লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই সন্দীপদার স্বপ্ন বেঁচে থাকবে

বুলবুল ইসলাম

 



কর্ণধার, নবজাতক প্রকাশন

 

 

 

বাংলা লিটল ম্যাগাজিন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল সন্দীপদার প্রয়াণে। একজন মানুষ শুধুমাত্র একার উদ্যোগে বাংলায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণের জন্য নিজের সারা জীবন দিয়ে যেতে পারেন, সেটা সন্দীপদার কাজ না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।

সপ্তাহের পাঁচদিন আর সন্দীপদাকে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে দেখা যাবে না। শুধু লিটল ম্যাগাজিনগুলো থেকে যাবে, যারা সন্দীপদার স্নেহে, ভালবাসায় এখনও না-ঘুমিয়ে জেগে আছে। চিরকাল সন্দীপদা প্রতিষ্ঠান গড়েই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রতীক হয়ে থেকে গেলেন। যে-কাজ সরকারের করা প্রয়োজন ছিল, যা অসংখ্য সরকারি গ্রন্থাগারের করা প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই কাজটাই সন্দীপদা প্রায় কোনও সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই করে গেলেন।

কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন ১৯৭৮ সালে। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে সেটাকে লালন করে গেছেন পরম যত্নে। ময়দানের বইমেলার সময় থেকে প্রখর রোদের মধ্যে একজন মানুষ মাথায় কাগজের টুপি পরে ঘুরে ঘুরে লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতেন। সেই বইমেলা আস্তে আস্তে কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে, লিটল ম্যাগাজিনের জন্য আলাদা প্যাভিলিয়ন হয়েছে। সেই কাগজের টুপি পরা মানুষটা কলকাতা বইমেলা ছেড়ে ছুটে গেছেন জেলায় জেলায়। জেলার বিভিন্ন প্রান্তরে বইমেলার মতোই আজ লিটল ম্যাগাজিন মেলাও হচ্ছে। একসময় সেই পরিস্থিতিই ছিল না, কিন্তু প্রকাশিত হত অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন। সেগুলো সংগ্রহ করা আজকের পরিস্থিতির মতো এত সহজ ছিল না। সন্দীপদার অদম্য আগ্রহ আর উদ্যম সেই কাজে কখনও বাধা তৈরি করেনি। নিজের মাইনের টাকায় কখনও পাতিরাম, কখনও জেলার বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের কাছ থেকে পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে আনতেন, সৌজন্য সংখ্যা চাইতেন না, নিজে কিনতেন, শুধু পত্রিকায় নিজের লেখা থাকলে ব্যতিক্রম। অন্যথায় বলতেন পত্রিকা না কিনলে পরের সংখ্যা প্রকাশের উৎসাহ তৈরি হবে কীভাবে? সৌজন্য সংখ্যা নয়, ছোট পত্রিকা কিনে পড়তে হয়, এটাই বারবার বুঝিয়ে গেছেন তাঁর কাজ ও ভাবনার মধ্যে দিয়ে।

পত্রপত্রিকা সংরক্ষণ কতটা জরুরি সেটা যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষণার জন্য লেখালিখির জন্য সন্দীপদার কাছে গেছেন তাঁরা জানেন। পত্রপত্রিকা সংরক্ষণ করা শুধু নয়, যাঁরা লিটল ম্যাগাজিন করতেন তাঁদের উৎসাহ দেওয়ার যে কয়েকজন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সন্দীপদা অন্যতম। তরুণ-তরুণীদের আশ্রয়ের জায়গা ছিলেন আমৃত্যু।

লিটল ম্যাগাজিন বা অপ্রাতিষ্ঠানিক পত্রপত্রিকা যেমন প্রশ্ন তৈরির, ভিন্নমত তৈরির আঁতুরঘর, তেমনই এইসব পত্রপত্রিকা বহু নতুন লেখক-লেখিকাদের জন্ম দেয়। আর সেই পত্রপত্রিকাকে যিনি বাঁচিয়ে রাখতেন, লালন করতেন, তিনিই সেই ভিন্ন সুরকে উৎসাহিত করবেন— এটাই স্বাভাবিক। সেটাই সন্দীপদা তাঁর কাজের মাধ্যমে করে গেছেন সারাজীবন। মানুষটাকে শুধুমাত্র গ্রন্থাগারিক ভাবলে ভুল হবে। অসংখ্য নতুন লেখক-লেখিকার অভিভাবকসম ছিলেন তিনি— কে কী কাজ করছেন যেমন জানতে চাইতেন, তেমনি সেই কাজে কী কী সাহায্য লাগবে, তার জন্য আন্তরিক সহযোগিতাও করে গেছেন।

লিখে গেছেন বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। পত্রপত্রিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পত্রপত্রিকা ডিজিটাইলেজশনের কাজ শুরু করেছিলেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। কিন্তু কোনও সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই এই বিশাল সংরক্ষিত পত্রপত্রিকাকে আধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, তবুও পিছিয়ে যাননি। হার-না-মানা প্রাণশক্তিতে পূর্ণ মানুষটি এগিয়ে যাওয়ার পথেই হেঁটেছেন চিরকাল…

বইপাড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত প্রায় প্রতিদিন হেঁটে যেতেন কোথায় নতুন কী প্রকাশিত হল, তার খোঁজে। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন আজীবন। কোনও ক্ষেত্রে ভণ্ডামি দেখলে সরবে প্রতিবাদ করতেন এই চিরপ্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কয়েক লাখ পত্রপত্রিকার মাঝে ঋজু প্রতিবাদী ফ্রেঞ্চ কাট এই মানুষটিকে আর দেখা যাবে না। একটা ট্রাস্টি বোর্ড গড়ে গেছেন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রের জন্য। আগামীদিনে এই গবেষণাকেন্দ্রটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে, সচল রাখতে পারলে সন্দীপদার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে। বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন থেকে যাবে, কিন্তু সন্দীপদাকে আর আমরা দেখতে পাব না। নবীন প্রবীণ সম্পাদক লেখক-লেখিকাদের সঙ্গে আলাপ বিনিময়ে নতুন অনেক মুখ আসবে, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের স্তম্ভটা শক্তিশালী করার অন্যতম কারিগর আজ চিরনিদ্রায় শায়িত…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...