অণুগল্পের প্রকৃতি এবং লিটল ম্যাগ

অণুগল্পের প্রকৃতি এবং লিটল ম্যাগ -- বিলাল হোসেন

বিলাল হোসেন

 



লেখক কবি, অণুগল্পকার। অণুগল্পের প্রচার ও প্রসার আন্দোলনে যুক্ত

 

 

 

প্রকৃতি নির্ধারণ: গদ্য-কবিতা-অণুগল্প

গদ্য লেখার প্রকৃতি এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা সম্ভব হয় নাই— একথা বলার অর্থ হল গদ্যের নির্দিষ্ট কোনও আকার নাই, চরিত্র নাই, গদ্যের এমন কোনও মানদণ্ড নাই যাকে দিয়ে বলা যায় গদ্য হবে এমন। এর কারণ হল, আমরা গদ্যে কথা বলি, ভাববিনিময় করি, চিন্তা করি, এমনকি স্বপ্ন দেখি গদ্যে।

একজন সাধারণ কি বোদ্ধা পাঠক কাব্যের চেয়ে গদ্যকে অনেক সহজ স্বাভাবিক বলে মনে করেন। এই সহজ স্বাভাবিক বিষয়কে— আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়— গদ্যকে আসলে একটি সরল বিষয় বলে মনে করেন। এর মধ্যেকার বিভিন্ন ক্যারিশমা বা গুপ্ত ইঙ্গিত, রক্তক্ষয় করা ভেতরগত ব্যতিক্রমী বুননরীতি রয়েছে— সেটিকে সাদাচোখে পাঠক বিচার করতে পারেন না বা এর ভেতরের লুকিয়ে থাকা মণিমাণিক্যের উজ্জ্বলতা নির্দিষ্ট করে আলাদা করা সম্ভবপর হয় না, যেমন সহজেই কাব্যের বিষয়ে হয়ে থাকে। গদ্যকে মনে হয় লেখকের কলমের টানেই হয়ে গেছে বুঝি। গদ্যের প্রকৃতি নির্ধারণে এই যে মনোভঙ্গি, সরল বিবেচনা, গদ্যের গঠনসৌষ্ঠব্য পরিচয়গত এই যে উদাসীনতা— এইটি গদ্যলেখকের ব্যর্থতা নাকি পাঠকদের ব্যর্থতা— সে প্রশ্ন না তুলে বরং একথা বলা যায়— এমন কোনও গদ্যরীতিযুক্ত কোনও সাহিত্য আবিষ্কার করা যায় কি না— পদ্যের মত পাঠক যা আলাদাকরণে সচেষ্ট হবে, কাব্যের মতই আবিষ্ট হবে; ভাষা সুনির্দিষ্টতা পাবে।

সে-ধারারই একটি শিল্পমাধ্যম হচ্ছে অণুগল্প। অণুগল্প কোনও সাধারণ রীতিতে লেখা গল্পাখ্যান নয়। এর প্রতিটি শব্দ বাক্য সুনির্দিষ্ট এবং পাঠকমনে রেখাপাতকারী। ফলে কাব্যের যে চিহ্নগুলি দেখে পাঠক সহজেই সেগুলিকে কাব্য হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন— অণুগল্পের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে থাকে। এইজন্যেই অণুগল্প পড়ে অনেকেই এর সঙ্গে কবিতার মিল খুঁজে পান।

 

অণুগল্পবোধ

অণুগল্পের ভেকধরা প্রচুর পরিমাণে আখ্যান প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকা এমনকি বইপত্রে, জনপ্রিয় অণুগল্প গ্রুপে প্রকাশিত হচ্ছে। সব পড়া না হলেও ৯৫ শতাংশ বা তারও বেশি আমার পড়া হয়ে থাকে। কেউ কেউ যখন খুব কষ্ট নিয়ে বলেন— “অণুগল্প গ্রুপে এখন আর তেমন অণুগল্প দেখতে পাই না। সব আখ্যান আর আখ্যান…” তাঁদের কথাটা সত্য। তবু তেমন কষ্ট পাই না শুনে। কেননা নবীন লেখক/সদস্যরা যখন অণুগল্পকে ধরার জন্যে চর্চা করতে থাকেন তখন অণুগল্পকার হওয়ার আগে একজন ভাল আখ্যানকার হয়ে ওঠা জরুরি। ভাল আখ্যানকার না-হওয়া পর্যন্ত তার পক্ষে একজন অণুগল্পকার হওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ অণুগল্পের গন্তব্যে পৌঁছাতে আখ্যান নামক মই বাইতে হয়। এই জন্যেই এখন যাঁরা ভাল ভাল আখ্যান লিখছেন একদিন তারাই তুখোড় অণুগল্পকার হয়ে উঠবেন। এই চিন্তার ওপর খেয়াল রেখেই আখ্যানরূপী অণুগল্প পড়তে পড়তে একেকজন লেখকের লেখালেখির বিভিন্ন গুণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি।

সবার মধ্যে সব গুণ হয়ত একসঙ্গে পাই না, কিন্তু এটা বেশ লক্ষণীয়, কারও গল্পের বিষয়বস্তু অসাধারণ। কেউ চমৎকার বুনন আয়ত্ত করেছেন। একজন আছেন মেদহীন লক্ষ্যভেদী সংলাপ যুক্ত করতে পারেন। কেউ কেউ চমৎকার ফিনিশিং টানতে পারঙ্গম। কেউ বাচ্চাদের নিয়ে লিখতে সিদ্ধহস্ত, কেউ বুড়ো মানুষদের জীবনযাপন খুব ভালো লিখতে পারেন। কেউ কেউ আছেন তাৎক্ষণিকভাবেই যে কোনও বিষয় নিয়েই লিখে ফেলতে দক্ষ। অবিষয়কে বিষয় করে আখ্যান লিখতে কেউ কেউ দুর্দান্ত ফলাফল দেখাতে পারেন। এইভাবে একেকজনের ভেতরে একেক গুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়।

ভালো লাগে এসব।

ভালো লাগে কেননা এসব গুণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত হলেই সিদ্ধিলাভ হয়ে যাবে— এই ভেবে। আর সেটি হচ্ছে— বোধ। অণুগল্পের বোধ। অণুগল্প একটি বোধের নাম।

সমস্যা হচ্ছে অণুগল্পের মত বোধও একটি জটিল আর কূলকিনারাহীন শব্দ যাকে আসলে ধরা যায় না, আগলে রাখা যায় না, যাকে বলেকয়ে আরেকজনকে বোঝানো সম্ভব না। শুধু বুঝে নিতে হয়। সেদিকে তাকিয়েই হয়ত জীবননান্দ বলেছিলেন— ‘জলের মত ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়’।

আকারহীন, ঘোর লাগা, সবরকম নির্দিষ্ট থেকে মুক্ত এই বোধ শুধু এক চেতনা কিন্তু চেতনা নয়, তার চেয়েও অধিক কিছু হয়ে জ্বলজ্বল করা একটি বিন্দু। অথবা অন্যভাবে বলতে পারি, যেমন বলেছেন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। তিনি বলেছেন— “বোধ মানে হচ্ছে আমি আছি, আমার চেতনা আছে, আমার জয় পরাজয় আমার হাতেই আছে। এ হচ্ছে একধরনের স্বোপার্জিত স্বাধীনতার বিষয়। নিজের জায়গা জমিনে নিজে দাঁড়ানোর গল্প।”

এই হচ্ছে বোধ। আর যে নিজের মুদ্রাদোষে হতেছে আলাদা সেটাই হচ্ছে অণুগল্পবোধ। অণুগল্পের আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে কথা কয়। যেন জল।

আর এভাবেই নতুনেরা আখ্যানের চর্চা করতে করতে অণুগল্পবোধে আচ্ছন্ন হয়ে লিখতে থাকবেন শিল্পোত্তীর্ণ একেকটি অণুগল্প। অপেক্ষায় আছি। যেমন অপেক্ষায় ছিলাম আগেও।

 

অণুগল্প, লিটল ম্যাগ এবং কয়েকটি পরামর্শ

এমন হচ্ছে— ইদানিং অনেক লিটল ম্যাগ ‘অণুগল্প’ সংখ্যা বের করছেন অণুগল্পের প্রতি ভালোবেসে, দায়িত্ববোধ থেকে। তাদের এই ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ নিঃসন্দেহে অণুগল্পের জন্যে প্রশংসিত আর ইতিবাচক একটি গতিবান স্রোতের জন্ম দিচ্ছে, যে স্রোত অণুগল্পকে নিয়ে যাবে সেই বন্দরে যেখানে বাঁধা থাকে ইতিহাসের নোঙর। এপার ওপারে তাই যেসব অণুগল্পসংখ্যা বেরিয়েছে বা বেরুবে বেরুবে করছে, সংখ্যার দিক দিয়ে খুব বেশি না হলেও অণুগল্পের নিরিখে অবশ্যই বেশি— এই যুক্তিতে: অণুগল্প বয়সে নবীন। এই সেদিনও এর অস্তিত্ব ছিল না। অথচ নিজগুণে অণুগল্প আজ নিজেকে এমন বলীয়ান এমন প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে যে আধো আধো বোল বলা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী উজ্জ্বল চরিত্রের অণুগল্পকে সবাই ভালোবেসেছে। তাকে নিজের করে ভাবছে। ফলে অণুগল্পের প্রয়োজনে না হলেও অণুগল্পের সঙ্গে থেকে, সান্নিধ্যে থেকে নিজের আধুনিকমনস্কতার পরিচয় তুলে ধরাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এর ফলে শেষপর্যন্ত লাভবান হচ্ছে অণুগল্পই। কারণ এতে করে অণুগল্পের পক্ষে একেকটি উল্লম্ফন রচিত হচ্ছে আর ছোটবড় এই উল্লম্ফনের মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠকের দুনিয়ায় অণুগল্প প্রবেশ করছে, করবে।

দিকে দিকে আগুন জ্বালানোর মতই সব জায়গা থেকে অণুগল্প-সংখ্যা বের করা দরকার। অণুগল্পের ভবিষ্যৎ তাই হবে। অণুগল্পবিহীন পত্রপত্রিকা বাংলায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে। নিজেদের প্রচারের জন্যে, পত্রিকার কাটতির জন্যে, অণুগল্পের গ্রাভিটি বলয়ের টানে পত্রপত্রিকার মেরুদণ্ড দিন দিন শক্ত হয়ে উঠবে, অণুগল্পের অপার্থিব হিরন্ময় আলোর বিচ্ছুরণে ঝিলমিল করে উঠবে পত্রপত্রিকার প্রথম, মধ্যম আর শেষ অংশ। পাঠকদের ক্রমাগত চাহিদার শেষ যোগানদাতা অণুগল্প দিন দিন সাহিত্যের মূল শেকড় হয়ে প্রোথিত হতে থাকবে গভীর থেকে গভীরে।

সে-এক দিন আসবে বটে সাহিত্যের জীবনে!

এবং এই করে করে অণুগল্প সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে-ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে চোখ জুড়ানো ইমারত। এই যে ইমারত হওয়া, সে-ইমারতের কোনও ধ্বংস নেই, ক্ষয় নেই। ঝড় বাদলে কিছু হবে না। না বজ্রপাত না ভূমিকম্প কোনও কিছুতেই এই ইমারত টলবে না। দুলবে না, বিধ্বস্ত হবে না। তবু এক ভিতরগত ভয় কখনও কখনও এমনভাবে ঝাপটে ধরে; চিৎকার করে উঠতে হয়। এর সুনির্দিষ্ট কারণ আছে।

ইতিহাস সব সময় একইরকম হয় না। ইতিহাস সব সময় ঘুরেফিরে আসে— এমন তো নাও হতে পারে। যেমন ছোটগল্প প্রতিষ্ঠালগ্ন, যেসব কারণ সাহিত্যে সমাজে দেশে মানুষের মনে সঙ্ঘটিত হয়েছিল, অণুগল্প পত্তনকালে সেই একই কারণ ফিরে আসেনি। ছোটগল্পের সেই প্রারম্ভিককালে উনবিংশ শতাব্দীর জনজীবনের হতাশা, যুদ্ধ, অবরোধ, হিংসা, দারিদ্রের ঘেরাটোপে বন্দি ছিল ইউরোপ। অস্থির মানুষের চিত্ত শান্ত করার, স্থির করার মাধ্যম হিসেবে মোটা মোটা উপন্যাসের প্রতি বিরাগ জন্মেছিল। সময় সঙ্কটে, অর্থ সঙ্কটে মানুষের জীবন উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছিল। ফলে গ্রন্থপাঠ, সংবাদপত্রপাঠ হ্রাস পাওয়াতে সম্পাদকগণ উপন্যাসের প্লট হিসেবে এমন কিছু ছাপাচ্ছিলেন যেন পাঠক ধরে রাখা যায়। ধরে রাখা যায় পত্রিকার কাটতি।

ব্যবসায়িকভাবে বুদ্ধিদীপ্ত সে-কার্যক্রমে সম্পাদকগণ সফল হয়েছিলেন। তাঁরা ছোটগল্পের লেখক সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁরা ছোটগল্প সম্পর্কিত নানান টিপস, নির্দেশনা দিয়ে দিয়ে তাঁদের মনের মত ছোটগল্প লিখিয়ে নিয়েছিলেন; শুধু তাই নয়, ছোটগল্পের ভবিষ্যৎও নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন।

ছোটগল্পের মত অণুগল্পের উত্থানপর্বে এইধরনের কোনও ব্যাপার নেই। অন্তত পত্রপত্রিকার সম্পাদকদের কোনও অবদান এক্ষেত্রে নেই। উনবিংশ শতকের সেই অস্থিরতা নেই, মানুষের জীবনের শান্তিবিনষ্টকারী কোনও যুদ্ধ এখন আর নেই। সম্পাদকদের ভয় নেই পত্রিকার কাটতি হ্রাস পাওয়ার।

বরং অণুগল্পের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহের কারণ অন্য এক জায়গায়।

লিটল ম্যাগ আঙ্গিক ফর্ম শিল্পরূপ নিয়ে চিরকালই আগ্রহী, পেছনের প্রচলিত সমস্ত আঙ্গিক-ফর্ম-শিল্পরূপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোটাও একটি অন্যতম চরিত্র। ফলে একই সঙ্গে উৎপাটন এবং অঙ্কুরোদগম, বিনাশ ও পত্তনে যুগপৎ ক্রিয়াশীল। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত লিটল ম্যাগগুলি সাহিত্যের কোনও বাঁক পরিবর্তনের আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছিল না, সাহিত্যের কোনও অংশ নিয়ে, তত্ত্ব বা ফর্ম নিয়ে কোনও আন্দোলন দানা বাঁধেনি বা লিটলম্যাগ দানা বাঁধাতে সক্ষম না-হওয়াতে শুকিয়ে যাওয়া ধারার মত বইছিল।

ফলত লিটল ম্যাগ ধুঁকছিল ইস্যুর অভাবে, বিষয়াভাবে। এক শূন্যতাক্রান্ত দীর্ঘসময় অতিক্রান্ত হওয়ার এই সময়ে অণুগল্প এল। পার্থক্য হল— অন্যবারে লিটল ম্যাগকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট গোষ্ঠীবদ্ধ লেখকেরা প্রচলিত সাহিত্য-অনুশাসনের সামনে বিদ্রোহী হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেন। চলমান সবরকমের শৈল্পিক বিধিকে অস্বীকার করে নতুন শিল্পকলা দেখাতে চাইতেন। সবরকম আঙ্গিক ভেঙে নতুন পথে যাত্রার উদ্দীপনামূলক সাহিত্যরূপ দেখানোর চেষ্টা করতেন।

ফেসবুকের কল্যাণে অণুগল্প ধীরে ধীরে পাখা মেলতে মেলতে মধ্যগগনের এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, তাকে সবাই দেখছে, দেখতে পারছে। অণুগল্প আর পেছনের লুকিয়ে থাকার কোনও বিষয় হয়ে নেই। বরং কেউ দেখতে না চাইলেও অণুগল্পের দীপ্ত আলো সবার চোখে গিয়ে পড়ছে।

লিটল ম্যাগের এই যে বহুকালের ক্ষুধার্ত উদরটি পূর্তি করার জন্যে খাদ্য হিসেবে অণুগল্প সুস্বাদু। লিটল ম্যাগ সম্পাদকগণ অণুগল্পের বিকাশ, প্রচার ও প্রসারে যতটুকু এখন পর্যন্ত হয়েছে তার থেকে আরও অনেকখানি এগিয়ে দেওয়ার জন্যে ভূমিকা রাখতে হাত বাড়িয়েছে— সেটা অণুগল্পের জন্যে বিশেষ পাওনা।

তবে এমনও হচ্ছে, লক্ষ করছি— পত্রিকার অনেক সম্পাদক আবার কিছুটা তাড়াহুড়োও করে ফেলছেন। ফলে অণুগল্প লিখে বা প্রবন্ধ রচনার মধ্যে দিয়ে এবং প্রকাশনা দিয়ে অণুগল্প সম্পর্কিত যে প্রস্তাবনা দিয়ে আসা হচ্ছিল দীর্ঘদিন যাবত; সে সম্পর্কে এসব পত্রিকার সম্পাদকরা নিতান্তই অজ্ঞতার মধ্যে আছে।

সুতরাং আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু।

অণুগল্প যেহেতু একটি নবতর বিষয় এবং এর অভিনব ফর্ম্যাটের সঙ্গে অর্থাৎ এর লেখনশৈলী, করণকৌশল বিষয়ে যদি পরিষ্কার ধারণা না রেখেই সম্পাদকরা অণুগল্প-সংখ্যা বের করেন তবে অণুগল্পের প্রতি হয়ত সঠিক বিচারটি সম্পন্ন না হয়ে অবিচারই করা হবে। সম্প্রতি অণুগল্প-সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকায় অণুগল্প সম্পর্কিত প্রবন্ধ দেখলেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, লেখকদের রয়েছে অণুগল্প সম্পর্কে ব্যাপক ভুল ধারণা। যেমন—

অণুগল্প লিখিয়ে নন কিন্তু অণুগল্প সম্পর্কিত জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখতে পটু কিছু প্রাবন্ধিকের আবির্ভাব ঘটেছে— অণুগল্প আর ফ্ল্যাশ ফিকশনকে এক করে ফেলেছেন তারা। তারা মনে করছেন ফ্ল্যাশ ফিকশনই বুঝি বাংলার অণুগল্প। এ সম্পর্কে এর আগে অনেক কথা বলা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে ফ্ল্যাশ ফিকশন একটি নাম মাত্র। এমন কোনও তত্ত্ব, ফর্ম্যাট বা আঙ্গিক নেই যাতে ফ্ল্যাশ ফিকশন একটি নবতর, ভিন্নতর সাহিত্য বলে মান্য হয়ে ওঠে। বরং এর শব্দসংখ্যা সহ অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে যা কিছু জানা যায় তা অত্যন্ত যৎকিঞ্চিৎ; একই সঙ্গে বিভ্রান্তিমূলক। সর্বজনসমর্থিত কোনও একটি দিক নেই যাকে ভিত্তি করে বলা যেতে পারে একে ফ্ল্যাশ ফিকশন বলে। এই শব্দটি মুখে মুখে রচিত হওয়া একটা বায়বীয় বেলুনমাত্র। যে বেলুন ওড়ার কথা ছিল— উড়েছে। এইটুকুই। ফ্ল্যাশ ফিকশনের নামের সঙ্গে আরও কিছু নাম উচ্চারিত হয়। সেগুলো হল— ন্যানো ফিকশন, মাইক্রো ফিকশন, পোস্টকার্ড ফিকশন, সুপার শর্ট ফিকশন, শর্ট শর্ট স্টোরি, সাডেন ফিকশন, ঝুরো গল্প ইত্যাদি। অণুগল্পের সঙ্গে কেউ কেউ এই নামগুলিও মিলিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা কেউ বুঝতেই পারেননি যে ফ্ল্যাশ ফিকশন আর অণুগল্প একই বস্তু নয়। সব অণুগল্পই ফ্ল্যাশ ফিকশন হলেও সব ফ্ল্যাশ ফিকশন অণুগল্প নয়।

তাছাড়া এইসব অণুগল্প-সংখ্যায় অণুগল্প সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলি যারা লিখছেন— দেখলেই বুঝতে পারা যায় বেশিরভাগই গুগল বা অনলাইন থেকে জাস্ট কপি করা।

এইসব পত্রিকার সম্পাদকদের অণুগল্প সম্পর্কিত ধারণা না থাকাতে এবং প্রবন্ধ রচয়িতারা কেউ অণুগল্প লেখক না হওয়াতে আজেবাজে ধারণাপ্রসূত বিষয়কে অণুগল্পের ধারণা হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের অন্যতম ধারণার মধ্যে একটি ধারণা হল এই— অণুগল্প নিয়ে যে হইচই হচ্ছে, সাহিত্যের শাখা হিসেবে যে প্রচার প্রোপাগান্ডা চলছে এবং একদল মানুষ অণুগল্প সম্পর্কিত যে উচ্চধারণা পোষণ করেন— এইসব তো নতুন কিছু না। আমাদের বনফুল হলেন অণুগল্পের স্থপতি/জনক/প্রতিষ্ঠাতা।

বনফুল যে অণুগল্প লেখেননি, অণুগল্পের নাম শোনেননি, অণুগল্পের ফর্ম্যাট, কাঠামো, অবকাঠামো সম্পর্কে ধারণা রাখেননি এই নিয়ে আমার পৃথক আলোচনা আছে। এখানে আর সে বিষয়ে উল্লেখ করলাম না। আগ্রহীরা পড়ে নিতে পারেন। আমি বরং অন্যকিছু বলি; প্রসঙ্গে থাকি।

কিছু পত্রপত্রিকা আমার কাছে আছে।

সেইসব পত্রিকা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উলটাতে উলটাতে নিজেকে যারপরনাই ফালতু বলে মনে হয়। সেইসব পত্রিকার প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অণুগল্পকে বলাৎকার করা হয়। এই মুহূর্তে আমার হাতে যে পত্রিকাগুলি আছে, ঘেঁটে দেখা গেল [পত্রিকাটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত] বাংলা সাহিত্যে হেন লেখক নাই যিনি অণুগল্পকার নন— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন অণুগল্পকার, রবীন্দ্রনাথ একজন অণুগল্পকার, শরৎচন্দ্র একজন অণুগল্পকার, অণুগল্পকারের তালিকায় আছেন— রামানন্দ চট্টপাধয়ায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ, মরেশ, সোমেন— এইভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রচুর লেখক অণুগল্পকার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। যদি এমন হত— আমার ধারণা— পত্রিকাটিতে স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা না থাকত তবে বাংলা সাহিত্যের এমন কোনও লেখকই বাদ যেতেন না। সবাইকে অণুগল্পকার বানিয়েই ছাড়তেন সম্পাদকদ্বয়। এই যে সবাইকে অণুগল্পকার বানিয়ে দিলেন সেটা কীভাবে একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। বঙ্কিমের ‘মৃণালিনী’ থেকে নির্বাচিত একটি অংশ নিয়ে, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের একটি নির্বাচিত অংশ নিয়ে, শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ থেকে নির্বাচিত অংশ নিয়ে, এমনি করে অন্যান্যদের নির্বাচিত অংশ নিয়ে অণুগল্পের পর অণুগল্প বিধৃত হয়েছে। এইসব নির্বাচিত অংশকে আবার সম্পাদকরা নিজেই নামকরণ করেছেন।

এই হল অণুগল্প! এই অণুগল্পই নাকি সাহিত্যের নতুন শাখা! স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত শাখা। বাংলা সাহিত্য কি এমন অণুগল্প চেয়েছিল? এইসব স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের পাশাপাশি আছে বর্তমান লেখকদের রচিত অণুগল্প।

কথা যখন উঠলই বলে ফেলি। এই যে সম্পাদকরা বড় বড় উপন্যাসের অংশবিশেষ নির্বাচিত করে অণুগল্পের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত আছে অণুগল্প সম্পর্কিত তাদের অজ্ঞানতা। অণুগল্পের জোয়ারে ভাসতে থাকা বা অণুগল্পের প্রতি তাদের আসক্তিকে খাটো না করে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে পারি— অণুগল্প যেসব কারণে সর্বস্তরের মধ্যে গণ্য হল, সমাদৃত হল এবং অণুগল্প আলাদা শাখা হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করল— সেসব তথ্যের সঙ্গে এই সম্পাদকের দূরতম সম্পর্ক নেই। ‘আকারে ছোট’ লেখাকেই তারা অণুগল্প হিসেবে ঠাউরে বসে আছেন। এর প্রমাণ এই বইয়ের পাতায় পাতায়। কোনও ফর্ম্যাট, লিখনশৈলী, করণকৌশল কিংবা অবকাঠামো তৈরিতে এই পত্রিকা/বইটি আলোচনা করে না। বা বিশ্বাস করে না, বা মাথাতেই নেই। ফলে অণুগল্পের অগ্রযাত্রায় এইটি কোন কাজে আসবে জানি না। তবে অণুগল্পের পথপরিক্রমায় বইটি যে আরও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করবে সে বিষয়টি আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ধোঁয়াশার বিষয়টি নিয়ে পরে আলাপ করছি। তার আগে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হল— এই যে বিভিন্ন লেখকের নির্বাচিত অংশ কেটেকুটে অণুগল্প বানানোর অপচেষ্টা, সেটি নতুন নয়। এই কর্মটি একদা অণুগল্প গ্রুপেও হয়েছিল। ‘অণুগল্প কুড়াই’ লিখে সার্চ দিলেই বেরিয়ে আসবে সেইসব লেখা। বঙ্কিম, হুমায়ুন আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, কমলকুমার মজুমদার, নাসরীন জাহান— এইরকম অনেকের লেখা থেকে কেটে কেটে অণুগল্প বানানোর একটি আদিকর্ম আমরা করেছিলাম যখন অণুগল্প ছিল বীজতলায় উপ্ত, আজ আর সেসবের দরকার নেই। কারণ বীজ থেকে গাছ অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে, ডালপালা ছড়িয়েছে, এবং পরিপূর্ণ গাছটি বৃক্ষে রূপান্তরিত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

এই কারণেই বলছিলাম সম্পাদকদ্বয় কোথায় পড়ে আছেন! তবে এগিয়ে আসতে বাধা কোথায়? একসঙ্গে কাজ করলে অণুগল্প আরও একধাপ এগুবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। সে-প্রস্তাবে আসতে গেলে সবরকমের স্ববিরোধী বক্তব্য, দেশকাল ভাষাবিভক্তি দূর করতে হবে। অণুগল্পবিষয়ক ধারণার মধ্যে নানা মত-তত্ত্ব আসতে পারে। এতে অণুগল্প সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু ধোঁয়াশা সৃষ্টিকারী কাজকর্ম বা পেছনে হাঁটার সবরকম চেষ্টা না করাই ভালো।

কেউ কেউ আবার মনে করছেন— বিষয়টি আলাদা করে নিয়েই বলছি; এটা প্রায় সবাই করে থাকেন— অণুগল্প আর আখ্যানের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা জানেন না— অণুগল্প আর আখ্যান একই বস্তু নয়। সব আখ্যান অণুগল্প নয় কিন্তু সব অণুগল্পের মধ্যে একটা আখ্যান পাওয়া যায়। যে সব আখ্যান অণুগল্প হিসেবে সম্বোধিত হচ্ছে— সেসব ফ্ল্যাশ ফিকশনের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে বড়জোর, কিন্তু অণুগল্প নয় একেবারেই।

কেউ কেউ আছেন অণুগল্পকে অণুগল্প হিসেবে না দেখে কবিতার মধ্যে গণ্য করেন। এঁদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে যদিও। এর মধ্যে এক সম্পাদকের একটা ফোন পেলাম। তারা অণুগল্প-সংখ্যা করতে চান। বললেন— অণুগল্পের সঙ্গে কবিতার সাদৃশ্য আছে। অণুগল্পের সঙ্গে কবিতার এই নিবিড় সম্পর্ককে ধরে একটি প্রবন্ধ লেখাতে চাই। কোন কবিকে ধরলে ভালো হয়?

স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মত প্রশ্ন।

কবিতা আর অণুগল্প সম্পর্কে কী পরিমাণ অজ্ঞ হলে এই ধরনের প্রশ্ন আসতে পারে। কবিতার সঙ্গে অণুগল্পকে মেলাচ্ছেন— এটা যত না অজ্ঞতার; হতেই পারে তার এমন; অনেকেরই হয়; বিশেষ করে অ-গল্প না-গল্প জাতীয় অণুগল্পের বেলায় অজ্ঞানতাবশত এমন হতেই পারে। কিন্তু আমার ফোকাসবিন্দুটি অন্য জায়গায়। একজন সম্পাদক অণুগল্প আর কবিতার আলোচনা করতে একজন কবিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন যিনি কখনওই অণুগল্প লেখেননি। এই কবি অণুগল্প নিয়ে কী ভাষ্য দেবেন, দিতে পারেন— সেটাই ভাবছি। আর এই পত্রিকাই বা অণুগল্প-সংখ্যা হিসেবে অণুগল্পকে কীভাবেই সমৃদ্ধ করবেন!

আরও অনেক কথা আছে। একজন সম্পাদক অণুগল্পকে পিছিয়ে দিতে পারেন আবার একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব। তবে শেষাংশে এই কথা দ্বিরুক্তি করছি— আপনার নিজের যতক্ষণ পর্যন্ত না অণুগল্প সম্পর্কিত ধারণা পরিষ্কার হবে, ততক্ষণ বিরত থাকুন। একমাত্র অণুগল্পকারদের নিকট থেকেই অণুগল্প সম্পর্কিত প্রবন্ধ আহ্বান করুন। এইটা জানুন— কবিতা আর অণুগল্প একই বস্তু নয়। আখ্যান আর অণুগল্প একই জিনিস নয়। অণুগল্প এবং ফ্ল্যাশ ফিকশন একই বস্তু নয়। অণুগল্প বাঙালিদের দ্বারা বাংলায় উদ্ভাবিত-জারিত-প্রতিপালিত সাহিত্যের সেই মাধ্যম যা অন্য কোনও দেশ থেকে আনা আইডিয়া নয়।

সুতরাং, সম্পাদকগণ, আগে অণুগল্প সম্পর্কে চর্চা পড়াশনা এবং জেনেশুনে তারপর এই ধরনের সংখ্যা বের করার জন্যে পরামর্শ থাকল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...