বিপ্রতীপের প্রতিষ্ঠান ও এক নিঃসঙ্গ ক্রনিকলার— ষষ্ঠ বর্ষ, নবম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

বঙ্গসমাজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতির কয়েকটি সাধারণ চরিত্রলক্ষ্মণ চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না…

উপরের কথাগুলি বহুশ্রুত, বহুচর্চিত, এবং সাধারণীকৃত হলেও আপামর বাঙালির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, নির্মম সত্যও বটে। অথচ এই নিন্দাসূচক সংজ্ঞার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যে কতিপয় মানুষজন তাঁদের জীবনব্যপী কাজের মাধ্যমে বঙ্গসমাজে কিছু যোগদান করেছেন, বাঙালি তাঁদের অনুসরণ করেনি ঠিকই, তবে মনে রেখেছে। আর আমরা যদি সদ্যপ্রয়াত এক বঙ্গসন্তানের জীবন ও কাজের কথা ভাবি, দেখতে পাব, রবীন্দ্রনাথ-কৃত এই সংজ্ঞার বিপরীতে যেকটি সুলক্ষণের কথা ভাবা যেতে পারে, শ্রী সন্দীপ দত্ত (১৯৫১-২০২৩) তার এক সার্থক রূপায়ণ।

বঙ্কিম বলেছিলেন, বাঙালি নিজের ইতিহাস সম্পর্কে অসচেতন৷ ইতিহাস বিস্মৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন টেমার লেনের এক ছোট্ট ঘরে সন্দীপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র। লিটল ম্যাগাজিন তার জন্মলগ্ন থেকেই সাহিত্যের বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতার বাইরে দাঁড়িয়ে বিকল্প (যা প্রকৃত পক্ষে সিরিয়াস সাহিত্যের মূল ধারা) ও প্রতিস্পর্ধী সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অথচ আমাদের দেশে ও রাজ্যে লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণের কোনও নীতি বা প্রথা ছিল না। তরুণ সন্দীপ জাতীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখে এসেছেন কী অবহেলা ও অমর্যাদা নিয়ে ধুলোয় পড়ে আছে বাংলা ভাষার পুরনো ও অমূল্য কিছু পত্রপত্রিকা। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই জাতির সমষ্টিগত আত্মবিস্মৃতির বিরুদ্ধে বাংলার শিক্ষক সন্দীপ দত্ত একাকী ডেভিডের মতো এক অসমসাহসী যুদ্ধঘোষণা করলেন৷ যে কাজ এক নয় একাধিক অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানের করা উচিত ছিল, সন্দীপ দত্ত সে গুরুদায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন একার কাঁধে। হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল টেমার লেন লাইব্রেরি, আজ সন্দীপ দত্তের প্রয়াণের মুহূর্তে সে লাইব্রেরি আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত ও প্রায় দেড় লক্ষ পত্রিকার বিপুল সম্ভার নিয়ে স্থানসঙ্কুলানের সমস্যায় ভুগছে। ‘পত্রিকা সংগ্রাহক’ শুধুমাত্র এই বিশেষণে সন্দীপ দত্তের কাজের বিশ্বকে মাপা সম্ভব হবে না৷ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলাভাষায় প্রকাশিত ও আগামীতে প্রকাশিতব্য যাবতীয় লিটল ম্যাগাজিনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুটির নাম সন্দীপ দত্ত। কলকাতা বইমেলায় ‘লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন ও পড়ান’ লেখা টুপি ও জামা পরা এক ‘পাগল’-কে দেখতে দেখতে আমরা অনেকেই শৈশব বা কৈশোর থেকে যাত্রা শুরু করে মধ্যবয়স পেরিয়ে এলাম। কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, তমলুক থেকে ত্রিপুরা— বঙ্গসংস্কৃতির যেকোনও প্রান্তে প্রকাশিত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ রাখতেন সন্দীপ, তা সংগ্রহ করার জন্য নিজের পয়সা খরচ করে চষে বেড়াতেন মেলা ও ম্যাগাজিন দপ্তর৷ ‘নিজের পয়সা’ শব্দবন্ধটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই বিপুল কর্মযজ্ঞে সন্দীপ মূলত ভর করেছিলেন স্ব-উপার্জনের ওপরেই, নিজের শিক্ষকের চাকরি ও কলেজ স্ট্রিটে একটি পারিবারিক ব্যবসার আয়ের ওপরে, নিজের পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বার্থের কথা না ভেবেই৷ আমৃত্যু কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাতেননি, অযাচিত সাহায্য এলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা গ্রহণ করেননি, কারণ কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজের মস্তক বিক্রয় করতে তিনি রাজি ছিলেন না৷ বইমেলায় তিনি প্রায় রোজই যেতেন, কিন্তু মেলার মাঠে অন্য অনেক প্রাক্তন ‘আগুনখেকো’ বিপ্লবী লেখকের মতো তাঁকে কোনও মুখ্যমন্ত্রীর পেছন পেছন ঘুরতে দেখা যায়নি। এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আদর্শই তো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের মূলমন্ত্র। আর এই মন্ত্রই ছিল সন্দীপ দত্তের গৌরবময় যাপন— প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাই লিটল ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিনই সন্দীপ দত্ত। সন্দীপ দত্তের সুহৃদ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাঁর বন্ধুর এই আদর্শের উৎসনির্দেশ করেছেন, ‘সন্দীপের এই গৌরব সত্তর দশকের। সত্তর দশক ছাড়া সন্দীপ দত্তের বা আমাদের কারও হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না।’ সন্দীপ দত্তকে আমরা শেষ দেখেছি, বিধাননগর করুণাময়ীতে, ২০২২-এর বইমেলায়। দু-তিন ব্যাগ বই-পত্রপত্রিকা কিনে পা টেনে টেনে মেলার মাঠ থেকে বেরিয়ে আসছেন অসুস্থ সন্দীপ। এই দৃশ্য আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল। আর ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলেন সন্দীপ দত্ত, আমাদের সন্দীপদা, প্রথম জীবনে কবি, প্রাবন্ধিক, পত্রিকা সম্পাদক তাঁর এইসব পরিচয় গৌণ হয়ে গেছে আজ, তিনি আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গসংস্কৃতির এক নিঃসঙ্গ ‘ক্রনিকলার’।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনা সন্দীপ দত্তকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেই নিবেদিত হল। সন্দীপ দত্ত ও তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধী যাপনকে স্মরণ করলেন তাঁর বন্ধু সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও মৃদুল দাশগুপ্ত, লিখেছেন ইন্দ্রনীল মজুমদার, লিখেছেন অনুজ লেখক সম্পাদক ও প্রকাশক সুস্নাত চৌধুরী, সেলিম মণ্ডল এবং বুলবুল ইসলাম।

আর শেষ কথায়, আমাদের সমস্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের মনে করাই, সন্দীপ দত্তের কাজটিকে বাঁচিয়ে রাখার এবং এগিয়ে নেওয়া যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। এ যেন আমরা বিস্মৃত না হই।

অলমিতি।

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
দেবব্রত শ্যামরায়

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...