Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অণুগল্প, মুক্তগদ্য এবং অন্যান্য

বিলাল হোসেন

বিলাল হোসেন

 




লেখক কবি, অণুগল্পকার। অণুগল্পের প্রচার ও প্রসার আন্দোলনে যুক্ত।

 

 

অণুগল্পে কিছু নিহিত শক্তি আছে; যা ব্যক্ত হয়ে পড়ে। এগুলিই মূলত অণুগল্পকে আলাদা করে চিহ্নিত করার ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নেয়। অর্থাৎ প্রতিটি ‘সার্থক অণুগল্প’তে এই নিহিত শক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাই। [সার্থক অণুগল্প বলতে আসলে কিছু নেই। অণুগল্প দুই প্রকার। আর সেটি হচ্ছে অণুগল্প এবং অণুগল্প নয়। যে গল্পটি অণুগল্প হয়ে গেছে/উঠেছে তাকে আর সার্থক অণুগল্প বলার প্রয়োজন নাই। প্রতিটি অণুগল্প সার্থক। আর যে গল্পটি অণুগল্প হয়নি তাকে ‘অসার্থক অণুগল্প’ বলাটা বাহুল্য। যেমন কোনও কিছুকে সেরা বলতে শ্রেষ্ঠ বলাই যথেষ্ট, বাড়তি করে শ্রেষ্ঠতম বলার দরকার নেই বা কনিষ্ঠ বলতে যেমন কনিষ্ঠ-ই বোঝায়, তার অধিক বোঝাতে সর্বকনিষ্ঠ বলা বাহুল্য। তেমনি অণুগল্পের বিষয়টিও। অণুগল্পের সার্থকতা-অসার্থকতা হয় না। অণুগল্প শব্দটিই সার্থকতার/শুদ্ধতার প্রতীক। অণুগল্প নিজেই সার্থকতার সমার্থক।] যে গল্পটি অণুগল্প হয়নি, কথার সুবিধার্থে ধরে নেই সেটি অসার্থক অণুগল্প, সেই অণুগল্পের মধ্যে কোনও শক্তির নড়াচড়া দেখা যায় না। মৃতের মত একটি শুকনো চাটাইয়ে ল্যাপটানো থাকে অণুগল্পের নিঃসাড় শরীর। কিন্তু কেন? কেন এমন হয়?

নিহিত শক্তির মধ্যে অণুগল্পের ‘ইচ্ছের প্রকাশ’কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি আমি।

যে-কোনও মাধ্যমের মতই অণুগল্প নিজেকে প্রকাশ করতে চায় সর্বোচ্চ পন্থায়, এই প্রকাশ যাবতীয় রীতি মেনেই হয়। এই রীতি কিছুটা অ্যাকাডেমিক বাকিটা লেখকের নিজস্ব চাল।

একটি অণুগল্প কীভাবে কোন পন্থায় নিজেকে প্রকাশ করবে সেটা নির্ধারণ করতে পারাটাই আমি মনে করি প্রথম সাফল্য। লেখক নিজেকে প্রকাশ করে আলাদা হয়; প্রকাশ করেই আলাদা হতে হয়; এর কোনও বিকল্প পন্থা নেই; পাশাপাশি যা প্রকাশ করা হল সে— অণুগল্পকে এমনভাবে প্রকাশ হয় যেন অন্যান্য শাখা থেকে নিজে ব্যতিক্রমী হয়; আলাদা হয়। ফলে এই ‘কীভাবে’ ব্যাপারটি খুবই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

অণুগল্পের ভেতরে দুটি বিষয় থাকে। একটি গল্প অন্যটি কাহিনি। গল্প একটি ফর্ম্যাট। আর কাহিনি হল একটি ঘটনা বা আখ্যান। গল্পের ফর্ম্যাটে কাহিনি/আখ্যান থাকতে পারে আবার না-ও পারে। গল্পের আখ্যান অনুযায়ী গল্পের ফর্ম্যাটের পরিবর্তন হবে নাকি ফর্ম্যাটের খাঁজে গল্পের আখ্যান ফেলে অণুগল্প বানাতে হয় বলাটা খুবই দুষ্কর।

এইজন্যেই অণুগল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচনের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে বলে আমার উপলব্ধি। নয়ত বিষয়বস্তুকে গল্পের ফর্ম্যাটে ঢেলে সাজানোর ক্ষেত্রে সীমা আছে। নিশ্চিতভাবে জানি না কী সেটা।

অণুগল্পের কিছু বিষয়বস্তু আছে যেগুলির ঘটনাপ্রবাহ খুব উচ্চকিত নয়। এসব সামান্য বিষয়কে গল্পের মূল ধরে অণুগল্প লিখলে গল্পের শরীর জুড়ে থাকে শব্দ আর ভাবের খেলা। এর চেহারা আর স্বভাবে থাকে মুক্তগদ্যের ব্যঞ্জনা। তবে মুক্তগদ্যের হাত ধরে কিছু উষ্ণতা পাওয়া যেতে পারে, শব্দ আর ভাবের উৎসারণে একধরনের তৃষা মেটানোর তৃপ্তি পাওয়া গেলেও বিশুদ্ধতার পান করার যে শান্তি, নিশ্চয়তা— সেটা পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় না। জীবাণুমুক্ত ত্রুটিহীন সুপেয় মুক্তগদ্যের অভাব চারপাশে। অন্তত আমার চারপাশে।

চোরাই পথে অনেক গল্প অণুগল্পের পোশাক পড়ে ঢুকে পড়ে। গল্পগুলি সহজ পোশাকের যে ছদ্মবেশ নেয় তার নাম মুক্তগদ্য। চোরাই পথ ধরে চলে আসা এইগল্পগুলিকে আমরা বলি— অগল্প, নাগল্প। মুক্তগদ্যেই সাধারণত অগল্প নাগল্প লিখিত হয়ে থাকে।

একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি।

 

নর্দমা

নাভীর নিচে শাড়ি পরলে নাকি নাভীর গর্তে কিছু পুরুষ মানুষও আটকা পরে। পাতলা শাড়ির সুতোর বুনোটের ফাঁকেফাঁকে যে ব্লাউজ দেখা যায় সেখানেও আটকা পরে আরও কিছু পুরুষ। আটকা পরে খোলা কোমরের ভাঁজে। মেয়েটা রোজ কিছু পুরুষকে শরীরে আটকে নিয়ে ফেরে।

স্নানঘরে গিয়ে ডলে ডলে সারা শরীর থেকে সেই পুরুষগুলোকে সাবান ফেনায় মিশিয়ে ঝরিয়ে ফেলে। পুরুষগুলো জানেও না তারা যেখানে মিশে ছিল সেখানে কোথাও তারা নেই। না সেই নাভীর গর্তে। না ব্লাউজে। না কোমরের ভাঁজে। প্রতিদিন এভাবে নর্দমায় জমতে থাকে পুরুষ। জমতে থাকে আবর্জনা। জমতে থাকে কালো কালো ঘৃণার দীর্ঘশ্বাস।

একদিন মেয়েটা এক নর্দমার পাশ দিয়ে নাকে শাড়ির আঁচল চেপে হাঁটার সময় চমকে গেল। নোংরা নর্দমায় কালো কালো আবর্জনার মাঝে নিজের বাবাকেও দেখতে পেল। একটু পাশেই তার ভাই। ভালো করে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে তার পরিচিত সব মানুষগুলো। পুরুষ মানুষগুলো। মেয়েটির গা গুলিয়ে উঠল। তাহলে কি ওরাও অন্য মেয়েদের…!

সারা শরীরে বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি হল। শাড়ির আঁচলটা ভালো করে শরীরে টেনে নিল। খোলা কোমর ঢাকার চেষ্টা করল। মেয়েটির কোমরের ভাঁজে, নাভীর গর্তে, ব্লাউজে তার বাবা ভাই হয়তো আটকা পড়ে না। কিন্তু অন্যদের বাবা ভাইরা তো আটকা পড়ে। নর্দমায় পড়ে আছে মেয়েটির বাবা, ভাই। পড়ে আছে জঘন্য কিছু অনুভূতি হয়ে। যদি পারত এখনই মেয়েটা সেখানে থেকে তার বাবা আর ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু তার বুক চিরে বের হয়ে এল— হে ঈশ্বর! সব পুরুষকে তুমি অন্ধ করে দাও।

সব পুরুষ অন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটি এখন আর কোনও পুরুষকে শরীরে আটকে ঘরে ফেরে না। মেয়েটি তবুও সাবান ডলে ডলে গোসল করে। এখনও নর্দমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দেয়। নর্দমায় পড়ে থাকে ওর মায়ের, ওর বোনের আবর্জনা। প্রতিদিন জমছে ঘৃণার আবর্জনা। এমনকি সেই মেয়ে নিজেও পড়ে আছে সেই আবর্জনার এক কোণে।