Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

“আজকে, একটাও বাণিজ্যিক পত্রিকার কোনও লাইব্রেরি নেই, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের আছে, মিনি হলেও আছে”— সন্দীপ দত্ত

রূপক বর্ধন রায়

 


লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার শ্রী সন্দীপ দত্তের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডঃ রূপক বর্ধন রায়। বাংলা সাহিত্য ও লিটল ম্যাগাজিন-অনুরাগী রূপক বর্তমানে ফ্রান্সের নীস শহরে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত।

 

 

 

 

আপনার তৈরি করা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি তথা গবেষণাগারের কাহিনি অনেকেরই জানা। আমি আরেকটু আগের কথা থেকেই শুরু করব। প্রথমেই জানতে চাইব ছোটবেলা থেকে বইপত্র, পড়াশোনার প্রতি আপনার ভালোবাসাটা কীভাবে তৈরি হল?

আমরা দুভাই। আমাদের শৈশব বা কৈশোরে স্কুলের পড়াশোনার বাইরেও, প্রতি বছর বাবা পুজোর সময় একটা দেব সাহিত্য কুটিরের বার্ষিকী দিতেন। আমরা গোগ্রাসে গিলতাম। এবং তাছাড়াও টুকটাক ঘনাদার গল্প, বা শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের সদাশিবের হই-হই কাণ্ড এরকম নানারকম বই, বা মামাবাড়িতে গিয়ে রাশিয়ান বই যেমন দাদুর দস্তানা, রূপকথার কাহিনিগুলো পড়তাম। কাজেই গতানুগতিক সিলেবাসের বাইরে যে পড়াশোনা সে দিকে একটা আগ্রহ ছিলই। তাছাড়া আমার একবার ডেঙ্গু হয়। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি, সিক্সটি ফাইভে। তখন একটা মোক্ষম সুযোগ হল। আমার সমস্ত সুখ ছিল ওই বই পড়ার মধ্যে। প্রচুর বই পড়েছি ওই সময়ে। সব বই যে হজম করতে পারতাম তা নয়। বাবার সংগ্রহের অনেক বিশাল বিশাল বই যেমন তালপাতার বার্ষিকী, গল্প সঙ্কলন (নীহাররঞ্জন গুপ্ত), বা বিমল মিত্রের বেগম মেরী বিশ্বাস পড়তাম।

তাছাড়া রবীন্দ্রজয়ন্তী কেন্দ্র করে রবীন্দ্রসদন চত্বরের সামনেটায় রবীন্দ্র হাট (বা মেলাও বলা যায়) বসত। বাংলার বিশিষ্ট গায়করা, আবৃত্তিকাররা একদিকে গানটান করত এবং অন্যদিকে “লিটল ম্যাগাজিন” কর্মীরা তাদের ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো নিয়ে এসে সেখানে বিক্রি করত, হকাররা লজেন্স-টজেন্স ইত্যাদি বিক্রি করত, কবি লেখকদের দল ভিড় করত।

এটা কোন সময়ের কথা বলছেন?

আমি প্রথম যাই তখন আমার ক্লাস নাইন। পুরো ব্যাপারটা শুরু হত ভোর ৬টা থেকে, গড়াত বেলা দুটো অবধি। তারপর বাড়ি ফিরতাম। সে একটা অন্যরকম দিন!

এখান থেকে অনেক পত্রিকা বের হত। সেসব সংগ্রহ করতাম। যেমন ‘দৈনিক কবিতা’ কিনেছিলাম। ১৯৬৬ সালের ২৫ বৈশাখ থেকে আরম্ভ করে ১৫ দিন এটা চলেছিল। রোজ। তারপর এই হুজুগটাকে কেন্দ্র করে অনেক ধরনের পত্রিকা বের হয়েছিল। যেমন ‘সাপ্তাহিকী’, সপ্তায় সপ্তায়। আবার সুশীল রায় করলেন ‘ঘণ্টিকি কবিতা’, অর্থাৎ ঘণ্টায় ঘণ্টায়। ওই ৬৬ সালের একটা দি্নেই, ৬ মে বা ৮ মে, আমার নির্দিষ্ট এখুনি ঠিক মনে পড়ছে না, সকাল আটটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আটটা সংখ্যা বেরিয়েছিল। আবার সেই সুশীল রায়ই বের করলেন ‘শতবার্ষিকী কবিতা’, মানে ১৯৬৬র পর আবার ২০৬৬তে বের হবে।

কবিতা নিজেও লিখতাম। খুব যে একটা প্রকাশ করতাম তা নয়। এখনও আমার ক্লাস ফাইভে নিজের লেখা কিছু খাতা রয়েছে।

আপনার নিজের লেখা প্রথম কবে প্রকাশ হয়?

এইসব করতে করতেই পাড়ার সুভেনিরে, “একা” বলে একটি কবিতা। সেই প্রথম। ৬৫ সালেই।

ওই ৬০-এর দশকেই আমাদের ট্যামার লেনের পাড়ায় এলেন দেব কুমার বসু, বিশ্বজ্ঞান বলে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে। তিনি ‘সময়ানুক’, ‘দর্শক’ বলে বিখ্যাত কাগজের সম্পাদক। আমি তখন চিনতাম না। আমাদের পাড়ার পুজো প্রায় ১০৫ বছরের। এই পুজোর চাঁদা নেওয়ার জন্য উপস্থিত হয়েছি বিশ্বজ্ঞানের সামনে। হঠাৎ এক ভদ্রলোক এসে বললেন, “আমি তো চাঁদা দিই না।” আমরা তো স্তম্ভিত, এরকম কেউ কখনও বলতে পারে? দুটাকা তো চাঁদা! ৭০ সালের কথা বলছি। তারপরে ভদ্রলোক বললেন, “তোমাদের মধ্যে কে কবিতা লেখো?” এই যে দুটো বাক্য, এর মধ্যে কোনও সম্পর্ক আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যাই হোক। পাড়ার বন্ধুরা আমায় দেখিয়ে দেয়। তখন দেবুদা বলেন, “ওর অনারে আমি দুটাকা দিলাম।”

কাজেই এর পর থেকে আমাকে টানতে লাগল ওই বিশ্বজ্ঞানের ঘরটা, ৯/৩ ট্যামার লেন। কলেজে পড়াকালীন একদিন আড্ডায় গিয়ে দেখলাম, ওরে বাপরে! প্রচুর লোকজন। প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত কবি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় পাশে বসে আছেন। কবি রবীন সুর, বাহ্নিক রায়, সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। এছাড়াও কবিতা সিংহ, সমরেশ বসুর মত আরও অনেককেই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি ওই ঘরেই।

দেবুদার একটা স্বভাব ছিল প্রত্যেকের সঙ্গে, সে যতই ছোট হোক, পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। কাজেই এইভাবে সবার সাথে পরিচিত হতে লাগলাম। কবিতা লেখার উৎসাহ আরও বাড়তে লাগল। আমার কাছ থেকে আগে কেউ কবিতা সেভাবে চায়নি, না চাইলে আমি নিজেও কুন্ঠিত। দেবুদা চাইলেন, আমিও দিতে লাগলাম। আরও অনেক পত্রিকায় লেখালেখি আমার শুরু হয়ে গেল। এভাবেই চলতে চলতে ৭৪ সালে আমার কবিতার বই, ‘কোলাজ’ বার করলাম। ওটাই আমার প্রথম কবিতার বই।

আর আপনি স্কটিশে ঢুকেছেন কবে? সেখান থেকেই তো আমরা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি তৈরির গল্পটা শুনতে পাই?

সেটা ৭২ সালে।

৭০ সালে ডিসেম্বর মাসে আমি আমার নিজের কাগজ করি, ‘পত্রপুট’। এই কাজটা করার সময় ন্যাচারেলি লিটল ম্যাগাজিনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হলাম, লিটল ম্যাগাজিনকে চিনতে শিখলাম। অনেক পত্রিকার সঙ্গে মুখোমুখি হলাম। অনেক লেখকের সঙ্গে পরিচয় ঘটল।

৭২এ স্কটিশে বাংলা অনার্স পড়ার সময় আমি মাঝেমাঝেই ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যেতাম। মে মাসের একটা ঘটনা। তখন লাইব্রেরির বাংলা বিভাগটা দেখতেন কবি নচিকেতা ভরদ্বাজ। আমি দেখলাম যে বহু পত্রিকা একজায়গায় জড়ো করা আছে। তাঁকে খুব কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম যে এগুলো দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে কেন? উনি বললেন এগুলো ফেলে দেওয়া, কারণ এগুলো নিয়মিত বেরোয় না আর এগুলো বাঁধাই করা অসুবিধে। আমার খুব অপমান বোধ হল। নিজের কাগজের প্রতি অপমান, গোটা লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি অপমান। মাথা থেকে পা অবধি জ্বলে গেল। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করি ন্যাশনাল লাইব্রেরি আর যাব না।

বেশ। তারপর লাইব্রেরি স্থাপনের আইডিয়াটা এল কীভাবে?

এরপর অনেকগুলো দিন গেল। আমি পার্ট টু দিলাম। দেওয়ার পর মনে হল একটা কিছু করা যাক। একটু ভাবনাচিন্তার পর ঠিক করি একটা লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী করব। অন্তত আমার কাছে যা জমেছে এদিক ওদিক থেকে তাই দিয়েই করব।

আমাদের পাড়ার একটা ক্লাব ছিল, নেতাজী স্পোর্টিং ক্লাব, তাদের বললাম। তারা তো আর লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী বোঝে না। আমায় বোঝাতে হল তাদের প্রদর্শনীতে কী থাকবে, লিটল ম্যাগাজিন কী, লিটল ম্যাগাজিন কেন… এই সব। ওরা রাজি হয়েছিল।

২৩ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর ৪ দিন ধরে হয়েছিল। কার্ড ছাপানো হয়েছিল, আমার কাছে কার্ডটা এখনও আছে। একটা ব্ল্যাক এ্যান্ড ওয়াইট ছবিও আছে। আমার ড্রয়িং রুম আর সদর দরজার জায়গাটা মিলিয়ে কাজটা করা হয়েছিল। প্রদর্শনী সাজিয়েছিলেন শুভাদা, শুভাপ্রসন্ন। টাটকা ফল, শাক-সবজি এই সব দিয়ে। আইডিয়াটা ছিল টাটকা ফলের সাথে টাটকা লিটল ম্যাগাজিন! একটা ক্যাপশান ছিল, “কলকাতার সম্পদ প্রকাশ্যে চুরি করুন”। একটা মন্তব্য খাতা করা হয়েছিল। সেও রাখা আছে।

তারাপদ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিভিন্ন গ্রাম মফস্বল থেকেও অনেকে এসেছিলেন। তখন তো আর ফেসবুক-ওয়াটসাপের যুগ নয়, প্রচারসর্বস্ব যুগ নয়। গোপনে নিভৃতে যতটুকু বলা যায় সেইটুকুর চেষ্টা করা আর কি। মুখে মুখেই যা ছড়িয়েছিল। তার মাধম্যেই কলকাতার কফি হাউস থেকে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা এলেন। তখনও কফি হাউসে আমি যাইনি। কাজেই এই প্রদর্শনীর পর আরও বড় পরিচিতির মধ্যে আমি জড়ো হলাম।

এই প্রদর্শনীটাই ছিল প্রতিবাদ।

তারপর?

এরপরই লাইব্রেরি করার কথাটা মাথায় আসে। আমার তিনতলায় স্টাডি রুমে পত্র, পত্রিকা, বইগুলো থাকত। লাইব্রেরিতে যে কষ্টিপাথরের টেবিলটা আছে, সেটা, তাছাড়া আলমারি তৈরি হল, ছটা চেয়ার তৈরি হল। মায়ের রান্নাঘরের কৌটো রাখার একটা কাঠের র‍্যাক অবধি নিতে ছাড়িনি। মা দিয়েছিলেন। ১৫০০ পত্রিকা দিয়ে সুচনা হল লাইব্রেরির।

এ তো গেল শুরুর কথা। সেই জায়গা থেকে লাইব্রেরির কাজ এগিয়ে চলল কীভাবে? যেমন প্রদর্শনীর ব্যাপারে বললেন, অর্থও তো একটা বিরাট ব্যাপার?

শুরুর দিকে বিভিন্ন সম্পাদকের কাছে রবিবারগুলোয় চলে যেতাম। কেউ কেউ পত্রিকা দিতেন। কখনও কখনও টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কিনেওছি। এছাড়াও আমি লাইব্রেরি চালানোর জন্য চারটে অর্থনৈতিক উপায় বার করেছিলাম।

  • ৭৭ সালে আমি মেদিনীপুরে রাধামোহনপুর বিবেকানন্দ হাইস্কুলে ১০০ টাকা মাইনের পার্ট টাইম পড়ানোর চাকরি নিলাম।
  • ৫০ টাকা পাই, নাইটে একটা খবরের কাগজে ট্রেইনি হিসেবে কাজ করে।
  • একটা লক্ষ্মীর ভাড় করলাম, নাম দিলাম “ত্রিবেণী অপেরা”, ব্রেখটের নাটকের নামে। নিজেই প্রথম দিকে ওতে কয়েন ফেলতাম।
  • আর সর্বশেষ, সিগারেট খাওয়া একেবারে প্রতিজ্ঞা করে ছেড়ে দিলাম।

কাজেই এইভাবেই চলতে লাগল। তখন নাম ছিল “বাংলা সাময়িক পত্র পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র”। কিন্তু লাইব্রেরি তো করলাম, পাঠক কি হবে? আমার বলার জায়গাটা কোথায়? আমি প্রচার করব কার কাছে? আমার কফি হাউসের বন্ধুবান্ধবরা আসত, এসে একটু গল্পটল্প করত, এই আরকি। ভাবলাম এইভাবে তো হবে না। একটা বিবলিওগ্রাফিকাল কাজ করা যাক। এই কাজটা শুরু করি ৮১ সালে। প্রথমে রবীন্দ্র বিষয়ে যত পত্রিকা আছে তা দিয়ে তৈরি করলাম শুধু পঞ্জি। আর লিখলাম, “পাঠক-পত্রিকা-পাঠাগার সংযুক্তি আন্দোলন”। এই কাজটা আমার পত্রপুটে বের করেছিলাম। সংযোগ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে পাঠককে পাঠাগারে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। অর্থাৎ পাঠক সেই পঞ্জি দেখবেন, দেখে তিনি লাইব্রেরিতে এসে পড়াশোনা করবেন।

তখন তো চাঁদা ছিল না। লেখা থাকত পাঠপ্রতি দু আনা। তারপর দেখি কেউ কেউ ৪ আনা, ৮ আনা, ১ টাকা এমনকি ১০ টাকাও দিচ্ছেন। এখন চাঁদা বার্ষিক ৮০০ টাকা, এবং আজীবন ৫০০০ টাকা।

এরপর লাইব্রেরির কথা মানুষের কাছে তবে পৌঁছেছিল কীভাবে? মানে প্রথম প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠানের কথা কবে লেখা হয়?

অশোক মুখোপাধ্যায় বলে একজন এসেছিলেন। আসলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল কান্তি দাসকে বলেছিলেন “রবীন্দ্রনাথ ও আমি” বলে একটা লেখা ওনার চাই। সেই সূত্রেই অশোকের আগমন এবং উনি লেখাটা হাত কপি করে নিয়ে যাবেন। অশোকের ভাল লেগেছিল লাইব্রেরিটা। উনি আমায় বলেন ‘কলকাতার কড়চা’য় লাইব্রেরি সম্বন্ধে লিখতে চান। সেটা বেরোয় ১৯৮১ সালের ১৬ জুন ‘ছোটই সুন্দর’ এই শিরোনামে। কাজেই এই প্রথম প্রচারিত হচ্ছে লাইব্রেরি।

এক পাঠক বলেছিলেন, সন্দীপবাবু আপনি তো অন্তত বছরে ১০ টাকা চাঁদা নিতে পারেন। এটা বলছি কিন্তু ১০ বছর পরের কথা, মানে ৮৮। তাই ঠিক হয়েছিল। সেই বছরই দশম বর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান করেছিলাম। অরুণ মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী এনারা এসেছিলেন, বিনয় মজুমদারকে আমরা সম্বর্ধনা দিয়েছিলাম।

আমি এমন এমন অসামান্য মানুষদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছি ভাবতে পারবে না। আমাদের বাড়িতে যে কাজ করত সে একবার একটি ছেলের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। সেও কাজ করত। ৩০ টাকা মাইনে পেত। তার থেকে একটা অংশ বাড়িতে পাঠিয়েও, নিজে থেকে ‘তিলোত্তমা’ বলে একটা কাগজ করেছিল। কি দুঃসাহস!

আমি মনে করি, আমি ভাগ্যবান যে ওয়াটস্যাপ-ফেসবুকের যুগে, মানে এই প্রচারসর্বস্ব যুগে কাজটা করিনি। নিভৃতে, নির্জন গোপনে যেটুকু করা যায়, সেভাবে কাজ করেছি। আজকে, একটাও বাণিজ্যিক পত্রিকার কোনও লাইব্রেরি নেই, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের আছে, মিনি হলেও আছে। এই যে আমাদের শতাব্দীতে হারিয়ে যাওয়ার রীতি, তার প্রায়শ্চিত্ত করার একটা জায়গা আমি তৈরি করার চেষ্টা করেছি।

আমাদের প্রজন্মের অনেকেই ৯০ এর দশকে হলেও লিটল ম্যাগাজিনের সাথে বড় হয়েছি। আমি যেমন বাবার সাথে বইমেলার লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে যেতাম। বাড়িতেও অনেকেই আসতেন। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তাদের জন্য যদি একটু মেইনস্ট্রিম বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোর সাথে লিটল ম্যাগাজিনের পার্থক্যটা বুঝিয়ে বলেন।

দেখো “বাণিজ্যিক” কথাটার মধ্যেই ওই পত্রিকাগুলোর মুনাফার চরিত্রটা লুকিয়ে আছে। এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাগজগুলোর বিশাল মেশিনারি। এদের অর্থের অভাব নেই। এখানে অর্থ ঢালা হয় আরও অর্থ তৈরি করার জন্য। এগুলোকে আমরা হাউস জার্নাল বলতাম। তো হাউস জার্নালগুলোয় তো সম্পাদক মালিকের ভাড়া খাটে, তার কোনও দায় থাকে না।

কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন এই জায়গাটার বেশ খানিকটা বাইরে। এর বাণিজ্যিক দিকটা ওই যেটুকু তার মূল্য ওইটুকুই, ৩ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকা। মানে ধরো একজন তরুণ কবির ২৫টা কবিতা ছেপে বা মূল্যায়ন করে সে কি লাভ করবে পাঠকদের থেকে? তার মানে, সে কাজটা করছে তার আদর্শবোধ থেকে, তার নৈতিক জায়গা থেকে বা তার নিজস্ব দায় থেকে। এই জায়গাটাতেই বেসিক তফাৎ।

তবে কি বলছেন বাণিজ্যিক কাগজগুলোয় সাহিত্য হয় না?

হয়। কেন হবে না। কিন্তু ওই একটা কথা মনে রাখতে হবে। কাদের নিয়ে তারা করছে? তারা করে প্রতিষ্টিত লেখকদের নিয়ে, যাদের টাকাপয়সা দিয়ে তাদের মত করে লেখানো হয়। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন নতুন নতুন লেখন সৃজনশীল লেখকদের নিয়ে লেখাকে প্রশ্রয় দেয়। একজন লেখককে তার মত করে সামনে নিয়ে আসার যে দায়, বাণিজ্যিক কাগজের তা থাকে না।

বাণিজ্যিক কাগজ কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের দিকেই খানিকটা চেয়ে থাকে। কবে সে একজন তরুণ লেখককে টেনে বের করে আনবে।

তাহলে “লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্টের” সময় শুরু করে এখন অবধি লিটল ম্যাগাজিন কি কখনও পপুলিজমের জায়গাটাকে ধরার চেষ্টা করেছে? নাকি তার থেকে সে একেবারেই স্বতন্ত্র?

দেখো, পপুলার বা পপ লিটারেচার যেটাকে বোঝায় সেটা হল জনপ্রিয় সাহিত্য। কাজেই তাকে জনপ্রিয় করার জন্যে কিছু উপাদান তৈরি করা হয়।

আর লিটল ম্যাগাজিনের একটা দিকই হল উপাদানবিমুখতা। ধরা যাক মলয় রায়চৌধুরীরা যখন হাংরি জেনারেশান মুভমেন্ট করেন বা শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন হয় বা ধ্বংসকালীন আন্দোলন হয় বা অটোমেটেড রাইটিং হয় বা থার্ড লিটারেচার আন্দলন হয় ‘কবিপত্র’ প্রকাশের মধ্যেমে, এই ধরনের বিকল্প সাহিত্য গড়ে তোলার পেছনে কিন্তু বিরাট একটা চলমানতার জায়গা ছিল না। মানে শত কাল ধরে চলবে এমন কোনও দাবি কিন্তু এ সাহিত্যের ছিল না। কিন্তু একটা ধাক্কা দিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, যা কিছু গতানুগতিক, তার বাইরে এসে অন্য ভাবে কথা বলা যায়, ভাষাকে বদল করা যায়, শব্দকে অন্যভাবে আবিষ্কার করা যায়। যেটা কমলকুমার মজুমদারের লেখায় আমরা পাই, যেটা সুবিমল মিশ্র, অজিত রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বীরেশ রায়ের লেখার মধ্যে পাই। তার যে বোবাযুদ্ধ, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

তবে হ্যাঁ; পরবর্তীকালে আমরা দেখলাম লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো এক এক করে পালটে গেল। প্রথম দিকে ধরো কবিতা পত্রিকা ছিল ৭০ ভাগ। প্রবন্ধ সংখ্যা খুবই কম। পরের দিকে যদিও কিছু বেরিয়েছে।

আরও পরে, মানে ধরো আটের দশকের শেষের দিকে বা নব্বই দশকে আমরা দেখলাম বিশেষ সাহিত্যিক সংখ্যা প্রকাশের প্রবণতা বাড়তে লাগল। অসুবিধাটা হল কোনও একজনের জন্ম বা মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে একটা সংখ্যা করা হল আর সারা বছর ভুলে যাওয়া হল এর বিশেষ মানে নেই। কাজেই অনেক জায়গাতেই শ্রদ্ধাঞ্জলি সংখ্যা শ্রাদ্ধাঞ্জলি সংখ্যা হয়ে গেছে।

(অট্টহাস্য)

কিন্তু শতবর্ষ উদযাপনের প্রবণতা শুরুর অনেক আগেই যদি দেখো, যেমন সাবিত্রী রায়কে নিয়ে ‘প্রথমত’ পত্রিকা যে কাজটা করেছিল, বা রমেশ্চন্দ্র সেনকে নিয়ে যে কাজ করেছিল; সেগুলি কিন্তু অবিস্মরণীয়।

এবার একটু মর্ডানিজমের জায়গাটায় আসি। লিটল ম্যগাজিনে আধুনিকতার জায়গাটা কোথায়?

শুধু আধুনিকতা কেন? লিটল ম্যাগাজিনের জায়গাটা বহুমাত্রিক। সে কিন্তু শুধু শুধুমাত্র সাহিত্যের মধ্যে থেমে থাকছে না। যেগুলো উপেক্ষিত বিষয়, যেমন ধর যৌনতা আমাদের বাঙালির কাছে ট্যাবুছিল তো? আমি ষাটের দশকের কাগজেও দেখেছি, লেখা চাওয়ার নিয়মাবলিতে বলা থাকত রাজনীতিবর্জিত লেখা পাঠান, অশ্লীল লেখা পাঠাবেন না। লিটল ম্যাগাজিনে কিন্তু যৌনতা নিয়ে বড় বড় কাজ হয়েছে, তৃতীয় লিঙ্গ, লিঙ্গ রাজনীতি, লিঙ্গ বৈষম্য, লেজবিয়ানিজম, হোমোসেক্সুয়ালিটি সব কিছু নিয়ে কাজ হয়েছে।

একটা অন্য প্রশ্নে আসি। সবার হাতেই আজকাল স্মার্টফোন। আর তাছাড়া বই পড়ার স্বভাবটা অনেকটাই কমে আসছে, এটা অস্বীকার করা যায় না যে বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো চাইলে কিছু জরুরি কাজ করতে পারে। আপনার কি কোথাও মনে হয় এই অনলাইন ম্যাগাজিনগুলো লিটল ম্যাগাজিনের জায়গাটা নিতে পারবে? আমি আপনার নিজস্ব ভাবনার জায়গাটা ধরতে চাইছি।

ওয়েব ম্যাগাজিনের সুবিধেটা হল চাইলেই বিশাল প্রচারকে এক জায়গায় ধরা যায়। আর তাছাড়া অর্থের দিক দিয়েও খানিকটা সুবিধা আছে। এই দুটো সুবিধা। কিন্তু অসুবিধা হল ডিজিটাল প্রথমত সবাই ব্যাবহার করতে পারে না। আর তাছাড়া আমার নিজস্ব মত অনুযায়ী, ঐতিহাসিকতার জায়গা থেকে একজন গবেষকের চোখ দিয়ে দেখলে অন্তত যদি এক কপি করে হলেও প্রিন্ট হিসেবে সেগুলো রাখা যায় তাহলে সার্থকতা থাকে। মানে যেখানে বাংলা ভাষায় আমি যতদূর জানি ওয়েব ম্যাগাজিনের সংখ্যাটা এখন ১৫০র কম নয়। কাজেই সংরক্ষণের দিক থেকে ভাবলে আমার তাই মনে হয়।

যে কারণে আমি আরও ডিজিটাইজেশনের কথাটা তুললাম। বেশ কিছু পত্রিকাকে ডিজিটাইজ করার জন্য আপনি একটা গ্রান্ট পেয়েছিলেন। সেই কাজ কতদূর এগিয়েছিল?

হ্যাঁ, ২০০৭ সালে আই এফ এ (ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশান ফর আর্ট) আমাদের ৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। তাতে ১৪০০ কাগজ ডিজিটাইজ করা হয়েছিল। এই কাজের পর অনেক পার্টি এসেছিল উইকিপিডিয়ার নাম করে, সমস্তটাই প্রায় প্রতারণার। অর্থাৎ তারা নেবে কিন্তু আমায় দেবে না এরকম একটা জায়গা। তারা নানারকম ক্যালিফোর্নিয়া ট্যালিফোর্নিয়া শোনায়। কাজেই খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে আমাকে।

সেই কাজটা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

আপাতত, লাইব্রেরিতে যে সমস্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা আছে তার সূচিপত্রগুলো ডিজিটাইজ করছি। সমস্ত কাগজের তো প্রয়োজনও নেই। কিন্তু ধরো গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো নষ্ট যাছিল, যেমন ‘বঙ্গদর্শনের’ প্রথম বছরের প্রথম সংখ্যাটা, বা ‘পরিচয়ের’ অনেক পুরনো সংখ্যা ডিজিটাইজ করা হয়েছে, ‘সবুজপত্র’, ‘অনুষ্টুপ অনেকটা করা হয়েছে।

কিন্তু ডিজিটাইজেশানের থেকেও অনেক বেশি করে যেটা জরুরি…

(একটু থেমে)

আমি তো স্বপ্ন দেখি আন্তর্জাতিক লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির। আমায় ভাবায় এই মুহূর্তে আমেরিকায়, ফ্রান্সে, বা অন্যান্য জায়গায় কী কাজ হচ্ছে? সেগুলোকে কীভাবে আর্কাইভ করা যায়? তার জন্য অর্থের যেমন প্রয়োজন, স্পেসেরও প্রয়োজন। আমার তিনটে মাত্র ঘরে ঠাই ঠাই করছে ৮০০০০ লিটল ম্যাগাজিন।

আমি জানি একসময় আপনি রাষ্ট্রের কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করে গিয়েছিলেন। সেই জায়গাটা কি আর কোথাও এগিয়েছে?

সত্যি কথা বলতে গেলে সরকার সম্বন্ধে আমার ধারণাটাই ভাল না। একটা আশ্চর্য দেশের মধ্যে বাস করছি আমরা। এরা এগুলোকে মান্যতা দেয় না। যদি মান্যতা দিত আমি দেখিয়ে দিতাম কী কাজ করা যায়। আজকে গাদা গাদা কবিতা লেখা হচ্ছে, একটা আন্তর্জাতিক কবিতা চর্চা কেন্দ্র নেই কোথাও। অনেকবার অনেকভাবে আমি বলার চেষ্টা করেছি। এখানে সব কবিরা শুধু কবিতাই লেখে। অর্গানাইজেশান আর কবিতা তো এক জিনিস নয়।

আন্তর্জাতিকভাবে কাজটা করতে গেলে লজিস্টিক্সের জায়গা থেকে কী প্রয়োজন?

দেখো আন্তর্জাতিক যোগাযোগটা অসুবিধা নয়। এমনকি আমার কাছে কিছু বিদেশি ম্যাগাজিনও আছে। কাজেই প্রয়োজন হল সংগ্রহটা বাড়িয়ে যাওয়া। আর সবথেকে বড় কথা একটা ভালো স্পেসের প্রয়োজন যেখানে এত পত্রিকা ভালোভাবে রাখা যাবে। আমার বাড়ি তো পুরনো হচ্ছে।

আমরা স্বপ্ন দেখি ঠিকই, কিন্তু তাঁকে রূপায়ণ করার দায় তো শুধু আমার নয়। এটা বাঙালির দায়। যেদিন এ লাইব্রেরি থাকবে না বাঙালি বুঝতে পারবে। সরকার তো সাহায্য করেনি। কাজেই নিজের মতন করে আমরা চেষ্টা করছি যদি ফান্ডিং আনা যায়।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে কোনও আশা রাখেন?

দূর না না। কিচ্ছু রাখি না। সেদিন নেই। এখন পলায়নের সময়। প্রতিষ্ঠান করার সময় নয়। সবাই পলাতক। ভাবে, হ্যাঁ করা উচিত। উচিত একটা দিক আর রূপায়ণ করা আরেকটা দিক। সেই দিন নেই।

আমার শেষ প্রশ্ন। এই সময় দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী দেখতে পান? মানে কোনও রকম “মৌলিক গবেষণা”র থেকে দূরে এই যে চতুর্দিকে রবীন্দ্র-সত্যজিতের নামে বিরাট একটা “সাহিত্য শপিং মল”, হতাশ লাগে না? আমার তো লাগে।

ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে একেবারে হতাশ হলে তো হবে না। সবসময় সামনে দেখতে হবে। কিছু না কিছু করে যেতে হবে। কখন কোথায় কী পাওয়া যায় বলা যায় না। আমি তো সবসময় সন্ধানে থাকি। এভাবে হতাশ হয়ে পড়লে চলবে না।

আসলে সবাই যে যার আর্থিক সাহিত্যচর্চায় ব্যাস্ত। গোটা বিশ্বসাহিত্যের যে জায়গাটা, সেই জায়গায় আমরা সমুদ্রে কতগুলো নুড়ি খুঁজছি মাত্র। আসল সাহিত্যের জায়গাটা তো অনন্ত বিশ্ব; সেখানে আমরা পৌছালাম কোথায়? একটা সামান্য আর্কাইভ করে আমার মনে হয়েছে কিছুই করলাম না। আমি যখন নিজের আর্কাইভের আবিষ্কারগুলো খুঁজতে খুঁজতে বিস্মিত হই……

(একটু থেমে)

এই যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একটা উইল করেছিলেন, সেই উইলের উপর একটা লেখা ছিল। আমার এখানে আছে। এক পাঠক পাচ্ছিলেন না। আমি আবার আবিষ্কার করলাম। এই যে, এ তো একটা বিরাট পাওয়া?

কাজেই হতাশ হলে চলবে না। বিশ্বসাহিত্য অনুবাদের যে বিরাট একটা জায়গা, সেই কাজটা কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা করে চলেছে, দেখছি। সব ফাঁকি নয়। কিছু নিষ্ঠ কাজ হচ্ছে। বিদেশি সাহিত্যচর্চটা নেই একেবারে তা না। অনেকে কাজ করছেন নানাভাবে। বিকাশ সিংহ বলে একজন আছেন চুঁচুড়া্য়, শতানিক রায় মার্কেজ নিয়ে কাজ করছেন মালদায়, এরকম কেউ কেউ আছেন। আসলে আমাদের তাকানোটা আরও অনেক বড় করতে হবে।

তাহলে কি, ডিজিটালে হোক বা মুদ্রণে, লিটল ম্যাগাজিনের এখনও একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে?

নিশ্চয়ই। আমি তো না বলি না। তার চরিত্র বা দিশা অনেক পালটেছে, কিন্তু তার সাথে সাথে প্রসার অনেক বেড়েছে।

ঠিক আছে সন্দীপদা। আপনার বলা দরকারি কথাগুলো মানুষের কাছে পৌছবে এই আশা রাখি। আপনি যেমন বললেন হতাশ হলে চলবে না। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।

তুমিও……