সন্দীপ দত্ত: লিটল ম্যাগাজিনের একক অধ্যায়

সেলিম মণ্ডল

 



সম্পাদক, তবুও প্রয়াস

 

 

 

 

বাঙালির কী আছে কী নেই এই নিয়ে সারাবছর তর্ক-বিতর্ক চলে। তবে আর যাই থাকুক না-থাকুক গর্ব করার মতো একটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি আছে বলতে পারি

 

তখন ‘তবুও প্রয়াস’ পত্রিকার শুরুর দিক, দেখতাম একজন মানুষ মাথায় কাগজের টুপি ও গায়ে লাল-সাদা টি-শার্ট পরে নন্দন লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বা কলকাতা বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর টি-শার্টে জ্বলজ্বল করছে কয়েকটি বাক্য— ‘লিটল ম্যাগাজিন কিনে পড়ুন’, ‘লিটল ম্যাগাজিন চিনে পড়ুন’, ‘Buy Little Magazie’, ‘Read Little Magazine’. আমাদের টেবিলে এসেও পত্রিকা কিনছেন। নামী, অনামী নানা পত্রিকা ব্যাগভর্তি করে কিনছেন। প্রথম প্রথম অবাক হয়ে যেতাম। কে উনি? আমাদের মতো অনামী কলেজ পড়ুয়াদের পত্রিকা বেরোলেই কিনে নিয়ে যান। জানতে পারি, সন্দীপ দত্ত। কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রের (সূচনা ১৯৭৮, ২৩ জুন) প্রতিষ্ঠাতা। জাস্ট এটুকুই। এরপর আস্তে আস্তে সন্দীপদার সঙ্গে আলাপ হল। পত্রিকা বেরোলেই কিনে নিতেন। পত্রিকার প্রশংসা করতেন। স্বল্পভাষী, কিন্তু মিশুকে। তরুণ কোনও সিরিয়াস ছেলেমেয়ে কাজ করতে চাইলে সর্বদা সহযোগিতা করতেন। বিশেষ সংখ্যার জন্য কোনও তথ্যের প্রয়োজন বা কোনও কনফিউশন হলেই সন্দীপদার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। নিমেষেই তা সলভ হয়ে যেত।

‘সত্যজিৎ সংখ্যা’ নিয়ে কাজ করার সময় সন্দীপদার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। লিখবেন জানালেন। কিন্তু অসুস্থতায় পেরে উঠলেন না। পরে বললেন, সেলিম কাজটা আমি বড় আকারে করব। মনে হলে বই কোরো৷ পত্রিকা প্রকাশের পর সন্দীপদাকে জানালাম, পত্রিকা বেরিয়েছে। তুমি কিন্তু কিনবে না। আমার যেতে লেট হচ্ছে। সন্দীপদার মেসেজ, সেলিম পত্রিকাটা কিনে নিই? পত্রিকার প্রতি এই ভালবাসা ক-জনের থাকে! পত্রিকা হাতে না পেয়ে এই ছটফট করে ওঠা! পত্রিকাকে স্বার্থহীন লালন করেই কাটিয়ে দিলেন জীবন। লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীর মতো সোজা শিরদাঁড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। কোনও প্রতিষ্ঠান বা শাসকের কাছে মাথা নোয়াননি।

আমি আর রবিউল মিলে ‘ছাদ পেটানোর গান’ নিয়ে একটি কাজ করেছিলাম। সন্দীপদা মাঝেমধ্যেই বলতেন, কাজটা খুব ভাল হয়েছে। কাজগুলো করা দরকার। জানিয়েছিলাম পরিবর্ধিত মুদ্রণ বা দ্বিতীয় খণ্ড করব আগামীতে। তোমাকে পাশে থাকতে হবে। সম্মতি জানিয়েছিল। আগামীতে কাজটি যখন করব তাঁর অভাব কীভাবে পূরণ হবে জানি না…

দু-টি ঘটনা খুব মনে পড়ছে—

প্রথমটি, গতবছর ‘তবুও প্রয়াস’-এর দশবছর যেদিন পড়ল ঠিক করেছিলাম অফিসে আমরা নিজেরা আড্ডা দেব। কেক কাটব। ওপেন ফেসবুকে একটা পোস্টও দিই। পার্সোনালি সেভাবে কাউকে বলা হয়নি। সন্ধ্যার দিকে সবাইকে অবাক করে সন্দীপদা ওই খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে হাজির অফিসে৷ যেদিন যতটা আনন্দ পেয়েছিলাম, তার বেশি মাথা নত হয়ে যাচ্ছিল। মানুষটিকে কিছু বলতে বলার সময় বলল, এদের এত ছোট থেকে দেখলাম। বড় হয়েছে। ওদের কাজও লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রকে লঙ্ঘন করে না। না এসে কি থাকতে পারি?

আরেকটি ঘটনা, একটা তথ্যের জন্য সন্দীপদাকে একবার ফোন করি। জানায়, শরীর খারাপ, পরেরদিন তোমায় জানাচ্ছি। অবাক হয়ে গেলাম, আধাঘণ্টার মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে তথ্য পাঠিয়ে দিলেন। এই যে কাউকে তথ্য দিয়ে আনন্দ পাওয়ার মতো মানুষ আজকের দিনে আছে ভাবলেই অবাক লাগে। অসুস্থতার চেয়ে তার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই আনন্দের কোনও মাপকাঠি নেই।

 

সন্দীপদা দুঃখ প্রকাশ করতেন—  তোমরা নতুন প্রজন্ম কাজ করছ। মাঝেমধ্যে এলে তো ভাল লাগে। আমি এত বই-পত্রিকা কাদের জন্য সংগ্রহ করছি?

ইচ্ছে থাকলেও পেরে উঠতাম না। যতবার গেছি কত দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা দেখিয়েছেন। কত কিছু জেনেছি।

আমাদের বাঙালির কী আছে কী নেই এই নিয়ে সারাবছর তর্ক-বিতর্ক চলে। তবে আর যাই থাকুক না-থাকুক গর্ব করার মতো একটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি আছে বলতে পারি।

সন্দীপদার মৃত্যুতে একটা যুগ শেষ হল। একটা অধ্যায় শেষ হল। আমাদের সবার আশ্রয় এই লাইব্রেরির কী হবে জানি না। তবে সন্দীপদার অভাব সহজে পূরণ হবে না… বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে সন্দীপ দত্তের নাম বারবার ফিরে আসবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...