িমিছরির দর। সবারই ঝলমলে রঙিন পোশাকে মালিকানা বোঝা দায়। কোনও কোনও বাড়ি খেতে দেয়, সকলের হয়ে যাওয়ার পরে। কোনও কোনও বাড়ি আবার বাইরে এনে দেয়। একসঙ্গে সব পদ একটা থালায়। তাদের কেউ জিজ্ঞেস করে না রান্না কেমন হয়েছে, তাদের জিজ্ঞেস করতে নেই।

যদি বলি জ্বর, তবে—

চলতে চলতে চলতে চলতে
পৌঁছনোর আগেই

দুরত্ব যেন কখন গা-সওয়া হয়ে গ্যাছে

গন্তব্য না থাকলে যা হয়…

ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে দাঁড়িতে থেকে লিফলেট বিলি করা ছেলেটার

বৃষ্টি আসলেও মুশকিল, লিফলেট ভিজে যাবে। দ্বন্দ্ব আমাদের মানুষ করেছে। আমরা একদিন আকাশের তলায় শান্তি খুঁজতে যাব। পাহাড়ের কাছাকাছি, তারা দেখব।

যদি বলো বেঁচে থাকা—

সে তো বাড়ি ঢুকে যাওয়ার আগে
তুমিও একবার পেছন ফিরে চাইতে

এখনও চাইলে দেখতে পাবে
একইরকম দাঁড়িয়ে আছি

নাগরিক হওয়ার প্রথম শর্ত, অন্ধবিশ্বাস।

তবে বলি— “চিতাকাঠ ডাকে আয় আয় আয়…”

***

 

এপিটাফ ২

এই যে আমার ক্রমাগত একটা জিতে যাওয়ার চেষ্টা তা নিয়ে আজকাল আর ভাবি না বিশেষ। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় সমস্ত বাড়ি বোধহয় লটারির টিকিটে তৈরি। আমি লটারি কাটি না যদিও, বাজি ধরি। এটা অমুক গল্পের লাইন, ওটা তমুক ছবির সংলাপ, সালটা এত নয় অত। বেশিরভাগ সময় জিতে যাই। গাঢ় আনন্দের, বাহবার, দু-চার মিনিটের জন্যে শিকারির মতো অপেক্ষা। দিনে একটা বা কখনও দুটো। জিততে আমাকে হবেই। গাঢ় আনন্দের, বাহবার, ওই যে দু-চার মিনিট, মনেপ্রাণে প্রার্থণা করি হে ঈশ্বর আমার গোটা জীবনটা এমন করে দাও। এমন এক আশ্চর্য মায়া যেন বেঁচে থাকা আমার দিকে আঙুল তুলে না বলে হেরো, হেরো, হেরো। অমূলক বাজি লড়ে যেতে কারই বা আর ভালো লাগে।

শববাহী যান দেখলে প্রিয়জনের মুখ মনে পড়ে। যারা বেঁচে আছে এখনও। তাদের দেখতে পাই। তাদের মুখ। তাদের ওখানে শুয়ে কেমন দেখাবে সেই চিন্তায় শিউরে উঠি৷ সিগনালে যখন আমার গাড়ির পাশের দাঁড়ায় কোনও ফাঁকা, বাতানুকূল, শববাহী যান তখন আমি উল্টোদিকে তাকিয়ে পোস্টার দেখি, রাস্তা দেখি, সুন্দরী মেয়ে দেখি৷ তার সঙ্গে প্রেমের কথা ভাবি আর মনে মনে ধন্যবাদ জানাই সৃষ্টির চতুরতাকে। ভাগ্যিস মানুষ নিজেকে দেখতে পায় না। ভাগ্যিস।

***

 

এপিটাফ ৩

পাগল যেমন ভাবে পার হয় রাস্তা, নিশ্চিন্ত, নিরুত্তাপ, তেমন একটা জীবন চেয়েছিলাম আমি। নিশ্চিন্ত বেঁচে থাকার একটা জীবন। যাবতীয় ঝঞ্ঝাট, দায়দায়িত্ব অস্বীকারের একটা বেঁচে থাকা। হয়ত এখনও আমার জন্মদিন পালন হয়, হয়ত এখনও আমায় এসে বন্ধুরা জানায় শুভেচ্ছাবার্তা, হয়ত বারবার মনে করিয়ে দেয় আমায় বাড়ি ফিরতে হবে। কথা বলতে চায় হয়ত, যদিও আমার কানে ঢোকে না সে কথা। আমার কানে শুধু ভেসে আসে গাড়িঘোড়ার আওয়াজ, মানুষের থাকার শব্দ ভেসে আসে কানে। আর আমি, সতর্ক সাবধান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি রাস্তার ধারে সিগনালের অপেক্ষায়৷

শোনো, যে যা বলে বলুক, যদি ভালোবাসতে চাও তবে মাতালের মতো ভালোবাসো। যেমনভাবে আগুন একদিন গ্রাস করবে তোমার দুশ্চিন্তা৷ এই যে সারাটাক্ষণ আমার মনে হয় আমি আসলে মানুষ নই, আমি আদতে একটা মাছ। এই যে সারাটাদিন জলের মধ্যে হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি একটা বড়শি অথবা একটা জাল, এই যে ভাবছি একবার ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি যদি, একবার ভাগ্যের যদি গিয়ে উঠতে পারি একটা নামকরা বাজারে, ব্যাস কেল্লা ফতেহ! শুধু বিক্রি হওয়ার এই যে অপেক্ষা, এই সব আসলে ভুয়ো। নকল। জোচ্চোরের চিন্তাভাবনা। তাই যে যা বলে বলুক, যদি ভালোবাসতে চাও তবে মনে রেখো, অন্ধকারে ঘুম ভালো হয়। অন্ধকারে, ঘুম, ভালো হয়।

***

 

ব্যবসায়ী

আমার ছোটবেলায় প্রায়ই চোর ধরা পড়ত। সকলে চোর দেখতে যেত, আমি অন্ধকার খুঁজতাম। চোরের জন্যে মায়া হত। সবাই বলত— ‘বোকা’৷ যখন গণপিটুনির গল্প কানে আসত, বন্ধুরা চোখ বড় বড় করে বলত ‘মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে’, ‘ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে রেখেছে’, কী কান্নাটাই না পেত। বোকা। ক্যাবলা। এখন আর কান্না পায় না৷ ডাক্তার বলেছে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করতে। চেষ্টা করিও। খুব চেষ্টা করি। এই তো, বাজার উঠে যাওয়া আর আবার বসার মধ্যবর্তী সময়ে আমি নিজেকে নিয়ে বেরোই। ভালোই দর হাঁকি। খদ্দের পছন্দ হলে কমসমও করি কিছু। বেশ কিছুদিন যাবৎ কেউ কিনছে না আমায় অথচ আমি হতাশ হইনি। নিয়ম করে বেরোই, পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে হাঁক পাড়ি… ‘মড়া নেবে গো, মড়া, মড়া নেবে?’

মাঝেমধ্যে গিয়ে ছোটবেলার পাশে বসা হয়ত যেত কিন্তু ও আমায় বড় ভয় পায়। আমি ওকে বড় ভয় পাই। ও ভয় পায় এই নিরুত্তাপ, শীতল, কিচ্ছুতে কিচ্ছু না যাওয়াআসার ধ্বংসস্তূপকে। আমি ভয় পাই ওর প্রশ্নে৷ সত্যিই তো, আজি কি আর জানি কেন ক্ষতবিক্ষত রাস্তায় অকারণ হেঁটে বেড়াই আর খেলার লোক খুঁজি? জানি কি? কে জানে, জানি বোধহয়। আর জানি বলেই ভয় পাই। আসলে দিনদিন এত ধান্দাবাজ হয়ে উঠছি যে আজকাল রাতে আলো জ্বালিয়ে শুই। বলা তো যায় না, কখন উঠে পড়তে হয়। কখন খদ্দের এসে বলে— ‘তা কই, দেখি কেমন মড়া এনেছ।’

***

 

এপিটাফ ৪

আমাকে এঁকে রাখল যে ঘুম তার সংসারে, কুয়াশা এসে পড়ুক বারোমাস। এখানে আলোর দ্বন্দ্ব। শরীর ক্ষতবিক্ষত হয় যখন, আমাদের ভেতরের অন্ধকার চিৎকার করে বলে ব্যথা ব্যথা ব্যথা… তখন আলো বুঝতে পারে না মেরে ফেলবে না ফেলবে না। এখানে আলোর দ্বন্দ্বের দিন। একদিন, একদিন আলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে শরীরে সর্বশক্তি নিয়ে, দ্বন্দ্বহীন। আমরা পরিষ্কার দেখতে পাব অন্ধ মালিকের বাতিঘরে কোটি কোটি জোনাকি… শরীরের সঙ্গে মিশে যাবে আকাশ, চাঁদ উঠবে, আর তারা, কোটি কোটি তারা। এই যে এত এত তারা সারারাত, এরা কার ক্ষতবিক্ষত শরীর? চাঁদ তবে কী? অস্ত্র? না মৃত্যু? শুনেছি এখানে ঈশ্বর কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েছিলেন। পায়ে মাটি লেগেছিল তাঁর। সেই মাটির দাগ আজও আছে ছায়াপথে৷ এখানে আর আলোর দরকার পড়বে না কখনও। এখানে হেরে যাওয়ার উৎসব হয় প্রতিদিন। একেকটা ক্ষতবিক্ষত শরীরকে দেখে যারা হারিয়ে যেতে চায় না তারা খুঁজে নেয় বাড়ির রাস্তা। যাদের দৃষ্টি ভালো না তারা জলের ভেতর দেখতে পায় না। তাদের সাঁতার শিখতে হয়। সার্ভাইভাল। বাকিরা অন্ধ, এই আমার মত। মন দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে শরীর, করছে, করছে, করেই চলেছে আলোর আশায়৷ একদিন সৌজন্যবোধ লোপ পেয়ে আমরা একে অপরেকে ছিঁড়ে ফেলব। আলো, আলো, আলো, আলো, আলো… সেইদিনের অপেক্ষা করা ছাড়া আর এই নিয়ম করে খাই দাই, ঘুমোতে যাই, চান করি, দাঁত মাজি আর দেখি এই একেকটা গল্প হুশ করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। চরিত্ররা সবাই বেঁচে৷ চরিত্ররা সবাই অন্ধকার…একটা ধারালো অস্ত্র খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছি। মৃত্যুর আগে, আর কিছু না হোক, আমার শরীর‍টাকে শালা আমি দেখে নেব। দেখে নেব কত অন্ধকার ও লড়াইয়ের আসরে নামাতে পারে আর কত আলোয় আমি ডুবে যেতে পারি। ভাগ্যিস সাঁতার জানি না! না হলে আজ বোধহয়… হ্যাঁ গল্পের শেষ এভাবেই হয়। শুধু পাঠক ভাবে পরে কিছু আছে আর সৃষ্টি নতুন অন্ধকারে হাত দেয়৷ এভাবেই। ঠিক এভাবেই।

***

 

লোডশেডিং

জেনো সব ক্ষত লেখা হয়নি, লেখা হচ্ছে না ইতিহাসে। কত শত মৃত বৃষ্টিরা, তবু সূর্যকে ভালোবাসে। জেনো সব নদী জল পায়নি, জল পাচ্ছে না কত ছবি। নিভে জ্বলে ওঠা ঘুম দেখে, তবু আমরা জোনাকি ভাবি। এসো পাশে বসো, দেখো অযথাই সব ভয়। না না ও কিছু নয়। আমরা আসলে পাখি, তাই গাছের বদলে ডানায় ভরসা রাখি। ও কিছু নয়, আমরা আসলে পাখি। হারিয়েই যাওয়া চিঠিদের ধরে। কারাগারে পুরে রাখা দ্বীপে। কিছু অক্ষর সাথী কবরের পাশে বাগান করেছে দারুণ, তুমি এসে দেখে যেতে পারো। নিজস্ব জলযানে চেপে এলে, রাতেই দিকেই এসো, দেখো জোনাকি পাহারা থাকে। ওটুকু আলোতে দোষত্রুটি দেখা যায় না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...